অন্ত্যাক্ষরী
পিয়ালি ব্যানার্জি
সে আমায় বললে, “গান তো গাইলেন অনেক, এ দ্যাশের গান শুনেছেন কি? ফেরার আগে শিখে নিয়ে যান দুয়েকখানা।”
চলন্ত জীপের শুকনো পাতা ভাঙার শব্দ, আর সামনের আসনের সমবেত হিন্দি গানের উচ্ছ্বাস পেরিয়ে তার সহজ কথাগুলো আমায় সজাগ করে। আপনমনেই গাইছিলাম জানালার ধারে। বাঁকুড়ার দক্ষিণ-পশ্চিমের জঙ্গলঘেরা গ্রামগুলো ছুঁয়ে আমাদের জিপ এগিয়ে যাচ্ছিল। কলেজ গ্রুপের মাতাল বয়েস সবুজের নৈঃশব্দ্যকে খানখান করে ফেলছিল। একটু দলছুট ছিলাম পিছনে আমি। কথাটা আমাকেই বলছে শুনে সামনে তাকাই খাকি পোশাকের ফরেস্ট গার্ড টুডুবাবুর দিকে। মুখটা ভাবলেশহীন, কর্তব্যপরায়ণ সরকারি চাকুরে যেমন হয় আর কি! হেসে একটা গান গুনগুন করি, ‘এই বাঁকুড়ার মাটি রে/পেন্নাম করি দিন্যে দুপুর্যে’। রেডিওয় শুনে তোলা গান।
“যে দেশে এল্যে, সে দেশ্যের গান শুনবে নাই?”
এখন আর খাকি উর্দির ধার ধারেনি। সহজ রাঢ়ের মিষ্টি ভাষায় বলে ক্ষুদিরাম টুডু। খুব ইচ্ছে করে শুনি, আর শিখি দুয়েকখানা। বলেই ফেলি, “আপনি গান বুঝি?”
“গাই আমি, কিন্তুক তার সময় আছে বট্যে।” উত্তর এল।
“ডিউটি শেষ হোক, আজ সন্ধেয় আপনি আসুন না আমাদের বনবাংলোয়।” দলপতির সম্মতি নিয়ে বলি, “একসঙ্গে খাওয়া হবে, আর গান।”
সবুজঘেরা ছোট্ট স্বপ্নের মতো বাংলোয় সন্ধে গড়িয়ে রাত নেমেছিল। রীতিমতো ইলেক্ট্রিক ছিল গরহাজির। ‘তারাগুলি নিয়ে বাতি’ স্পষ্ট ছিল অমাবস্যার আকাশে। বাংলোর পিছনে উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘর ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় ভরেছিল। অন্ধকারে দিশি মোরগের চিৎকার কয়েক মিনিট ঘরের কলকল হাসি-কথাকে থামিয়ে দিয়েছিল যদিও। কলকাতায় কি আর এমনটি পাওয়া যাবে! এধরনের লঘু-গুরু কথায় সন্ধে জমজমাট হয়েছিল। রাত্তিরে মোমবাতির ভিতু আলোয় খাওয়া দিব্যি জমেছিল।
খাওয়াদাওয়ার পর অতিথিকে নিয়ে সামনের খোলা চাতালে মশলা মুখে বেতের আরামকেদারায় গা এলিয়ে বসা হয়েছিল। সামনে চারপাশে যতদূর দেখা যায় সেগুন, সোঁদাল, পিয়াশালের কালচে অন্ধকারে জোনাকি জ্বলছিল।দলপতি বললেন “হ্যাঁ হ্যাঁ, গান হোক এবার। কে কে গাইবে? অন্তাক্ষরীই হোক না কেন!”
অলঙ্করণঃ অংশুমান