আলোর পানে প্রাণের চলা পর্ব-১, পর্ব-২, পর্ব ৩
[এই দেশের বহুত্বের স্বর বহুধা বিস্তৃত। নানা ভাষা, ধর্ম, আচারের বে–নি–আ–স–হ–ক–লা’র মতো এই দেশের সঙ্গীতের বহতা ইতিহাসের ধারাও নানা বাঁকে বাঁকে নিজেকে পুনরাবিষ্কার করেছে। জয়ঢাকের এই প্রবন্ধমালায় আমরা সেই বিরাট শ্রুতির ধারার কয়েকজন পুরোধার জীবনের এক সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত বয়ান করব]
চতুর্থ পর্ব
ওস্তাদ ইমদাদ খান
মহিষাদল রাজপ্রাসাদের সান্ধ্যকালীন সঙ্গীতের আসর বসেছে। সময়টা বিংশ শতাব্দীর নিতান্ত শৈশব। সেই সময় ঠিক যেমন ছিলেন ওই রাজপরিবারের কুমার দেবপ্রসাদ গর্গ। সেই সন্ধ্যায় শিল্পী বেহাগের আলাপ ধরেছেন বাদ্যযন্ত্রে। অবরোহণের ফিরতি পথে দুই মধ্যমকে স্পর্শ করে শ্রুতি যেন ফিরছে ওই আসরে উপস্থিত সব শ্রোতার কান্না বুকে নিয়ে। কিছুক্ষণ বাদেই বালক দেবপ্রসাদের মনে হল মীড় গমকের মধ্যে যেন মিশে আছে শিল্পীর মগ্নচৈতন্যের কোন অশ্রুত কষ্ট। তাঁর নিজেরও বুক ফেটে কান্না আসতে লাগল। তাঁকে ওই অবস্থায় দেখে ওঁর পিতৃদেব খানসামা বেচারামকে ডেকে তাঁকে নিয়ে যেতে বললেন অন্দরমহলে তাঁর মায়ের কাছে। তিনি নিজেও তখন বিষাদগ্রস্ত ওই অলৌকিক সুরের আবেশে। পরদিন সকালে শিল্পী নিজেই এসে দেখা করলেন বাবা ছেলের সাথে। তাঁর নিজের বয়ানে, “…মুঝে ইস বিহাগকে লিয়ে বহুত ভারী কুরবানি দেনা পড়া…”। বোঝা গেল আগের সন্ধ্যার ঘটনা কোনও অলৌকিক সমাপতন ছিল না।
পিছিয়ে যাওয়া যাক আরো বেশ কয়েকটা বছর। আদরের মেয়ে গুরুতর অসুস্থ। চিকিৎসার কোনও ত্রুটি নেই কিন্তু অবস্থা ধীরে ধীরে আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। এদিকে রেয়াজের সময় অন্য দিনের মতোই সাধনায় মগ্ন হয়েছেন শিল্পী, তাঁর জীবনদেবতাকে তিনি আহ্বান করছেন সুরের অর্ঘ্যে। শেষে অবস্থা এতটাই খারাপ হল যে ডাক্তার আসার পরেও সে যাত্রায় আর বাঁচানো গেল না মেয়েকে। সেদিন সেই মৃত্যু সংবাদও শিল্পীকে নড়াতে পারল না তাঁর সাধনা থেকে। তিনি শুধু বললেন লোক ডাকিয়ে দাফনের ব্যবস্থা করার জন্য, রেয়াজ শেষ করে তিনি আসছেন। সেই সময় পিতৃহৃদয় কি সত্যি আড়ালে চলে গেছিল শিল্পী সত্তার ? তা হয়তো একেবারেই না। কিন্তু শিল্পীদের মধ্যে মুষ্টিমেয় কয়েকজনই হতে পারেন সাধক যাঁরা উপেক্ষা করতে পারেন না এই জগত পেরিয়ে সুরলোকের দুর্নিবার ডাক’কে। এই সাধক শিল্পীর নাম ওস্তাদ ইমদাদ খান, যাঁর নামে প্রসিদ্ধ ইমদাদখানী বাজ আজও রসিক শ্রোতাকে মুগ্ধ করে চলেছে সুরের গভীর আবেশে।
১৮৪৮ সালে উত্তরপ্রদেশের আগ্রার কাছে এটাওয়ায় জন্ম ইমদাদ খানের। ওঁর বাবা সাহাবদাদ খান ওরফে সাহাব সিং ছিলেন বিখ্যাত ধ্রুপদীয়া এবং দিল্লী দরবারের গায়ক। এই পরিবারের সাথে রাজপুতদের একটা যোগ ছিল। জন্মসূত্রে সাহাবদাদ ছিলেন হিন্দু পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় তাঁর নাম পরিবর্তিত হয়। গোয়ালিয়র ঘরানার বিখ্যাত ভ্রাতৃদ্বয় হদ্দু এবং হসসু খানের কাছে তিনি তালিম পেয়েছিলেন কণ্ঠসংগীতের। পরে নিজে থেকেই সেতার এবং সুরবাহারের চর্চা করেছিলেন তিনি। ইমদাদের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় তাঁর বাবার কাছেই। সেই সময় তিনি কণ্ঠসংগীতের চর্চাই করছিলেন কেবল।

শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর
পরবর্তীকালে সেতার এবং সুরবাহারের প্রতি তাঁর অনুরাগ জন্মায়। ওস্তাদ হদ্দু খানের শিষ্য এবং জামাই কিরানা ঘরের বিখ্যাত বীণকার ওস্তাদ বন্দে আলি খানের কাছেও তিনি শিক্ষাগ্রহণ করেন। পরে তানসেন প্রবর্তিত সেনিয়া ঘরানার সাজ্জাদ মহম্মদ খান এবং জয়পুর ঘরানার রজব আলি খানের কাছেও তিনি গেছিলেন সাচ্চা সুরের সন্ধানে। পণ্ডিতদের মতে, ‘পাঁচ বাগিচার ফুলে তিনি তাঁর সুরের ডালি ভরিয়েছিলেন।’ পণ্ডিত বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখণ্ডে রচিত হিন্দুস্থানী সঙ্গীত পদ্ধতি (চতুর্থ খণ্ড) থেকে জানা যায় যে এক সময় ইমদাদ পাথুরিয়াঘাটার জমিদার এবং সংগীতশাস্ত্রে বিশেষ পারঙ্গম শ্রী শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের অধীনে চাকরি করেছিলেন। তাঁর দরবারেই তিনি স্বনামধন্য ওস্তাদ সাজ্জাদ মহম্মদকে প্রথম শোনেন এবং পরে তাঁর কাছে শিক্ষালাভ করেন।
ইমদাদখানী বা এটাওয়া ঘরানা বিখ্যাত হয়ে আছে সেতার ও সুরবাহারের বিশিষ্ট বাজে, যে বাজ তাঁর পরবরতীকালে তাঁরই পুত্র এনায়েত খাঁ এবং এনায়েত খাঁর পুত্র বিলায়েত খাঁর হাতে সমৃদ্ধতর হয়েছে। শুধুমাত্র ধ্রুপদী গ্রাম্ভারি চলন নয় বরং আলাপের ক্ষেত্রে খেয়ালের বেশ কিছু অঙ্গ বা টুকরা সংযোজন করেছিলেন খান সাহেব। যার ফলে অনুনাদী সৌকর্য্যে আরো গভীর হয়ে উঠেছিল সেই বাদনশৈলী।
ইমদাদ খানের চিল্লা নেয়া বা একনাগাড়ে কয়েক দিন বা সপ্তাহ বা মাস সব কিছু ভুলে সাধনা করে যাওয়ার ঘটনা বিখ্যাত হয়ে আছে। যৌবনে প্রায় বারো বছর তিনি এমনধারার জীবন কাটান। পরে শুধু নিজেরই নয় বরং তাঁর সন্তান এবং শিষ্যদের রেয়াজের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বেশ কড়া টাস্ক মাস্টার। দিনে প্রায় বারো ঘণ্টা রেয়াজ করাতেন তিনি। ঘরোয়া আসরগুলোতে নানা দুরূহ তাল প্রায় অসম্ভব লয়ে বাজাতে ভালবাসতেন তিনি। ফলে আসরে তাঁর সাথে সঙ্গত করতে ভয় পেতেন সেকালের বহু নামী শিল্পী যাঁরা তালবাদ্যে খুবই পটু ছিলেন। জীবিতকালেই প্রায় কিংবদন্তীর পর্যায়ে পৌঁছে গেছিলেন খান সাহেব। শোনা যায় দিল্লী দরবারে রাণী ভিক্টোরিয়ার সামনে সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য তাঁর ডাক পড়েছিল। আমাদের দেশে গ্রামোফোন শুরু হবার পর তিনি এবং ওস্তাদ বরকতুল্লা খানই ছিলেন প্রথম দুই সেতার শিল্পী যাঁদের বাদনকে রেকর্ডিং করা হয়।
জীবনের শেষ বয়স ইন্দোর দরবারে কাটালেও প্রথমদিকে প্রায় ২০ বছর তিনি কলকাতায় কাটিয়েছিলেন। মেটিয়াবুরুজে অবস্থিত লক্ষ্ণৌয়ের নির্বাসিত নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের দরবারে, পাথুরিয়াঘাটার মহারাজ যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের সভায় এবং শেষ জীবনে ইন্দোরের হোলকর রাজাদের সভাশিল্পী হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন।
ওস্তাদ ইমদাদ খানের বাজানো রাগ সোহিনী যেখানে বাজনা শেষে শিল্পী আত্মপরিচয় দিচ্ছেন।
ইমদাদখানী ঘরানার সুরের সম্পদ ছড়িয়ে আছে খান সাহেবের বংশধর এবং অযুত শিষ্য পরম্পরার মধ্যে দিয়ে। ওঁর দুই ছেলে এনায়েত খান এবং ওয়াহিদ খান নাতি বিলায়েত এবং ইমরাত খান (এনায়েত খানের ছেলে) এবং তারও পরবর্তী প্রজন্মের বংশধরেরা যেমন শাহিদ পরভেজ (ওয়াহিদ খানের নাতি), সুজাত, হিদায়েত এবং জিলা খান (বিলায়েত খানের সন্তানেরা), নিশাদ, ইরশাদ, ওয়াজাহত এবং সফত খান (ইমরাত খানের সন্তানেরা) এই ঘরানার ঐতিহ্য বয়ে চলেছেন তাঁদের সঙ্গীতের মাধ্যমে। ১৯২০ সালে মৃত্যু হয় ওস্তাদ ইমদাদ খানের কিন্তু তাঁর মতো সাধক শিল্পী মৃত্যুহীন, যাঁরা ভগীরথের মতো সপ্তসুরের ধারাকে ‘ত্রিপথগা’ করে সঙ্গীতপিয়াসি অসংখ্য মুমুক্ষুর তৃষ্ণা দূর করেছেন।
ক্রমশ