মহুয়া মল্লিকের আগের গল্পঃ মায়া রয়ে যায়, আরশিনগরের মেয়ে
সঙ্গে, কিন্তু নানারকম অসুবিধা হচ্ছিল, তাই বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়া মাত্র যোগাযোগ করেছিল। ভাগ্য ভালো একজন ইন্ডিয়ান কাপল অ্যাপার্টমেন্টটা ছাড়ব ছাড়ব করছিল, প্রজেক্ট শেষ হয়ে যাওয়ায় নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই দেশে ফিরতে হবে তাদের তাই লিজ ব্রেক হওয়ার ক্ষতিপূরণ এড়াতে নিজেরাই ভাড়াটে খুঁজতে উঠে পড়ে লেগেছিল। ঝিলমিলকে দেখে ওদেরও বেশ পছন্দ হয়েছিল, আর ঝিলমিলের খোলামেলা অ্যাপার্টমেন্টটা। ওয়ান বিএইচকে হলেও বেশ হাত পা ছড়িয়ে থাকা যাবে। কার্পেট যদিও বেশ পুরনো, ঝিলমিল ঠিক করে নিয়েছিল, নিজের গ্যাঁটের পয়সা খরচ করেই কার্পেট পরিষ্কার করিয়ে নেবে। কারণ তার টিভি দেখা, বই পড়া বা ল্যাপটপ নিয়ে কাজ সবই তো পা ছড়িয়ে মেঝেতে বসে। তার এই অভ্যাস নিয়ে ছোটবেলায় ঠাকুমা যে কত বকুনি দিয়েছে।
বাড়ির কথা মনে পড়ায় ঝিলমিল একটু উদাস হয়ে গিয়েছিল। এসব ভাবতে ভাবতে অ্যাপার্টমেন্টের একদম কাছে পৌঁছে গিয়েছিল সে। মাথাটা হঠাৎ ভারভার লাগে, নিজেকে সামলে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করে। আর তারপরেই বিপত্তি। সিঁড়ির একদম মাথায় কালো বিড়ালটা বসে ছিল, প্রথমেই ওর চোখ দুটো চোখে পড়েছিল, ধিকিধিকি আগুনের মত জ্বলছে।
ঝিলমিল ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। বিড়ালটাকে তাড়াতেই সে এক ঝাঁপ দিয়ে তার কাঁধ ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল। ক্ষিপ্রগতিতে বিড়ালটাকে সরে যেতে দেখে একটু অবাকই হয়েছিল ঝিলমিল, কারণ এখানে অনেকেই বিড়াল পোষে, সেইরকমই কারো পোষা হবে! সুযোগ পেলেই এরা বাইরে ঘুরে বেড়ায়। তবে, পোষা বিড়াল তো পায়ে পায়ে ঘোরে! এভাবে তো পালায় না।
কিন্তু ঝিলমিল বেশি ভাবার সময় পায়নি, তার কাঁধের কাছটা জ্বালা জ্বালা করে উঠছিল। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে এসে উজ্জ্বল আলোর নিচে দাঁড়াতেই চোখে পড়েছিল, সাদা টপের হাতায় সূক্ষ্ম রক্তের দাগ। তারমানে বিড়ালটা আঁচড়ে দিয়ে গেছে। সামান্য একটু ফার্স্ট এইড করে বিছানায় শরীরটা ছেড়ে দেয়। শরীরটা এত খারাপ লাগছিল যে জামাকাপড় পাল্টানোরও ইচ্ছে হল না।
***
খুব সকালবেলায় লোকজনের চিৎকারে ঘুমটা ভেঙে গেল। উইক-এন্ডে এত সকালে ওঠার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না ঝিলমিলের। বিরক্ত মুখে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল সে, আর তখনই চোখে পড়ল গতরাতের সেই কালো বিড়ালটা মরে পড়ে আছে। মাথাটা কেউ ধড় থেকে খুবলে নিয়েছে। নৃশংস দৃশ্য। ঝিলমিল দৌড়ে ওয়াশ রূমে ঢুকে হড়হড় করে বমি করে ফেলল।
এই ঘটনার ঠিক দুদিন পরে আবার ঝলমলে একটা দিন। উইক এন্ড কাটিয়ে ঝিলমিল অন্যদের মতই বেশ ফ্রেশ মুড নিয়ে অফিসে গেল। এদেশে নিয়ম অনুযায়ী উইকডেজ-এ সে মুখ গুঁজে কাজ করে আর ছুটির দিনটা নিজের মত কাটায়। এবারই তার ব্যতিক্রম হয়েছিল শুধু। হাল্কা জ্বর আর মন খারাপ নিয়ে উইক এন্ডটা কাটানোর পর আজ অবশ্য সে বিন্দাস মুডে কাজ সেরে ফিরে এল, তারপর পোশাক পাল্টে জিমে চলে গেল। আজ একটু বেশি ওয়ার্ক আউট করার প্ল্যান।
ট্রেডমিলের উপর ছুটতে ছুটতে কাচের দেওয়াল দিয়ে দেখে সুইমিং পুলে তেমন লোকজন নেই, তার মানে বেশ রাত হয়ে গেছে। এমন ফাঁকা পুল দেখে ঝিলমিল বরাবরই লোভ সামলাতে পারে না, আজও তার ব্যতিক্রম হল না। তাড়াতাড়ি জিম থেকে বেরিয়ে পুলে নেমে পড়ল সে। ভাগ্যিস সুইম স্যুটটা লকারে রাখা ছিল।
মনের সুখে জল তোলপাড় করতে করতে হঠাৎ ঝিলমিলের কেমন যেন মনে হল, সে ডুবে যাচ্ছে! এইটুকু জলে কেউ ডোবে না, কিন্তু কে যেন তার মাথাটা ধরে নিচের দিকে টানছে, আর কাছেই কোথাও একটা বিড়াল একটানা কেঁদে যাচ্ছে। ঝিলমিল প্রাণপণে হাত পা নেড়ে জল ঠেলে উপরে উঠতে চাইল, কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই যেন কেউ ওর হাত পা চেপে ধরেছে। ওরা ঠিক কতজন? একজনের পক্ষে কি এভাবে দুটো হাত, দুটো পা এবং মাথা চেপে ধরা সম্ভব? ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে আসছিল ঝিলমিল।
(দুই)
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঝিলমিল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে দেখছিল। কদিন আগেই তার সঙ্গে এত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল, যদিও আসল কথাটা কেউ বিশ্বাসই করতে চাইবে না। জিমের ট্রেনার পুল-এ তাকে ডুবে যেতে দেখে ছুটে এসে শেষ মুহূর্তে বাঁচিয়েছিলেন। ডাক্তার ডাকা হয়েছিল। ডাক্তার বলেছিলেন, সে ভীষণ দুর্বল ছিল, কয়েক সেকেন্ডের ব্ল্যাক আউটে এমনটা হয়েছিল, এ নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই। রেস্ট আর হেলদি ডায়েট দরকার।
আয়নায় নিজেকে ভালো করে দেখে আবার ঝিলমিল, এই তো তার ফর্সা গলায় আঙুলের ছাপ, কেউ যে গলা টিপে ধরেছিল তার স্পষ্ট প্রমাণ। অথচ ওরা কেউ…
গলায় একটা বাহারী স্কার্ফ ঝুলিয়ে সে অফিস বেরিয়ে যায়। হেলদি ডায়েটের মধ্যে থাকলেও পর্যাপ্ত রেস্ট নেওয়া সম্ভব না। এক আধদিন ওয়ার্ক ফ্রম হোম করলেও টানা সেটাও করা যায় না।
ড্রাইভ করতে করতে অপরূপ প্রকৃতিকে দেখছিল ঝিলমিল। ম্যাপল-এর পাতায় পাতায় কমলা রঙের বৈভব, রঙের এমন বিস্ফোরণ, এমন উৎসব চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ঠিক সেইসময়ই জিয়ার ফোন এল, “কেমন আছিস ঝিল? অনেকদিন দেখা হয় না। আজ বসবি কোথাও? সুহানাকেও বলেছি।”
জিয়ার ফোন এলেই মন ভালো হয়ে যায়। তারা দুজন নার্সারি ক্লাশ থেকে বন্ধু। আঙ্কল ট্রান্সফার নিয়ে চলে যাবার সময় নাকি দুজনে খুব কেঁদেছিল, সে-সব তাদের মনেও নেই। এখানে এসে আবার অদ্ভুতভাবে যোগাযোগ হয়ে গেছে। জিয়ার সঙ্গে ওয়েভ লেংথেও মেলে ভালো। সে অনেকটাই তার মত। এখানকার ইউনিভার্সিটিতে পোস্ট ডক্টরেট করছে। সুহানা ওর বন্ধু। দুজনের সেম সাবজেক্ট। ওদের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটালে মন ভালো হতে বাধ্য।
ঝিলমিলকে চুপ থাকতে দেখে জিয়া তাড়া দিল, “কীরে বিজি থাকবি? তাহলে অন্যদিন। আসলে এখানে তো উইক এন্ড ছাড়া কেউ বসে না; এটা মাথায় রাখা উচিৎ ছিল আমার।”
“কী যে বলিস জিয়া! আমরা কি আমেরিকান নাকি? সেটা নয়, আসলে…” ঝিলমিল আমতা আমতা করে। বন্ধুকে বলতে পারে না, রাত করে বাড়ি ফেরার কথা আর সে চিন্তাই করতে পারে না। যদিও এই চার দেওয়ালেও সে খুব যে সুরক্ষিত তাও না, রোজ রাত্রে ঘুমের মধ্যে মনে হয় কে যেন মুখের উপর ঝুঁকে তাকে দেখছে, চোখ খুললেই মনে হয় পর্দার আড়ালে কে যেন মিলিয়ে গেল। বা বন্ধ কল দিয়ে জল বেরিয়ে যাবার আওয়াজ, দৌড়ে কল বন্ধ করতে গিয়ে দেখে, কোথায় কি!
“আসলে কী? আমাকেও বলতে আপত্তি?”
“বাইরে কোথাও যেতে ইচ্ছা করছেনা রে, আমার এখানে যদি বসিস?”
“এই কথা? বেশ আমরা পৌঁছে যাব, তুই ফিরবি কখন সেটা জানা।”
“এই ধর এইট পিএম।”
“ও ক্কে, সফট ড্রিঙ্কস আর চিপস ছাড়া আর কিছু ব্যবস্থা করিস না, আমরা নিয়ে যাব সব।”
ঝিলমিলকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোনটা কেটে দিল জিয়া।
(তিন)
একটানে ঝিলমিলের গলা থেকে স্কার্ফটা খুলে দিল সুহানা। জিয়াই প্রথম লক্ষ করে ড্রেস চেঞ্জ করে আসার পরও স্কার্ফটা খোলেনি সে। জিয়া দু’একবার বলতেই এড়িয়ে গেছে, সবার হাতে হাতে জুসের গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে কিচেনে ঢুকে গেছে।
সুহানা স্কার্ফটা খুলতেই সেটা আঁকড়ে ধরে ঝিলমিল। কাতর গলায় বলে, “প্লিজ।”
ব্যাপারটা জিয়ার চোখেও আশ্চর্য লাগে, সামান্য একটা স্কার্ফ নিয়ে এমন করছে কেন মেয়েটা? এত ন্যাকা টাইপ তো গত এক বছরের মেলামেশায় একটুও মনে হয়নি ওকে! তাহলে?
জুসের গ্লাসটা রেখে উঠে আসে জিয়া। ঝিলমিলের পিঠে হাত রেখে নরম গলায় জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে রে? এমন করছিস কেন?”
ওর গলায় এমন কিছু ছিল, ঝিলমিল ঘুরে দাঁড়ায় তারপর ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে, সুইমিংপুলের ঘটনাটা বলে, তারপর বলে, “কেউ আমায় মেরে ফেলতে চাইছে, এই দেখ আমার গলায় এখনো দশ আঙুলের দাগ, আর এটা ঢাকতেই…”
সুহানাও উঠে এসেছে ততক্ষণে, ওরা দুজনেই ঝিলমিলের গলার দিকে তাকায়, উজ্জ্বল আলোর নিচে ভালো করে দেখে, কোনও দাগ চোখে পড়ে না ওদের। সে-কথা বলতেই ঝিলমিল পাগলের মত আয়নার সামনে দৌড়ায়, তারপর ওদের ডাকে, “এই তো দাগ, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমি, আর তোরা মিথ্যা বলছিস!”
জিয়া আর সুহানা লক্ষ করে কথাগুলো বলতে বলতে চোখ লাল হয়ে উঠছে ঝিলমিলের, সারা শরীর কাঁপছে আর মুখ দিয়ে থুতু ছেটাচ্ছে। ওরা পরস্পরের দিকে তাকায় কয়েক মুহূর্ত, ওদের মধ্যে একটা গোপন বোঝাপড়া হয়ে যায়।
জিয়া আরেকটু কাছে যায়, “হ্যাঁ এই তো দাগ, এতক্ষণ চোখেই পড়েনি।” দেখাদেখি সুহানাও একই কথা বলে। ঝিলমিল এবার একটু শান্ত হয়। নিজেকে সামলে নেয়। স্কার্ফটা আবার গলায় জড়াতে গেলে জিয়া বাধা দেয়, “আমরাই তো আছি, ছাড় না, চল এবার ডিনার করে নিই।” ঝিলমিল মুখেচোখে জল ছিটিয়ে ওদের সঙ্গে খাবার গরম করে প্লেট সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
খাওয়াদাওয়ার শেষে সুহানাকে ফিরে যেতে বলে জিয়া। ঝিলমিলের কাছে রাতে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করতেই দেখে ঝিলমিলের চোখে কৃতজ্ঞতার ছায়া। মেয়েটা বেশ কয়েক রাত্রি ভালো করে ঘুমায়নি। চোখের নিচে কালি দেখে প্রথমে ভেবেছিল কাজের চাপে এই অবস্থা, কিন্তু ব্যাপারটা আদৌ তা নয়। আজ অন্তত ভালো করে ঘুমোক তবে। তার আগে জিয়া অনেক গল্প করবে। গল্প করতে করতেই খুঁজে বার করবে আসল কথাটা। সুহানা এক ফাঁকে তাকে জানিয়েছে, “ব্যাপারটা তার ভালো লাগছে না, কোথাও একটা গোলমাল আছে, ঝিলমিল তো এমন প্যানিক করার মেয়ে নয়। তুই সবটা জানার চেষ্টা কর, তারপর আমার এক বান্ধবীকে এই বাড়িতে আনব। সম্ভবত বাড়ির কোনও দোষ।”
ঝিলমিল এই ক’দিনের সমস্ত ঘটনা এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলল জিয়াকে। শুনতে শুনতে জিয়ার শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছিল তবু সে ঝিলমিলের কথা শেষ হলে জিজ্ঞেস করে, “জল খাবি?”
বলল বটে, তবে জলের বোতলটা অনেক আগেই খালি করে ফেলেছে সে নিজেই। জল আনতে কিচেন অবধি যেতে হবে ভেবেই হাত পা আরও যেন ঠান্ডা হয়ে আসছে। ঝিলমিলকে এক ঝলক দেখে উঠে পড়ল বিছানা থেকে। শোবার ঘর পেরিয়ে, লম্বা একটা প্যাসেজ ধরে কিছুটা এগিয়ে গেলে তবে কিচেন।
বাইরে বের হয়েই জিয়া দেখল একটা জমাট অন্ধকার যেন নড়েচড়ে দেওয়ালের সঙ্গে মিশে গেল। তবু সে সাহসে ভর করে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেল। বাইরের আলোয় ঘরটা আবছা আলোছায়ায় ভরে আছে, ফলে আরও রহস্যময় লাগছে।
কিচেনের দরজার সামনে গিয়ে থমকে গেল জিয়া। একটু আগেও এখানে কেউ ছিল। মিষ্টি একটা পারফিউমের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে কিচেন জুড়ে, এই গন্ধটা তারা কেউ আজ কেন কোনদিন ব্যবহার করেনি। কেউ ছিল, জিয়ার পায়ের শব্দ পেয়েই দেওয়াল বরাবর যেন উড়ে গেল, ধাক্কা লেগে চূরমার হয়ে যাবে এই ভয়ে কয়েক সেকেন্ড জিয়া চোখ বন্ধ করেছিল। চোখ খুলেই দেখে কেউ কোথাও নেই।
লাইট অন করতেই উজ্বল আলোয় ভরে যায় কিচেন। জানলা বা গারবেজ রাখার সরু প্যাসেজের দিকের দরজাটা বন্ধ। যে ছিল সে কি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল? অদ্ভূত তো!
জল নিয়ে ফিরে এল জিয়া। ঝিলমিল দু’হাঁটুর মাঝে মুখ গুঁজে বসে ছিল। ওকে জল খাইয়ে শুইয়ে দিল। ওর পাশে শুয়ে জিয়া আবার কথা শুরু করল। ঝিলমিলও জিয়ার সঙ্গে সহমত, অ্যাপার্টমেন্টের কোনও দোষ নেই। জিয়া নিজেও এখানে রাত কাটিয়ে গেছে, সুহানাও। আর ঝিলমিল তো প্রথম থেকেই একাই থাকে। কিন্তু হঠাৎ একটা গণ্ডগোল শুরু হল, সেই যেদিন রাত্রে বাড়ি ফেরার সময় বিড়ালটার সঙ্গে টক্কর হল, তারপর থেকেই সব বদলে গেল। কে বা কারা যেন রাত হলেই ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। সব সময় যেন ঝিলমিলকে লক্ষ রাখছে।
জিয়া চুপ করে শোনে, ঝিলমিলের একটা বাক্যও তো মিথ্যা নয়, সে নিজেই টের পাচ্ছে কে যেন আশপাশেই আছে। ঘাড় ঘোরালেই যেন তাকে দেখতে পাবে।
(চার )
মারিয়া ঘরে ঢুকেই নাক টানতে শুরু করল, তারপর কাঁধের ঝোলা ব্যাগটা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত ছোটাছুটি করল কিছু সময়। একসময় ক্লান্ত হয়ে একটা চেয়ারে বসে কারুকে ফোন করল। ঝিলমিল, মারিয়ার রকমসকম দেখে খাঁটি বাংলায় বলে ফেলল, “এ কাকে ধরে আনলি? এ তো আস্ত পাগল!” সুহানা ইশারায় চুপ করতে বলে ওকে, তারপর বলে মারিয়া কিন্তু ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটা “প্যারা নর্মাল এক্টিভিটি” সল্ভ্ করে ফেলেছে।
একটু পরেই ফোন রেখে তার ঝোলা ব্যাগ থেকে একটা মাঝারি মাপের কাচের বাটি বার করে টেবিলের উপর রাখল মারিয়া। নিজেই কিচেন থেকে জল এনে বাটিটা ভর্তি করে, তারপর ব্যাগ থেকে একটা ছোট কৌটো বার করল। বেশ সুন্দর দেখতে কৌটোটা। সেখান থেকে সাদা গুঁড়ো গুঁড়ো কিছুটা পদার্থ জলের মধ্যে ফেলে অপলক তাকিয়ে রইল সে জলভরা পাত্রের দিকে। সাদা গুঁড়োটা সম্পূর্ণ মিশে গেলে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করতে করতেই একসময় ধীরে ধীরে চোখ খোলে মারিয়া। জলভরা পাত্রের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে একটা রহস্যময় হাসি।
ওদের তিনজনের দিকে একঝলক ঘুরে দেখে নিল মারিয়া। তারপর ঝিলমিলকে নির্দেশ দিল সেদিন যেভাবে সেজে গিয়েছিল ঠিক সেভাবে সেজে যেন আবার আসে, সেদিনের রূমাল, ব্যাগ, এমনকি লিপস্টিকের রঙ পর্যন্ত যেন এক থাকে।
এই অদ্ভুত কার্যকারণের মানে খুঁজে পাচ্ছিল না ঝিলমিল। এসবে তার বিশ্বাস নেই। তবু দুই বন্ধুকে আঘাত দিতে না চেয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। কিছুক্ষণ পরেই সেদিনের মত সেজে বের হয়ে এল সে। ব্লু ডেনিম, সাদা টপ, লেদারের বেল্ট,বড় বড় ইয়ার রিং, পার্পল লিপস্টিক, ডার্ক ব্রাউন হ্যান্ড ব্যাগ – সব এক। তবু তাকে দেখে মারিয়ার কোঁচকানো ভ্রু সোজা হয় না, জলভরা পাত্রের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে ধমক লাগায় ঝিলমিলকে।
“পুওর গার্ল, যদি বাঁচতে চাও মনে কর, আর কী ছিল সেদিন তোমার শরীরে?”
ঝিলমিল একটু কেঁপে ওঠে, তারপর আবার ঘরের দিকে দৌড় লাগায়। একটু পরেই মারিয়ার সামনে এসে দাঁড়ায় যখন, সবাই দেখে তার গলায় দুলছে অপূর্ব সুন্দর নানার রঙের পুঁতির একটা হার, তার ঠিক মাঝখানে বড়সড় একটা লকেট, তিব্বতে এধরনের লকেট দেখতে পাওয়া যায়। সম্ভবত তিব্বত বেড়াতে গিয়ে কেউ এনে দিয়েছে ঝিলমিলকে।
লকেটটার রক্ত লাল রঙের দিকে চোখ আটকে যায় জিয়া আর সুহানার। এদিকে পাত্রের জলে প্রবল আলোড়ন দেখা যায়, কী করে এটা সম্ভব? এই প্রথম ওরা দেখে মারিয়ার ভ্রু জোড়া স্বাভাবিক আর মুখে চোখে প্রসন্ন ভাব ফুটে উঠেছে। ইশারায় তার সামনের চেয়ারে ঝিলমিলকে বসতে বলে। ঝিলমিল আলোড়িত জলের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে চেয়ারটা টেনে বসে পড়ে বাধ্য মেয়ের মত।
“কোথায় পেয়েছ এই লকেটটা?”
মারিয়ার প্রশ্নের সামনে চোখ বন্ধ করে ভাবার চেষ্টা করে ঝিলমিল। নাহ্, তার তো মনেই পড়ছে না, কোথায় পেয়েছে এটা! তবে সেদিন আয়নার সামনে সাজতে সাজতে মনে হচ্ছিল গলাটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, জুয়েলারি বক্স খুলে সোনার চেনটা বার করার জন্য ড্রয়ারটা টানতেই একটা কাগজের মোড়ক চোখে পড়ে, কৌতূহলী হয়ে সেটা খুলতেই হারটা বেরিয়ে আসে। তার বান্ধবী তিস্তার গলায় এই রকম একটা হার দেখে মুগ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল কোথায় পেয়েছে জিনিসটা? তখনই জেনেছিল এটা তিব্বতী লকেট। সেইরকমই একটা জিনিস যে তার কাছেও আছে এটা সে জানতই না। তাই বেশি না ভেবে ওটা পরে নিয়েছিল।
জিয়া বলার চেষ্টা করে, “এখানে তো আগে এক ইন্ডিয়ান কাপল থাকত, তারা ফেলে গেছে কি?”
মারিয়া এতক্ষণ চুপ কএর সব শুনছিল। জিয়াকে থামিয়ে দিয়ে বলে, “তারা এ জিনিস কেন ফেলে যাবে? তাদের সঙ্গে কি ঝিলমিলের পূর্ব পরিচয় ছিল? চেনাজানা কেউ ক্ষতি করার জন্য এটা রেখেছে, এটা মারাত্মক জিনিস।”
“চেনাজানা কেউ?”
নিজের অজান্তেই ওরা তিন বান্ধবী তিনজনকে একবার আলতো চোখে দেখে নেয়। ঝিলমিলের মেলামেশা সবই বাইরে, এখানে জিয়া-সুহানা ছাড়া কেউ তো আসেই না। নাহ্! ক্রমশ ব্যাপারটা জটিল হয়ে যাচ্ছে। ঝিলমিল, মারিয়ার সম্মতি নিয়ে কফি বানাতে উঠে যায়। ওকে হেল্প করতে যায় সুহানা।
চারজনে বসে কফি খাচ্ছিল। তিব্বতী লকেটটা একটা প্যাকেটে মুড়ে নিজের ঝোলা ব্যাগে ভরে নিয়েছে মারিয়া। ঝিলমিলের একটু মনখারাপ যে হয়নি তা না, জিয়া ওকে কথা দিয়েছে ওর থেকেও ভালো একটা লকেট তাকে গিফট করবে। ঠিক এইসময় ঝিলমিলের মায়ের ফোন আসে। টুকটাক কথা বলার পর তিনি সরাসরি চলে যান তিব্বতী লকেট বসানো হারটার প্রসঙ্গে।
“তোর নতুন ডিপিতে দেখলাম হারটা। লকেটটা কী সুন্দর না! যেন রক্ত প্রবাল জ্বলজ্বল করছে। ওসব তোর বয়সেই মানায়, আমাকে এসব জিনিস যে কেন দেওয়া বুঝি না।”
ঝিলমিল সজাগ হয়। মা জানে এই লকেটের কথা? তার মানে এটা মায়ের জিনিস? হ্যাঁ তার মা তো খুব সুন্দর সুন্দর জাঙ্ক জুয়েলারিতে সাজে! মায়ের দারুণ কালেকশান। ইসস সে কী বোকা, একবারও ভাবেনি মা তার জুয়েলারি বক্সে ওটা ঢুকিয়ে দিয়েছিল। শিফটিং এর সময় এদিক ওদিক হয়ে বেরিয়ে এসেছে।”
মা’কে থামিয়ে দিয়ে ঝিলমিল জিজ্ঞেস করে, “ ওটা কে দিয়েছিল তোমায় মা ?”
“কেন? তোর দেবযানী আন্টি দিল তো! মনে নেই গতবার তো ওরা তিব্বত ঘুরে এল, তারপরই সুনয়নার ছেলের বিয়েতে, আমায় দেখেই বলল চটপট এটা তোর ব্যাগে ঢুকিয়ে নে। আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করারও সুযোগ দেয়নি। আমিও ভুলে গিয়েছিলাম, এবার তুই যখন এলি, খুঁজে পেতেই ভাবলাম…”
মা বড্ড কথা বলে। মাকে থামিয়ে দিয়ে মামুলি দু’একটা কথা বলে ফোন রেখে দিল ঝিলমিল। তারপর সবটা বন্ধুদের শেয়ার করল। মা আর দেবযানী আন্টির গানের প্রোগ্রামের কথা, দুজনের ঠান্ডা লড়াই এর কথা। দেবযানী আন্টি গানটা ছাড়েননি, যত্ন করে চর্চা করে গেছেন বছরের পর বছর ধরে, বিপুল সুনাম অর্জন করেছেন। মা জয়েন্ট ফ্যামিলি, সংসার, সন্তানের চাপে সব ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু বছর কয়েক একটু অবসর মেলায় আবার ফিরেছে। মায়ের গলা ঈশ্বর দত্ত। অল্প সময়েই প্রচুর জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সোশাল মিডিয়ার দৌলতে চেনা বন্ধুরা সব সময় মাকেই বেশি ফেভার করে। দেবযানী আন্টি এটা নিতে পারে না।
“আর তাই ঈর্ষার আগুনে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে চেয়েছিল প্রধান কমপিটিটরকে। এ ছিল মন্ত্রপুত লকেট। এই লকেট যেই ধারণ করত তারই ক্ষতি হত, শেষে মৃত্যু।” মারিয়ার কথা শুনে শিউরে ওঠে ওরা তিনজন। মারিয়া, ঝিলমিলের কাঁধে হাত রাখে। আশ্বাস দেয় আর কিছু হবে না।
সুহানা বলে, যে এত বড় ক্ষতি করতে চাইল, তার কিছু হবে না? একটা কঠিন শাস্তি কী দেওয়া যায় না ঐ আন্টিকে?
মারিয়া হাসে, ক্ষমা সুন্দর সে হাসি। “তুমি, আমি কে শাস্তি দেবার? বুকে ক্রশ আঁকতে আঁকতে বলে, প্রত্যেকেই তার কর্মের ফল ভোগ করে এই পৃথিবীতেই।”
ঠিক সাতদিন পরে। বন্ধুদের অনুরোধে “হাউস ওয়ার্মিং” পার্টি চলছে ঝিলমিলের ঘরে। হাল্কা মিউজিকের সঙ্গে ঝিলমিল নাচছে, ওর চোখমুখ ঝলমল করছে। জিয়া আর সুহানা সেই আগের ঝিলমিলকে ফিরে পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়।
গ্রাফিক্স্ঃ ইন্দ্রশেখর
জয়ঢাকের গল্প ও উপন্যাস
খুব সুন্দর গল্প। ছায়া ছায়া ভাব গোটা গল্পে
LikeLike
কি সুন্দর গল্প
LikeLike