ডাক
হীরক সেন
বেলা পড়ে এসেছে। গঙ্গার ঘাটের দিকটায় হাওয়ায় একটা শিরশিরানি ভাব। এদিকটা বেশ নির্জন। কলকাতার মধ্যে হলেও বেশ কিছু পুরনো ভাঙাচোরা অট্টালিকা আজও রয়ে গেছে। শরিকি ঝামেলার কারণে আজও ফ্ল্যাট হয়ে যায়নি।
উঠে পড়লাম। একবার মায়ের ওখানে যেতে হবে। শান্তিপিসি খবর পাঠিয়েছিল। অবস্থা ভালো নয়। ডাক এসে গেছে।
আমাদের বাড়িটারও ভগ্নদশা। দক্ষিণদিকের একভাগে কোনওরকমে মা, শান্তিপিসি থাকে। ঢুকে দেখলাম, নিমগাছটার তলায় বসে শান্তিপিসি জ্বালানির কাঠ চিরাচ্ছে। সেই এক চেহারা, ছোটোবেলা থেকে যা দেখে আসছি। খালি কপালের ফাটা দাগটা যোগ হয়েছে। ওই নিমগাছের ডাল পড়েই। আমাকে দেখে বলল, “যা, ডাক এসে গেছে। এখন তখন। আমার আর ডাক আসবে না রে।”
সত্যি, পিসির বয়সের গাছপাথর নেই। আমি বললাম, “তুমি গাছের নিচ থেকে সরে এসো। মনে নেই? আর এখনও কাঠ চিরে যাচ্ছ কেন? কোন কাজে লাগবে?”
পিসি বলল, “ও আমার আর কী হবে? আর সত্যি বাপু, এত দিনকার কাজের অভ্যেস। বেকার বসে থাকলে হাঁফ ধরে।”
মায়ের ঘরে ঢুকে দেখি প্রতিবেশীরা ভিড় করে আছে। এদের কাউকেই আমি চিনি না। সবাই আমি চলে যাওয়ার পর এসেছে। অবস্থা সত্যিই এখন তখন। ডাক এল বলে। ওখানে দাঁড়িয়ে থাকার কোনও মানে হয় না। নেমে এলাম। শান্তিপিসি বলল, “কী রে, থাকবি না?”
আমি বললাম, “না। তুমি কিছু হলে খবর পাঠিও, আমি যাব।”
বেরিয়ে আসার সময় শুনি পিসি চেঁচাচ্ছে, “বড় নিদয় তুই।”
বিকেলে শান্তিপিসি খবর পাঠাল, আমি বেরিয়ে আসার পরপরেই মা চলে গেছে। কালীঘাটে আছে। ঠিকানাটা চেনা। আমি দৌড়ে বেরুলাম। এরপরেই তো সব যোগাযোগ শেষ।
কালীঘাটের নার্সিংহোমটা ছোটো, কিন্তু নামকরা। পৌঁছে দেখি, শান্তিপিসি দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। আঙুল তুলে দেখাল, “ঐ দ্যাখ।”
চিনতে অসুবিধা হল না। একটা কাচের ছোট্ট বাক্সের মধ্যে ছোট্ট মা হাত পা ছুড়ছে। সেই একমাথা কোঁকড়া চুল, চিবুকের তিলটাও আছে। পাশে ঘিরে নতুন আত্মীয়স্বজন।
গলার কাছটা ধরে এল। আর থাকা যায় না। মিলিয়ে যেতে যেতে শুনি শান্তিপিসি বলে চলেছে, “তোর ডাক আসার আগে অবধি মাঝে মাঝে আসিস বড়োখোকা। আমার আর ডাক আসবে না রে…”
অলঙ্করণঃ অংশুমান
এটা মাস্টারপিস লেখা
LikeLike
অলৌকিক এক অনুভূতি হল। অসাধারণ।
LikeLike
just beutiful,opurbo
LikeLike