আজ টোটোনের টিউশন থেকে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। অনিমেষ স্যার আজ অঙ্কের পরীক্ষা নিলেন। সারপ্রাইজ টেস্ট। তাই অন্যদিনের তুলনায় একটু দেরি হয়ে গেল। ডন বস্কো (লিলুয়া) স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র টোটোন, ভালো নাম রাজর্ষি। ছোটোবেলায় বাবার কোলে চেপে খালি ঘুরতে যাবার বায়না করত বলে দাদু-দিদুন আদর করে টোটোন বলে ডাকতেন। সপ্তাহের পাঁচদিনই তার টিউশন পড়া থাকে। কোনওদিন অঙ্ক, কোনওদিন সায়েন্স, কোনওদিন ইংরাজি—এইরকম। আর শনি-রোববার সকালে থাকে সাঁতারের আর ক্যারাটের ক্লাস, সন্ধ্যায় ড্রয়িং ও তবলা শেখাতে ঘরে আসেন দু’জন মাস্টারমশায়। স্কুল ছুটি হয় চারটেয়। কাছেই বাড়ি, লালাবাবু সায়ার রোডে। তাই নিজের সাইকেল চেপেই সে স্কুলে যাতায়াত করে। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতে চারটে পনেরো হয়ে যায়। তারপরেই নাকেমুখে গুঁজে একটু কিছু খেয়ে পাঁচটার মধ্যে কোচিং সেন্টারে পৌঁছাতে হয়। বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় ছ’টা-সাড়ে ছ’টা বাজে। আজ সাতটা বেজে গেছে। ফিরে আবার স্কুলের হোম-ওয়ার্ক করতে হবে। ওর বাবা বলেন, ‘আমাদের টোটোনবাবু এখন শহরের ব্যস্ততম মানুষ।’ উপায়ও নেই। আজকের দিনের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে ভালো ভালো স্কুলের ছেলেমেয়েদের এইরকমই ব্যস্ত থাকতে হয়। সেখানে খেলাধূলা, হাসি-আড্ডা, পাড়াপড়শির সঙ্গে মেলামেশার জন্য অতিরিক্ত সময়ের মঞ্জুরি নেই।
রোজ ফেরার সময় মা এসে গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। টোটোন সাইকেলটা হাঁটিয়ে মায়ের সঙ্গে গল্প করতে করতে ফেরে। আজ মা আসবেন না, তাই একাই ফিরছে টোটোন। মা গেছেন বরানগরে, দিদুনের বাড়ি। দাদুর শরীর খারাপ, তাই দেখতে। মা বলেছিলেন, “টোটোন, সাবধানে দেখেশুনে সাইকেল চালাবি।”
লালাবাবু সায়ার রোডের এই পথটা ভীষণ ঘিঞ্জি। বাস, লরি, অটো, টোটো, রিকশা—কোনও যানবাহনই বাদ নেই। একটু অসতর্ক হলেই অঘটন ঘটার সম্ভাবনা। টোটোন মাকে আশ্বাস দিয়েছিল, “মা, তুমি একদম চিন্তা কোরো না। আমি এখন বড়ো হয়ে গেছি, ঠিক বাড়ি পৌঁছে যাব।”
হঠাৎ একটা ব্যাপার দেখে থমকে সাইকেল থামাল টোটোন। হাত খানেক দূরেই তার দিদুনের বয়সী এক বৃদ্ধা একটা রিকশাকে পাশ কাটাতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন রাস্তার উপরে। তাঁর হাতে বাজারের থলে। সেখান থেকে কিছু সবজি গড়িয়ে গেল রাস্তায়। টোটোন সাইকেলটা সাইড করে রেখে কাছে গেল। পথে অনেক লোক চলাচল করছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ‘মাসিমা, দেখেশুনে চলতে পারেন না?’ মন্তব্য ছুড়ে দিয়ে পাশ কাটাল। কেউ কেউ আবার টোটোনকে এগিয়ে আসতে দেখে ওঁর পরিচিত মনে করে আর এ ব্যাপারে মাথা ঘামাল না। টোটোন কাছে গিয়ে ঐ বৃদ্ধাকে যত্ন করে হাত ধরে তুলল। বলল, “আপনার বাড়ি কতদূর? নিজে যেতে পারবেন কি? চলুন, আমি আপনাকে এগিয়ে দিচ্ছি। আপনার বাজারের থলিটা আমার সাইকেলের ক্যারিয়ারে দিন।”
বৃদ্ধা মহিলার কৃতজ্ঞতায় ভরা চোখে জল চিকচিক করে উঠল। তিনি ধীরে ধীরে চলতে শুরু করলেন। বললেন, “বেশি দূরে নয় সোনা, ঐ পরের গলির কল্পতরু অ্যাপার্টমেন্টে। কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই টিউশন পড়ে ফিরছ, বাড়িতে না বলে আমার সঙ্গে গেলে বাড়ির লোক চিন্তা করবে না?”
টোটোন কোনও কথা বলল না। ওর খুব মায়া হচ্ছিল।
হাঁটতে হাঁটতে উনি বললেন, “তোমার দাদুর খুব জ্বর, আজ তিনদিন হল। তাই ডাক্তারবাবুকে ফোন করে বলতে উনি ওষুধ পালটে দিলেন। ওষুধ কিনে ফেরার সময় ভাবলাম, ঘরে তো রান্নার কিছু নেই, একটু সবজি নিয়ে যাই। উনি তো বেরোতে পারছেন না। তা না হলে আমি ঘর থেকে বড়ো একটা বেরোই না।”
টোটোন মৃদু স্বরে প্রশ্ন করল, “ঘরে আর কেউ নেই?”
“আমার এক ছেলে লন্ডনে ডাক্তারি পড়ছে, আরেক ছেলে আমেরিকার টোরান্টোয় চাকরি করে।” গর্ব ঝরে পড়ল বৃদ্ধার গলায়।
একটা ব্যথা দলা পাকিয়ে উঠল টোটোনের গলার কাছে। তার মামুও চাকরি করছে অস্ট্রেলিয়ায়। দাদু-দিদুনকে সেখানে নিয়ে যেতেও চেয়েছে অনেকবার। কিন্তু তাঁরা নিজের দেশের মাটি ছেড়ে কোথাও নড়বেন না। তাই সময়ে অসময়ে প্রয়োজন পড়লে তার মা গিয়ে দাদু-দিদুনের দেখাশোনা করে আসেন।
নতুন দিদুনের ফ্ল্যাটে পৌঁছে টোটোন দেখল ফ্ল্যাটটা নানা আসবাবপত্র, ছবি, শো-পিস ইত্যাদি দিয়ে সুন্দর করে সাজানো। দাদু জ্বরে প্রায় বেহুঁশ। টোটোন বলল, “আমি দাদুর মাথায় জলপট্টি দিচ্ছি দিদুন, তুমি গিয়ে দুধ গরম করে আনো।”
বৃদ্ধা তাই করলেন। তারপর বললেন, “দাদুভাই, তুমি টিউশন পড়ে এলে, ক্ষিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই। দেখো, ওষুধ খেয়ে, গরম দুধ খেয়ে, তোমার দাদু এখন অনেক ভালো আছেন। তুমি বাড়ি যাও ভাই। তোমার বাবা-মা না জানি কত ভাবছেন।”
টোটোন একটা কাগজে তার বাবার মোবাইল নম্বর লিখে দিল নতুন দিদুনকে। বারবার বলল, “রাত্রে কোনও দরকার হলে ফোন কোরো কিন্তু।”
তারপর সে বিদায় নিয়ে রওনা হল নিজের বাড়ির দিকে। তার মনের মধ্যে একটা ভাঙচুর হচ্ছিল।
অনেক রাত হল। মা ফিরে দেখেন, টোটোন এখনও ফেরেনি। সে কী! টোটোনের বাবা অফিস থেকে ফিরে টিভিতে নিউজ দেখছিলেন। মায়ের দুশ্চিন্তা দেখে বললেন, “হয়তো কোনও বন্ধুর সঙ্গে গল্প করছে, তুমি কোচিং সেন্টারে ফোন করে দেখ না।”
ইতিমধ্যেই ম্লান মুখে ঘরে ঢুকল টোটোন। ছেলের মুখ দেখেই মা কিছু আঁচ করেছেন। বললেন, “কী রে? আজ কী হল?”
টোটোন সব খুলে বলল। বাবা টোটোনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “তুই খুব ভালো কাজ করেছিস বাবা!”
পরেরদিন সকাল সকাল টোটোনের স্কুলে যাওয়ার পর মিতালি গিয়ে হাজির হলেন কল্পতরু অ্যাপার্টমেন্টে। বৃদ্ধা দেখেই চিনলেন। “রাজর্ষির মা তুমি, তাই না? ভারী ভালো ছেলে তোমার।”
মিতালি বললেন, “মাসিমা, ওইটুকু ছেলেই আমার চোখ খুলে দিল। কী বলল জানেন? বলল, ‘তুমি বরানগরে গিয়ে নিজের মা-বাবার সেবা করে আসছ। আর ঘরের কাছেও যে তোমার এমন কত বাবা-মা আছে, তাদের সুখদুঃখের কথাই জানো না?’ আবার স্বামীজীর বাণী মনে করিয়ে দিল আমাকে, ‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর/ জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।’ আমার কাছে ছেলে কথা আদায় করেছে, এখন থেকে পাড়ায় খোঁজ নিয়ে আমি যেন এই আপনাদের মতো, মানে ওর দাদু-দিদুনের মতো সব একলা থাকা দাদু-দিদুনদের সুবিধা-অসুবিধার খোঁজ নিই। ছেলে বলে, ‘মা, দুনিয়াটা এখন ছোট্ট একটা গ্রাম। সবাই সবার পাশে থাকবে, তবেই তো পৃথিবীটা স্বর্গ হবে!’ আমাকে আর পর মনে করবেন না মাসিমা। মনে করবেন, আজ থেকে আমি আপনার এক মেয়ে।”
অধীর আনন্দে নতুন পাওয়া মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরেন টোটোনের ‘নতুন দিদুন’।