আগের পর্বগুলো
যুদ্ধের খবরটা চারপাশে রটে যাওয়ায় এর পর কেউ আর আমাদের কোন ঝামেলায় ফেলতে সাহস করেনি। পরে খবর পেয়েছিলাম, বাচ্চা ছেলেটার ক্ষতবিক্ষত দেহ দেখতে পেয়ে এক রাখাল গিয়ে সে এলাকার ঠাকুরকে খবরটা দিয়েছিল। আমাদের কাছে তার রাজপুতদের হার মানবার খবর পেয়ে ঠাকুর নাকি বেজায় রেগে গিয়ে তাদের সবকটাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দিয়েছিল, আর কসম খেয়েছিলো, ঠগিদের ওপরে এই অপমানের বদলা সে নেবেই। শুনেছি এর পর থেকে বেশ কিছু ঠগিকে ধরে ঠাকুর মেরে ফেলেছিলো। কিন্তু আমার দলের টিকিটিও সে আর ছুঁতে পারে নি।
সাগর-এ এসে পৌঁছোবার পর গণেশ জেমাদারের দলটাও আমাদের সঙ্গে এসে যোগ দিল। বলে, তাদেরও কাজ ভালোই হয়েছে। এক হাতকাটা জেমাদার আর তার দলবলকে ফিরিঙ্গির দল থেকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে এসে সে তাদের সবকটাকেই নিকেশ করে দিয়েছে। টাকাপয়সাও মন্দ পায় নি। তবে সমস্যা একটু হয়েছিল প্রথমে।খুঁতো মানুষকে ভবানীর বলি চড়ানোর নিষেধ আছে। সেজন্য গণেশের দল নাকি প্রথমে হাতকাটা জেমাদারকে মারতে চায়নি। ওদিকে তাকে যে দল থেকে আলাদা করে দেবে তেমন কোন সুযোগও ছিল না। শেষে গণেশ তাদের বোঝায় , লোকটা তো খুঁতো হয়ে জন্মায় নি, তার হাত তো কেটেছে মানুষে। কাজেই বলি চড়াবার পর তার আত্মা গোটা শরীর নিয়েই ভবানীর কাছে পৌঁছোবে। তাছাড়া কোন শিকার না করে ফিরলে তারা বাকি দলের কাছে মুখই বা দেখাবে কেমন করে। এইসব যুক্তিটুক্তি দিয়ে শেষমেষ গণেশ তার লোকজনকে শান্ত করলেও জেমাদারকে কেউ নিজে হাতে মারতে চায়নি। শেষে গণেশ নিজেই জেমাদারকে মারে। দলে জেমাদারের দুটো সুন্দরী মেয়ে ছিল। সে দুটোকে বিয়ে করবার প্রস্তাব দিয়েছিলো দলের দুজন লোক। কিন্তু তারা তাতে একেবারেই রাজি না হওয়ায় তাদেরও গলায় রুমাল দেয়া হয়।
এবারে কোন পথে যাওয়া হবে তা ঠিক করবার জন্য ভবানীর সংকেত নেয়া হল। তাতে দেখা গেল আমাদের যেতে হবে উত্তর দিকে। সেইমতো সাগর ছেড়ে উত্তরের দিকে গিয়ে আমরা এসে পৌঁছোলাম সেরঞ্জ-এ। এখান থেকে বাবা ফিরে গেল ঝালোনে। আর আমরা দুটো দলে ভাগ হয়ে রওনা হলাম। একটা গেল গণেশ জেমাদারের সঙ্গে, আর অন্যটা আমার সঙ্গে চলল। দলটাকে দু ভাগে ভাগ করবার কারণ ছিল একটা। সে সময় এ অঞ্চলে ফিরিঙ্গিদের শাসন কায়েম হয়েছে। তার ওপর কাছাকাছি নানান এলাকায় ঠগিদের বিভিন্ন দলের হাতে হাতে তখন বেশ কিছু লোক মারা যাওয়ায় লোকজন একটু বেশি সতর্ক। সে অবস্থায় খুব বড় দল নিয়ে চলাফেরা করা নিরাপদ ছিল না। প্রত্যেকটা যায়গায় পৌঁছে পাহারা চৌকিতে নানা প্রশ্নের জবাব দিতে হচ্ছিল আমাদের। কোথাও ঘুষ দিয়ে, কোথাও গলাবাজি করে পাড় পেয়ে যাচ্ছিলাম অবশ্য, তবে বড়সড়ো শিকার কিছু মিলছিল না। দিনে একটা দুটো শিকার মেলে, তাও তাদের থেকে টাকাপয়সা বেশি কিছু পাওয়া যায় না।
এমনি করে চলতে চলতে হোলকারদের রাজত্বের একলেরা গ্রামে পৌঁছে আমাদের সোথারা খবর আনল, তারা একটা ছোটখাটো পথিকের দলকে পাকড়েছে। লোকগুলো্র ক্রোশকয়েক দূরের একটা গ্রামের দিকে যাবার কথা পরের দিন। পথে ঠগির ভয় দেখিয়ে সোথারা তাদের আমাদের দলে ভিড়িয়ে নিয়েছে। সেদিন সন্ধেবেলা সোথারা দলটার কয়েকজন লোককে একলেরার বাজারের কাছে আমার সঙ্গে দেখা করাবার জন্য নিয়ে এল। আমি তাকে বেশ ভালোভাবে অভ্যর্থনা করে বসিয়ে, আমারই দলের নানান কীর্তিকলাপ অন্য নামধাম দিয়ে শুনিয়ে ভয় ধরিয়ে দিলাম।
গল্প শুনে তাদের একজন বলে, “শোন, আমি নিজে কখনো ঠগি দেখিনি। এই এলাকায় ঠগির কথা শোনাও যায় না বিশেষ। কিন্তু ঠগিরা যে এখানে ঘোরাফেরা করছে সেটা আমি জানি। আমার নিজের শ্বশুরই তো ঠগিদের হাতে মারা পড়েছিল।”
আমি শুনে চোখ কপালে তুলে বললাম, “কী ভয়ানক! বলেন কি? কী করে হল? আপনি সবটা জানেন?”
“উঁহু, অত ভালো করে কিছু জানি না। আমি তখন লোকের মুখে তবে হ্যাঁ আমাদের গ্রামের বুড়োমানুষরা সব কথা জানে। আমার বউকে যিনি তারপর দত্তক নিয়েছিলেন তাঁকেই আমি এখন আমার নিজের শ্বশুর বলে মানি। তিনি ঘটনাটা পুরোটা জানেন।”
কেন জানি না, আমার হঠাৎ খুব কৌতুহল হচ্ছিল ঘটনাটা পুরো শোনবার জন্য। বললাম, “চলুন আপনার শ্বশুরমশাইয়ের কাছ থেকে গল্পটা শুনেই আসি।”
তখন বিকেল পড়ে আসছে। গ্রামদেশে এই সময়টা ভারি ব্যস্ততার সময়। রাতের আগের সব কাজকর্ম গোটাবার পালা চলে তখন। মাঠ থেকে গরুর দল ধুলো উড়িয়ে এসে গ্রামের মধ্যে ঢুকছে তখন। তাদের খুর থেকে ওঠা ধুলোয় চারদিক আবছা হয়ে রয়েছে। তবু তারই মধ্যে দিয়ে গ্রামটার যেটুকু দেখা যাচ্ছিল তাতে আমার বারবার মনে হচ্ছিল এ গ্রামটাকে আমি আগে কোথাও দেখেছি। তার সবকিছুই আমার বড় চেনা চেনা ঠেকছিল। এক একটা জায়গা দেখছি আর কেমন করে যেন তার নাম আমার মনে পড়ে যাচ্ছে। খানিকদূর গিয়ে এক ফকিরের আস্তানা দেখে অন্যমনস্কভাবে তার ভেতরে ঢুকে পড়তে গিয়েও কোনমতে নিজেকে সামলে নিলাম। বারবার চোখ চলে যাচ্ছিল আমার সেইদিকে, যেন বহুকালের পুরোন কোন বন্ধুর মুখটা হঠাৎ দেখে ফেলেছি আমার পাশে।
কিন্তু অজানা গ্রামে এসে এইভাবে কোন জায়গার ব্যাপারে অনাবশ্যক কৌতুহল দেখানোটা বিপজ্জনক হতে পারে এই ভেবে আমি নিজেকে সামলে নিলাম। তবু সেই গ্রামের বাজার, কোতোয়ালের চৌরি, মসজিদ, মহাদেবের ছোট্ট মন্দিরটা, এই সবকিছু আমার স্মৃতিতে এসে বারবার ধাক্কা দিচ্ছিল। যেন আমি সবে গতকালই এইসব জায়গা ছেড়ে গিয়েছি।
আমার নতুন বন্ধুটি অবশ্য আমার হাবভাবের দিকে বিশেষ নজর দিচ্ছিল না। আগে আগে চলতে চলতে সে একসময় একটা বাড়ির ভেতরে আমায় নিয়ে ঢুকে এল। তার ডাক শুনে ঘরের ভেতর থেকে যে বের হয়ে এল তাকে দেখেই বুকটা একবার কেঁপে উঠল আমার। হায় আল্লা, এঁকেও তো আমি চিনি! বয়স হয়েছে, বলিরেখা ভরা মুখ, তবু চিনতে একবিন্দু সমস্যা হচ্ছিল না আমার। ইনিতো—
নামটা ধরে ডেকে উঠতে গিয়েও আমি নিজেকে সংযত করলাম। সম্ভবত ঘুরতে ঘুরতে কখনো এই গ্রামে এসে দিনকয়েক থেকে গিয়েছি কখনো। না হলে এত চেনা ঠেকছে কী করে সবকিছু। ভদ্রলোক নিজেই এবার তাঁর নাম বললেন। ফুতি মহম্মদ খান। খানিক এ কথা সে কথা বলবার পর তিনি তাঁর গল্প শুরু করলেন। যাঁর গল্প, তাঁর নাম ইউসুফ খান পাঠান। মেয়েকে রেখে বউ ছেলেকে নিয়ে সে রওনা হয়েছিলো ইন্দোরের পথে—
গল্প শেষ হবার পরে একটুক্ষণ চুপ করে বসসে রইলাম আমি। তারপর জিজ্ঞাসা করলাম, “ইউসুফ খানের ছেলেটাকে তারপর আর কোনদিন কেউ দেখেনি?”
“না। কত বছর কেটে গেল তারপর। বেঁচে থাকলে আজ সে আপনারই মত বড় হতো মীর সাহেব–” বলতে বলতেই সে আমার মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ বলে উঠল, “সেই মুখ, সেই চোখের দৃষ্টি—দেখো দেখো, এ যেন একেবারে ইউসুফের বউয়ের মুখটা কেটে বসানো। তুমি কে বাবা?”
তাঁর জামাইও সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে বলে, “প্রথম দেখে আমারও সেইরকমই মনে হয়েছিলো বটে। কিন্তু–”
হঠাৎ আমার মনের ভেতর বিদ্যুতচমকের মত একটা কথা খেলে গেল, আমিই সেই ছেলেটা নই তো? তার পরেই মনে হল তা কেমন করে হবে? তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে হেসে বললাম, “না না , কী যে বলেন! আমরা সাতপুরুষের সৈয়দবংশ, পাঠান নই। তাছাড়া আমার বাবা ইসমাইল এখনও বেঁচে আছেন। মা মিরিয়াম মারা গিয়েছেন অবশ্য। ভুল করছেন আপনারা।”
বৃদ্ধ মাথা নেড়ে বললেন, “তাই হবে হয়ত। সবই ওপরওয়ালার লীলা। তাঁর কাজ কোন পথে চলে কে বলতে পারে? দুই দেশের দুই আলাদা লোকের মুখ একরকম হয় সে তো ঘটতেই পারে।”
আমার মাথায় তখন অন্য একটা কথা ঘুরছে। গল্প বলতে বলতে বৃদ্ধ একটা জাদুটোনা করা মুদ্রার কথা বলছিলেন বারবার। তাঁর পালিতা মেয়ে মুদ্রাটা সবসময় গলায় পরে থাকে। তার নাকি অনেক গুণ। আমি কথা ঘুরিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আচ্ছা আপনি কি একটা মুদ্রার কথা বলছিলেন যেন–”
“ওহো, আমার মেয়ের গলার মুদ্রাটার কথা বলছ তো? সে এক আশ্চর্য জিনিস। কোত্থেকে পেয়েছিল কে জানে! কিন্তু ওটা গলায় পরে থাকে যতক্ষণ ততক্ষণ ওকে কোন অমঙ্গল ছুঁতে পারে না। আর কখনো খুলে রাখলে সেইদিনই কিছু একটা অসুখবিসুখ বাধাবে বা অন্য কোন বিপদ হবে।”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “সবই আল্লার লীলা। এমন জিনিস পাবার সৌভাগ্য সবার হয় না। আমার একটা ছেলে ছিল। একবার এক ফকিরকে ভিক্ষে না দেয়ায় সে এমন অভিশাপ দিল যে ছেলেটা আমার কদিন বাদে শুকিয়ে মরে গেল। আমি তখন বিদেশে ছিলাম। ফিরে এসে সে খবর পেয়ে ইস্তক আমার আফশোষ আজও গেল না। ওপরওলা আমায় আর ছেলে দিলেন না। একটা মেয়ে আছে। যত সাধুসন্ত, পীরফকির দেখি সবার কাছে তার জন্য দোয়া চাই, যে যা ধারণ করতে বলে তাই কিনে নিয়ে তার গলায় ঝুলিয়ে রাখি, কিন্তু তাও মেয়েটা আমার কখনো ভালো থাকেনা। বড় রোগা। অসুখ লেগেই থাকে, রাতবিরেতে দুঃস্বপ্ন দ্যাখে–”
“মন শক্ত রাখুন মীরসাহেব। দুঃখ করবেন না। পীরফকিরের এত সেবা করছেন যখন তাদের আশীর্বাদ আপনার মেয়ে পাবেই। সব ঠিক হয়ে যাবে দেখবেন।”
“সেই আশীর্বাদই করুন আপনারা,” বলতে বলতে আমি উঠে দাঁড়ালাম। রাত হয়ে এসেছে। এবার আমায় ঘাঁটিতে ফিরতে হবে। মনে মনে ঠিক করে নিলাম, মুদ্রাটা এবারে আমি আমার মেয়েটার জন্য নিয়ে যাবো। মেয়েটা ভালো থাকবে। আজিমা খুশি হবে–আজিমা আর মেয়েটার কথা আমার তখন খুব মনে পড়ছিলো। এই বনেজঙ্গলে ঘুরে উদ্দাম জীবনের পাশে, বাড়িতে আজিমার পাশে শুয়ে মেয়েটাকে আদর করবার ছবিটা আমাকে বাড়ি ফেরবার জন্য বড় ব্যস্ত করে তুলছিল।
আমার সঙ্গীটি আমার সঙ্গে সঙ্গে বের হয়ে এসেছিলেন আমায় পৌঁছে দেবার জন্য। তাঁর কাছে বিদায় নেবার সময় বলে দিলাম, “কাল একেবারে ভোর ভোর বের হব আমরা। তাহলে গরম কম থাকতে থাকতে অনেকটা পথ পাড় হয়ে যাওয়া যাবে। তৈরি থাকবেন।”
“আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন মীরসাহেব। শেষ রাত থেকেই উঠে তৈরি হয়ে থাকবো আমরা,” সে বলল।
সকালে তাড়াতাড়ি উঠে তৈরি হয়ে নিলাম আমরা। আমাদের সঙ্গীদের কিন্তু তখনো দেখা নেই। আমার প্রধান সহকারী লালু অধৈর্য হয়ে বলে, “চলুন রওনা দিই।”
তাকে বললাম “একটু দাঁড়াও। ভালো বুনিজ আছে। এক্ষুণি এসে পৌঁছোবে।”
বলে, একটা লোককে তাড়াতাড়ি গ্রামের ভেতর পাঠিয়ে দিলাম তাদের ডাকতে।
খানিক বাদে সে ঘুরে এসে বলে, “ওরা আসছে।”
“কতজন?”
“টাট্টুঘোড়ার পিঠে দুজন মহিলা, পায়ে হেঁটে এক বুড়ি আর গাদাবনুক হাতে তিনজন পুরুষ।”
“হুঁ। সব মিলিয়ে ছ জন। ভালো। লালু, তুমি সবাইকে বলে দাও। আজ ভালো জায়গা পেলে আজই ঝিরনি দিয়ে দেবো। নাহলে কাল।”
“কালকেই করুন মীরসাহেব,” লালু বলল, “ভবানীর সংকেত নিয়েছিলাম ভোরে উঠে। আজকের জন্য লক্ষণ ভালো নয়। শুধু শুধু বিপদের বোঝা মাথায় নিয়ে লাভ কী?”
“ঠিক আছে। রাতে বেলহাদের পাঠিয়ে দিও আগে আগে জায়গা খুঁজে রাখবার জন্য। তারপর কাল দেখা যাবে।”
লোকগুলো এসে পৌঁছোলে আমরা চলতে শুরু করলাম। জায়গাটায় একেবারে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে গ্রামের পর গ্রাম। কাজ করবার মত এতটুকু ফাঁকা জায়গা নেই কোথাও। তাই দেখতে দেখতে যাচ্ছি তখন আমার সঙ্গীটি বলে, “কালকের রাস্তাটা কিন্তু বিপদের মীরসাহেব। ত্রিসীমানায় কোন জনবসতি পাবেন না। ডাকুর ভয়ও আছে। কাল একটু সাবধানে চলবেন।”
সেদিন বিকেলে বিশ্রাম নিতে থেমে আমি লোকটার বউটার মুখটা আর তার গলার মুদ্রাটা একঝলক দেখবার জন্য অনেকবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সেটা কিছুতেই সম্ভব হল না। মেয়েটা মুখের বোরখা একবারের জন্যও খুলল না কিছুতেই। তবে সে না খুলুক গে, আমার মাথায় তখন কেবল একটাই কথা ঘুরছে। মেয়েটাকে আমি কাল নিজে হাতে মেরে ওর গলার মুদ্রাটা খুলে নিয়ে যাব আমার মেয়েটার জন্য। ওটা আমার চাই।
সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে লালু কয়েকজন বেলহাকে পাঠিয়ে দিল কাজের জায়গা খুঁজে রাখবার জন্য।
সেদিন মাঝরাতে উঠে আমরা ফের রওনা দিলাম। অত রাতেও গরম পুরোপুরি কমেনি। প্রায় তিন ক্রোশ পথ ধরে বেশ কিছু গ্রাম পার হবার পর নির্জন রাস্তা শুরু হল। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ধূ ধূ প্রান্তর আর রাস্তার পাশের কাঁটাঝোপের মধ্যে দিয়ে মাঝরাতের গরম হাওয়া দীর্ঘশ্বাসের মত শব্দ করে বয়ে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে দু একটা টাট্টু ঘোড়া চিঁহি চিঁহি করে ডেকে উঠছিলো শুধু। কখনো বা হায়নার আর্তনাদ শোনা যাচ্ছিল অনেক দূর থেকে। সে আওয়াজ ছুরির মুখে জবাই হতে থাকা মানুষের চিৎকারের মত। শুনলে রক্ত ঠান্ডা হয়ে যায়।
বেশ খানিকটা পথ এইভাবে চলবার পর একটা বাঁকের মুখে এসে দেখি অন্ধকারের মধ্যে একজন বেলহা বসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। তার কাছে গিয়ে চাপা গলায় রামাসি ভাষায় জিজ্ঞাসা করলাম, “ভিলা মাঞ্জে?”
“মাঞ্জে। কবর তৈরি মীর সাহেব।”
“কত দূরে, গোপাল?”
বেশি দূর নয়। একটা শুকনো নালা গেছে এই রাস্তাটার ওপর দিয়ে। দুপাশে অনেক বালি। ওখানেই ব্যবস্থা করেছি।
“ভালো। এবার আমার ঘোড়াটা তুমি ধরবে। আমি একটু দূরে গিয়ে নেমে যাবো। একটা কাজ আছে, সেটা আমি বিশ্বাস করে অন্যের হাতে ছাড়তে পারবো না।”
ঘোড়ার গতি আস্তে করে দিলাম আমি। বুনিজের দলটা একটু বাদেই আমার কাছাকাছি চলে আসতে দাঁড়িয়ে পড়ে বললাম, “কি জঘন্য রাস্তাঘাট তোমাদের খান! আমার ঘোড়াটার একটা নাল খুলে পড়ে গেছে কোথায়। পায়ে একটু চোট পেয়েছে মনে হয়। এখন দু এক ক্রোশ একটু পায়ে হেঁটে ঘোড়াটাকে বিশ্রাম দিতে হবে। এ রাস্তাটা তার চেয়ে বেশি লম্বা হবে না বোধ হয়?”
“হ্যাঁ, তা ওইরকমই হবে। খানিক দূর গিয়ে একটা শুকনো নালা পড়বার কথা। সেটা পেরোলে আর দেড় ক্রোশ দূরে একটা গ্রাম পড়বে। তার পর থেকে রাস্তা আবার ভালো।”
হঠাৎ পেছন থেকে মিঠে বাজনার মত গলা ভেসে এলো একটা, “মীরসাহেব আমার টাট্টুটাতে চড়তে পারেন। আমার পায়ে ঝিঁঝি ধরে গেছে। হাঁটবো একটু।”
সেই মেয়েটার গলা। গলাটা ভারি সুন্দর। আর মিনিট পনেরোর মধ্যে অবশ্য আমার হাতেই এর সব আওয়াজ থেমে যাবে।
“আরে না না খানসাহেব,” আমি মাথা নেড়ে বললাম, “আপনি ওঁকে বলে দিন, আমি এটুকু হেঁটেই যেতে পারবো। যুদ্ধবিগ্রহ করে খাই, গায়ে এইটুকু জোর আমার আছে।”
“সে আপনার যেমন ইচ্ছে মীরসাহেব। তবে আমার বিবির ঘোড়াটায় আপনি চড়লে তাতে হয়তো এই যে আপনি আমাদের বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সে উপকারের একটু প্রতিদান দেয়া যেত। এ রাস্তাটা খুব খারাপ, আর যে নালাটা পেরোতে যাচ্ছি ওখানে অনেক মানুষের রক্ত ঝরেছে!”
টাট্টুর ওপর বসে থাকা মেয়েটা একবার কেঁপে উঠল কথাটা শুনে। তাড়াতাড়ি করে বললাম, “ছি ছি খান, এইসব কথা বলে মেয়েদের ভয় দেখাতে আছে? হত কোন লড়াইয়ের ময়দান তাহলে নয় আলাদা কথা ছিল। সেসব গল্প এঁদের শুনতে ভালোই লাগবে। কিন্তু এইখানে এখন ডাকুর গল্প বলে ভয় দেখিয়ে লাভ কী? এখানে কোন ভয় নেয় তোমাদের।”
বলতে বলতেই আমার পায়ের ওপর দিয়ে কী যেন একটা চলে গেল। আমি চমকে উঠে বললাম, “কী গেল ওটা?”
“ও কিছুনা মীরসাহেব। একটা খরগোশ। শেয়ালে তাড়া করেছিল বোধ হয়! আপনি চমকালেন যে?”
আমার বুকের ভেতরটা তখন হিম হয়ে গেছে। খরগোশ রাস্তা পাড় হওয়া! ঠগিদের কাছে এর চেয়ে কুলক্ষণ আর কিছু হয় না। তার মানে সামনে বিপদ অনিবার্য। এ সংকেত না মানলে প্রাণসংশয় কিংবা লম্বা কারাবাস হবেই।
মুখে অবশ্য সে ভাবটা প্রকাশ না করে বললাম, “ও কিছু নয়। আসলে আমাদের ওদিকে এটাকে খুব কুলক্ষণ বলে মানা হয় কি না! যতসব কুসংস্কার।”
মনের ভেতর তখন অবশ্য একটা ঝড় চলছে আমার। এসব ভবানীর সংকেত টংকেতে আমার নিজের বিশ্বাস নেই খুব একটা। যেটুকু মানি সে আমার দলের লোকজনের মুখ চেয়ে। কিন্তু এবারে একেবারে সরাসরি আমার পরীক্ষা। সংকেতটা আমি একলা পেয়েছি। দলের কেউ জানে না। তার ফলাফল আমাকেই ভোগ করতে হবে। ভবানীর সংকেত না মানলে কী হয় তার হাজারো উদাহরণ আমার চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যাচ্ছে তখন। একজনকে পোকায় কুড়ে কুড়ে খেয়েছিলো, একজনের ফাঁসী হয়, একজনের বউ বাচ্চা মারা যায়—আমার বাড়িতেও তো আমার—-
কিন্তু খানিকক্ষণের মধ্যেই আমি সেসব একেবারে ভুলে গেলাম। মুদ্রাটা আমি হাতছাড়া হতে দিতে পারবো না। আমার মেয়েটার জন্য ওটা আমার দরকার। তার জন্য কোন সংকেত, কোন দুর্লক্ষণ আমি মানিনা। দুর্লক্ষণ! হাঃ যতসব ছেলেভোলানো গল্প—হঠাৎ হা হা করে হেসে উঠলাম আমি।
“কী হল মীরসাহেব, খুব মজা পেয়েছেন মনে হচ্ছে?” খানিক সামনে থেকে লালু জিজ্ঞাসা করল, “কী হয়েছে আমাদেরও একটু বলুন!”
“ও কিছু নয়,” আমি জবাব দিলাম, “আমার হুঁকোটা কোথায় জানো?”
“উঁহু। দাঁড়ান আনিয়ে দিচ্ছি।”
মুখে মুখে কথাটা দলের পেছনদিকে চলে গেল। এটা ছিল আমাদের তৈরি হবার সংকেত। শুনেই সবাই বুনিজদের অলক্ষ্যে যার যার জায়গা নিয়ে নিল। নালাটা আর দূরে নয়। আমার এই কথাটার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সঙ্গীদের বেঁচে যাবার শেষ সম্ভাবনাটাও দূর হয়ে গেল।
কয়েক মিনিট হাঁটবার পর নালাটা সামনে চলে এল। নালার মধ্যে নেমে আমি রুমালটা খুলে আনলাম হাতে। একে একে অন্যেরাও নালার মধ্যে নেমে এলো। গোটা দলটাই তখন তার বালিতে ভরা খাতের মধ্যে মিলেমিশে চলাফেরা করছে। আমি ঝিরনি দিয়ে দিলাম।
প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই কাজ শেষ হয়ে গেল আমাদের। একটা টুঁ করে শব্দও উঠলো না। মেয়েটার বরের গলা থেকে শুধু হালকা একটা ঘরঘর শব্দ শুনেছিলাম শুধু এক মুহূর্তের জন্য। মেয়েটা তখন আমার রুমালের টানে ছটফট করতে করতে এলিয়ে পড়ছে।
সে পড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমি তার গায়ের কাপড় ছিঁড়ে ফেলে, তখনও গরম বুকের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিতেই সেই মুদ্রাটা আমার হাতে চলে এলো। জিনিসটা একটা রেশমি সুতো দিয়ে তার গলায় বাঁধা ছিল। টানাটানি করেও খুলতে না পেরে আমি আমার ছুরিটা বের করে সুতোটা কেটে মুদ্রাটা তুলে নিলাম। কি যে আনন্দ হচ্ছিল আমার তখন, সে কথা বলে বোঝানো যাবে না। চলে আসবার আগে ভাবলাম, লুগাইরা নিয়ে গর্তে ফেলে দেবার আগে মেয়েটার মুখটা একবার দেখে নেয়া যাক। ঘুরে চাইলাম তার মুখে দিকে। ভারী সুন্দর মুখটা। কিন্তু তার সেই ঠেলে বের হয়ে আসা রক্তজড়ানো চোখদুটো! হায় ঈশ্বর! কেন আমি তার মুখের দিকে তাকাতে গেছিলাম! না তাকালে হয়তো এতদিন ধরে যে ভীষণ যন্ত্রণায় ভুগেছি আমি তার কিছুই ভুগতে হত না আমাকে! আজও সে মুখটা আমার পিছু ছাড়ল না। মৃত্যু অবধি আমার সে মুখের হাত থেকে মুক্তি নেই।
সে মুহূর্তে অবশ্য আমার মনে সে নিয়ে এমন কোন প্রতিক্রিয়া হয়নি। আমার শাস্তি শুরু হয়েছিল যখন জানতে পারলাম আমি কী করেছি সেই তখন থেকে! তখন শুধু মনে হয়েছিল, মেয়েটা ভারী সুন্দর। লুগাইরা অবশ্য সেসব রূপটুপ বুঝবে না, টান দিয়ে নিয়ে কবরে ছুঁড়ে ফেলবে। আমি মেয়েটার শরীরটা ফের ভালো করে ঢেকে দিয়ে তার পাশে বসে লুগাইদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।
হঠাৎ গোপাল আমার কাছে এসে বলে,“কী ব্যাপার মীরসাহেব? মেয়েটার গায়ের কাপড়টা খুলে নেন নি যে বড়? অন্তত দুটাকা দাম হবে জিনিসটার।”
“না গোপাল,” আমি জবাব দিলাম, “ওটা ওর গায়েই থাক। ও কেউ খুলবে না। তোমরা ওর মুখও দেখো না কেউ। যেমন আছে তেমনি করে কবরে নিয়ে শুইয়ে দাও।”
“জো হুকুম। তা গয়নাগাঁটি কিছু আছে নাকি দেখে নিয়েছেন তো?”
“দেখেছি। সেসব কিছু নেই। এখন যাও, নিয়ে যাও একে।”
মেয়েটার শরীরটার সঙ্গে সঙ্গে কবর অবধি আমি নিজেও হেঁটে গেলাম। সেখানে গভীর গর্তের মধ্যে একে একে শরীরগুলোর পেট চিরে দিয়ে ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে। মেয়েটার শরীরতে কোন অস্ত্র ঠেকাতে দিলাম না আমি। তাকে সম্পূর্ণ পোশাক পরা অবস্থাতেই অন্য শরীরগুলোর ওপরে যত্ন করে শুইয়ে দেয়া হল।
দ্রুতহাতে সব কাজ সেরে আমরা জায়গাটা ছেড়ে রওনা হয়ে গেলাম। আর তাড়াতাড়ি করবার ফলে বিরাট একটা বিপদের হাত থেকে রক্ষাও পাওয়া গেল। আধ ক্রোশ পথ যেতে না যেতে দেখি বিরাট একটা দল আসছে উলটো দিক থেকে। আমাদের দলটার মতই, সংখ্যায় অনেকজ্জন হওয়ায় তারা রাতের অন্ধকারকে ভয় না করে বের হয়ে পড়েছে রাস্তায়। তাদের সঙ্গে দু একটা কথাবার্তা বলে সামনে রাস্তা আর জলটলের খোঁজখবর নিয়ে আমরা আবার এগিয়ে গেলাম। এদিকে রাস্তা ভালো। পথের কষ্ট কম।
কাজটা করে সাকুল্যে চল্লিশটা টাকা আর একশো তাকার গয়না পাওয়া গেছিল মাত্র। কিন্তু আমার সুখের সীমা ছিল না। সাত রাজার ধন এক মানিক সেই মুদ্রাটা আমি পেয়ে গেছি আমার মেয়েটার জন্য। এবার আমার মেয়েটা ভালো থাকবে। নিজের মেয়ের জন্য এর চেয়ে বেশি দুনিয়ায় আর কি চাইবার থাকতে পারে তার বাপের!
পথ চলতে চলতে মুদ্রাটা আমি হাজারবার বের করে করে দেখতাম। যতই দেখতাম, মনে হত মুদ্রাটাকে আমি চিনি। তার কালো হয়ে যাওয়া ধাতুটায় এর আগেও আমি হাত ছুঁইয়েছি কখনো! অথচ তেমনটা হবার তো কোন কারণ নেই। তাই আস্তে আস্তে আমার বিশ্বাস হল, মুদ্রাটার জাদুশক্তি আমার ওপর ছাপ ফেলছে নিশ্চয়। আমারও মঙ্গল হবে ওতে! ঈশ্বর মঙ্গলময়।
এরপর আরো কিছুদিন ঘুরে বেড়ানো যেত হয়তো, কিন্তু আমার মন তখন বাড়ির দিকে টানছে। অতএব ঝালোনের দিকে পা বাড়ালাম আমরা। পথে কাজের সুযোগ অনেক এসেছিল, কিন্তু সেসব সুযোগ নেবার আগ্রহ আমার আর ছিল না। নিতান্তই যে দুএকটা অভাগা পথিক জোর করে আমাদের দলে ঢুকতে চেয়ে নিজের বিপদ ডেকে এনেছে, তাদেরকেই বাধ্য হয়ে মারা হয়েছিল ফেরবার পথে।
ক্রমশ