জয়ঢাকের খবরকাগজ–২০১৩ থেকে মনমতানো সমস্ত খবরের অর্কাইভ এইখানে
অবিবাহিতের গ্রাম – রাজঘাট
যে গ্রামে কেউ মেয়ে দিত না। অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিবেদন
আগ্রা থেকে মাত্র পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে এক শান্ত গ্রাম, নাম রাজঘাট। এক টুকরো পাথুরে জমিতে ঘুমিয়ে থাকা এই গ্রাম যেন সভ্যতার বাইরে বাস করে। রাজস্থান আর মধ্যপ্রদেশের সীমান্তে রাজঘাটে জনসংখ্যা মাত্র ৩৫০। উন্নয়নের স্রোত উদাসীন ভাবে এক টুকরো রুক্ষ এই জমিটাকে কেমন যেন উপেক্ষা করে এড়িয়ে গেছে।
রাজঘাটকে বলা হত অবিবাহিতদের গ্রাম। দুই দশক ধরে কেউ এই গ্রামের যুবকদের হাতে বিয়ে দিয়ে মেয়েদের তুলে দিতে চায়নি। চাইবেই বা কি করে? সে গ্রামে না আছে পাকা রাস্তা, না ইলেক্ট্রিসিটি, না একটা হাসপাতাল। গ্রামে এই সেদিনও কোনও স্কুল ছিল না। হালে একটা প্রাইমারী স্কুল খুলেছে, সেটাও পড়ুয়ার অভাবে ধুঁকছে। গোটা গ্রামে একটাই টিউবওয়েল ছিল, এখন তা শুকিয়ে কাঠ, একফোঁটা জলও তার কাছ থেকে আশা করা বৃথা। পাথুরে গ্রামে একটা পুকুরও নেই, থাকবার কথাও নয়। তাহলে জলের ব্যবস্থা হয় কী করে? শুনলে গা শিউরে ওঠে। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে চম্বল নদী। একমাত্র জলের এই উৎস লিকলিকে শরীর নিয়ে পাথরের বুক চিরে বয়ে চলেছে। তাই তার জল অকল্পনীয় দূষিত। জলে ভেসে আসে জন্তু আর মানুষের শব। একমাত্র জলের উৎস থেকে সেই জলই বাধ্য হয়ে ব্যবহার করে রাজঘাটের মানুষ। জল খেয়ে তারা কখনো কখনো অসুস্থ হয়ে পড়ে। সরকারি হাসপাতাল এখান থেকে অনেক দূরে, তাই বিনা চিকিৎসায় হয় মানুষ মরে যায়, নয়ত রোগের সাথে একটানা মরণপণ লড়াই চালাতে চালাতে ভগবানকে অভিশাপ দেয়। চম্বল নদীতে বাস করে ধূর্ত ঘড়িয়াল। রাজঘাটের অধিবাসীরা নদীতে জল আনতে গিয়ে কেউ কেউ তাদের পেটেও চলে যায়। গরীব মানুষগুলো জীবনের সাথে লড়ে যায়, হার মানে না।
অন্য গ্রামের মানুষ রাজঘাটে মেয়েকে বিয়ে দিতে চায় না। এখানে বিয়ে দেওয়া আর মেয়েকে নিজের হাতে খুন করা, একই ব্যাপার। তাই বলে এখানে সব মানুষই কি অবিবাহিত। তা নয়। কেউ উদ্যোগী হয়ে অন্য গ্রামে গিয়ে বিয়ে করেছে। কেউ বেমালুম গোপন করে গেছে যে সে রাজঘাটের বাসিন্দা। আগ্রা বা অন্য কোথাও বিয়ে করে কিছুদিন সংসার করার পর যখন তারা গ্রামে ফিরে এসেছে, তখন আর সংসারী বধূটির বাস্তব না মেনে নিয়ে কোনও উপায় থাকেনি।
বাইশ বছর পর মাত্রই কয়েকদিন আগে ২৩ বছরের পবন কুমার রাজঘাট গ্রামে বিয়ে করে নিয়ে এল এক তরুণীকে। গোটা গ্রাম মেতে উঠল আনন্দ উৎসবে। আনন্দ হবারই কথা। বাইশ বছর পর সে গ্রামে বেজে উঠল বিয়ের সানাই। দরিদ্র গ্রামবাসীরা মেতে উঠল বিয়ের অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে।
আপাততুচ্ছ এই বৈবাহিক ঘটনার পিছনে আছে মেডিক্যাল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রের হাত। ঢোলপুর শহরের বাসিন্দা, জয়পুরের সওয়াই মান সিং গভর্নমেন্ট মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র অশ্বিনী পরাশর, পড়াশুনোর থেকে খানিকটা সময় বাঁচিয়ে তিন বছর আগে নেমে পড়েছিল রাজঘাটের মানুষের উন্নয়নের কাজে। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত যাতায়াতের রাস্তা বানানোর উদ্যোগের মধ্যে দিয়ে তার কাজ শুরু হয়। আজ ঢোলপুর শহর থেকে রাস্তা পাকা না হলেও, চলাচলের উপযুক্ত কাঁচা রাস্তা গ্রামবাসীদের শহরে যাওয়ার সুবিধা করে দিয়েছে। রাজঘাটের অনগ্রসর অশিক্ষিত অধিবাসীদের অশ্বিনী বোঝায়, দেশি মদে নিজেদের না ডুবিয়ে গ্রামের সর্বাঙ্গীণ উন্নতির কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া তাদের আবশ্যিক কর্তব্য। অশ্বিনীর সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইন (#save_rajghat) এবং সাংগঠনিক উদ্যোগের ফলে বহু মানুষ অর্থ সাহায্য করেছেন। সেই অর্থে গ্রামে একটি রিভার্স অস্মোসিস প্ল্যান্ট বসিয়ে পরিস্রুত পানীয় জলের ব্যবস্থা হয়েছে। সোলার ল্যাম্প বসিয়ে রাস্তা আলোকিত করা হয়েছে। বসানো হয়েছে গণশৌচাগার।
গত বছর রাজস্থান হাইকোর্টে অশ্বিনী একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে, যাতে বলা হয়, রাজঘাটের মানুষকে উন্নয়নের রথের থেকে দূরে সরিয়ে রাখা ভারতীয় সংবিধানের ২১ নম্বর ধারার অন্তর্গত মৌলিক অধিকার রক্ষার আইন বিরোধী। ফলে প্রশাসন এখন নড়েচড়ে বসেছে। দুই প্রদেশের সীমান্ত অঞ্চলের এই ছোট্ট গ্রামটি কোন প্রদেশের অন্তর্গত, সেই বিবাদ ছেড়ে হাইকোর্টের নির্দেশে আঞ্চলিক উন্নয়নের কাজ শুরু হয়েছে।
পবন কুমারের বিয়ের সময় ভবিষ্যতের তরুণ ডাক্তার অশ্বিনী মন্তব্য করেছেন, আমাদের তিনবছরের পরিশ্রম সার্থক হল। ধীরে ধীরে সভ্যতার আলো রাজঘাটে পৌঁছচ্ছে, এর চাইতে আনন্দের আর কী হতে পারে!
অশ্বিনী পরাশর আজ সমস্ত তরুণ প্রজন্মের কাছে এক দৃষ্টান্ত। তার স্বপ্ন, রাজঘাটে একটি প্রাথমিক চিকিৎসালয় খোলা। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে সভ্যতার আলো না পৌঁছানো ভারতের গ্রামগুলো হয়ত হাজার অশ্বিনীর উৎসাহে আর উদ্যোগে অগ্রসর হবে। আরও উন্নত হবে মানব জীবন।
তথ্যসূত্র ও চিত্র সূত্র–
- The Hindu, May 4,2018
- The Better India, April 17, 2017
- Youth Ki Awaj, June 24, 2017
Khub bhalo laglo
LikeLike