সুরঢাক আগের পর্বগুলো
‘উৎপাদন’ ব্যাপারটা কবিতার ক্ষেত্রে যতটা ভয়ানক, বিজ্ঞানের বেলায়ও ততটাই। চারুশিল্প, সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তো বটেই। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে কেউ বলেনি – এ মাসের মধ্যে পাঁচটা ভার্জিন অফ্ দ্য রক্স্ (Vergine_delle_Rocce) এঁকে ফেলতে হবে, নইলে চাকরি নাই। যতদিন না জ্ঞান, সে বিজ্ঞানের হোক বা সঙ্গীতের, সমাজে মাতব্বরি করার মত জায়গায় এল বৈষয়িকতার হাত ধরে, ততদিন তা স্বাধীনভাবে চলতে পেরেছে নিজের পথে, অমৃতের খোঁজে। এখনকার ব্যতিক্রমী শিল্পী বা বিজ্ঞান-সাধকদের কথা বাদ দিলে ‘যেনাহম নামৃতাস্যাম কিমহং তেন কুর্যাম‘ এর মানে হয়ে গেল চাঁদির জুতা যাতে নাই, তা দিয়া কাম নাই! জয়ঢাকের প্রয়াসের সাথে যদিও চাঁদির ব্যাপারটা একেবারেই নেই, তবুও গুঁতো আছে – সময়ের। তাই ধিক্ শতধিক্ এড়াতে সময়মত লিখে ফেলতেই হয় কাঠফাটা রোদেও ভৈরবী।
হিন্দুস্তানী সঙ্গীতের দশটি ঠাটের আর দুটি নিয়ে আলোচনা করা বাকি। ভৈরবী আর টোড়ী।
শুনতে একটু অদ্ভুত লাগলেও উত্তর ভারতীয় রাগ হিসেবে ভৈরবী বোধহয় সবচেয়ে ‘বিখ্যাত’ রাগ। ভৈরবীর মত এত পরিচিত, এত ব্যবহৃত রাগের তুলনা হতে পারে একমাত্র ইমনের সাথে। ভৈরবী যে কত জনপ্রিয় রাগ, সেটা বোঝা যাবে এবারের লেখার সাথে দেওয়া তালিকা দেখলে আর অডিও লিঙ্ক গুলো শুনলে। এই রাগের সহজ চলনের জন্য বেশীরভাগ শিল্পীই সহজে এই রাগটি পরিবেশন করতে পারেন আর সেটাও এই রাগের জনপ্রিয়তার কারণ খানিকটা। মাটির গন্ধমাখা অত্যন্ত সুরেলা এই রাগটিকে রাগের রাণী বলা হয় অকারণে নয়।
দশটি ঠাটের অন্য জনক রাগগুলির মত ভৈরবীও এই একই নামের ঠাটের জনক রাগ। যে স্বরগুলি এই রাগে সাধারণতঃ ব্যবহৃত হয় সেগুলি হল –
সা ঋ জ্ঞ ম প দ ণ – অর্থাৎ রে গা ধা নি এই চারটি স্বরই কোমল।
তবে দশটি ঠাটের অন্যান্য রাগগুলির তুলনায় ভৈরবীর বৈশিষ্ট্য হল যে গুণীজনের পরিবেশনে এই রাগে স্বরগ্রামের সব কয়টি স্বর লাগলেও রাগরূপ বজায় থাকে। সেই হিসেবে বিবাদী স্বর, প্রয়োগ সাপেক্ষে, এই রাগে অনুপস্থিত। তবে অন্য স্বরগুলি প্রধান রূপে ব্যবহার করলে তখন রাগটিকে বলা হয় মিশ্র ভৈরবী। আবার এই রাগটি সকালের রাগ হলেও অন্য সময়েও পরিবেশন করা চলে। তাই সর্বকালিক রাগ বলা হয় ভৈরবীকে। এখন তো মোটামুটি রেওয়াজই হয়ে গেছে যে বেশীরভাগ শিল্পী অনুষ্ঠানের শেষ করেন এই রাগটির কোন না কোন রূপ পরিবেশন করে। সর্বকালিক হওয়া ছাড়াও এত সহজিয়া ভাবের সুরেলা রাগের পর অন্য কোন রাগ আর নূতন করে রেখাপাত করে না বলেও সবশেষে গাওয়া হয় ভৈরবী। বিলম্বিত খেয়াল বিশেষ গাওয়া না হলেও এই রাগটিতে ধ্রুপদ, ধামার, তারাণা, টপ্পা, ঠূমরী, দাদরা ছাড়াও ভারতীয় সঙ্গীতের অন্য লোকপ্রিয় ধারাগুলি যেমন ভজন, গীত, গজল, কাওয়ালি, নাট্যসঙ্গীত ইত্যাদি সব রকমই পরিবেশিত হয়।
সঙ্গীতের তাত্ত্বিক লেখা ধৈর্য ধরে পড়া, বিশেষ করে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তত্ত্বকথা, আরও বিশেষ করে আমার মত লকীর কে ফকীরের লেখা, বেশ একটা শ্রমসাধ্য ব্যাপার। তবে, ‘যব দিল হি টুট গয়া’ – নৌশাদ জীর সুরে এই গানটি বা চিত্রগুপ্ত জীর ‘তুম হী হো মাতা পিতা তুমহি হো’ গানটি গুনগুন করতে করতে পড়লে বোধহয় ভৈরবীর আলোচনাটা ততটা অসহ্য লাগবে না। এই রাগের আধারে তৈরি ‘হিট‘ গানগুলির মধ্যে কয়েকটি হল তু গঙ্গা কে মৌজ ম্যয় যমুনা কা ধারা, বাবুল মোরা নৈহর ছুটরি যায়, জ্যোত সে জ্যোত জগাতে চলো, লাগা চুনরি মে দাগ, ভোর ভয়ে পনঘট পে, সত্যম শিবম সুন্দরম, চিঙ্গারী কোঈ ভড়কে, ইত্যাদি। যাঁরা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শোনেন, তাঁদের অবশ্য একবার মনে করিয়ে দিলেই মনের কানে শুনতে পাবেন পরভীন সুলতানার সেই বিখ্যাত সাদরা –‘ভবানী দয়ানী’ অথবা ভীমসেন যোশিজীর ‘যো ভজে হরি কো সদা’।
পৌরাণিক উপাখ্যানে আছে শিব ভৈরব হলে পার্বতী হন ভৈরবী। তন্ত্রশাস্ত্রে ভৈরবী-তন্ত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বহুপ্রাচীন বইতে ভৈরবীর উল্লেখ থাকলেও তখনকার আর বর্তমান ভৈরবী রাগের বর্ণনা বিচার করলে বোঝা যায় যে নামটা পুরোনো হলেও বর্তমান কালের ভৈরবীর রূপ বেশ খানিকটাই আলাদা তার আগের রূপের তুলানায়। আগের চেহারায় শুদ্ধ রে থাকার ফলে সেটা বরং এখনকার আসাবরী ঠাটের সাথে মেলে।
আরোহণ – স, ঋ, জ্ঞ, ম, প, দ, ণ, র্স
অবরোহণ – র্স, ণ, দ, প, ম, জ্ঞ, ঋ, স।
জাতি – সম্পূর্ণ- সম্পূর্ণ
বাদী স্বর – ম (ভিন্নমতে প), সম্বাদী স্বর- সা।
পকড় – ণ্ স জ্ঞ ম দ প, জ্ঞ ম জ্ঞ ঋ স।
ম জ্ঞ ঋ জ্ঞ, স ঋ স, দ্ ণ্ স।
মুখ্য অঙ্গ – জ্ঞ স ঋ স, জ্ঞ ম প, দ ম দ ণ র্স, র্র র্স দ প জ্ঞ ম ঋ স।
কোমল ধা (দ) স্বরটি সাবধানে ব্যবহার করতে হয় আসাবরী অঙ্গের ছোঁয়া এড়াতে।
বিশেষত্ব – পা এর পর ঋস লাগাবার আগে পা তে দাঁড়ানো, পা থেকে মা তে যাবার সময় মীড়, আরোহণের সময় জ্ঞ তে যেতে ঋ স্বরের স্পর্শ, পা স্বরে দপমপ আন্দোলন, জ্ঞ স্বরে মৃদু আন্দোলন ইত্যাদি।
ভৈরবীর মিল আছে ঐ একই নামের করণাটকি রাগের সাথে নয়, বরং কর্ণাটকি পদ্ধতির হনুমাতোড়ি বা জনটোড়ি রাগম্ এর সাথে। আরোহণ সা, র১, গ২, ম১, প, ধ১ ন২ র্স, আর অবরোহণ -র্স, ন২, ধ১, প, ম১, গ২, র১, স। সাথের লিঙ্ক-এ হনুমাতোড়ীর আরোহ-অবরোহ শুনে দেখ। ভৈরবীর স্বরস্হানের মিল আছে ডোরিয়ান গ্রীক স্কেল (মোড) এর সাথেও।
দুশো’র বেশী ভৈরবী রাগ আধারিত আধারিত রবীন্দ্রসঙ্গীতের কয়েকটি:
তুমি মোর পাও নাই | তুমি যেও না এখনি | সার্থক জনম আমার | সকরুণ বেণু বাজায়ে |
প্রেম এসেছিল নিঃশব্দ | প্রাঙ্গনে মোর শিরীষ | অয়ি ভূবনমনমোহিনী | ওকে ধরিলে তো ধরা |
নিশীথে কি কয়ে গেল | নাই নাই ভয় | মধুগন্ধে ভরা | কেন যামিনী না যেতে |
জীবনে পরম লগন | যখন ভাঙল মিলনমেলা | হে নূতন দেখা দিক | হে ক্ষণিকের অতিথি |
এসেছিলে তবু আস নাই | দূরে কোথায়, দূরে দূরে | আমি চঞ্চল হে | বরিষ ধরা মাঝে |
কয়েকটি নজরুল গীতি – বাগিচায় বুলবুলি তুই, মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর, তোমার বুকের ফুলদানিতে, নিশি ভোর হল জাগিয়া, ফুল ফাগুনের এল মরশুম, আনো সাকী সিরাজি, স্বপনে এসেছিল, এ আঁখিজল মোছ পিয়া, সে প্রিয় কেন গো, প্রভাত বীণা তব, কত জনম যাবে তোমার বিরহে, জয় বিগলিত করুণা রূপিনী, হে মাধব হে মাধব, ছি ছি হেরে গেলে শ্যাম।
ভৈরবী রাগ আধারিত হিন্দী ছায়াছবির কিছু গান:
ইন্সাফ কা মন্দির হ্যয় | নয়া দওর | তু গঙ্গা কি মওজ | বৈজু বাওরা |
লগা চুনরী মে দাগ | দিল হি তো হ্যয় | দোস্ত দোস্ত না রহা | সঙ্গম |
জয় বোলো বেঈমান কি | বেঈমান | অ্যায় মের দিল কহিঁ অওর | দাগ |
রামাইয়া বস্তাবইয়া | শ্রী৪২০ | বোল রাধা বোল সঙ্গম | সঙ্গম |
যব দিল হি টুট গয়া | সাহ্জাহাঁন | কৈসে যাঁউ যমুনা কে তীর | দেবতা |
বাবুল মোরা, নৈহর ছুটো | স্ট্রীট সিঙ্গার | জ্যোত সে জ্যোত | সন্ত ধ্যানেশ্বর |
আঈ দিওয়ালী | রতন | বরসাত মে হম সে মিলে | বরসাত |
দো হংসো কা জোড়া | গঙ্গা যমূনা | মেরা জুতা হ্যয় জাপানী | শ্রী৪২০ |
মেরা এ্যয় দিল বতা | ঝনক ঝনক পায়েল বাজে | ক্যায়সে সমঝাঁঊ | সূরজ |
যা রে উড় যা রে পঞ্ছী | মায়া | ভোর ভয়ে পনঘট পে | সত্যম শিবম সুন্দরম |
এবারের অডিও লিঙ্কের প্রথমেই বসন্ত বাহার ছবির ‘ম্যয় পিয়া তেরি তু মানে ইয়া না মানে’ গানটিতে পণ্ডিত পান্নালাল ঘোষের বাজানে বাঁশী আছে শুনে দেখ। এরপর আছে যা রে উড় যা রে পঞ্ছী, লগা চুনরী মে দাগ, এ্যয় মেরে দিল কঁহি অওর চল, এসেছিলে তবু আস নাই আর ওকে ধরিলে তো ধরা দেবে না।
দ্বিতীয় লিঙ্কটায় আছে – ভৈরবীর আরোহন-অবরোহণ, কর্ণাটিক হনুমাতোড়ীর আরোহণ-অবরোহণ, তারপর DAW -সফ্টওয়্যারে বাজানো ভাতখন্ডেজীর ভৈরবী কহি মন মানী(এর স্বরলিপিও দেওয়া আছে)। এরপর রামপুর-সাহসোয়ান ঘরাণার শ্রদ্ধেয় মুস্তাক হুসেন খাঁ সাহেবের টপ্পা, বিসমিল্লা খাঁ সাহেবের সানাই, শরণ রাণীর সরোদ, পরভীন সুলাতানার বিখ্যাত ভবানী দয়ানী আর ভীমসেন যোশীজীর সেই অবিষ্মরণীয় ভজন যো ভজে হরি কো সদা। প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য শ্রদ্ধেয় দীপক চৌধুরীর একটি ভৈরবী সরগম দেওয়া আছে তারপর।
প্রবাদপ্রতিম সঙ্গীত প্রতিভা পদ্ম-বিভূষণ কিশোরী আমোনকর ৩রা এপ্রিল, ২০১৭য় চলে গেলেন তাঁর আরাধ্য সুরলোকে। তাঁরই গাওয়া ভৈরবী এবারের অডিও লিঙ্কের শেষ অংশে আমাদের গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজো।
‘ভৈরবী কহী মন মানী’ র পণ্ডিত বিষ্ণুদিগম্বর ভাতখন্ডেজীর স্বরলিপি নীচে দেওয়া হল।
ভৈরবী –ত্রিতাল (মধ্যলয়)
ভৈরবী কহী মন মানী
কোমল সবসুর কর গুণী গাওয়ত
প্রথম পহর কী রাণী হো।
মধ্যম বাদী সুর সমবাদী ভক্তি রস কী খানী
সবকোই গাওয়ত সবকো রিঝাওয়ত
ভৈরবী শাস্ত্র প্রমাণী হো।
রাগ ভৈরবীর একটি প্রাচীন চিত্ররূপ
সুরঢাক আগের পর্বগুলো