জয়ঢাকি খবরের কাগজ—আজকের তাজা খবরঃ
বসন্তে চীনদেশের কোন কোন জঙ্গলে গেলে একটা মজার দৃশ্য দেখতে পাবে। সেখানে একধরণের গাছে পাকা পাকা ফল দুলছে। মাঝেমাঝে একটা করে ফল ফেটে যাচ্ছে আর—ম্যাজিক—তার মধ্যে থেকে বোঁ বোঁ করে উড়ে যাচ্ছে একটা করে মথ!
রাতের বেলা সে জঙ্গলে ফিরে এসে সে গাছকে ফের একবার নজর করে দেখ। দেখবে সে গাছে তখন ফুল এসেছে। সে ফুল থেকে অদ্ভুত এক গন্ধ বেরিয়ে বাতাস ম ম। আর—সকালে ফল ফেটে বেরিয়ে যাওয়া মথরা এবার ঘুরেফিরে আসছে নতুন ফুলের মাথায়। গুণগুণ করে গান গেয়ে গেয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে তার নতুন ফুলে ফুলে।
এ গাছের নাম লিফফ্লাওয়ার গাছ। মথের নাম লিফফ্লাওয়ার মথ।
আজব এ গাছে বসন্তে ফুল ফোটে। পুরুষ আর মহিলা ফুল আলাদা হয়। সে ফুলে মধু হয় না। ফলে বেশির ভাগ পোকামাকড়ই দিনের বেলা তাকে পাত্তা না দিয়ে চলে যায়। ফুল বেচারা তাহলে পরাগসংযোগ করে কেমন করে?
তারপর রাত যেই আসে অমনি ফুল তার ম্যাজিক দেখাতে আরম্ভ করে। এক আশ্চর্য মাদক গন্ধ বের হতে তার থেকে। সে গন্ধের জাদু কাজ করে ওই লিফফ্লাওয়ার মথের ওপরেই। গন্ধের টানে মেয়ে মথের দল ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসে সে গাছের ফুলদের কাছে।
ফুলদের কাছে এসে তারা একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ফুলের সেবা শুরু করে দেয়। প্রথমেই তারা গিয়ে বসে পুরুষ ফুলদের ওপরে। নিজেদের ফাঁপা শুঁড়ে টেনে নেয় তার পরাগরেনু। এবারে তারা উড়ে যায় মেয়ে ফুলদের মাথায়। সেখানে পরাগরেনু ছড়িয়ে দেয় প্রথমে।
তা এত খাটুনি যে সে করল, তার মজুরি চাই তো? নাকি? এইবার, পরাগসংযোগ শেষ করবার পর মথনির মজুরি নেবার পালা। মেয়ে ফুলটার বুকে সে আস্তে করে একখানা ডিম পেড়ে রেখে উড়ে উড়ে চলে যায় অন্য ফুলের দিকে।
এদিকে সেই চীনে গাছ ভারী চালাক। সে কিন্তু ফুল থেকে বেজায় তাড়াতাড়ি ফল বানাবার দিকেই যায় না। অপেক্ষা করে সে। বসন্ত গিয়ে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ হেমন্ত কাটে একে একে। ফুল ট্যাঁ ফো করে না। তার বুকে জমে থাকা মথের ডিমও ঘুমোতেই থাকে। তারপর নতুন বছর পড়লে জানুয়ারি মাসে পুরোনো ফুল থেকে ফল তৈরি শুরু করে গাছ। এইবারে গল্প এগোয় বেজায় তাড়াতাড়ি। মাত্রই মাসদুয়েকের মধ্যে, গাছ যখন নতুন ফুল ফুটে উঠবে, তখনই গতবারের ফুলের ফল পেকে উঠে ফেটে যাবে।
মথের ডিমও অমনি তার সাথে তাড়াতাড়ি বাড়তে শুরু করে দেয়। বেজায় তাড়াতাড়ি পাড় হয়ে যায় শূককিট, মুককিট, পিউপার স্তর। এ সময়টা বেড়ে ওঠা ফলের থেকে দু তিনখানা বীজ শুধু খেয়ে জীবনধারণ করে সে। তারপর, ফল যখন পেকে উঠেছে তখন, পিউপা থেকে বের হয়ে এসে পূর্ণাঙ্গ মথ হয়ে সে অপেক্ষা করে থাকে।
একদিন ফল ফেটে যায়। তখন তার ভেতর থেকে ডানা মেলে বের হয়ে আসে পূর্ণাঙ্গ পাতাফুল মথ।
যেদিন সে বেরিয়ে আসে বাইরের দুনিয়ায় সেদিন সন্ধেবেলা হঠাৎ তাদের দলের মথনীদের নাকে আসে একটা জাদুগন্ধ। সে গন্ধের এমন অমোঘ টান যে তার ইশারা মেনে মথনীরা ফের উড়ে যায় গাছের সে বছরের পুরুষ ফুলদের বুকে। তারপর—
–ফের গোড়া থেকে পড়ো।
লিফফ্লাওয়ার গাছ ও মথের একটা প্রজাতিজুটি আছে যার গাছেরা পরাগসংযোগের পর সাধারণ নিয়মে কিছুদিনের মধ্যে ফল ধরে। মথের ডিমেরাও তাড়াতাড়ি ফুটে যায় ও শূককিটের দল ফলের চামড়া ফুটো করে জঙ্গলের মাটিতে নেমে সেখানেই আস্তে আস্তে মথ হয়ে ওঠে। এই প্রজাতিদের বিবর্তনকে খুঁজে বিজ্ঞানিরা দেখেছেন, বহু কোটি বছর ধরে একইসাথে বিবর্তিত হয়েছে তারা। নানান প্রাকৃতিক পরীক্ষানিরীক্ষায় তাই গড়ে উঠেছে তাদের এমন বন্ধুত্বের নানান ধাপ।
কিন্তু ওদের যে প্রজাতিজুটির গল্প প্রথমে বললাম, তাদের পরীক্ষা করে বিজ্ঞানিরা একটু অবাক হয়ে রয়েছেন। সেই দুই জুটির মধ্যে সম্পর্ক কিন্তু মোটেই অত পুরোনো নয়। মাত্রই কিছুকাল আগে গড়ে উঠেছে তাদের বোঝাপড়া। অথচ এর মধ্যেই গাছ শিখে গেছে, ফুল থেকে ফল দেরিতে এনে মথকে ঠিক নতুন ফুলের মরশুমেই বাতাসে ছাড়বার কায়দা, আর মথও শিখে গেছে দীর্ঘদিন ডিম হয়ে ঘুমিয়ে থেকে তারপর ডিম ফুটেই বেজায় তাড়াতাড়ি পুর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠবার কৌশল, আর দুটো পদ্ধতিই এমন একসঙ্গে ঘড়ি ধরে করছে দুই বন্ধু যাতে মাদার জীবনচক্র আর গাছের ফুল-ফলের চক্র চলে এক তালে।
এই দেখেশুনে বিজ্ঞানিরা এখন ভাবতে লেগেছেন, বিবর্তন বোধ হয় সবসময় বেজায় লম্বা সময় নেয় না। দরকার পড়োলে কখনো কখনো খুব তাড়াতাড়িও বিবর্তন ঘটে যেতে পারে এবং তাতে গাছ আর প্রাণী মিলে যৌথ বিবর্তনও সম্ভব।
প্রকৃতিতে এমন আরো কত রহস্য যে লুকিয়ে আছে কে জানে! সে রহস্যে এখন আবার মানুষরাও নতুন নতুন মাত্রা যোগ করতে শুরু করে দিয়েছে। জানো তো, মৌমাছির সংখ্যা কমে আসছে বলে মানুষ এখন পরাগসংযোগের জন্য যন্ত্রমাছি বানাচ্ছে? এরপর সেই ড্রোনমাছিদের খবর দেব’খন।
বেজায় আশ্চর্য হলাম এই সব কান্ড কারখানা জেনে ! ফের শুরু থেকে পড়ছি !
LikeLiked by 1 person
এ পাতার নীচে আর ওপরে যে লিংক দিয়েছি তাতে অমন অনেক আশ্চর্য লেখার কোষাগার রয়েছে। তুলে নিলেই ঘড়ির কাঁটা দৌড়োবে। এ হল গিয়ে জয়ঢাকি খবরের কাগজ! হুঁ হুঁ।
LikeLike
দারুণ! ড্রোন মৌমাছিদের পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম। একটা কথা, মথেদের কোন প্রজাতি সত্যি কী গুনগুন করে, নাকি লেখা হয়েছে পড়তে ভালো লাগানর জন্য?
LikeLiked by 1 person
পাখায় শব্দ ওঠে। মৌমাছি বা অন্য কোন ডানাওয়ালা পোকারই বোধায় স্বরযন্ত্র নেই। ডানায় শব্দ তোলা তাদের অভ্যেস।
LikeLike