শতবর্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্য
চিত্ররথ
(একটি শর্টফিল্ম)
।।সত্যজিৎ রায়ের শতবর্ষে একদঙ্গল তরুণ একলব্যের শ্রদ্ধাঞ্জলি ।। (তন্ময় বিশ্বাসের রিপোর্ট)
না। গোটা কাজটার কোথাও সত্যজিৎ রায়ের জীবনকথার উল্লেখ নেই। নেই কোনো উচ্চকিত প্রণাম। এ তবে কেমন শ্রদ্ধাঞ্জলি? জানতে হলে প্রথমে নীচের শর্ট ফিল্মটা দেখুন। আর লেখাটার সবটা পড়বার ধৈর্য না থাকলে তার শেষের প্যারাগ্রাফটা পড়ুন। জানতে পারবেন। এবং হ্যাঁ। এই চুয়ান্ন বছরের আধপাকা মাথাটাকে নত করেই বলছি, এই উত্তরসূরী জয়ঢাকি তুর্কিদের কাছে আমাদের অনেক কিছু শেখবার আছে। যথা, শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের এমন সৃজনশীল ও আদর্শ পথ। ভবিষ্যৎ নিয়ে আর ভাবনা নেই। আমাদের প্রজন্মের যোগ্যতর উত্তরসূরীরা সৃষ্টির উঠোনে এসে গেছে।
– সম্পাদক, জয়ঢাক
লকডাউন যখন শুরু হয়েছিল, তখন একবারের জন্যও মনে হয়নি যে, ব্যাপারটা একমাসের বেশি গড়িয়ে যাবে! তাই ২রা মে-র প্ল্যানগুলো রাখা ছিল সেফ জোন-এ।
১০০ বলে কথা! প্রথমে বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়ি। সেখান থেকে নন্দন, লাঞ্চ এবং বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে জ্ঞান মঞ্চ। ওখানে ফেলুদার নাটকের টিকিট প্রায় ছ’মাস আগে থেকেই কাটা ছিল আমাদের। সেই টিকিট এখনও আমার ওয়ালেটে খাবি খাচ্ছে। কিন্তু করোনা!
মনখারাপ হলেই দেখেছি, মাথা একটা এসকেপ প্ল্যান ঠিক ভেবে নেয়। তার ওপর তখন ফেসবুক জুড়ে শুরু হয়েছিল ‘পাস দ্য ব্রাশ’ চ্যালেঞ্জ! শুরুর দিকে সেটা করছিলেন নামজাদা মডেলরা মেকআপ ব্রাশ নিয়ে, তারপর সেই তুলি, রঙের প্যালেটে ডুবতেই হুলুস্থুল পড়ে গেল। আর আমিও একটা সবুজ দরজা পেয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করলাম সেদিকে।
জয়ঢাক সাহিত্য সফরের কচিকাঁচাদের নিয়ে আলাদা একটা গ্রুপ আছে। সেখানে দেওয়া হল প্রস্তাব। এবং আঁকিয়েরা তৎক্ষণাৎ রাজি। নচিকেতা, উপাসনা, শ্রীময়ী আর প্রমণা। সায়নদা আর সপ্তর্ষিদাকে জানানো হল আলাদা করে। ঋতুপর্ণাকে পাওয়া গেল শ্রীময়ীর রেফারেন্স থেকে। আর যেকোনো গল্প সংকলনের সম্পাদকের মত নিজের মাথাটাও ঠিক গুনে নিলাম এর মধ্যেই! অতএব তৈরি হল আটজনের শক্তপোক্ত দল।
উপাসনা মোটামুটি দায়িত্ব নিয়ে স্ক্রিপ্ট লিখে ফেলল। তাই আমি হাত দিলাম স্টোরি বোর্ডিংয়ে। কিন্তু মেন সমস্যা শুরু হল ক্যামেরায়। দেখা গেল সবাই পাইকারি রেটে ফটোগ্রাফার হলেও, ভিডিওর ব্যাপারে নেহাতই হরিদাস!
কেউ আলোর দিকে পিঠ করে বসে। তো কেউ শ্যুটই করে ৪২০পি তে। আর পোট্রেট মোডের কথা তো ছেড়েই দিলাম। কেন যে ফোনটাকে কেউ শোয়াতে চায় না!
সবাইকে আবার রিটেকের জন্য পাঠানো হল। মনে আছে একমাত্র ঋতুপর্ণা আর সপ্তর্ষিদার ওয়ান টেক-এই ওকে হয়ে গেছিল। সপ্তর্ষিদার কিছু সমস্যা ছিল অবশ্য। হয়েছিল কী, শটে পেনটা ক্যাচ করার সময় সপ্তর্ষিদা হাতের খাতাটা কোলে নামিয়ে রাখছিল, আর তাতে আঁকাটা দেখা যাচ্ছিল পুরোপুরি! পেন আসার আগেই আঁকা হয়ে গেছে! এই ব্যাপারটা খুব একটা ভাল দেখাবে না পর্দায়। আবার ক্যামেরার বাইরে থেকে যিনি পেন ছুঁড়ছিলেন, তাঁর ছায়াও পড়ছিল ফ্রেমের এক কোণে! কী করা যায়! শটটা এত ভাল এসেছে যে রিটেক করতেও মন চাইছে না।
তাই বসলুম ছুঁচ সুতো নিয়ে। জুম ইন জুম আউট করে ছায়াটা বাদ দিলাম শুরুতেই। তারপর লেগে গেলাম ফ্রেম বাই ফ্রেম কোলের পাতাটা সাদা করার কাজে। মনে আছে প্রায় ১৬৫টা ফ্রেম বসে বসে সাদা করেছিলাম সেদিন। যেটা আপনারা দেখেছেন বড়জোর তিন সেকেন্ডের জন্য।
তবে আমাদের আসল চ্যালেঞ্জ কিন্তু ছিল পেনটার কন্টিনিউয়িটি রক্ষা করা, যেন কোনরকম জার্ক না বোঝা যায়।
তাই আগেই ঠিক করলাম, একসাথে সবাইকে শ্যুট করতে বলে লাভ নেই। পরপর করলে সুবিধা হচ্ছে , আমি আমার ফুটেজটা তুলে নচিকে পাঠিয়ে দিলাম। নচি দেখে নিল আমি পেনটা কোনদিকে ছুঁড়েছি। ও ক্যাচ নেবে তার ঠিক উল্টো দিকে। তারপর নচিরটা পাঠানো হবে সপ্তর্ষিদাকে। আর এভাবে চলতে থাকবে।
উপাসনা পুরোটা খুব ডিটেলে সাজিয়েছিল। কিন্তু নচিকেতা বলল, কিছু সমস্যার জন্য ও কদিন পর শ্যুট করবে! ও ছিল তিন নম্বরে, আগের দুটো হয়ে গেছে, এখন ওর না হলে বাকিদেরটা কী করে করি! তখন মাথায় কী বুদ্ধি খেলল। সপ্তর্ষিদাকে নিজের মত শ্যুট করে নিতে বললাম। ধান্দাটা এই, যে ওই শটটা নচিকেতা আর তার পরের জনকে পাঠিয়ে দেব। সেক্ষেত্রে সপ্তর্ষিদা যেদিক থেকে ক্যাচ করেছে সেদিকে তাক করেই নচি পেনটা ছুঁড়বে। আর তার পরের জন ক্যাচ করবে সপ্তর্ষিদা যেদিকে ছুড়েছে তার উল্টো দিকে। সপ্তর্ষিদার পরে শ্রীময়ী প্রমনাদের রিটেক গেল, অন্ধকার ঘরের জন্য। ওদের শট সবথেকে ইন্টারেস্টিং ছিল। কারণ একমাত্র ওরা দু’বোন একসঙ্গে ছিল, তাই তুলি কাড়াকাড়ি ইত্যাদি ব্যাপারগুলো রাখা গেছিল বেশ।
ওদিকে টেনশনের বসে নচি করে বসল ঝামেলা। তুলি যেদিকে ছোঁড়ার কথা, ছুঁড়ল ঠিক তার উলটো দিকে! আবার ছেঁড়ো চুল! পুরো ফুটেজটাকেই ফ্লিপ করে দেওয়া যায় বটে। কিন্তু তাতে করে সিনেমার নচিকেতা হয়ে যাবে ন্যাটা। কী হয়, কী হয়! তখন উপাসনার কাছে জানলাম ঋতুপর্ণার শট নেওয়া এখনও বাকি। আমি ঝটপট সেটা বন্ধ করতে বলে, ঋতুপর্ণার স্টোরি বোর্ডটা পুরো উলটে আঁকলাম। নচি আর সপ্তর্ষিদার ফুটেজদুটো তার সঙ্গে স্টেপল করে পাঠিয়ে দিলাম। ফলে দুজনের মাঝে ঋতুপর্ণার ফুটেজটা ঢুকে পড়ে দুটোকেই সুন্দর ব্যালেন্স করে ফেলল।
ও ভাল কথা। এই যে “করলাম”, “বললাম” বলছি। আসলে আমি কিন্তু পায়ের ওপর পা তুলে ফরমায়েশ করে গেছি। তা বাদে যাবতীয় দৌড়াদৌড়ি, সব কিছু সামলে জনসংযোগের কাজগুলো করেছে উপাসনা। ততদিনে সৈকতদা মানে, সৈকত মুখোপাধ্যায় আমাদের প্রজেক্টের নাম দিয়েছেন ‘চিত্ররথ’। উপাসনা সেটা দিয়ে ক্যালিগ্রাফি আর পোস্টার বানিয়ে ফেললে, আমি তাতে অ্যানিমেশন ভরে দিলাম ফটাফট।
তখন আমরা দু’সপ্তাহের মাথায়। রি-টেক শট তখনও এসে পৌঁছায়নি। একদিকে সুবিধা, কারণ সায়নদার একটা ছুটির সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছিলাম সামনে। সায়নদা ডাক্তার মানুষ, পিজির মতন প্রতিষ্ঠানে গুরুতর কাজের দায়িত্বে আছেন এই সময়! তাকে দু’বার রিটেক করতে বলা আমার জীবনের সবথেকে বড় পাপগুলোর মধ্যে একটা!
যায় হোক এবার কিন্তু সবাই এবার উৎসাহ হারাচ্ছিল। তাই বাদ পড়া সিনগুলো নিয়ে একটা টিজার ভিডিও বানিয়ে দিলাম। সৈকতদা আগেই কবিতা পাঠ করে পাঠিয়েছিলেন। সেটা রইল আমাদের শিরদাঁড়া হিসাবে। টিজার বেরোল।
ব্যাস, বাকিটা আর ভাবতে হয়নি। ফটাফট সবকটা ফুটেজ চলে এল। “তালপাতার সেপাই” মিউজিক টিমের প্রীতম দাস এককথায় অনুমতি দিয়ে দিলেন। তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া গেল “চাঁদের শহর” গানখানা। “আমাদের দেখা হোক” কবিতা বিভিন্ন কবির নামে ঘুরলেও তার আসল সৃষ্টিকর্তা সায়ন দাসের কাছে পৌঁছে গেল আমাদের টিম। তারও অনুমতি মিলল। টিম তখন ফুল ফর্মে!
বেশ মনে আছে, এডিটিং শেষ হওয়ার ঠিক দশমিনিটের মাথায় প্রকাশ পেয়েছিল “চিত্ররথ”। তিন সপ্তাহ পরে আর কারোই হ্যাজাতে ভাল লাগছিল না। আমারও এডিটর হিসাবে কনফিডেন্স ছিল তুঙ্গে। সেটা যে কতটা কী হয়েছে, ভিডিও দেখলেই বুঝতে পারবেন।
শুধু একটা খুব কমন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাই। যে ১০০ বছরের শ্রদ্ধার্ঘ্যতে এই ভিডিও, তিনি কোথায়? না তাঁর কোথাও ছবি আছে, না আছে তাঁর কোনো কাজের রিক্রিয়েশন।
তবে?
কী জানেন তো, গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজোটা বড্ড ক্লিশে লাগে আজকাল।
Our Lady’s Juggler মনে আছে? আনাতোলে ফ্রাঁস-এর কালজয়ী গল্পের সেই শিক্ষাদিক্ষাহীন জাগলার শিল্পী মাদার মেরিকে মন্ত্রতন্ত্রের জায়গায় দান করেছিলেন তার শিল্পটুকু। কারণ তিনি সেটুকুই পারতেন।
আমরা ছোট থেকে ছ’ফুট চারের রূপকথা পড়ে বড় হয়েছি। আরও একটু বড় হয়ে পর্দায় তাঁর কাজ দেখেছি মুগ্ধ হয়ে। কিন্তু তাই বলে সেগুলো আবার রিক্রিয়েশন! প্রত্যেক বছরই তো করি। এবার না হয় একটু অন্য ভাবে হোক। আমরা যা কিছু পারি তাই দিয়েই নৈবেদ্য সাজাই একটা গোটা শতাব্দীর। আলো আসুক, ক্যামেরা চালিয়ে কান পেতে থাকি অপেক্ষায়। আমরা তো জানি কোনো এক মেঘের দেশ থেকে ব্যারিটোনে ঠিক ভেসে আসবে শব্দ… অ্যাকশন!
তন্ময় বিশ্বাস