সমস্ত জাতক কথা একত্রে
তিলমুষ্টি-জাতক
নন্দিনী চট্টোপাধ্যায় (দাস)
গোঁফে তা দিয়ে রাজামশাই ভাবলেন,”এতদিনে তবে পাখি নিজে থেকেই খাঁচায় ঢুকল!” ভাবতেই পিঠের মাঝখানটা কেমন শিরশির করে উঠল!
সে কি আজকের কথা! সেই কতদিন আগে, আজকের পোক্ত রাজা তখন কিশোর রাজপুত্র। রাজপ্রাসাদে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হতেই বাবা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন পাশের রাজ্যের এক গুরুমশায়ের কাছে। বাবা ভেবেছিলেন, নিজের রাজ্যের কোনো অধ্যাপকের শিষ্য হলে বিদ্যা হয়ত আয়ত্ত করবে, কিন্তু প্রকৃত মানুষ হবে না, রাজপুত্রের গরিমা সেখানে প্রতি পদে বাধা দেবে।
যাই হোক , রাজপুত্র গুরুদক্ষিণা নিয়ে হাজির হল সেই গুরুগৃহে। তখনকার নিয়ম অনুযায়ী আর পাঁচজন সাধারণ ছাত্রের মতো গুরুগৃহে তার শিক্ষা শুরু হল। এখানে সে রাজপুত্র নয়, গুরুর শিষ্য এই-মাত্র তার পরিচয়। ছাত্রাবাসে অন্য ছাত্রদের সঙ্গেই তার থাকার ব্যবস্থা।পাথরের মেঝের উপর সার দেওয়া বিছানার একটা তার। আর পাঁচজন ছাত্রের সঙ্গে তার কোনো পার্থক্য রাখেননি গুরুদেব। না পোশাক-আশাকে, না অন্যান্য উপকরণে। রাজামশাইও এটাই চেয়েছিলেন।
মাঝে মাঝে তার ভিতরের রাজপুত্রটা বেরিয়ে আসতে চায়, কিন্তু পাত্তা পায় না। বাবার আদেশ, কাজেই কয়েকটা বছর তাকে এভাবে মাটি কামড়ে কষ্ট করে পড়ে থাকতে হবে। সে রাজপুত্র। সে কেন অন্যের অনুগ্রহভাজন হবে?
অন্য শিষ্যদের মতো সে-ও কষ্টসহিষ্ণু, আত্মনির্ভরশীল হতে শেখে ধীরে ধীরে। একদিন রাজপুত্র নদীতে স্নান করতে গেল। গুরুগৃহ থেকে নদীতে যেতে মাঝখানে একটা ছোটো জনপদ। সেখানে একটা ছোট্টো কুঁড়ের সামনে রোদে সাদা তিল শুকোতে দিয়ে এক বুড়িমানুষ পাহারা দিচ্ছিল। কুমার যেতে যেতে একমুঠো তিল তুলে নিয়ে মুখে ফেলল। দিব্যি খেতে তিলগুলো! বুড়ি দেখল, কিন্তু কিছু বলল না। ‘ক’টা তিল বই তো নয় , হয়তো বাছার খিদে পেয়েছে।’ ভেবে একটু মমতাই হল।
পরের দিনও একই ব্যাপার। সেদিনও বুড়ি কিছু বলল না। কিন্তু রোজই যখন রাজপুত্র এই ঘটনা ঘটাতে লাগল, তখন বুড়ি খুব রেগে গেল। শেষ পর্যন্ত একদিন বুড়ি কুমারকে ডেকে বলল, ” এই যে বাছা, তুমি তোমার গুরুর কাছে কি চুরিবিদ্যা শিখতে এসেছ?”
পাড়ার লোকও ছুটে এল, “ছি ছি , এত বড়ো আচার্যের শিষ্য কিনা চোর!”
আচার্যের কানে একথা পৌঁছনোমাত্র তিনি ছুটে এলেন অকুস্থলে। কুমার তখন রাগে অগ্নিশর্মা। গুরুকে সামনে পেয়েই সে ফুঁসে উঠল, “সামান্য একমুঠি তিল খেয়েছি বলে আমাকে চোর বলা! এরা জানেনা আমি কে! গুরুদেব, আপনি এদের বোঝান সে কথা।”
গুরুদেব একবার তাকালেন কুমারের দিকে। তারপর বৃদ্ধাকে হাতজোড় করে বললেন, “আমি ওর হয়ে ক্ষমা চাইছি আপনার কাছে। আপনার তিলের দাম আমি দিয়ে দেব। তবে তার আগে ওকে উচিৎ শিক্ষা দিচ্ছি, যাতে কোনোদিন এই ধরণের অন্যায় ও না করে।”
আচার্যের হাতের বেতের লাঠির আঘাতে কুমারের ফরসা পিঠে লাল লাল দাগ ফুটে ওঠে। রাজার ছেলে। কোনোদিন তার সঙ্গ কেউ উঁচুগলায় কথা বলেনি। আজ সবার সামনে চোর অপবাদে তার পিঠে বেতের ঘা! আঘাত যত না লাগল পিঠে , তার চেয়ে অনেক বেশি লাগল মনে।
তার রাগে অপমানে লাল হয়ে যাওয়া মুখ আচার্য কিন্তু ঠিকই লক্ষ করলেন।
দিন যায়। একদিন রাজপুত্রের শিক্ষা শেষ হল।
সেই ঘটনার পর থেকে রাজপুত্র-শিষ্যকে আচার্য অনেকদিন দেখেছেন তাঁর দিকে কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টিটা তাঁর ভালো লাগেনি।
যাই হোক, যাবার সময় আচার্যকে খুব ঘটা করে প্রণাম করে শিষ্য বার বার বলে গেল, সে যখন রাজা হবে, তখন যেন তিনি অবশ্যই তাঁর রাজ্যে আসেন। তাঁর মনে একটা কাঁটা কিন্তু বিঁধেই রইল, কারণ রাজপুত্রের সেই দৃষ্টি তিনি ভোলেননি। তাঁর শুধু মনে হল, ‘অতি ভক্তি যেন কীসের লক্ষ্মণ ? ‘
এদিকে রাজপুত্র দেশে ফিরে আসায় সবার মনে খুব আনন্দ। তার বাবা বিদ্বান ছেলের হাতে রাজ্যপাট সঁপে দিলেন।
রাজা হয়েই শিষ্য গুরুদেবের কাছে লোক পাঠাল তাঁকে নিয়ে আসার জন্য।
গুরুদেব এলেন না।
দূতের কাছে সে খবর পেয়ে রাজা একটু দমে গেল। কিছুদিন বাদে আবারও লোক গেল আচার্যের কাছে এবং ফিরে এল খালি হাতে। এবারও এলেন না তিনি। অনেকবার এইরকম হওয়ার পর অবশেষে হাল ছেড়ে দিল রাজা।
*****
কিন্তু আজ এতবছর বাদে রাজ-দ্বারীর কাছে একি শুনছেন তিনি! সেই আচার্য নিজে এসেছেন রাজ-দ্বারে! রাজার কাছে নির্দেশ পেয়ে দ্বারী আচার্যকে স-সম্মানে নিয়ে এল রাজসভায়। সেদিনকার সেই শিষ্য আজ রাজাসনে, সামনে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ আচার্য।
“তাহলে গুরুদেব, এতদিনে আসার সময় হল এ অধমের দরবারে! তবে আপ্যায়নটা এবার সেরেই ফেলি?”
রাজার শ্লেষাত্মক কথায়ও বিচলিত হলেন না তিনি। রাজা প্রহরীকে ডেকে আদেশ দিলেন, “এক্ষুণি এই নরাধমকে শূলে চড়াও —“
সভার সবাই হতবাক। তারা কিছুক্ষণ আগেই শুনেছে ইনি রাজামশাইয়ের শিক্ষাগুরু। একি ব্যবহার তাঁর সঙ্গে!
“মনে পড়ে গুরুদেব, কিছু লোকের কথায় চোর অপবাদে রাস্তার মধ্যে আমাকে বেত্রাঘাত? আজ সেই কর্মফল ভোগ করুন। “
“খুব ভালো। কর্মফলই বটে!” একটু থেমে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা বাবা, তোমার কি একবারও মনে হয় না, আমার সেই কর্মফলেই আজ তোমার এত সমৃদ্ধি, প্রতিপত্তি?”
রাজা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আচার্যের দিকে তাকালেন।
“আমার সেই বালক শিষ্যের ন্যায়-অন্যায় বোধ ছিল না। অন্যের জিনিস না বলে নেওয়া যে অপরাধ, গুরু হিসাবে আমার কি সে শিক্ষা দেওয়া উচিৎ হয়নি? আজ তুমি রাজা। তোমার বিচারবুদ্ধি কী বলে?”
রাজা চুপ। তবুও একবার তেড়েফুঁড়ে বলতে চেষ্টা করলেন, “তাই বলে রাজপুত্রকে ওইভাবে অপমান?”
স্মিত হাসলেন বৃদ্ধ, “উঁহু, ভুল করলে। আমি কিন্তু রাজপুত্রকে শিক্ষা দিইনি, শিক্ষা দিয়েছি আমার পুত্রসম শিষ্যকে। সেদিন ওভাবে না শেখালে তোমার সমস্ত শিক্ষাই যে ভস্মে ঘি ঢালা হত। একদিন, দু’দিনের মজা তোমার স্বভাবে পরিণত হত। আজ তুমি রাজা নয়, হয়ত একজন বড়ো চোর বা ডাকাত হয়ে উঠতে।”
রাজা অধোবদন। সিংহাসন থেকে নেমে লুটিয়ে পড়লেন আচার্যের পায়ে। চোখের জলে তাঁর মনের সমস্ত কালি ধুয়ে গেল।
প্রশান্তি আজ আচার্যের মনে। এতদিনে তাঁর শিষ্যের শিক্ষা সম্পূর্ণ হল!
সে জন্মে বুদ্ধদেব ছিলেন এই আচার্য।
অলঙ্করণঃ শ্রীময়ী