আজ থেকে চারশ চল্লিশ বছর আগেকার এক গনগনে দুপুর। ১৯৭৬ এর ২১ শে জুন। রাজপুতানার গোগুন্ডা নগরের কাছে আরাবল্লী পর্বমালা ঘেরা হলদীঘাটি গিরিখাতে মুখোখুখি হয়েছে যুযুধান দুই পক্ষ। একদিকে চল্লিশ হাজার সশস্ত্র মুঘল সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে ফুঁসতে থাকা সম্রাট আকবরের পুত্র যুবরাজ সেলিম আর মুঘল পক্ষের বীর সেনাপতি অম্বরের রাজা মান সিংহ। আরেকদিকে হাজার তিনেক অশ্বারোহী, হাজার দুয়েক পদাতিক সৈন্য, শ’খানেক হাতি আর শ’পাঁচেক পার্বত্য ভিল উপজাতির যোদ্ধাদের নিয়ে গড়ে ওঠা মাত্র হাজারপাঁচেক সশস্ত্র রাজপুত বীরের মেবার বাহিনী, নেতৃত্বে মেবারের অবিসংবাদীত নেতা, মহারাণা প্রতাপ সিংহ।
সম্রাট আকবর চান রানা প্রতাপ সিংহ নামক এই বেপরোয়া, একগুঁয়ে, হার মানতে না চাওয়া রাজপুত অধিনায়কের বশ্যতা। এতদিন নানা কূটনৈতিক আলোচনা ও শান্তিপ্রক্রিয়ার শর্তে মহারাণা প্রতাপকে মুঘল সাম্রাজ্যের বশে আনার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন মহামতি আকবর। ঠিক যেভাবে রাজপুতানার বাকি রাজারা বেশির ভাগই ভয়ে কিংবা ভক্তিতে বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে মুঘল সম্রাটের। কিন্তু মেবারের রাণা প্রতাপ সিংহ যেন ব্যতিক্রমী মানুষ। এভাবে আকবর বাদশার কাছে রাজ্য ছেড়ে দেওয়া তাঁর চরিত্রবিরোধী। আকবর বাদশা রীতিমত তিতিবিরক্ত এই রাজপুত বীরের ঔদ্ধত্যে। আর তাই এই রাজপুতকে উচিত শিক্ষা দিতেই পুত্র সেলিমের নেতৃত্বে আর সেনাপতি মানসিংহের ভরসায় বিশাল মুঘল সৈন্যবাহিনী পাঠিয়েছেন মেবার রাজ্যে।
মুঘল সৈন্য মেবারের বহির্ভাগ আক্রমণ করে একরকম প্রতিরোধহীন হয়েই গিয়ে দাঁড়ালেন আরাবল্লী পর্তবপ্রদেশের নিকট। এবারে ঢুকতে হবে মেবার রাজ্যে। তছনছ করে দিতে হবে রানা প্রতাপের অহঙ্কার। কিন্তু সে পার্বত্য পথ তো বন্ধ! একমাত্র দ্বার হল হলদীঘাটি, আরাবল্লী পর্বতের এক কিলোমিটার ব্যাপী এক অমসৃণ গিরিখাত। আর তার প্রহরায় রয়েছে রানা প্রতাপের অসমসাহসী রাজপুতবাহিনী। তীব্র জেদ নিয়ে অপেক্ষা করছে মুঘল সৈন্যের।
আরাবল্লীর এই পাহাড়ি পথে যুদ্ধ যথেষ্ট বিপদসংকুল। মুঘল সৈন্যরা তেমন অভ্যস্থও নয়, চেনাও নেই এ পথ। কিন্তু মুঘল সৈন্যবাহিনী তো পিছু হটবে না। মুঘল সম্রাট যেভাবেই হোক হারিয়ে দিতে চান মহারাণা প্রতাপকে, কোনঠাসা করে দিতে বদ্ধপরিকর মেবারকে।
কিন্তু মহারাণা প্রতাপও তো ছেড়ে দেবার মানুষ নন! মেবারের যোদ্ধারা মরার আগে হেরে যেতে শেখেনি কোনওদিনই। অতএব যুদ্ধ শুরু হল। মুঘল যুবরাজ সেলিম আর রাজপুতানার বীর অম্বররাজ মানসিংহ ঝাঁপিয়ে পড়ল মুঘল বাহিনী নিয়ে। রাণাপ্রতাপের বাহিনীও কম নয়। মরণপণ যুদ্ধ চলল মেবারকে আগলে রাখার, স্বাধীনতা না খোয়াবার।
দেখা গেল, যুদ্ধের ময়দানে মহারাণা প্রতাপকে সবসময়ের জন্য আগলে রেখেছে মধ্যতিরিশের এক বীর রাজপুত। ইনি রানা প্রতাপের বিশ্বস্ত সহচর, রাজকোষের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচক্ষণ কর্মচারী ও মেবার রাজ্যের মন্ত্রী। নাম… ভামা শাহ। বয়েসে বছর দুয়েক ছোটই হবেন মহারাণার চেয়ে। এই বিবেচক ও সৎ মানুষটির ওপরে মহারাণার প্রবল ভরসা। ওশোয়াল বর্ণের কাবাডিয়া গোত্রে জন্ম নেওয়া এই মানুষটির দেশভক্তি, প্রশাসনিক দক্ষতা ও যুদ্ধনীতির পারদর্শীতা যে প্রশ্নাতীত তা জানেন মহারাণা।
হলদীঘাটির মাটিতে মাত্র চার ঘন্টার এই তুমুল যুদ্ধ যেন আরো চিনিয়ে দিল ভামা শাহের অবিচলিত দেশভক্তি ও বীরত্ব। শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত লড়াই করলেন ভামা শাহ। মহারাণা প্রতাপকে চোখে চোখে রাখলেন সারাক্ষণ। কিন্তু মহারাণাকে খানিকটা পিছু হটতে হল শেষ বেলায়। আত্মগোপন করতে হল মুঘল বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে। যুদ্ধ চালিয়ে যাবার মত সৈন্যবল আর ছিল না যে! মুঘল সৈন্য দখল করল মেবার। গোগুন্ডার প্রাসাদে উড়ল মুঘলের পতাকা।
কিন্তু ছেড়ে দেবার মানুষ তো মহারাণা প্রতাপ সিংহ নন। বিদেশী শক্তির কাছে মাথা নোয়াবেন না কিছুতেই। মেবারের সম্মান মাটিতে মিশিয়ে দিতে পারেন না তিনি। অতএব পণ করলেন আমৃত্যু যুদ্ধের।
কিন্তু এ তো সহজ কাজ নয়। লড়াই চালিয়ে যাবার রসদ কোথায়? রাজপুতাণার কোনো রাজার বন্ধুত্বের হাত পাবেন না তিনি। মুঘলের দলে নাম লিখিয়েছে বাকি সব রাজ্য। মেবারই আজ কোণঠাসা। এই বিপদের দিনে মহারাণার পাশে এসে দাঁড়ালেন চিরদিনের সঙ্গী সেই ভামা শাহ। মানুষটা নিজের হাতের তালুর মত চিনতেন রাজপুতানার মাটি, আরাবল্লী পর্বতমালার অলিগলি।
ঠিক হল এবারে তবে গেরিলা যুদ্ধ। ভামা শাহ ও তার ভাই তারাচাঁদকে নিয়ে মহারাণা প্রতাপ গেরিলা কায়দায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন নানা মুঘল সৈন্য ছাউনিতে। লুঠ করতে লাগলেন মুঘল সম্পদ। এভাবেই জমে উঠল পরবর্তী যুদ্ধের রসদ। পরের বছরগুলো জুড়ে রইল শুধুই গেরিলা যুদ্ধ। আরাবল্লীর গভীর গোপন গুহা থেকে মহারাণা প্রতাপ কখন যে মুঘল ঘাঁটিতে আক্রমন হানবেন এ জানা ছিল দুঃসাধ্য। আর এসব যুদ্ধে তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী সেই ভামা শাহ।
ইতিহাস বদলে যায় চোখের পলকে। বছর পাঁচেক পরে মুঘল সম্রাট আকবর খানিক যেন রাশ আলগা করলেন রাজপুতানায়। আর সেই সুযোগে গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে রাণা প্রতাপের বীর যোদ্ধারা পুনরায় দখল করে নিল হারিয়ে যাওয়া নিজেদের সাম্রাজ্য। কুম্ভলগড়, উদয়পুর, গোগুন্ডা, রনথম্ভরে আবার উড়ল রাণা প্রতাপের জয়পতাকা। ভামা শাহ হলেন প্রধানমন্ত্রী। বাকি জীবনটা জুড়ে যথারীতি রইল মেবারের প্রতি এই মানুষটার অসামান্য স্বার্থত্যাগ আর রাজভক্তি।
ভামা শাহ যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তখন ওঁর বয়স প্রায় ষাট ছুঁতে চলেছে। সারাজীবনের সঙ্গী, মহারাণা প্রতাপের মৃত্যুর পরে বুকে আগলে রেখেছেন মহারাণার জ্যেষ্ঠ পুত্র রাণা অমর সিংহকে। বয়োজ্যেষ্ঠ এই মানুষটার মৃত্যুতে সারা মেবার জুড়ে সেদিন চোখের জল।
এই বীর যোদ্ধা ও দেশভক্ত মানুষটাকে আমাদের দেশ ভুলে যায়নি। তাঁর নামে ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে ভারত সরকার। আর রাজস্থান সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে চালু করেছে ভামা শাহ পুরস্কার আর ভামা শাহ যোজনা। ভামা শাহ নামক মানুষটার স্বার্থহীন আত্মত্যাগ, তুমুল যুদ্ধনীতি, রাজকোষ সামলে রাখার বিচক্ষণতা ও নিজের দায়িত্বের প্রতি দায়বদ্ধতা তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রেখে দিয়েছে এদেশের ইতিহাসে।