অনসূয়া খাসনবীশ
“হাট্টিমা টিমটিম মানেই কি যাদের মাথায় খাড়া দুটো শিং? এ ভারি অন্যায় কথা। আমি এই এক হাট্টিমা দেখে এলাম।” বলে সিন্নিপিসি বেশ যেন রাগ করেছে এমন মুখ করল।“আরে, হাট্টিমারা তো এই দেশের লোকই নয়। আর তাদের মোটেই শিং ছিল না।” বলে পিসি।
শীত, তাই মা লেপ-কাঁথা রোদে দিয়েছে। তার উপরেই পুঁটলি, চিন্টি, গিল্লুরা হুজ্জুতি করছিল। মা বড়ি তুলছিল। সিন্নিপিসির হাঁটুর ব্যথা, তাই চেয়ারে বসেছে। খাওয়াদাওয়া সেরে এই সময় সবাই একটু রোদে এসে বসে। পিসি এই দু’দিন হল এখানে এসেছে। তাই মায়ের কথায় পুঁটলি হাট্টিমা টিমটিম গান গেয়ে শোনাচ্ছিল পিসিকে। শেষ হতেই এই কথা।
গিল্লু তার তোতলা ভাষায় পিসিকে বোঝায়, “ও তো মিথ্যে কলে গান। হাত্তিমা তিমতিম তো নেই।”
পিসি চোখদুটো বড়ো বড়ো করে বলে, “কে বলেছে? জানিস হাট্টিমাদের গল্প? ওদের শিংয়ের গল্প? আর হাট্টিমারা মোটেই ডিম পাড়ে না। সে তো ওদের জুমানপুখি ছিল ডিমের মতো দেখতে।”
জুমানপুখি, শিং – গল্পের গন্ধ পেয়ে পিসির পায়ের কাছে এসে বসে চিন্টি। দেখাদেখি পুঁটলিও। গিল্লুর দাঁতে মাংসের টুকরো ঢুকেছিল। ছাদের কলের জলে কোনওরকমে কুলকুচো করে দৌড়ে এল।
“সে কী? বল বল। ও পিসি,” সবাই মিলে চেপে ধরতে পিসি খসখসে হাত-পায়ে আর একটু খসখস শব্দ তুলে, চশমাটা খুলে বসল।
“তবে শোন। হাট্টিমারা এখন আমাদের মতোই থাকে। আমাদের মতোই কথা, আমাদের মতোই খাওয়াদাওয়া, আর জামাকাপড়। কিন্তু ওরা থাকত ভারতের পুবে যে মেঘালয়, তারও পুবে যে জঙ্গল, তারও পুবে। কয়েকশো বছর আগে পুবের দুর্গম জঙ্গল পেরিয়ে তারা ভারতে আসে। তা হাট্টিমারা থাকত ঘন জঙ্গলে। এতই ঘন যে সচরাচর অন্য কোনও আদিবাসীরা সেখানে যেত না। ঘন জঙ্গল আরও ঘন হতে হতে যখন প্রায় পথ হারাবার মতো অবস্থা, ঠিক তখনই জঙ্গল হাল্কা হয়ে পাহাড় শুরু হয়। সেই পাহাড় আর জঙ্গলের মাঝের জায়গায় পাতার ছাউনি দেওয়া ঘরে থাকত হাট্টিমারা। ছোটোখাটো গাট্টাগোট্টা চেহারা তাদের। কিন্তু গারোদের মতো তাদের চোখগুলো ছোটো ছোটো নয়। বেশ বড়ো বড়ো, এই পুঁটলির মতো। তবে তাদের ছেলেমেয়ে কারোর মাথায় বেশি চুল হত না। পাতার তৈরি একরকম টুপি তারা পরত যার দু’পাশে দুটো ছ্যাদা থাকত। সেই ছ্যাদার মধ্যে দিয়ে তারা তাদের গুটিকয়েক চুল বের করে রাখত। হাওয়ায় সে চুল উড়লে শিংয়ের মতো দেখাত। এই ছিল তাদের সাজ।
“আর ছিল জুমানপুখি। হাট্টিমাদের ভাষায় জুমান মানে পবিত্র আর পুখি মানে ডিম। জুমানপুখি আসলে ছিল তিন মানুষ লম্বা, ডিমের মতো আকারের একটা পাথর। রঙ ছিল টকটকে লাল। ঐ এলাকা কেন, কোশ কোশ দূরেও ঐরকম কোনও পাথর কস্মিনকালে কেউ দেখেনি। আজম্মকাল ধরে তারা দেখে আসছে পাহাড়ের চূড়ার ঠিক নীচে একটা প্রায় ঝুলন্ত আড়াআড়ি পাথরের উপর দাঁড়িয়ে আছে জুমানপুখি। যেন কোনও বাতাসের হাত তাকে ধরে আছে। ঝড়, জল কোনও কিছুতেই তার হেলদোল নেই। হাট্টিমাদের বিশ্বাস ছিল জুমানপুখির অলৌকিক ক্ষমতা আছে। তাই তারা খুব ভক্তি করে পুজো করত এই পুখিকে। অনেকেই বলত, তারা নাকি গভীর রাতে জুমানপুখিকে পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠানামা করতে দেখেছে।
“হাট্টিমারা সাধারণত পাখি ধরত, পুষত। আর পাখির মাংসই খেত। আর সেই পালকে জামা বানিয়ে পরত। রাত্রিবেলা আগুন জ্বেলে তার চারপাশে তারা নাচগান করত। জুমানপুখির উৎসব হত প্রতি পড়ন্ত শীতে। দূর দূর থেকে আদিবাসীরা আসত। মেলা বসে যেত। বিয়ে হত। আর তাতে জংলি লতাপাতা দিয়ে মাটির কালো হাঁড়িতে বনের পাখির মাংস রান্না করত হাট্টিমারা। তাই খেতে সবাই ভিড় করত।
“একবার বুড়িমা মুজানচি স্বপ্ন পেল, লাল টুকটুকে জামা পরে লম্বা, একমাথা কোঁকড়া চুল এক সুপুরুষ তাকে বলছে, মুজানচি সবাইকে নিয়ে পশ্চিমে চলে যাও। আজ থেকে তিনদিন পর এখানে সব ধ্বসে পড়বে। পশ্চিমের বন পেরিয়ে রসা জমি আছে। সেখানে বস। আমি আবার আসব।
“মুজানচি সব্বাইকে ডেকে ডেকে এই কথা বলল। কেউ কেউ বিশ্বাস করল। কেউ কেউ হেসে বলল, বুড়িমা স্বপন দেখেছে। তারা গেল না। বাকিদের নিয়ে বুড়ি রওনা দিল। গিয়ে বসল সেই জমিতে। সেখানে তারা চাষ শিখল। আর তাদের চাষের জমির ঠিক মাঝে জুমানপুখির বেদি তৈরি করল গাছের কাঠ দিয়ে। কিন্তু সেই বেদি রইল শূন্য। একদিন হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে তারা দেখল, সেই বেদিতে সেই লাল টকটকে জুমানপুখি এসে বসেছে। ভোরের সূর্যের আলো মেখে মনে হচ্ছে যেন তার গায়ে আগুন জ্বলছে। এমন ঘটনা কেউ কখনও ভাবেওনি। খুব ভক্তিভরে তারা পুজো দিল। আর কাঁদল, যারা তাদের সাথে আসেনি তাদের জন্য। অন্যান্য আদিবাসীরাও ভিড় করে পুজো দিতে এল। অনেক শীত সেখানে হাট্টিমারা থাকল শান্তিতে। কিন্তু মুজানচি জানত এই শেষ নয়। দেবতা বলেছে আবার আসবে। এত শান্তিতে থাকতে থাকতে তার মনে হতে লাগল, দেবতা আর না দেখা দিলেই হয়তো ভালো হয়। সে বেদিতে যেত না আর ভয়ে। পাছে দেবতা স্বপ্ন দেয়। কিন্তু দেবতার কথা মিথ্যে হবার নয়। একবছর শুরু হল বৃষ্টি। সে বৃষ্টির তোড়ে সব ভেসেই যায় বুঝি। এত জল কেউ কখনও দেখেনি। সব শস্য নষ্ট হয়ে গেল। বাচ্চারা অসুস্থ হতে লাগল। মুজানচি না খেয়ে না দেয়ে জুমানপুখির পায়ে ধর্না দিল। তিনদিন তিনরাত সে ভিজেই চলল। তারপর দিন বৃষ্টি একটু বাঁধল। সবাই মিলে বুড়ির খোঁজে যেতেই দেখল পুখিকে আঁকড়ে ধরে পড়ে আছে সে। ভেজা গায়ে আগুনের মতো তাপ। চোখ লাল। সারামুখ ফোলা। অনেক কষ্টে সে বলল, “তোরা চলে যা এখান থেকে। জুমানপুখি আমায় বলেছে, পশ্চিমে, আরও পশ্চিমে। সেখানে আছে সোনার দেশ। নদীর ঐ ধারে। চলে যা, চলে যা। পশ্চিমে, আরও পশ্চিমে। দেবতা পথ বলেছেন। একপক্ষের মধ্যে তোরা চলে যা সবাইকে নিয়ে। পশ্চিমে। জুমানপুখি সহায় হোন। আমি রইলাম তার পায়ে।
মুজানচি বুড়িকে রেখে ভারী মনে সবাই চলা শুরু করল। যাবার সময় দেখতে পেল, বুড়ি তার দেবতার সাথে যেন কত সুখদুঃখের গল্প করছে। তাদের চলার পথে ভয়ংকর বন পড়ল, ভীষণ নদী পড়ল। সব পেরিয়ে তারা পৌঁছল সোনার দেশে। আমাদের এই দেশে। হাট্টিমারা এখানে এসে থাকতে শুরু করল। এখানকার ভাষা শিখল, আর শিখল রান্না। তাদের দেখে এখন আর চেনাই যায় না হাট্টিমা বলে। চুল তাদের এখনও তেমন বেশি না। তবে সেই রান্না। জুমানপুখির আশীর্বাদ। রান্না খেলেই বোঝা যায়।”
তিনজোড়া গোল গোল চোখ অপলক তাকিয়ে শুনছিল এতক্ষণ। এতক্ষণে চিন্টি বলে, “তাহলে কি হাট্টিমারা এখনও আছে?”
পিসি বলে, “হ্যাঁ, আছে। এই বাড়িতেই আছে। কাউকে বলবি না বল, তাইলে বলি। হাট্টিমারা দারুণ মুরগি রাঁধে।”
তিনজনে সমস্বরে চীৎকার করে উঠল, “নিমাইদা। বেঁটে, মোটা। চুলও নেই। নিমাইদা নিশ্চয়ই হাট্টিমা।”
পিসি খুব চিন্তায় পড়ে গেল যেন। বলল, “কিন্তু হাট্টিমারা খুব ঝাল ভালোবাসে।”
গিল্লু বলে, “হ্যাঁ তো ,নিমাইদা খুব জাল দেয়। কেতেই পালি না।”
পিসি বলে, “তার আগে জিগ্যেস করতে হবে নিমাইদা মুজানচিকে চেনে কি না।”
যেমনি বলা, সক্কলে হই হই করতে করতে নীচে দৌড়ল।
সন্ধ্যে নেমে গেছে। পদ্মদি সেই কখন লেপ-কাঁথা তুলে নিয়ে গেছে। মা এতক্ষণ মিটিমিটি হাসছিল। ওরা নীচে নামতেই বলল, “তুমি পারও দিদি। আমায় বলবে তো।”
পিসি হাসতে হাসতে বলল, “নিমাইটা বড়ো ঝাল দেয়। এ ওর পুরনো অভ্যাস। বললে শোনে না। আমার আবার পাইলসের সমস্যাটা বেড়েছে কিনা। এবার বুঝুক।”
ছবিঃ শিমুল
জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে