চোখ
জয়তী রায়
রবিবারের দুপুরবেলা। মায়ের হাতের রান্না করা কষা মাংস আর পোলাও খেয়ে শুয়ে আছে রাজা। ঘুমোবে না। সোমবার বাংলা পরীক্ষা। সে এখন ক্লাস এইট। সব সাবজেক্টে ভালো করলেও, বাংলায় কেন জানি না কিছুতেই মনের মতো নম্বর ওঠে না। রেজাল্ট বেরোলেই বাবাইয়ের মুখ গম্ভীর। বাবাইকে নিয়ে রাজার খুব গর্ব। কলকাতার নামকরা ডাক্তার। তাছাড়াও তিনি মাসে একবার করে দূর দূর গ্রামে যান নিজের বড়ো গাড়ি, ওষুধ আর নার্সদের নিয়ে দুঃস্থ লোকেদের সেবা করার জন্য। বড় হলে রাজা বাবাইয়ের মতো হতে চায়। মুশকিল করে বাংলা সাবজেক্ট। বাবাই বলবে, “বাংলায় যদি ভালো না হতে পার রাজা, তার চেয়ে লজ্জার আর কিছু নেই।”
নাহ্! এবার কিছুতেই কম নম্বর পাবে না সে। আজ দুপুর, তাই গেম খেলবে না, টিভি না, কিচ্ছু না। শুধু পড়া। ভাবতে-ভাবতেই শোনে বাইরের দরজা খোলার শব্দ আর মায়ের গলা। “ওমা, নোনতাদাদু! কতদিন পরে! আসুন, আসুন। সঙ্গে এ কে?”
রাজা বুঝল, এসেছে মায়ের প্রিয় কোনও মানুষ। সেজন্যে গলায় এমন আনন্দের সুর। সে নিজের ঘর ছেড়ে বসার ঘরে এসে দেখল, বাবাই আর মায়ের মুখ উজ্জ্বল। যেন খুব আপনজন কেউ এসেছে ঘরে। দরজার সামনে যে মানুষটি হাসিমুখে দাঁড়িয়ে, তিনি বেশ লম্বা। ঝুঁকে পড়েছেন সামনে। ঢোলা প্যান্ট। আর হাফ হাতা সাদা শার্ট। দুটোই এলোমেলো। একমাথা সাদা ঝাঁকড়া চুল, মুখে সরল হাসি। রাজা বিড়বিড় করে বলল, “প্রফেসর শঙ্কু!”
লম্বা মানুষটি নিচু হয়ে তাকে ছুঁয়ে কপালে চুমু খেলেন। মা বলল, “প্রণাম কর, রাজা। উনি আমার নোনতাদাদু।”
ঘর ফাটিয়ে হেসে উঠলেন দাদু। “তোমারও তাই। সকলের আমি নোনতাদাদু। চলো চলো, বসে খানিক জিরিয়ে নিই। তারপর আলাপ কোরো ছোটুর সঙ্গে।”
তাই তো! এতক্ষণ চোখে পড়েনি, দাদুর হাঁটুর নিচে গুঁড়ি মেরে দাঁড়ানো এক ছেলে। কালো খরগোশ ছানার মতো। জুলজুল চোখ। মাথাটা ন্যাড়া। পরনে কালো হাত কাটা নাইলনের গেঞ্জি। সুতির ঢলঢল হাফ প্যান্ট। ধুলো ধুলো শরীর। দুই হাতে আঁকড়ে আছে দাদুর পা। ঠিক যেন গাছে ঝুলে আছে। মিটমিট করে দেখছে। বাবাই জোরে শ্বাস টেনে বলল, “বুনো লতাপাতার গন্ধ আসছে দু’জনের শরীর থেকে। শহরে এমন সুবাস কোথাও পাবে না।”
আবার হেসে উঠলেন নোনতা দাদু।
মাস ফাল্গুন হলেও গরম তো কম নেই। মা দইয়ের শরবত আর সন্দেশ নিয়ে গুছিয়ে বসল। ছোটু বলে বাচ্চাটা দাদুর কোল ঘেঁষে সোফায় বসে চুকচুক করে শরবত খাচ্ছে। মা বলল, “দাদু, একে একটু স্নান করানো দরকার। আপনিও স্নান করুন। সেই ভোররাতে বেরিয়েছেন!”
“অস্থির না হয়ে শোনো আসল কথা। আমি তো কাল সকালেই চলে যাব। ছোটু তোমাদের এখানে থাকবে, কাবেরী। ওর মাকে ডাইনি সন্দেহে পুড়িয়ে মেরেছে গাঁয়ের লোক।”
“সে কি!” বাবাই আঁতকে উঠল। “এখন! এই সময়?”
“তেমন করে কিছু পালটায়নি, বাবু। পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গাঁয়ে অন্ধবিশ্বাস এখনও ভয়াবহ। সে যা হোক, আমি যতদিন না ওদিকটা সামলাতে পারছি, বাচ্চাটা এখানে থাকুক। পরে গণ্ডগোল থামলে আমি নিয়ে যাব আবার।”
বাবা দু’হাত নেড়ে বলে উঠল, “আরে ওসব নিয়ে ভাববেন না। ও থাকবে। ভালোই থাকবে।”
“সে বিশ্বাস না থাকলে বিনা খবর দিয়ে চলে আসি?” বলে তিনি ফিরলেন ছোটুর দিকে। “দেখেছিস? এ হল রাজাদাদা। এর সবকথা শুনবি।”
কালো মুখে সাদা দই, অবাক সরল চোখে তাকে দেখছে ছেলেটা। লজ্জা পেল রাজা। ওর তুলনায় বড্ড বেশি চকমকে জামাকাপড় পরে আছে সে। ট্রেন্ডি পোশাক পরতে ভালোবাসে ও। তেরো বছর বয়স। কিন্তু এখনই ক্রিকেট আর জিম করে। সে বেশ লম্বা। সুগঠিত। কোথাও গেলে লোকে তারিফের চোখে তাকায়। এটা বেশ লাগে রাজার। অথচ এই বাচ্চার অবাক চোখের সামনে নিজের ট্রেন্ডি পোশাক কেমন বাড়তি মনে হল হঠাৎ।
নোনতাদাদু বললেন, “রাজা, তুমি আমাকে আগে দেখনি। শহরে আসতে পারি না। এই ছোটুর বয়স ছয় বছর। ভুল-টুল করলে একটু বুঝিয়ে দিও।”
রাজা হকচকিয়ে উঠল। এত বড়ো সম্মান তাকে এর আগে কেউ দেয়নি। বোঝা গেল, নোনতাদাদু ভিতরে ভিতরে টেনশন করছেন।
দু’দিন হল ছোটু এসেছে। রাজার ঘরে ক্যাম্প খাট পেতে ওর শোবার জায়গা। রাজা কোনওদিন নিজের ঘর কারও সঙ্গে ভাগ করেনি। মজা লাগছিল। মা বলল, “রাজা, ছোটুকে সব শিখিয়ে দাও।”
রাজার নিজেকে বেশ বড়ো বড়ো মনে হল। সত্যি তো! শহরের বাথরুম ব্যবহার ছোটু জানবে কী করে? সবকথার উত্তরে ঝকঝকে দাঁত বার করে বলবে, হ। কেবল মেঝেতে বসতে চায়। ভাত মেখে টেবিলে দিলে হবে না। ও মেঝেতেই বসবে! তাই-ই করা হল। ভাত ছড়িয়ে একশা করছে দেখে মা টেবিলে বসিয়ে খাইয়ে দিল। আপনমনে বলল, “আহা রে, মা বোধহয় খাইয়ে দিত।”
বুকের মধ্যে মোচড় দিল রাজার। ওর মা নেই! ইস। মা ছাড়া দুনিয়া কেমন হয় রাজা জানতেই চায় না।
প্রথম চমক এল ক্রিকেট মাঠে। নামকরা এক ক্লাবে খেলে রাজা। রবিবারের সকাল। ছোটুকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। বাড়িতে একলা থেকে কী করবে? গাছের ছায়ায় আরাম করে বসে আছে রোগা কালো নিরীহ ছেলেটা। কেবল ও যখন তাকিয়ে থাকে, কেমন যেন লাগে। মনে হয়, ওর চোখে পলক পড়ছে না। রোগা পাদুটো ছড়িয়ে ঘাসের উপর উদাস বসে থাকে। টিমের ক্যাপ্টেন অর্ক বলল, “ও কি তোদের বাড়ি কাজ করে?”
রাজা ঘাড় নেড়ে ‘না’ বলল। মুখে কিছু বলল না। ডাইনি অপবাদে পুড়িয়ে মেরে ফেলা এক মায়ের ছেলে ছোটু, এটা বলতে পারে কখনও? অর্ক আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি। শুধু তাচ্ছিল্যের চোখে ওর দিকে তাকাল। মনের ভুল কি না কে জানে, রাজার মনে হল, ছেলেটার গোল গোল চোখে যেন আগুন জ্বলে উঠল।
খেলা শুরু হল। কোচ প্রদ্যুৎদা মনোযোগ সহকারে লক্ষ করছে সকলকে। মাসের শেষে টুর্নামেন্ট। অদ্ভুত ব্যাপার হল, অর্ক কিছুতেই রান নিতে পারছে না। দুটো ওভার শেষে বোল্ড আউট হয়ে গেল! এমনকি, বল করার সময়ও প্রচুর ভুল করল। এমন হবার কথা নয়। অর্ক খুব ভালো ক্রিকেট খেলে। প্রদ্যুৎদা কপালে ভাঁজ ফেলে অর্কের কাছে এগিয়ে এসে বলল, “ওভার কনফিডেন্ট হলে এমনই হয়। প্রতিনিয়ত শিখতে হয়। অন্যদিকে মন না দিয়ে প্র্যাকটিস বাড়িয়ে যাও।”
অর্কর কান লাল। রাজা চমকে লক্ষ করল, ছোটু হাসছে। কালো মুখে ঝকঝকে সাদা দাঁত বার করে হাসছে। জুলজুল চোখে অর্ককে দেখছে। চোখের পলক পড়ছে না।
ঘটনাটা রাজা কাউকে বলেনি। মাকেও না। একটু খটকা থাকল তার মনে।
শনি-রবি ছুটির দিন শেষ। বাবা-মার কাজ শুরু। রাজার স্কুল শুরু। সেজন্য অত চিন্তার কিছু নেই। পুরনো আমলের কাজের লোক আছে, সীমামাসি। সেই সামলাবে সব। বলা আছে।
বাবা-মা দু’জনে ব্যস্ত থাকে। সীমামাসি আছে। ছোটুকে ওই দেখে। খেতে দেয়, স্নান করতে সাহায্য করে। ছেলেটা বড্ড ছোটো। রাজা স্কুল থেকে বাড়ি ঢুকে পড়ে বিকেল চারটেতে। ঢুকতে-ঢুকতেই ছোটু ওর কোলে চেপে বসবে। কিন্তু কোনও কারণে সীমামাসি একটু গোমড়া মুখে থাকে। মা বিরক্ত। একটা বাচ্চাকে ঘণ্টা কয়েক দেখতে হয় বলে সে এমন করছে? যাক, রাজার গরমের ছুটি পড়ে যাবে খুব শিগগিরই।
বাবাই বলল, “সীমাদি মানুষ খারাপ নন। রাজাকে বড়ো করেছে। এখন বয়স হয়েছে। তাই বোধহয়…”
কারণ বোঝা গেল এক হপ্তার মাথায়। শুক্রবারের সন্ধ্যা। বেশ আরাম করে বসে টিভি দেখছে সবাই। শনি-রবি ছুটি। রাজার কোলে ছোটু। ছবির বই দেখিয়ে রাজা পড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। হাতি দেখালেও সে বলে, হ। বাঘ দেখালেও সে বলবে, হ। বাবাই হাসতে হাসতে বলে, “আর মোটে কিছুদিন। তারপর নিজের জায়গায় চলে যাবে। ওকে আর যন্ত্রণা দিস না। মজা করুক।”
মা বলল, “হ্যাঁ রে রাজা, বাচ্চাটা রাতে ঘুমোয়? কাঁদে না?”
রাজা চুপ করে থাকে। বলবে কি বলবে না, ভেবে পায় না। সে যখন বিছানায় যায়, ছোটুকে তার আগেই শুইয়ে দেওয়া হয়। আর রাজা? বিছানায় পড়তেই তলিয়ে যায়। কিন্তু… এমন গভীর ঘুম রাজার হয় না কখনও। চোখ যেন আঠার মতো লেগে থাকে। একবার বাথরুমে যায়। আধো ঘুম, আধো জাগা। কেন এরকম হচ্ছে? একটা কিছু হচ্ছে, যা স্বাভাবিক নয়।
মায়ের প্রশ্নের উত্তরে সে আড়চোখে ছোটুকে দেখে বলে, “না না, কাঁদে না। খুব ঘুমোয়।”
শুনে খিলখিল করে হেসে ওঠে ছেলেটা। রাজার দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে বলে, “গান গায় যে। গান শুইন্যে ঘুমায় পড়ি।”
বুধবার সন্ধ্যাবেলা সীমামাসি হাউমাউ করে চেঁচিয়ে নালিশ করে, “মা গো, বাড়িতে একটা ভূত আসে। রোজ দুপুরে। আমি আর থাকব না, মা।”
রাজা, বাবাই, মা সব সীমামাসিকে ঘিরে ধরল। “আরে! হল কী বলবে তো!”
আঁচল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে সীমামাসি বলল, “দুপুরে ছোটুকে ভাত-মাছ দিয়ে একটু এদিক ওদিক গেলেই খিল খিল হাসির আওয়াজ কানে আসে। দৌড়ে ঘরে এলে দেখি, কোথাও কিছু নেই। বাচ্চাটা ছাদের দিকে গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে। যত বলি, খাচ্ছিস না কেন! সে বলে, খাব। তুমি যাও।”
“তাতে কী হল, সীমাদি?” মা ধমকে বলেন, “বাচ্চারা অমন কত কথা বলে। আজ এক সপ্তাহের বেশি হল ছোটু এসেছে। কিছুই তো দেখি না আমরা।”
মা রীতিমতো রেগে গেছে। বাবাও বেশ বিরক্ত। রাজা শুধু কৌতূহলী। সে লক্ষ করছে, দরজার আড়ালে ছোটু দাঁড়িয়ে। চোখ স্থির। পলক পড়ছে না।
“না দিদিমণি, না। আমি কেন এই জন্য ভূতের গল্প শোনাব? কিন্তু কেমন যেন মনে হচ্ছে, আগের মতো নেই বাড়িটা। কে যেন এসেছে। বিশ্বাস করো। দুপুরে আমার খুব ভয় করে।”
“কেন, বলো কেন?”
“ঐ ছেলেটা ভালো না, দিদিমণি। মা ডাইন, ছেলে দানো।”
মা-বাবা গুরুত্ব দিল না। রাজার কেমন মনে হল, সীমামাসি সত্য বলছে। গত পরশু রাতে যে ঘটনা ঘটেছে, তারপরে তারও একটু কেমন কেমন লাগছে।
পরশু অর্থাৎ সোমবার একটু বেশি রাত পর্যন্ত অঙ্ক করছিল। ছোটু ঘুমিয়ে আছে। তাই টেবিল ল্যাম্প জ্বলছিল। ঘরের বাকি দিক অন্ধকার। হঠাৎ মনে হল ছোটুর বিছানার দিকে একটা আলোমতো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে কিছু নেই। মাথা নিচু করে অঙ্ক শেষ করায় মন দিল। এবার শোবে। এমন সময় সে ডাকল, “দাদা।”
তাকিয়ে দেখে বিছানার উপর উঠে বসেছে ছেলেটা। জুলজুল চোখদুটো স্থির। “দাদা। শ্যুইয়ে পড়ো।”
রাজার বলতে ইচ্ছে করল, ‘না। আমি এখন শোব না। দেরি আছে।’ বলতে পারল না। ছেলের শরীর অন্ধকারে জ্বলছে। গলা কঠিন। “মা বুলছে, শ্যুইয়া পড়।”
রাজা অবাক। তার শরীর বিদ্রোহ করছে, শুতে চাইছে না। কিন্তু চেতনা বলছে শুয়ে পড়তে। কেউ তার মন নিয়ন্ত্রণ করছে। সে বলতে চাইল, ‘এই, তুই কে?’ শব্দ করতে পারল না। সে বলতে চাইল, ‘আমি শুয়ে পড়লে তোর কী?’ পারল না। বোধহীন শরীর টলতে টলতে বিছানার দিকে গেল। টেবিল ল্যাম্প নিভে গেল আপনা-আপনি। ঘরভর্তি কেমন গন্ধ। অচেনা মিহি সুর। রাজা তলিয়ে গেল।
সীমামাসি কাজ ছেড়ে দিল। রাজার জন্মের আগের থেকে আছে সে। মা-বাবা কিছুতেই রাখতে পারল না তাকে। সে যেন কীসব দেখে। আবার না দেখলেও তার মনে হয়, কেউ আছে। ছোটুর সঙ্গে কথা বলছে। ভাত মেখে দিচ্ছে। এদিক ওদিক দৌড়ে যাচ্ছে বাচ্চা। সে দেখছে। পিছনে একটা বাতাস। কেউ নেই, আবার কেউ আছে। একদিন বাচ্চাটাকে বকুনি দিয়েছিল। সেদিন সারাদিন তার মাথায় কে যেন চাটি মেরেছে!
বাবাই হো হো করে হেসে উঠল। “উফ্, সীমাদি! তুমি পারো বটে। ডাইনির গল্প শুনে নিজের মাথায় এসব বানাচ্ছ।”
“না, দাদাবাবু। আমি বানাচ্ছি না গো। বাচ্চাটা চলে যাবার পরে আবার ডেকো। আসব। আমরা গাঁয়ের লোক। এসব বুঝি। ওর আমাকে সহ্য হচ্ছে না।”
সীমামাসি চলে যাবার পরে মা গভীর চিন্তায় পড়ে গেল। অফিস ছুটি নিতে হল। দুটো লোক রাখা হল। সকালের আর বিকেলের। মুশকিল হল, দুপুরে কে থাকবে? ছোটু যে একলা হয়ে যাবে! মা বলল, “দুয়েকদিন পরে রাজার গরমের ছুটি শুরু। তখন দুপুরবেলা রাজা থাকবে বাড়িতে। বিকেলে তো লোক চলেই আসবে।”
রাজা বলল, “চিন্তা কোরো না মা, আমি থাকব দুপুরে।”
মা বলল, “জানি না বাপু, এত মিষ্টি একটা বাচ্চা! তাকে নিয়ে থাকতে পারল না সীমাদি?”
বাবাই বলল, “আরে এরা তো গ্রামের লোক। তার উপরে সবসময়ের কাজের লোক। নোনতাদাদু তো ওর সামনেই ডাইনির গল্পটা বলছিলেন। ওটাই হয়তো ওর মাথায় কাজ করেছে।”
ছোটু রাজার ঘরে বসে ছিল। খেলনাপাতি নিয়ে খেলছিল। যেই বাবাইয়ের গলা কানে গেল, ওর গোল গোল চোখদুটো স্থির। যেন কিছু বলতে চায়। রাজা ওর কাছে গিয়ে বলল, “কী রে, কিছু বলবি?”
“মোর মা ডাইন না রে, দাদা। সীমাদিদি মার নামে খারাপ কুথা বলে। আমার ভালো লাগে না।”
রাজার কাছে ছোটু একলা আছে দুপুরে। মা দু’বার ফোন করেছে। রাজা অভয় দিয়ে বলল, “আমি বাংলা পড়ছি। ও মন দিয়ে খেলছে। তুমি চিন্তা করো না, মা।”
গরম পড়েছে বেশ। সকালের কাজের লোক রান্না করে, সব গুছিয়ে চলে গেছে বাড়ি। দুপুর হচ্ছে ধীরে ধীরে। রাস্তায় লোক চলাচল কমে এসেছে। রাজা বলল, “চল ছোটু, তোকে খেতে দিই।”
“চল দাদা, খিদা নেগেছে। মা বুলেছে, আজ তোর সাথ খেতে।”
রাজা ফিরে তাকাল ওর দিকে। দুপুর নীরব। বাড়ির কার্নিশে কাক ডাকছে তারস্বরে। ছেলেটাও ওর দিকে তাকিয়ে। ধীরে ধীরে বলছে, “মা বুলচে, তোরা ভালো লোক বটে। তুদের ভালো হব্যেক।”
সেদিন সন্ধ্যাবেলা বাবাই ফিরল খুব উত্তেজিত হয়ে। আজ নার্সিংহোমে একটা অ্যাক্সিডেন্ট কেস এসেছিল। মহিলাকে ধাক্কা দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে প্রাইভেট গাড়ি। মহিলা মারা যাবার আগে কাউন্সিলরের ছেলের নাম করে গেছে। বাবাই পুলিশ ডেকেছে। ঘটনা বলেছে। ব্যস! আর যায় কোথায়। ধমক দিয়ে ফোন আসছে ক্রমাগত। বাবাই ক্লান্ত শরীর সোফায় ছেড়ে দিতে দিতে বলল, “আর পারা যায় না। জোর যার মুল্লুক তার। জেনেশুনে এমন অন্যায় সহ্য করা যায়?”
বাড়িতে একটা থমথম পরিবেশ। মা ভয় পেয়ে গেছে। পরের দিন বাবাই নার্সিংহোমে গেল বটে, সেখানে পুলিশ পাহারা আছে, কিন্তু রাতে বাড়ি ফিরে মুখ গোমড়া করে রইল। ছোটু আবার এ ক’দিনে বাবাইয়ের খুব ন্যাওটা হয়ে পড়েছে। কেউ বাড়িতে খেলছে না। ওর গাল টিপে দিচ্ছে না। জামা-প্যান্ট গুঁজে পরিয়ে ছবি তুলছে না। ছেলেটা বুঝেছে, কিছু একটা হয়েছে। এমন সময় দরজায় দমাদম ধাক্কা।
“দরজা খুলুন। দেখি কত্ত বড়ো ডাক্তার!”
বাবায়ের চোয়াল শক্ত। মা পাগলের মতো মোবাইলে যোগাযোগ করছে পুলিশের সঙ্গে। এবার আরও জোরে দরজায় ঘা। বাবাই বলল, “খুলে দিই। দেখি কী বলে।”
“না!” আর্ত চিৎকার করে উঠল মা। “না। ওরা সব পারে। খুনে ডাকাত।”
বাবাইয়ের পাশ থেকে নিঃশব্দে উঠে দাড়িয়েছে ছোটু। বাবাইয়ের দিকে তাকিয়ে কঠিন চিকন গলায় বলে, “দরজা খুল।”
“মানে?” বাবাই হতবাক।
“খুল দরজা।”
“কী বলছিস পাগলের মতো? না। কেউ দরজা খুলবে না।”
মা থরথর কাঁপছে। ফর্সা রঙ নীল যেন। রাজার বুকের ভিতর পর্যন্ত শুকনো। বাবাইয়ের পাংশু মুখ।
“খুল!”
পালটে গেছে ছোটু। সোজা তাকিয়ে আছে দরজার দিকে। পলক পড়ছে না। জ্বলছে চোখদুটো। “যাও। খুল দরজা!”
বাইরের দমাদম শব্দ ছপিয়ে ঘর ভরে উঠল মিষ্টি গন্ধে। ছোটু সোজা তাকানো মায়ের দিকে। চোখের পলক পড়ছে না। ধীরে ধীরে চেতনায় ঢুকে পড়ছে মিষ্টি গন্ধ। ঘরের মধ্যে আরও কেউ আছে। হিলহিল করছে ঠাণ্ডা বাতাস। ওদের নিজেদের বোধ কাজ করছে না। পুতুলের মতো গিয়ে দরজা খুলে দিল বাবাই। সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল চার-পাঁচজন গুণ্ডা। কিন্তু পারল না। ঘরের ভিতরকার মিষ্টি গন্ধ এবার দরজার দিকে এগিয়ে গেল। লোকগুলো একটুও শব্দ করছে না। কেবল ছটফট করছে। যেন প্যাঁচের পর প্যাঁচ দিয়ে জড়িয়ে ধরছে ময়াল সাপ। শ্বাস বন্ধ হচ্ছে তাদের। ঠেলে বেরিয়ে আসছে চোখ। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল সবাই।
নোনতাদাদু গম্ভীর মুখে বললেন, “ছেলের সামনে মাকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হল। আত্মা শান্তি পায়নি। ঐ ছেলের সঙ্গে আছে। এমন হয়। সব ব্যাখ্যা তো বিজ্ঞান করতে পারে না।”
সকালের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। আর একটু পরেই চলে যাবে ওরা। এখন নিশিন্তে বসে কুটকুট করে বিস্কিট খাচ্ছে। রাজা ডাকল, “ছোটু!”
ডাক শুনে ফিরে তাকাল ছেলেটা। সকালের আলোর মতো নিষ্পাপ চাউনি। রাজাকে দেখে মিষ্টি করে হেসে বলল, “দাদা, যাই রে।”
রাজা কান দিল না। সে মন দিয়ে দেখতে লাগল ছোটুর চোখ। পলক? পড়ছে কি?
অলঙ্করণঃ স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়
জয়ঢাকের গল্প ও উপন্যাস