জয়ঢাকের খবরের কাগজের সমস্ত আশ্চর্য খবর এই লিঙ্কে
মহাশূন্যে মানবসভ্যতার ইতিহাস
অরিন্দম দেবনাথের প্রতিবেদন
না, কোন বিশেষ দেশের হেফাজতে নয়, মানব সভ্যতার ইতিহাস পৃথিবী ছেড়ে পাড়ি জমাল মহাকাশে। বেশি নয় মাত্র ত্রিশ মিলিয়ন পাতার তথ্য-ভাণ্ডার কয়েকটা ছোট ডিভিডি ডিস্ক আকারের চাক্তিজাত হয়ে, এবছর অর্থাৎ ২০১৯-এর ফেব্রুয়ারির শেষে ইসরায়েলের বেয়ারশিট স্পেসক্র্যাফটে চেপে সোজা গেছে চাঁদের বুকে। আয়োজকরা প্রথমে শঙ্কু আকৃতির ক্ষুদে মাল-যানে চেপে কী যাচ্ছে সে সম্পর্কে বিশেষ কিছু আলোকপাত করেননি। কিন্তু সম্প্রতি জানিয়েছেন ডিস্কে করে মানব-সভ্যতার ইতিহাস পৃথিবীর বাইরে সংরক্ষণের কথা।
চন্দ্র-পাঠাগার (লুনার লাইব্রেরি) নামে অবিহিত ডিস্কে ঠাসা মানবসভ্যতার তথ্য আগত মানব বংশধরদের জন্য বলে জানিয়েছেন লসএঞ্জেলেস ভিত্তিক অমুনাফাকারি সংস্থা আর্চ মিশন ফাউন্ডেশানের সহ-প্রতিষ্ঠাতা নোভা স্পাইভেক। এই সংস্থা এমন এক সংগ্রহশালা গড়ে তুলছেন যা মহাশূন্যে অন্তত ছ’শো কোটি বছর টিকে থাকবে।
পল ডেভিস,অ্যারিজোনা স্টেট ইউনির্ভাসিটির বিওন্ড সেন্টার ফর ফান্ডামেন্টাল কনসেপ্টস ইন ফিজিক্স এর ডিরেক্টর চন্দ্র-পাঠাগারকে মূলত প্রতিকি বলে মনে করলেও বলেছেন “কিন্তু এই উদ্যোগের গুরুত্ব আছে। এটা আরো অনেককেই ব্রহ্মাণ্ডের মাঝে মানবজাতির অস্তিত্বের স্বাক্ষর স্থাপনে উৎসাহিত করবে। ভেবে দেখুন আমরাও মহাবিশ্বে প্রানের অস্তিত্ব খুঁজে বের করতে কত সাধনা করে চলেছি।”
“যদি আমরা চাঁদের বুকে দীর্ঘ-জীবন ধারণকারী নথি রেখে দিতে পারি, হতে পারে ঠিক এরকমই কিছু একটা করে গেছে বা যাবে আমরা যাদেরকে ই.টি বলি” বলেছেন ডেভিস। “মানবজাতির উচিৎ হবে চাঁদ বা অন্য গ্রহে এলিয়েনরা ওই ধরনের কিছু রেখে গেছে কিনা তারও খোঁজ খবর করা।” কোন কিছুই অসম্ভব নয়।
মহাকাশে লাইব্রেরি পাঠানো আর্চ ফাউন্ডেশানের কাছে নতুন কিছু নয়। এর আগে স্পাইভেক ও তার দল আমেরিকান লেখক ইজেক আসিমভের লেখা কল্পবিজ্ঞান কাহিনী ‘ফাউন্ডেশান’ একটা স্ফটিকের ডিস্কে ভরে মহাশূন্যে পাঠিয়েছেন, যা নাকি সূর্যের কক্ষপথে টেস্লা রোডস্টের চেপে ঘুরছে। আসিমভের কল্পবিজ্ঞান কাহিনী স্পাইভেকের চিন্তায় অনেকটাই প্রভাব রেখেছে।
“চন্দ্র-পাঠাগার আরও বিশদ তথ্য ভাণ্ডার। আমরা একটা ‘রোসেটা স্টোন’ বানাচ্ছি যা ভবিষ্যতে সৌরমণ্ডলের কোথাও রাখা হবে।” জানিয়েছেন স্পাইভেক। ‘রোসেটা স্টোন’ হল নীল নদের ধারে রোসেটা অঞ্চলে ১৭৯৯ সালে খুঁজে পাওয়া প্রস্তরলিপি। হায়ারোগ্লিফিক, ডেমোটিক এবং গ্রিক ভাষায় লেখা মিশরের এই প্রাচীন ইতিহাসলিপির মর্মোদ্ধার করেছিলেন জিন ফ্রাঙ্কো চ্যাম্পলিয়ন ১৮২২ সালে।
কী আছে এই চন্দ্র-পাঠাগারে? একটা ডিভিডি চাকতির মত আকার ও আয়তনের এই পাঠাগারের ওজন ১০০ গ্রাম। আসলে কিন্তু চল্লিশ মাইক্রন পুরু পঁচিশখানা নিকেলের চাকতি একের ওপর আরেকটা বসিয়ে তৈরি করা হয়েছে জিনিসটাকে। ওপরের চারটে চাকতিতে রয়েছে মোট ৬০০০০ খানা ছবি। তারা সব সেরা সেরা বইয়ের পাতা, ফোটোগ্রাফ আর অলঙ্করণ। সবার ওপরের স্তরটা খালি চোখেই দেখা যাবে। তাতে রয়েছে মোট দেড় হাজার ছবি। যেকোনো সাধারণ মাইক্রোস্কোপ দিয়ে একশোগুণ বিবর্ধিত করলেই সেগুলোকে পড়া যাবে। এর পরের তিনটে স্তরের প্রতিটিতে আঁটানো হয়েছে আরো কুড়ি হাজার করে পাতা। হাজার গুণ বিবর্ধন করে নিলে সেগুলোকে পড়া যাবে। মজার খবর হল, এই স্তরগুলোর অক্ষরগুলোর আয়তন একেকটা ব্যাসিলাস ব্যাকটিরিয়ার সমান।
আর কী আছে তাতে? ছবি আর শব্দ দিয়ে পৃথিবীর প্রধান প্রধান ভাষাগুলোর প্রাথমিক শিক্ষার প্রথম পাঠ। সেইসঙ্গে প্রায় এক হাজার পার্থিব ভাষার গঠন শেখাবার জন্য তৈরি করা একটা প্রোগ্রামের সবটাই। (মজার খবর হল, এই প্রোগ্রামটার নামও রোসেটা ডিস্ক) । এর নীচের স্তরে রয়েছে, লাইব্রেরির পরবর্তী স্তরগুলোতে আরো ঘনভাবে সাজানো তথ্য উদ্ধারের যান্ত্রিক পদ্ধতির পাঠ। সেই স্তরগুলোয় কী আছে? আছে অনেক ব্যক্তিগত লাইব্রেরি সংগ্রহ, আছে ইজরায়েলের ইতিহাস লেখা একটা টাইম ক্যাপসুলের সমস্ত লেখা, অজস্র গান, শিশুদের আঁকা ছবি। ওপরের এই স্তরগুলোর ভেতরে বাকি স্তরগুলোয় আর পাতার ছবি নয়। রয়েছে ডিজিটালি কোড করা তথ্যভাণ্ডার। প্রত্যেকটায় রয়েছে একটা করে ডিভিডি মাস্টার। তাতে আছে কয়েক লক্ষ উপন্যাস ও গল্প, পাঠ্য পুস্তক। রয়েছে গোটা উইকিপিডিয়াটা। রয়েছে ৫০০০ হাজার পার্থিব ভাষাশিক্ষার পাঠ, আর তাদের একটা থেকে অন্যটায় করা দেড়শো কোটি ট্রান্সলেশনের পাঠ। সব কিছু ভরা হয়েছে ২৫টা নিকেলের চাক্তিতে। প্রতিটি চাক্তি এক ইঞ্চির ৬০০ ভাগের এক ভাগ পুরু।
কিন্তু কথা হচ্ছে এই চাক্তিগুলো চাঁদের বুকে কতদিন টিকে থাকবে? আর্চ ফাউন্ডেশান এই তথ্য লেখার জন্য ন্যানোফেচ প্রযুক্তি প্রয়োগ করেছে। চাঁদে যা তাপ থাকে তার থেকেও দশগুণ বেশি তাপে এই তথ্য বেঁচে থাকবে। আর চাক্তিগুলো নিকেলে তৈরি করা হয়েছে স্থায়িত্বের জন্য।
এরপর এই চাঁদ-পাঠাগারের ওপর বিশেষ আস্তরণ দেওয়া হয়েছে চাঁদে সর্বক্ষণ বয়ে চলা ধুলিঝড় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য।
আরও এই ধরনের পাঠাগার ছড়িয়ে দেওয়া হবে মহাশূন্যের বিভিন্ন অংশে। ঠাসা হবে আরও নতুন তথ্য। প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা বলছেন, একসুয় গটা সৌরজগতটা জুড়েই তাঁরা ছড়িয়ে দেবেন এহেন অজস্র লাইব্রেরি। নিঃশব্দে তারা ভেসে চলবে অন্ধকার মহাকাশে। তারপর… ভবিষ্যৎ কেউ না কেউ হয়ত পাবে এই তথ্য। তখন হয়ত পৃথিবী, চাঁদ বা মঙ্গল বলে কিছুই থাকবে না…