শতবর্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্য
একেকটা মানুষের কথা ভাবলে হিরের কথা মনে হবেই। নিপুণ হাতে কাটা তলগুলো থেকে একেকরকম আলো ঝিকমিক করে জ্বলে। একটু নাড়াচাড়া দিলে আলোর ছটায় চেয়ে থাকা দায়, অজান্তেই মুগ্ধ হয় মন। মানিকদার কাজগুলো যেন সেইরকম। আমার ছোটবেলা থেকে তাঁর মৃত্যু অবধি পাশে বসে তাঁকে আঁকতে দেখে আর ফরমাশমতো নিজে আঁকতে আঁকতে মানুষটার গুণ সম্বন্ধে একটু আভাস পাওয়া গেল। তবে ম্যাজিকটা অধরাই রইল যেন। আমি শুধু তাঁর ইলাস্ট্রেশনের কথাই বলব, যদিও মনের অন্য দিকগুলোর সঙ্গে এই আঁকাআঁকির যোগ খুব ভালোরকমই আছে বলে এখন বুঝতে পারি। প্রথম হল চূড়ান্ত রসবোধ। আঁকা তো বটেই, ভালো ছবি দেখে বুঝতে পারার জন্যেও এটি দরকার। এই গুণটি বোধহয় জন্মগত এবং পারিবারিক সূত্রে পেতে হয়। বিচ্ছিন্নভাবে চর্চা করে নিজের মধ্যে এই গুণ আয়ত্ত করা যায় না। রস ব্যাপারটা তো একরকম হয় না, সবক’টিকে আলাদাভাবে বুঝতে পারার ক্ষমতা সহজ নয়। কোন লেখার মধ্যে কোন রসটি ফুটে উঠেছে তার নিরিখে ছবি আঁকা। সবক’টিতেই মানিকদা ছিলেন সিদ্ধহস্ত। এমন অন্তত আমার আর কখনও চোখে পড়েনি। সবাই ছবি আঁকেন তাঁদের নিজস্ব ঢংয়ে, দেখলেই দিব্যি বোঝা যায় কার আঁকা। মানিকদার ছবি নানারকম। লেখার সঙ্গে যেন আঁকার শক্তিশালী যুগলবন্দী। রসের কথায় পরে আসছি।
আমি মোটেও বিশেষজ্ঞ নই, আর্ট কলেজের ছাত্রও ছিলাম না কোনও কালে। বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে নিজের মগজে যতটুকু বুঝেছি সেইটাকে কম কথায় বলব।
ছোট্ট বেলা থেকে বই পড়ার অভ্যেস আমার। পড়ার বইয়ের ওপর অত ভালোবাসা ছিল না যতটা ছিল বাইরের অন্য বইয়ের ওপর। অবশ্য রবিঠাকুরের সহজ পাঠের কথা আলাদা। কারণ, তাঁর অসাধারণ সহজ লেখার সঙ্গে নন্দলাল বসুর অসামান্য ছবি। ছোটবেলায় সবার প্রিয় বই সহজ পাঠ। আমার ছবি আঁকার উৎসাহও ওই ছবি দেখে। একটু বড়ো হওয়ার পর হাতে পেলাম নতুন পর্যায়ের সন্দেশ পত্রিকা। সহজ পাঠের পরে সন্দেশে সত্যজিৎ রায়ের আঁকা ছবি দেখে নতুন করে মুগ্ধ হলাম। তাঁর শেকড় যে ওই শান্তিনিকেতনে—এ বয়সেই দিব্যি টের পাওয়া গেল। লেখার ধরনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কতরকম যে ছবি! আঁকার যে কত রকমফের হতে পারে! কোনোটা তুলিতে জলরংয়ে আঁকা, কোনোটা কালিকলমে। এত রকমফেরের একটাই কারণ, তাঁকে আঁকতে হয়েছে নানাধরনের লেখার সঙ্গে যাদের ছবির ইমেজ আলাদা আলাদা রকমের।
তাঁর মনে যে বিভিন্ন ধারাগুলো একই সঙ্গে বয়ে যায় বেশ বোঝা গেল। সকাল সাতটায় চান করে এসে বসেছেন। চশমা খুলে হাতে ধরা। ডাঁটির কোণটা দাঁতে ধরা। খালি চোখে জানালা দিয়ে চেয়ে আছেন বাইরে। মনটা কোথায় আছে বুঝে পাওয়া দায়। কানের কাছে বাজছে কখনও বিটোফেন, মোজার্ট বা সালিয়াপিন। কোলে রাখা বোর্ডের গায়ে সাদাকালো রেখার সঙ্গে তুলির ডগা ঠিকঠাক পয়েন্ট করতে করতে অজান্তেই তৈরি হওয়া অপূর্ব টেক্সচার। এবার কাগজ কলম নিয়ে স্বরলিপির নোটেশন লেখা হতে হতে দেখলাম ছুঁচলো ঠোঁটে শিস দিয়ে সুর করছেন গুপির গানের। চারটি লাইন তৈরি হতে খাতার ওপর কলম রেখে বোর্ডে কার্ট্রিজ কাগজের টুকরোয় তুলি ঠেকালেন। দশ মিনিটে হয়ে গেল একটা হেড পিস! তলায় নাম লিখে নামিয়ে রাখলেন পাশে। এবার উঠে এল আধখানা লেখা কোনও গল্প। কলমের পেছনটা কামড়ে দু’মিনিটে লেখা হয়ে গেল শেষ তিনটে পাতা। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে আমার দিকে ফিরলেন, ‘কই, কী আঁকলে দেখি।’ মন দিয়ে আমার আঁকা ছবিটা দেখে বোধহয় খুশি হয়েছেন, ‘তুমি তুলিতেই আঁকতে বেশি ভালোবাসো, না? ভালো। কিন্তু কঠিন তুলিতে আঁকা।’ গল্পের মতো করে বললেন নন্দলাল বসু, বিনোদ বিহারীরা কেমন যত্ন করে তুলির পয়েন্ট ঠিক করতেন, কীভাবে তুলি ধরে রাখতেন। গল্প লিখতে লিখতে ফোন বাজল। রিসিভার তুলে কথা বলছেন, কলম থামালেন না একবারও। বুঝলাম, একাগ্রতা থাকলে মনটাকেও ভাগ করে ফেলা যায়। সময় হাতে রেখে কাজ করা যায় ঠিকঠাক। আসল ব্যাপার হল মনটা, আর সময়ের মাপ।
একেবারে ছোটবেলা থেকে তাঁর মৃত্যু অবধি অনেকদিনের অনেক দেখা, অনেক শেখা ছোটো মাপে বলা মুশকিল। মোদ্দা কথা, মনের সবদিক নিয়েই শিল্প, সবাইকে নিয়েই শিল্পী। ছবি আঁকা আলাদা কিছু নয়। মানিকদার তো একই।
অফসেট ছাপার যুগ নয় সেটা। তুলি কলম আর সাদাকালো রংই সম্বল। মানিকদার আঁকা সাদাকালো ছবি রং ধরাত মনে। হাফটোন বা কোয়ার্টার টোনে পারতপক্ষে আঁকতেন না, দরকারে স্ক্রিন ব্যবহার করতে নীল রং দিয়ে বুঝিয়ে দিতেন কোথায় কী ধরনের স্ক্রিন চান। ব্লক তৈরি করার সময় সুবিধে হত বুঝতে। ঘন কালো কালিতে রেখার জালে ছায়া আঁকতেন। সেই অদ্ভুত টেক্সচারে ছবিতে নতুন ডাইমেনশন আসত।এই জালি টেক্সচার আঁকার শিক্ষা পেয়েছিলেন পারিবারিক সূত্রে। উপেন্দ্রকিশোর আর সুকুমার রায়ের আঁকা ছবি দেখলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে। বেশি খরচে হাফটোন ব্লক বানাবার ঝামেলা, বাসাতেই এই জাল ব্যবহারের সৃষ্টি। কেন জানি না, হাফটোনের চাইতে এই ইকড়ি মিকড়ি মনে দাগ কাটত অনেক বেশি।
সরু দাগ, মোটা দাগ আর আরবি হরফের টানে বা বাংলা পটের মতো কতরকমভাবে যে এঁকেছেন—বলার নয়। কালো সলিড ফিগারের ছবি আছে অনেক। তুলিতে বানটেন ব্রাশ, ড্রাই ব্রাশ, সেমি কন্টেন্ড ব্রাশ।অর্থাৎ যেমন দরকার, তেমন দাগ দিয়ে যাওয়া। মাত্রা যেন হাতের মুঠোয়! টেক্সচারের জন্যে কতরকম পরীক্ষানিরীক্ষা!
মোটা স্টেনসিল ব্রাশ দিয়েও আঁকতে দেখেছি। ফ্ল্যাট তুলি বা কলমে এঁকেছেন। ছবি ধরে ধরে বলতে গেলে মহাভারত লেখা যায়, আমি তার পক্ষপাতী নই এখানে। আমি শুধু আঁকিয়ে মানুষটায় কথা বলব। সহজ সরল মানুষটার ওপরকার গম্ভীর ছদ্মবেশের তলায় মানিকদা ছিলেন শিশুর মতো সন্ধানী। সবকিছু জানার এত আগ্রহ আর কারও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। মানিকদার ছোটবেলার অনেক গল্প শুনেছি। চার-পাঁচ বছর বয়সে পেনসিলে বড়ো বড়ো হরফে লেখা পোস্টকার্ড দেখিয়েছিলেন নলিনীদি। সেখানে কত কী লেখা! নতুন দেখা কোনও পাখি, খেলনা বা বই থেকে শেখা শব্দের কথা লেখা ছিল। বাংলা-ইংরেজিতে লেখার অভ্যেস তখন থেকেই। সেই পোস্টকার্ডেই ছবি আঁকা থাকত। পঁচানব্বই বছর পার করে সেই বিবর্ণ পোস্টকার্ডের ছবি এখন বড়ো হতে হতে আকাশ ছুঁয়েছে।
যেকোনও বড়ো মাপের প্রতিভাবান মানুষ তাঁর বুকের ভেতর সবুজ সতেজ শিশু-মনটিকে লালন করেন। তাঁদের দেখার চোখের বিস্ফার শিশুর মতো, কালের দিগন্ত ধরা পড়ে যায় আনায়াসে।
রসের কথায় আসি। আগেই বলেছি, রসবোধ আসে পারিবারিক সূত্রে, আর বেশিরভাগটাই জন্মগত। উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার হয়ে সত্যজিতে সেই রসবোধ সঞ্চারিত তো বটেই, পরিবারটির সকলেরই রসবোধ অসাধারণ। এঁদের সকলের কল্পনার উত্তরাধিকার সত্যজিতের। মূলত শিশুসাহিত্যে জড়িয়ে থাকা পরিবারটিতে ছবির ব্যবহার ছিল খুবই। তাছাড়া মুদ্রণ বিজ্ঞানের চুড়োয় মানুষগুলো লেখার সঙ্গে কেমন ছবি যাবে, কীভাবে তা ছাপা হবে—এ নিয়ে অনেক দূর এগিয়ে ছিলেন। যৌথ পরিবারটি উত্তর কলকাতার সুকিয়া স্ট্রিট থেকে গড়পাড়ের বাড়িতে এসে ওঠার পর উপেন্দ্রকিশোর ছাপাখানা বসালেন একতলায়। হাসিখুশি মানুষগুলো সবাই নানারকম সৃষ্টি মূলক কাজে ব্যস্ত থাকেন। খেলা, গান, নাটক লেগেই আছে। ১৯১৩ সালে সন্দেশ পত্রিকা বার হওয়ার পর লেখা আর ছবি আঁকার বান ডেকে গেল। বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ, পুরাণ, মজার গল্প, খেলার কথা, বিজ্ঞানের ওপর আন্তর্জাতিক মানের প্রবন্ধ, জীবজন্তুর গল্প, শিকারের গল্প, মজাদার নাটক, উদ্ভট ছড়া, রূপকথা—কী নেই! নানারকম রসের ছড়াছড়ি। বাড়িটা সবসময় যেন হাসত। সত্যজিৎ সব পেলেন উত্তরাধিকার সূত্রে। অবশ্য সব রস ছোটোদের ভালো লাগার কথা নয়, দরকারও নেই তেমন। বাদ গেল শৃঙ্গার, করুণ, ভয়ানক, বীভৎস, দাস্য রস। জায়গা পেল উদ্ভট রস। এ রসের তুলনা নেই। বাংলায় কেউ লেখেওনি এর আজ্ঞে। প্রথম এবং প্রধান স্রষ্টা সুকুমার। সত্যজিতের আবছা মনে ছিল তাঁর বাবাকে। তবে পড়তে শেখার পর চিনেছিলেন তাঁকে। লেখা তো বটেই, এঁর ছবি আঁকাও কঠিন। আঁকলেন ব্রহ্মনারায়ণ খাঁর ইঞ্জিন পোশাক, দাড়ির বেহালা, বেড়ালের হারমোনিয়াম গোছের আশ্চর্য ছবি। মাথায় রইল সুকুমারের আঁকা কুমড়ো পটাশ, প্যাঁচার বিচার সভা। উদ্ভট রস বা অ্যাবসার্ডিটির ওপরে যুক্তিহীন সংজ্ঞা, সত্য থাকে গুপ্ত।
ট্যাঁশ-গরু গরু নয় আসলেতে পাখি সে,
যার খুশী দেখে এসো হারুদের আপিসে।
এ নিয়ে বলার কী থাকতে পারে? আশা করি ট্যাঁশ মানে সকলের জানা আছে। বিশেষত সে হারুদের আপিসে চাকরি করে বলে শোনা গেছে। অথবা সেই মহামন্ত্র—
হ্লদে সবুজ ওরাং ওটাং
ইটপাটকেল চিৎপটাং।
গন্ধগোকুল হিজিবিজি
নো অ্যাডমিশন ভেরি বিজি।
মুশকিল আসান উড়ে মালি
ধর্মতলা কর্মখালি।
উদ্ভট রসের বহু লেখা আর ছবি মানিকদা দিয়ে গেছেন। সুকুমারের মতো রায় পরিবারের আরও অনেকেই লিখে গেছেন, মানিকদা তার জন্যেও বহু ছবি এঁকেছেন। পুরাণের ছবি আঁকার সময় যে দেশের গল্প, আঁকা হতে হবে সে দেশের ধারায়। উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন এই ধারার প্রবর্তক। যে দেশের ছবিই হোক, তার মানুষগুলোর ছবি, পোশাকআশাক, অস্ত্র আর শরীরের ভঙ্গি সহ নিখুঁত হতে হবে, তবেই সে গল্প বিশ্বাসযোগ্য হবে—এই বিশ্বাসে ছবি আঁকতেন মানিকদা। অনুবাদ গল্পের ছবিতেও তাই।
ভূতের ছবির মধ্যে অদ্ভুত রস। ভয় দেখানোর ইচ্ছে নেই ছোটোদের, তাই খানিকটা মজা করে আঁকা। গুপি গাইন বাঘা বাইন সিনেমার জন্যে ভূতের রাজা আর তার সাঙ্গোপাঙ্গদের যে ছবি আঁকা আছে খেরো খাতায় তার জুড়ি নেই। ইতিহাসের ছোঁয়া লাগা সেসব ভালোবাসার ভূতেরা লড়াই করলেও বীর রসের বদলে হাস্যরস আর অদ্ভুত রসই ফুটে উঠেছে। ভারেঙ্গার ভূত বা মালশ্রীর পঞ্চতন্ত্রের জল থেকে উঠে আসা দৈত্যের ছবিতেও তাই।
হাতে তলোয়ার ঢাল নিয়ে আগাডোম বাঘাডোম আর ঘোড়াডোমের চমৎকার ছবি সরু তুলির চটজলদি টানে আঁকা বীর রসের আদর্শ ছবি। বাংলা পটের টান, শান্তিনিকেতনের প্রভাব স্পষ্ট। বিনোদ বিহারী-নন্দলালের কাছে শিক্ষানবিশির ফল।
জটায়ুর, অর্থাৎ লালমোহন গাঙ্গুলির নেপালি জপমন্ত্র বা প্রে হুইল হাতে অন্তুর নাচ অসাধারণ। ফেলুদার কুংফুও তাই। মানিকদার আঁকার চরিত্রই কিছু না কিছু করছে, মুখের অভিব্যক্তিও নিখুঁত। অ্যাকশন থাকলেও চূড়ান্ত ঘটনাগুলোর ছবি ইচ্ছে করেই কম আঁকতেন, ওটা পাঠকের কল্পনার জন্যে ছেড়ে দিতেন।
কোনও স্টাইলাইজেশন ছাড়া সহজ লাইনের ছবিই সংখ্যায় বেশি। যেমন নিজের লেখা গল্প ফেলুদা, শঙ্কুর উপন্যাস বা অন্য সন্দেশী লেখকদের লেখা গল্পগুলোয় আঁকা ছবি। এতেও প্রত্যেকটা চরিত্রের শরীর, মুখের ভাব, পোশাক, যন্ত্রপাতি—এমনকি রিভলভারটি পর্যন্ত নিখুঁত। আমাদের চেনা পরিবেশের চেনা মানুষ সবাই। জীবজন্তুর ছবিও বেশিরভাগই যথাযথ। তবে গল্পের বৈশিষ্ট্যে বাঘ, বেড়াল, কুকুর আঁকাতে তুলি চলত পটের ঢংয়ে। মালশ্রীর পঞ্চতন্ত্রের জন্যে বিভিন ঢংয়ের ছবি। মিশরীয় থেকে বাংলার পট বা সহজ রেখার ছবি।
হাফটোন আর কোয়ার্টার টোনে অল্প ছবির মধ্যে উপেন্দ্রকিশোরের দুঃখীরাম, ব্যোমযাত্রীর ডায়েরি, আনন্দমেলার পুজো সংখ্যার ছবি, বঙ্কুবাবুর বন্ধু ইত্যাদি। খুব বেশি নেই। কারণ বেশিরভাগ ছবি সন্দেশের জন্যে আঁকা, যা ছাপা হত নিকৃষ্ট নিউজপ্রিন্টে, হাফটোন তাতে ফুটতই না ভালো।
পঞ্চুলাল (পিনোচ্চিও) উপন্যাসের সরু তুলির টানে অনবদ্য ছবিগুলো স্টাইলাইজড। দাড়ির সমুদ্রে পঞ্চুর দোল খাওয়া বা মেলার দৃশ্য ভোলা যায় না।
কার্টুন ছবি বলতে বহু চেনা মানুষের মুখের ক্যারিকেচার। অসামান্য ছবি। গোটা দু-তিন কমিকস এঁকেছিলেন বড়ো মাপের সন্দেশের কভারের জন্যে। সেগুলোও কার্টুনধর্মী ছবি, কোনও ডায়ালগ নেই।
আশ্চর্যরকমের গ্রাফিক্সের নমুনা হল জমাট কালো ফিগারের ছবিগুলো। উপেন্দ্রকিশোরের মজার গল্প শেয়ালের ঘি খাওয়ার ছবি যেন কথা বলে। লাঠি হাতে পূজারি জালায় লাঠিপেটা করছে, কালো জালার মধ্যে সাদা রংয়ে আঁকা শেয়াল লুকিয়ে। জালার মধ্যে থাকলে শেয়ালকে দেখতে পারার কথা না, কিন্তু একটুও রসালো না করে শেয়ালকে দেখানো গেল।চটজলদি টানে প্রায় কলম না তুলে আঁকা কবিতার ছবিগুলো সন্দেশের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে। কলমের নিবে বেশি কালি নিয়ে আলতো হাতে আঁকা। আঁকতে গিয়ে থামার জো নেই, কালির ফোঁটা পড়ে ছবি নষ্ট হবে। সংক্ষিপ্ত লাইনে আঁকা, বাড়তি লাইন নেই কোথাও।
ক্যামেরার অবস্থান পালটালে যেমন ডাইমেনশন বদলে যায়, দরকারে মানিকদা ডাইমেনশন বা পরিমিতি পালটেছেন। ‘মিস্টার ককলিঙের কাঁকড়া’ অনুবাদ গল্পে বিশাল যান্ত্রিক কাঁকড়ার দাঁড়ায় ধরা ককলিঙের দেহের ছবি লো অ্যাঙ্গেলে যেন ক্যামেরায় ধরা ভয়ানক ছবি। একে বলা যেতে পারে ভয়ানক রসের কালজয়ী ছবি।
‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’র টপ অ্যাঙ্গেলে দেখা ছবিটিও সেরা ছবি। ইলোরার কৈলাস মন্দিরের অসাধারণ স্থাপত্য বড়ো থেকে ছোটো হয়ে নিচে নেমে গেছে। পাশের পাহাড়ের পাথুরে গা আর মন্দিরের মাঝের গলিতে ছোট্ট দেখাচ্ছে পড়ে থাকা মৃতদেহটা। বোধহয় এইরকম ছবি আঁকতে পেরেই মানিকদা বলেছিলেন, ‘এইসব ছবি এঁকে আমি একটা সিনেমা তৈরি আনন্দ পাই।’
জীবজন্তুর ছবির মধ্যে লাইনে আঁকা কয়েকটি ছবি মনে পড়ছে। দীপালি চৌধুরীর আফ্রিকার চিঠি, হাতি শিকারের ছবি, বাঘের ছবি। তাঁর মাস্টারপিসের মধ্যে রাখব ‘দৈত্যের কেটলি’ গল্পের ছবি, ‘হাঁস’ গল্পের বড়ো সাঁওতালটির ছবি, গুগাবাবার জঙ্গলের ধারে ভূতের রাজার গানবাজনা শোনাবার ছবি, পঞ্চুলাল, শিব আর রাক্ষস, বৃহচ্চঞ্চু, মালশ্রীর পঞ্চতন্ত্র, গল্প-উপন্যাসগুলোর ছবি। কাকে ফেলে কাকে রাখি, তাঁর সব ছবিই আগামী দিনে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
কল্পনায় কত কী দেখে লোকে। তাতে খানিক বাস্তব আর খানিকটা বিজ্ঞানের ফোড়ন দিয়ে তৈরি হল কল্পবিজ্ঞান। বিদেশে এসেছে অনেকদিন আগে, বাংলায় এসেই পেয়ে গেল পাক্কা আসন। কল্পবিজ্ঞান আগেও কি ছিল না? ভারতবর্ষ এক আজব জায়গা। রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ ঘাঁটলে কল্পবিজ্ঞানের শেকড় খুঁজে পাবে। সুকুমার রায়, সুবিনয় রায়, লীলা মজুমদার, প্রেমেন্দ্র মিত্রের পর সত্যজিৎ রায়, অদ্রীশ বর্ধন কল্পবিজ্ঞান নিয়ে কম লেখেননি। কারও লেখায় কল্পনা বেশি, বিজ্ঞান কম। কারও বা বিজ্ঞান বেশি, কল্পনা কম। হাঁসজারু মজার হতে পারে, যদিও খুঁজতে যাওয়া বৃথা। মনে রাখতে হবে কল্পবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বললে অসুবিধে আছে। বরং কল্পনাটাই বেশি আনন্দ দেয়।
সত্যজিতের ছবি নিয়ে বলছি, তাই প্রফেসর শঙ্কু আসবে আলোচনায়। ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়েরি’ থেকে আশ্চর্য এক দুনিয়ার খোঁজ পেল কিশোরকিশোরীরা। ‘স্বপ্নদ্বীপ’ উপন্যাসের ছবিগুলো অবিস্মরণীয়। ___ সূক্ষ্ম টানে আর সলিড কালো জলে অসামান্য কাজ। কল্পনার আগল খুলে শঙ্কুর আশ্চর্য ব্যোমযান আর অচেনা অপার্থিব গাছপালা, যাদের খাদ্য প্রতিভাবান মানুষের মগজ। বিজ্ঞানের যুক্তি বাদ দিয়ে কল্পনার যাত্রা বহুদূর। বড়োদের সাহিত্যে বিজ্ঞান নির্ভর গল্প-উপন্যাস অবশ্যই আছে, দরকারও আছে। কল্পবিজ্ঞান নাম দিলে বিজ্ঞান গৌণ, কল্পনার অবাধ বিস্তারটাই কাম্য। মানিকদারও এই মত ছিল বলে জানি।বিজ্ঞাপন চিত্র, বইয়ের কভার মানিকদার হাতের সেরা কাজগুলোই পেয়েছে। নানান বইয়ের বা পত্রিকার ভেতরকার ইলাস্ট্রেশন প্রচুর আছে। তাতে সন্দেশের মতো এত রকমফের নেই। সন্দেশ পত্রিকা তাঁর নিজের, সেখানে তিনিই রাজা।
ছোটো মাপে এত বড়ো বিষয় নিয়ে লেখা সম্ভব নয়। ভবিষ্যতে গবেষণা করার মতো এত ভালো বিষয় আর কি আছে? সে কাজটা ঠিকঠাক করতে পারলে কেন ইলাস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে তাঁর পাশে দাঁড়াবার মতো কেউ নেই। শুধু এদেশে নয়, গোটা পৃথিবীতেই নেই। কারণ, ইমেজ ড্রয়িং কথাটাই ভালো করে মাথায় আসেনি কারও। বেশিরভাগ শিল্পীই নিজস্ব একটা ঢংয়ে এঁকে গেছেন, লেখা যেমনই হোক। মানিকদা করেছেন ইমেজ ড্রয়িং।
___
লেখক পরিচিতি
*সত্যজিৎ রায় কৃত ইলাসট্রেশনগুলি লেখকের সৌজন্যে প্রাপ্ত। তাঁকে অশেষ কৃতজ্ঞতা।
ডকুমেন্টেড হয়ে থাকার মত লেখা।
LikeLike
very valuable document on satayajit Roy. we came to know many things which were unknown so far. salute to writer
LikeLike
ছোটমামা you are just too good….
LikeLike
শিবশঙ্কর, খুব সুন্দর লিখেছ। এত অল্পকথায় সত্যজিৎ রায়ের অলংকরণ নিয়ে এমন লেখা তোমার পরিমিতিবোধের পরিচয় বহন করে, তোমার অলংকরণে যা সহজেই ফুটে ওঠে।
তবে এই বিষয়ে আরও লেখা পড়তে চাই।
LikeLike