আগের পর্বগুলো
কয়েকদিনের মধ্যেই দলে আমার অবস্থান বেশ পাকাপোক্ত হয়ে উঠল। শ’খানেক লোকের একটা দলের দায়িত্ব দেয়া হল আমাকে। যদিও আমার ওপরে গফুর খান রয়েছে, তবু যে সম্মান আমি পেলাম তা জীবনে কখনো পাবো বলে আশা করিনি। একটু সময় বের করে আমি এইসব খবর জানিয়ে বাবা আর আজিমাকে লম্বা চিঠি লিখে ফেললাম। জানতাম আমার উন্নতির খবরে তারা সবচেয়ে বেশি খুশি হবে।
শিবিরের রোজ সকালটা আমার শুরু হত চিতুর সঙ্গে ঘুরে ঘুরে নতুন আসা সেনাদের মহলা দেখে। দিন শেষ হত লড়াইয়ের মাঠে অস্ত্রশস্ত্রের মকশো করে। সেখানে আমি আমার সুনামটা নিয়মিতই ধরে রাখতাম। নেমাওয়ারের এই একটা মাস ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের সময়।
দেখতে দেখতে দশেরা এসে গেল। মহা ধুমধামে মা দুর্গার আরাধনা শেষ করে সৈন্যদের সাজিয়ে গুণতিকরে ফেলা হল। দেখা গেল পাঁচ হাজার সুশিক্ষিত যোদ্ধা আর কিছু কম পটু তলোয়ারবাজ নিয়ে মোট আট হাজার সৈন্য একত্র হয়েছে। সবাই তখন দেশে লুটপাটের অভিযান চালাবার জন্য তৈরি। ঠিক করা হল নর্মদা পার হয়ে গোটা দলটা দু ভাগে ভাগ হয়ে যাবে। বলা বাহুল্য ফিরিঙ্গিদের সৈন্য আমাদের তাড়া করবেই। তাদের হাত এড়িয়ে কৃষ্ণা নদী পার হয়ে দাক্ষিণাত্যের একেবারে গভীরে ঢুকে যাবে আমাদের দলবল।
পুরো বাহিনীটাই শিবির ভেঙে রওনা হয়ে গেল একদিন সকালে। নর্মদায় নৌকোর ব্যবস্থা করে রাখা ছিল তাইতে করে সেদিনই দুপুরের মধ্যে নর্মদা পার হয়ে দক্ষিণ পারে হিন্দিয়া শহরের কাছে আমরা প্রথম ঘাঁটি গাড়লাম।
এইখান থেকে দল দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেল। চিতুর দলের সঙ্গে আমি চললাম পশ্চিমমুখো, তাপি নদীর দিকে। তাপির অববাহিকা ধরে আমরা গিয়ে ঢুকবো নাগপুরের রাজার এলাকায়।তাঁর সঙ্গে আগে থেকেই চুক্তি করা আছে, তিনি আমাদের কোন বাধা দেবেন না। বিনিময়ে আমরাও তাঁর রাজত্বে কোন লুটপাট করব না বলে কথা দেয়া হয়ছে।
অন্যদলটা যাবে পুব মুখে। তার নেতা ভিখু সৈয়দ। দলে চিতুর ঠিক পরেই তার স্থান। তারা নর্মদার পাশবরাবর গিয়ে নাগপুরের বড় রাস্তা ধরবে।
আমাদের দলটা খুব তাড়াতাড়ি চলছিল। টাকাপয়সার অবস্থা সবারই বেশ খারাপ। শিগগির ঠিকঠাক এলাকায় ঢুকে লুটপাট শুরু করতে না পারলে না খেয়ে থাকতে হবে। আমাদের খোঁজারুরা খবর এনেছিল, ফ্রেজার নামে এক ইংরেজ সেনাপতি তিনশো সেনা নিয়ে পনেরো ক্রোশ দূরে বসে আমাদের গতিবিধির ওপর নজর রাখছে। কথাটাতে আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিইনি। কয়েক হাজার ঘোড়সওয়ারের একটা দলকে মাত্র তিনশো লোক এত দূর থেকে এসে আক্রমণ করবে সেটা মোটেই ভাবা যায় না।
কিন্তু বাস্তবে তাই হল। সাহেবের সাহসের বহর আমরা আন্দাজ করতে পারিনি। সেদিন সকালবেলা একটা গ্রামের কাছে এসে আমাদের দলটা রান্নাখাওয়া শুরু করেছে এমন সময় লাল কোট পরা সৈন্যদের দলটা আমাদের কাছাকাছি এসে পৌঁছে দুমদাম গোলাগুলি ছুঁড়তে শুরু করল। তাতে লোকজন দেখি বেজায় ভয় পেয়ে এলোমেলো ছুটছে। একবার যদি ঘুরে দাঁড়াতাম আমরা তাহলে সেই তিনশোটা লোক এক ফুঁয়ে উড়ে যেতো আমাদের সামনে। সে চেষ্টাও আমি করেছিলাম। কিন্তু আমার একশোটা লোক ছাড়া আর কাউকে সঙ্গে পেলাম না। বাধ্য হয়ে আমাদেরও পেছন ফিরে পালাতে হল। দূর থেকে দেখলাম, আমাদের গোটা ঘাঁটিটা তারা এসে দখল করল। উনুনে উনুনে রান্না হতে থাকা খাবার তো তারা পেয়েছিলই, সেইসঙ্গে আমাদের দলের অধিকাংশ লোক দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে খালি হাতেই ঘোড়ায় চড়ে পালাবার ফলে অনেক দামি জিনিসপত্রও পেয়ে গেছিল তারা। ভাগ্য ভালো যে ইংরেজদের দলটা তত বড় ছিল না। নইলে সেদিন আমাদের দলটার আর অস্তিত্ব থাকত না। দিনতিনেক পরে আবার যখ সব একত্র হলাম তখন দেখা গেল সাকুল্যে একশো লোক মারা গেছে আমাদের। বাকি দলটা এবার ফের একত্র হয়ে এগিয়ে চললাম।
জঙ্গলের পথ ধরে চলতে চলতে অবশেষে আমরা এলিচপুরের কাছাকাছি এসে পৌঁছোলাম একদিন। রাস্তাটায় আমি আগেও এসেছি সেই শুরফুনের ঘটনাটার সময়। সেই রাস্তা ধরেই ওয়ারদা নদীর কাছ দিয়ে এসে আমাদের দল নিজামের রাজত্বে ঢুকল। তারপর একদিনে পঁচিশ ক্রোশ রাস্তা পার হয়ে এসে পৌঁছোল চিতুর প্রথম নিশানা অমরাবতীতে। আগে যখন এখানে এসেছি তখনও শহরটা সমৃদ্ধ ছিল। এখন দেখলাম আরো সমৃদ্ধ হয়েছে।
আমাদের বন্যার মত ধেয়ে আসতে দেখে পথের পাশে প্রত্যেকটা গ্রাম ছেড়ে লোকজন পালিয়ে যাচ্ছিল। ফাঁকা গ্রামগুলো লুটপাট করে বেশ ভালোরকম রোজগার হচ্ছিল আমাদের। আমি ছিলাম একেবারে সামনের দলে। আমার পেছনে ঘোড়সওয়ারের সংখ্যা তখন বেড়ে পাঁচশো হয়েছে। গফুর খানের বোধ হয় সে দিনটা আমার ওপর একটু ঈর্ষা হয়ে থাকবে। তাকে সেদিন চিতুর সঙ্গে সঙ্গেই থাকতে হচ্ছিল। আমার সঙ্গে চিতু বেশ কিছু লোক পাঠিয়ে দিচ্ছিলো যাতে আগে আগে গিয়ে অমরাবতী শহরটা ঘিরে ফেলি। আর মূল দলটাকে নিয়ে চিতুরা পেছনপেছন আসছিল।
আমার দলটা একপাল পঙ্গপালের মত ধেয়ে যাচ্ছিল অমরাবতী শহরের দিকে। ঘোড়ার পিঠে ছুটতে ছুটতে দেখছিলাম, হাজার হাজার লোক চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পালাচ্ছে। একেকটা গ্রামে ঢুকে দেখা যাচ্ছিল, গোটা গ্রাম খালি। শুধু কিছু লোক সোনাদানা, টাকাপয়সা নিয়ে অপেক্ষা করছিলো আমাদের হাতে তুলে দেবার জন্য। তাদের একটাই ভিক্ষা, গ্রাম যেন জ্বালিয়ে না দিয়ে যাই। আমার তাতে আপত্তি ছিল না বিশেষ। কিন্তু এগোতে এগোতে পেছনে আকাশ বেয়ে ওঠা ধোঁয়ার কুন্ডলি দেখে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না, পেছনে আসা চিতুর মূল দলটার বুকে আমার মত অত দয়ামায়া নেই।
বিকেল বিকেল অমরাবতী পৌঁছে দেখি, যে সামান্য কজন সৈন্য শহর পাহারা দেবার জন্য রাখা ছিল তারা আমাদের আসবার খবর পেয়েই দল বেঁধে পালিয়ে গেছে। পাহারাহীন শহরে আমি আমার দল নিয়ে বিজয়ীর মত এসে ঢুকলাম। এর আগে যখন এখানে চোরের মত এসে ঢুকেছিলাম তখনকার সঙ্গে এই আসায় কত তফাৎ!
শহরের বাজার এলাকায় এসে প্রথমেই তার মূল রাস্তার দুপাশে পাহারা বসিয়ে দেয়া হল।এখানেই এখানকার সব বড় বড় ব্যবসায়ীদের ঘাঁটি। তারপর, বাজারের মাঝখানে চক এলাকায় পৌঁছে আমি ঘোড়া থেকে নামলাম। সেখানে শহরের গণ্যমান্য লোকেরা গালচে বিছিয়ে আমাদের স্বাগত জানাবার জন্য অপেক্ষা করছিল। তবে দু’পক্ষের কেউই যেহেতু খোশগল্প করবার জন্য সেখানে আসিনি তাই সৌজন্যমূলক কথাবার্তায় কেউই বিশেষ সময় নষ্ট করলাম না।
লোকগুলো আমায় প্রস্তাব দিল যেন এক লখ টাকা নজরানা নিয়ে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। এ নিয়ে খানিক টালবাহানা করবার পর আমি বললাম, “এসব বাজে কথা রেখে এইবার কাজের কথা শুনুন। মাত্র এক লাখ টাকা দিয়ে চিতুকে খুশি করে ফেলবেন এই যদি আপনাদের ধারণা হয় তাহলে আপনারা খুব বড় ভুল করছেন। পিন্ডারিরা যেখান দিয়ে যায় সে জায়গার কী দশা হয় যদি দেখতে চান তো একটা উঁচু বাড়ির মাথায় উঠে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখুন একবার আমাদের আসবার পথে গ্রামগুলোর কী দশা করা হয়েছে। চিতুর মূল বাহিনী আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এখানে এসে পৌঁছোবে। তার আগেই আপনারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে ঠিক করে নিন, কী করবেন। আপনাদের প্রস্তাবে যদি চিতুকে খুশি করতে না পারেন তাহলে আপনাদের যা আছে সে সব তো যাবেই, সেইসঙ্গে আপনাদের ঘরের বউ-মেয়েরাও নিরাপদে থাকবে না। তখন আমরা এইখানেই ক’দিন থেকে গিয়ে আপনাদের প্রত্যেকের অন্দরমহলের খবরাখবর নেব, কী বলেন?” এই বলে আমার তলোয়ারটাকে আমি মাটিতে শুইয়ে রেখে বললাম, “যান। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলুন। ওই গাছের ছায়াটা এই তলোয়ার অবধি পৌঁছোন পর্যন্ত আপনারা সময় পাবেন। তার মধ্যে আমাদের খুশি করবার মত কোন প্রস্তাব নিয়ে আসতে না পারলে, আপনাদের বাড়িগুলো তো কাছাকাছি রইলই, আমরা সেগুলোর খবর নিতে শুরু করব।”
আমাদের দলের লোকজন খুশি হয়ে বলে, “দারুণ বলেছেন মীর সাহেব, কিন্তু খবরাখবরটা এক্ষুণিই নিতে শুরু করতে দোষ কী? এই কিপ্টে সাহুকারগুলো আমাদের মানইজ্জত বাঁচাবার মত প্রস্তাব দিতে পারবেই না।”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “একটু ধৈর্য ধর। দেখা যাক না কী বলে এরা। ততক্ষণ কোন গন্ডগোল কোরো না।”
গাছের ছায়াটা যখন তলোয়ারটাকে প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে, আর আমার লোকেরাও অধৈর্য হয়ে ছটফটানি জুড়েছে তখন সাহুকারদের দলটা ফের এসে হাজির হল। তাদের মধ্যে সবচেয়ে মোটা সর্দারমতো একজন সামনে এগিয়ে এসে বলে, “আসুন মীরসাহেব, বসুন। বসে কথা বলা যাক। তাড়াহুড়োয় ব্যবসার কথাবার্তা ভালো করে হয় নাকি?”
উত্তর আমি বললাম, “উঁহু , বসা টসা নয়। আপনাদের যা বলবার তা আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই শুনব। আমার লোকজন কেমন ছটফট করছে দেখতে পাচ্ছেন তো! আপনারা ভালো কিছু না শোনাতে পারলে কিন্তু এদের আমি আর বেশিক্ষণ আটকে রাখতে পারব না। আপনাদের কথায় এরা যদি খুশি না হয় তাহলে আপনাদের জীবনের জিম্মা আর আমার নয় এই কথাটা বলে দিলাম।”
সাহুকারদের সর্দার বলে, “তাহলে মীরসাহেব, আপনি আমার সঙ্গে একটু দূরে চলুন। যা বলবার আপনাকে আলাদাভাবে বলি। ভয় পাবেন না। সাহুকার কখনো ছুরিটুরি মারে না।”
আমি হেসে বললাম, “ভয় আর পাবো কাকে? চলুন, কী বলবেন বলে ফেলুন তাড়াতাড়ি। আপনাদের দোকানটকান আর বাড়িগুলো দেখে লোভ সামলে রাখা বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে আমাদের,” এই বলে দলের অন্যদের দিকে তাকিয়ে বললাম, “এই মহাশয়দের ততক্ষণ তোমরা একটু দেখেশুনে রেখো হে। আমি কথাটা শুনে আসি গিয়ে।”
খানিক দূরে গিয়ে সাহুকার আমায় বলে, “শুনুন,আপনার দলটা তো মূল দলের আগে আসা খোঁজারু দল। আমরা শুধু এই খোঁজারু দলটাকে এক লাখ টাকা দিচ্ছি। তার মধ্যে দশ হাজার যাবে আপনার একার ভাগে। এই নিয়ে খুশি হয়ে যান। ভাঙচূর কিছু করবেন না। মূল দলটা এসে পৌঁছোলে আমরা তাদের সঙ্গে নতুন করে বোঝাপড়া করে নেব। টাকাটা নিয়ে আপনারা সামনে এগিয়ে গিয়ে রাতটা কোন একটা গ্রামে কাটান।”
প্রস্তাবটা আমার মনে ধরল। চিতু এখান থেকে যত টাকা তুলবে বলে ঠিক করেছে সেটা সে যেনতেনপ্রকারেণ তুলে নেবেই। আমরা তাহলে আমাদের ভাগটা ছাড়ি কেন। আমাদের হিস্যা থেকে তাকেও তো এক তৃতীয়াংশ আমরা দেবই। বললাম, “ঠিক আছে। কিন্তু আমরা এখান থেকে উপস্থিত কোথাও যাচ্ছি না। পঁচিশ ক্রোশ ঘোড়া চালিয়ে এসেছি। আমাদের একটু বিশ্রামও তো দরকার নাকি?”
“ঠিক আছে। থাকুন তাহলে। টাকা তৈরি আছে। আপনার দলকে গিয়ে বোঝান এবারে। মারপিট করলে এরা যা পাবে, তার চেয়ে মিষ্টি কথায় অনেক বেশি টাকা পেয়ে যাবে।”
দলের মধ্যে ফরে এসে সব খুলে বলতে সবাই বেজায় খুশি হয়ে হই হই করতে শুরু করে দিল।
টাকাটা এরা নিশ্চয় আগে থেকেই জোগাড় করে রেখেছিল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই দেখি বড় বড় টাকার বস্তা নিয়ে লোকজন সার বেঁধে আমাদের দিকে আসছে। পিন্ডারিদের একেকটা দল তাদের সর্দারের নেতৃত্বে এগিয়ে আসতে লাগল। প্রত্যেক পিন্ডারি পেল একশো টাকা, আর তাদের সর্দাররা পেল হাজার টাকা করে।
সবার টাকা নেয়া হয়ে গেলে সাহুকার বলে, “আপনি আপনার টাকা নিলেন না মীর সাহেব?”
বললাম, “সে আমি পরে আপনার কাছ থেকে বুঝে নেব।”
পীর খান দেখি খুব খুশি হয়েছে। বলে, “একদিনে, একটা লোকও নিকেশ না করেই হাজার টাকা চলে এলো, মীরসাহেব, এ দেখছি আমাদের পেশার চেয়ে অনেক ভালো কাজ!”
তাকে ঠোঁটে আঙুল রেখে বললাম, “চুপ। আমাদের গোপন কথা নিয়ে একটা কথাও নয় এখানে। এখন যাও। খেয়াল রাখো আমাদের লোকজন যেন কোন ঝামেলা না বাধায় এখানে।”
সে হাসিমুখে মাথা নেড়ে চলে যেতে সাহুকারদের দলটা এসে আমায় ঘিরে বসল। বলে, “চিতু সর্দার কত চাইবেন বলে আপনার মনে হয় মীরসাহেব?”
বললাম, “সে আমি বলতে পারবো না,তবে টাকাপয়সা নিয়ে বেশি কষাকষি না করাই ভালো। পিন্ডারিরা আবার বেশি কথার মানুষ নয়। সোজাসুজি হাত চালিয়ে দেবে রেগে উঠলে। লোকজনকে কষ্ট দেবার করবার ব্যাপারে এরা বেজায় দক্ষ কিনা!”
শুনে, গোটা দলটা দেখি বেশ ভালোরকম চমকে উঠেছে। বুঝলাম ঠিক জায়গাটাতেই ঘা দিয়েছি। ব্যাপারটাকে একটু বিস্তারিত করয়ার জন্য বললাম, “এই যেমন ধরুন কোড়ার ঘা। আপনাদের ওই নরম পিঠগুলোর থেকে খাবলাখাবলা মাংস উঠে যাবে এক এক ঘায়ে—কিংবা ধরুন আঙুলের তলায় দড়ি বেঁধে ফুলে ওঠা আঙুলের মাথায় লাঠি দিয়ে পেটানো। অনেকে আবার আছে, থলের মধ্যে নানান বাজে জিনিস ভরে মাথার ওপর পরিয়ে দিয়ে তারপর পেটানো চালু করে। তবে সেসব হল বদমাশ সাহুকারদের জন্য। আপনারা তো আর সেরকম লোক নন, তাই বলছিলাম–”
এইবারে তারা আমায় ধরে একেবারে ঝুলোঝুলি শুরু করে দিল। বলে, “মীর সাহেব, একটা আন্দাজ অন্তত দিন, কত পেলে চিতু খুশি হয়ে যাবে। তাঁর সঙ্গে তো হাজারপাঁচেক লোক আছে বলে শুনেছি।”
বললাম, “উঁহু। লোক আছে দশ হাজারের কাছাকাছি। সে তো একটু পরে গোটা দলটা এসে পৌঁছোলে নিজের চোখেই দেখতে পাবেন। আমার মনে হয় চিতুর জন্য এক লাখ, তার তিন প্রধান সেনাপতি গফুর খান, হীরু আর রাজনের জন্য পঞ্চাশ হাজার করে, প্রত্যেক সর্দারের জন্য এক হাজার আর প্রত্যেক পিন্ডারিকে একশো করে দিলেই চলবে। কী? ঠিক বলছি তো?”
“হে ভগবান! সে তো প্রায় আট লাখ টাকা হয়ে যাবে। মরে যাব হুজুর। বিলকুল মরে যাব আমরা।”
“না না, মরবেন কেন? আমরা তো জানি অমরাবতী হায়দরাবাদের চেয়েও বেশি বড়লোকের জায়গা। টাকা তো এখানে শুনি লাখে নয়, কোটিতে হিসেব করা হয়। সেই নেমাওয়ার ছেড়ে বের হবার পর থেকে রোজগারপাতি হয়নি কিছুই, তার ওপর এতটা পথ পেরিয়ে চিতু তেতেপুড়ে আসবে! আমার মনে হয়, এইসব কথা তাকে শোনালে সে দশ হাজার লোক শহরে ছেড়ে দিয়ে বাড়ি বাড়ি ঢুকে যাচাই করিয়ে নেবে সত্যিসত্যি আপনাদের কাছে কত টাকা আছে। তার চেয়ে শুরুতেই একটা ভালোমত নজরানার প্রস্তাব দিয়ে দিন, চিতুর মেজাজ শরিফ হয়ে যাবে। তাতে আপনাদেরই লাভ।”
সর্দার তার দলের দিকে ফিরে বলল, “মীর সাহেব কথাটা ঠিকই বলেছেন। আমাদের মা মেয়েদের ইজ্জত বাঁচাতে হলে ওঁর কথাটা শোনাই ভালো বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু এত টাকা–”
বুঝলাম, একটু দর কষাকষি করবে এরা। মুখে বললাম, “বেশ, বেশ। এই তো বুদ্ধিমানের মত কথা বলেছেন। এইবারে শুনুন। চিতু খুব মানী মানুষ। তার সেনাপতিরাও তাই। আপনারা তাড়াতাড়ি পান আতর টাতর দিয়ে একটা থালা সাজিয়ে ফেলুন। আর হ্যাঁ, কটা ভালো শাল আনিয়ে নিন। চিতু এসে পৌঁছোনো মাত্র তাকে খাতির করে বসিয়ে পান, আতর দিয়ে, কাঁধে শাল জড়িয়ে অভ্যর্থনা করে সামনে নজরানা সাজিয়ে দেবেন। দেখবেন দশ লাখের জায়গায় আট লাখ টাকা দিয়েই পার পেয়ে যাবেন। শহরটাও বেঁচে যাবে।”
“নিশ্চয়,নিশ্চয় মীর সাহেব।আপনি না থাকলে আজ আমরা কী যে করতাম-”
“ওহো, আরেকটা কথা। চিতু এলে তার সামনে মুখ গোমড়া করে থাকবেন না যেন। বেশ হাসিখুশি একটা ভাব দেখাবেন, যেন সে এসে পায়ের ধুলো দেয়ায় আপনারা কৃতার্থ হয়ে গেছেন। যতক্ষণ না ভয় পাবার কোন কারণ দেখা দিচ্ছে ততক্ষণ ভয় প্রকাশ করবেন না।”
বলতে বলতেই একসাথে অনেক ঘোড়ার পায়ের শব্দ আর গাদাবন্দুকের গুলি ছোঁড়ার আওয়াজ আসতে বুঝলাম চিতুরা পৌঁছে গেছে। সাহুকারদের দেখি এত বোঝানো সত্ত্বেও ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেছে। ঠকঠক করে কাঁপছে সবাই। একটু পরেই সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে চিতু ঢুকতে সাহুকারদের দলটাকে নিয়ে আমি তার কাছে এগিয়ে গেলাম। সর্দার সাহুকার চিতুর ঘোড়ার জিনে কপাল ঠেকিয়ে বলল, “আসুন হুজুর। আরাম করুন। আপনার নজরানা তৈরি আছে।”
আমি তাদের সঙ্গে সঙ্গে সেই একই কথা বলে উঠতেই চিতু দেখি কান খাড়া করেছে। বলে, “চেনা গলা মনে হচ্ছে? কোন শয়তান রে?“
বললাম, “আমি, আমীর আলি হুজুর। আপনার দাসানুদাস।”
“সে কী হে মীরসাহেব? তুমি কি সাহুকার বনে গেলে নাকি? ব্যাপারটা কী?”
“না হুজুর। আমি এদের সঙ্গে মিলেমিশে আপনার অপেক্ষায় ছিলাম। এরা ভারি ভয় পেয়েছিল হুজুর। আমি এদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করেছি।”
“বেশ , বেশ। তা, সব তৈরি তো?”
“তৈরি হুজুর,” সব সাহুকার একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল।
সর্দার সাহুকার এইবারে চিতুকে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে কাছের একটা বাড়িতে নিয়ে গেল। সেখানে উজ্জ্বল আলো জ্বালানো একটা ঘরের ভেতর সাদা চাদর পাতা ছিল। তার ওপর রাখা একটা মসনদের ওপর বসানো হল চিতুকে। খাতির পেয়ে চিতুর ভয়ানক মুখটায় দেখি বেশ খুশি খুশি ভাব জেগেছে। পাশ ফিরে রাজনকে বলে, “লোকগুলো তো বেশ ভদ্র দেখছি। আমি তো এরকম খাতরদারি পাব ভাবিই নি। কী বলো?”
সে মাথা নেড়ে বলে, “আমিও ভাবিনি। ভবেছিলাম বেশ একটা যুদ্ধটুদ্ধ করে শহরে এসে ঢুকব। এ নিশ্চয় আমীর আলির হাতযশ।”
“হ্যাঁ, তাই হবে। নাহলে এই জন্তুগুলো যার যার বাড়ির দোর বন্ধ করে বসে থাকত এতক্ষণে। আমাদের গিয়ে টেনে টেনে বের করতে হত সব। তা ঠিক আছে। এখন দেখা যাক এরা কী বলে!”
সর্দার সাহুকার অমনি আমাকে একটা গুঁতো দিয়ে বলে, “চিতুকে যদি আমাদের প্রস্তাবে রাজি করাতে পারেন তাহলে আরো পাঁচশো টাকা পাবেন আপনি—না না, ওটা হাজারই ধরে নিন।”
“গাধার বাচ্চাগুলো তোমার সঙ্গে কী এত গুজুর ফুসুর করছে আমীর আলি? কথা বলে না কেন?” চিতুর গর্জন ভেসে এল হঠাৎ।
আমি বললাম, “খোদাবন্দ, আপনার সামনে ভয়ে মুখ খুলতে পারছে না এরা। আপনার উপযুক্ত নজরানাই এরা দেবে, কিন্তু আপনার প্রতাপ দেখে মুখ ফুটে সে বিষয়ে কিছু বলবার ক্ষমতা এদের চলে গেছে। এরা আমায় অনুরোধ করছিলো এদের হয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলতে।”
চিতুর মুখে একটা ঠান্ডা হাসি ফুটে উঠল। মনে মনে খুশি হয়েছে সে বোঝা যাচ্ছিল। বলে, “কবুল, কবুল। এখন নজরানা পেশ করা হোক। দেখি অমরাবতীর সাহুকারের নজরানা কেমন হয়।”
পনেরোটা ভেলভেটের ঢাকনা দেয়া থালা এনে নামিয়ে দেয়া হল চিতুর সামনে। ঢাকনা সরিয়ে দেখা গেল তার মধ্যে চারটেয় বোঝাই করা আছে খেজুর, মনক্কা, কাজু, পেস্তা আর নানাজাতের মিষ্টি। বাকি থালাগুলোতে অজস্র দামি দামি দেশি আর বিলিতি কাপড়ের স্তূপ। একেবারে রাজার নজরানা যাকে বলে। চিতু তো দেখে ভারি খুশি। আমি সর্দার সাহুকারকে একটা ঠেলা দিয়ে বললাম, “এইবারে মেজাজটা শরিফ হয়েছে। শাল আর আশরফিগুলো কোথায়?”
সাহুকার একজন কাজের লোকের হাত থেকে শাল নিয়ে তার ওপরে পাঁচটা আশরফি রেখে তাই নিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে তিনবার কুর্নিশ করে শালটা মেলে ধরল। চিতু তার থেকে আশরফিগুলো তুলে নিতে শালটা তার কাঁধে জড়িয়ে দিয়ে পিছিয়ে এসে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে রইল সাহুকার।
গফুর খানের দিকে ফিরে চিতু এইবার বলে, “লোকগুলোর বুদ্ধিশুদ্ধি আছে দেখছি। মানীর মান রাখতে জানে। তবে, আমায় খাতির করলেও তোমাদের তো কিছুই দিল না হে!”
“না প্রভু। ভুলিনি,” বলতে বলতে ফের একবার এগিয়ে গিয়ে সাহুকার তিন সেনাপতির কাঁধেও শাল জড়িয়ে দিল তাড়াতাড়ি।
চিতু এইবার হাঁক দিল, “এবারে ঘরটা তাড়াতাড়ি ফাঁকা করে দাও হে। এই ভদ্রলোকদের সঙ্গে এইবারে কাজের কথা বলা যাক। সেসব ঠিকভাবে মিটলে তখন খাওয়াদাওয়ার কথা ভাবা যাবে।”
সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য লোকেরা ঘর ছেড়ে চলে গেল। সাহুকারের দল এবার দেখি বাজপাখির মুখে পায়রার মত কাঁপছে। চিতু তাদের আঙুল নেড়ে ডাকল, “এইও, কাছে এসে আমাদের সঙ্গে বস। কথা বলা যাক।”
তারা এসে বসলে চিতু ফের বলল, “দেখো হে, আমার টাকা চাই। সেই নিতেই আসা। লোক আমরা সুবিধের নই। বাঁচতে চাইলে আমাদের খুশি করে দাও। চলে যাব। নইলে তোমাদের কপালে দুঃখ আছে। এইবার বল, কত দেবে বলে ঠিক করলে?”
সর্দার সাহুকার বলল, “খোদাবন্দ, আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষমতায় যতটুকু সাধ্যে কুলিয়েছে তা আপনাকে দেবার জন্য তৈরি করেই রাখা আছে। এই তালিকাটায় সেইসব লেখা আছে। যদি দয়া করে একবার দেখেন!” এই বলে ফার্সি ভাষায় লেখা একটা লম্বা কাগজ সে চিতুর হাতে তুলে দিল।
চিতু মাথা নেড়ে বলে “আরে আমি কি মুন্সি নাকি যে ওসব অংবং পড়ে ফেলব? ওসব আমার আসে না। এই তোরা কেউ পড়তে পারবি কী লিখেছে?” অমনি তার চারপাশ থেকে দলের সবাই মাথা নেড়ে বলে তারা কেউই পড়তে জানে না।
“একজন মুন্সিকে কি খবর দেব হুজুর?” এই বলে এক সাহুকার খুব বিনয়ের সঙ্গে চিতুর দিকে তাকাচ্ছিল। আমি তখন এগিয়ে এসে বললাম, “যদি অনুমতি করেন তাহলে আমি লেখাটা পড়ে শোনাতে পারি।”
চিতু অবাক হয়ে বলে, “সেকী? তুমি দেখছি সিপাহীর পাশাপাশি কেরানির কাজও জানো, অ্যাঁ?পড়ো পড়ো।”
কাগজটা হাতে নিয়ে তাতে চোখ বুলিয়ে আমি বললাম, “লিখছে,মহান চিতুর আগমনসংবাদ পাইয়া আমরা অমরাবতীর ব্যবসায়ীগণ সাধ্যমত নিম্নলিখিত তালিকা মুতাবেক যথাসম্ভব ধনসম্পদ আহরণ করিয়া হুজুরের সমীপে নজর বাবদ প্রস্তুত করিতেছি।”
“আরে ওসব ছেড়ে কাজের কথাটা বল দেখি তাড়াতাড়ি। আমার এখন ক্ষিধে পাচ্ছে। এনাদের বাড়ির মেয়েদের রান্না খাবার জন্য সেই কখন থেকে অপেক্ষায় আছি আমি!” চিতু অধৈর্য গলায় তাড়া দিচ্ছিল।
শুনে সাহুকার তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বলে, “খাবার তৈরি আছে প্রভু। তবে আমাদের হিন্দুদের সাদামাটা রান্না আপনাদের মুখে মোটেই স্বাদের ঠেকবে না। তাই সেরা বাবুর্চিদের এনে আপনাদের খাবার তৈরি করে রাখা হয়েছে।”
চিতু হুংকার দিয়ে উঠল, “চোপ। অনুমতি ছাড়া একটাও কথা নয়।” সাহুকার তাড়াতাড়ি চুপ করে গেল। এইবার তালিকাটা নিয়ে আমি পড়তে শুরু করলাম-
“আপনার জন্য পঞ্চাশ হাজার নগদ।”
চিরুর ভুরু কুঁচকে উঠল। বলে, “শুধু এই?”
“আজ্ঞে না হুজুর , আরো আছে,” বলে আমি ফের পড়তে লাগলাম, “পনেরো হাজার টাকার দামি পাথর, আর দশ হাজার টাকা মূল্যের তিন থালা ভর্তি শাল ও বেনারসী জরির কাপড় প্রভুর মহলের জন্য। সব মিলিয়ে পঁচাত্তর হাজার টাকা। প্রত্যেক সেনাপতির জন্য দশ হাজার করে নগদ টাকা, পাঁচ হাজার টাকার দামি পাথর ও পাঁচ হাজার টাকার দামি কাপড়, সব মিলিয়ে প্রত্যেকের কুড়ি হাজার টাকা।”
“বলে যাও, বলে যাও–” চিতু উৎসাহ দিচ্ছিল।
“ত্রিশজন সর্দারের প্রত্যেকের জন্য এক হাজার টাকা করে মোট ত্রিশ হাজার টাকা।”
“ভালো। আর?”
“প্রত্যেক সৈনিকের জন্য পঞ্চাশ টাকা করে। শুনেছি সব মিলিয়ে চার হাজার অতিথি এসেছেন। এছাড়া যতদিন শহরে থাকবেন ততদিন প্রভুদের খাওয়াদাওয়া, থাকা, ঘোড়ার দানা সবকিছুর খরচ শহরবাসী বহন করবে। সব মিলিয়ে এই হল এঁদের প্রস্তাব। প্রভু কী বলেন?”
“প্রস্তাব তো ভালোই। কিন্তু হিসেবে ভুল আছে একটু। সর্দার আমাদের দলে পঞ্চাশজন, তাই না গফুর খান? তাছাড়া সৈন্যও তো আছে মোট পাঁচ হাজার। কী? তাইতো?”
কথাটা অবশ্য সর্বৈব মিথ্যে। কিন্তু সে কথা বলে লাভ নেই কোন, উলটে লোকসান। কাজেই আমি তাড়াতাড়ি বললাম, “আমি তো সে কথা এঁদের আগেই বলেছিলাম খোদাবন্দ।”
“ঠিক আছে। হিসেবটা তাহলে নতুন করে কষে দেখ তো, ঠিক কত পাচ্ছি?”
আমি হিসেবটিসেব করে বললাম, “আজ্ঞে, তিন লাখ পঁচাশি হাজার।”
“হুম। গফুর খান, ঘোড়াগুলোর নাল সব পাল্টাতে হবে, তাই না। ওই বাবদ আরো পনেরো হাজার ধরে দাও হে মীরসাহেব! সব মিলিয়ে চার লাখ হয়ে যাবে তাহলে। আর শোন হে সবাই। যত তাড়াতাড়ি পারো টাকাটা এনে ধরে দাও নইলে আমাদের হাত লাগাতে হলে আবার–”
সাহুকাররা নিজেদের মধ্যে খানিক আলাপ আলোচনা করবার পর সর্দার সাহুকার উঠে হাত জোড় করে বলে “আমরা রাজি হুজুর।। টাকা আসছে।”
“ভালো। এইবার খাবারের জোগাড় করো হে। আর শোন, সব সর্দারকে কাল সকালে এই বাড়িতে এসে তাদের ভাগের টাকা আর যার যার দলের পিন্ডারিদের নিয়ে যেতে।”
সবাই ঘর ছেড়ে বের হয়ে যাচ্ছি এমন সময় চিতু আমায় ডাকল, “এসো হে, আজ তুমি আমার সঙ্গে খাবে।”
খাওয়াদাওয়ার আয়োজন ভালোই করা হয়েছিলো। সে’সব সেরে তামাক টানতে টানতে চিতু জিজ্ঞাসা করল, “এসব করলে কেমন করে?”
আমি তখন সব কথা ভেঙে বললাম। শুধু আমার হিস্যার পরিমাণটা আর তাকে বললাম না। বললে তার অর্ধেকটা চিতু নিঃসন্দেহে বাগিয়ে নিত আমার থেকে। সব কথা শুনে চিতু হেসে বলে, “মীর সাহেব তোমার বুদ্ধিতে আমি পঁচাত্তর হাজার টাকা পেলাম, আর বাকি টাকা থেকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে আরো পঁচিশ হাজার তো পাবই। একুনে হল গিয়ে এক লাখ। শুরুটা মন্দ নয় , কী বলো? তা এসব করবার জন্য পেলে কত?”
“বেশি নয় হুজুর। সেনাপতিদের সমান ভাগ চাইতেই পারতাম, কিন্তু সেসব কিছু করিনি। আমি পেয়েছি পাঁচ হাজার।আমি খুশি।”
“উঁহু। বড্ডো কমে খুশি হয়েছো হে মীরসাহেব। এর পর থেকে কথাটা খেয়াল রেখো। যতটা পারবে নিজের জন্য তুলে নেবে। যাই হোক, এখন থেকে খোঁজারু দলটা সবসময় তুমিই আগে আগে নিয়ে চলবে। গফুর খান একটু বিরক্ত হবে। কিন্তু সে আমি সামলে নেবো। ভালো সেপাই বটে লোকটা, কিন্তু মাথামোটা। লোক মেরে আর আগুন জ্বালিয়ে কাজ উদ্ধার করতে চায় কেবল। তার বদলে একটু বুদ্ধি করে মিষ্টি কথায় যে ওর থেকে অনেক বেশি টাকা আদায় করা যায় সে কথা ওর মাথায় ঢুকলে তো!”
আমি মাথা নিচু করে বললাম, “আপনার জয় হোক হুজুর। এই বান্দা আপনাকে যথাসাধ্য সেবা করবে।”
চিতুর কাছ থেকে বাইরে এসে দেখি সাহুকাররা দল বেঁধে বসে টাকা গুণে চলেছে। আমায় দেখে তারা খুব খুশি। তক্ষুণি আমার বিকেলের সেই দশ হাজার টাকা মিটিয়ে দিতে চাইছিল তারা। সঙ্গে আরো হাজার টাকা অত্তিরিক্ত। আমি বললাম, “টাকা নয়, আমার পাওনা টাকা আমায় সোনায় দাও। নিতে সুবিধে হবে। শুধু দু একশো টাকা খুচরো দিও পথখরচের জন্য।”
তারা এক কথায় রাজি। একটুক্ষণের মধ্যেই সোনা এসে গেল। ঘোড়ার জিনের মধ্যে সেলাই করা থলেতে সেই সোনা ভরে নিয়ে আমি ফিরে গেলাম।
ডেরায় ফিরতে সব শুনে পীর খান বলে, “এইরকম চললে যখন বাড়ি ফিরব ততদিনে একশোটা ঠগি অভিযানের টাকা সঙ্গে নিয়ে ফিরব মনে হচ্ছে মীর সাহেব। আমার আর মোতিরামের আরো কিছু রোজগার হয়েছে জানো তো? আমরা তো তোমার কাছেপিঠেই ঘুরঘুর করি। তাই তোমায় তাদের প্রস্তাবে রাজি করাবার জন্য বিকেলবেলা ঘুষ হিসেবে আমাদের আরো কিছু টাকা দিয়েছে সাহুকাররা।ব্যাটারা ভেবেছে আমরাও দলের সর্দার বুঝি।”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “একটু ভালো করে লড়াইটড়াই করো, ঘোড়াগুলোকে ভালো অবস্থায় রাখ, দেখবে চিতুর নজরে একবার পড়ে গেলে সত্যি সত্যি সর্দার হতেও দেরি হবে না বিশেষ।”
সকালে সাহুকাররা টাকাপয়সা সব নিয়ে এলে সেসব সুষ্ঠুভাবে ভাগযোগ করে দেবার পর আমরা ফের শহর ছেড়ে রওনা হয়ে গেলাম। সাহুকারদের ভালো ব্যবহারের জন্য চিতু তাদের কথা দিয়ে এলো যে ভবিষ্যতে আর কখনো আমরা অমরাবতীকে বিরক্ত করব না। সেই কথা চিতু রেখেওছিল। তাছাড়া এই অভিযানের পর অমরাবতীতে সৈন্যের সংখ্যাও অনেক বাড়িয়ে দেয়া হয় রাজসরকারের থেকে। সেটাও চিতুর কথা রাখবার আরেকটা কারণ হতে পারে।
এবার ফের শুরু হল আমার খোঁজারু দলটাকে নিয়ে ঝড়ের বেগে সামনে ছুটে যাওয়া। পথে যেসব গ্রাম পাওয়া যাচ্ছিল সেগুলো যথেচ্ছ লুটপাট করে সঙ্গের মালবাহী উটের পিঠে লুটের মাল চাপিয়ে ফের ছুটতাম আমরা। পেছনের মূল দলটা এসে সেসব জায়গায় বিশেষ কিছু না পেয়ে গ্রামকে গ্রাম জ্বালাতে জ্বালাতে আসত।
পথে করিঞ্জা শহরে একটু বাধা এসেছিল। সেখানে ছোট একটা সৈন্যের দল রুখে দাঁড়িয়েছিল আমাদের সামনে। তাদের মেরে তাড়াতে বেশি সময় লাগল না। তারপর শহরটাকে শিক্ষা দেবার জন্য পিন্ডারিদের লেলিয়ে দেয়া হল। সে এক মর্মবিদারী দৃশ্য। গোটা এলাকাটা দাউ দাউ করে জ্বলছে, আর তার মধ্যে দিয়ে একযোগে অনেক লোকের মরণ চিৎকার ভেসে আসছে , আর তার সঙ্গে সঙ্গে পিন্ডারিদের উৎকট উল্লাসের শব্দ। সবচেয়ে কষ্ট হচ্ছিল আমার মেয়েদের তীক্ষ্ণ আর্তনাদের শব্দ শুনে। আমরা ঠগিরা এইরকম নারকীয় কাজকর্ম করতে অভ্যস্ত নই। কিন্তু এদের বাধা দিতে যাওয়াও আত্মহত্যারই সামিল হত সেই মুহূর্তে। তাই আমি আর আমার ঠগি বন্ধুরা ছোট একটা দল করে আমাদের ঘাঁটিতে বসে বসে সেই ধ্বংসলীলা দেখছিলাম, এমন সময় একেবারে কাছাকাছি একটা বাচ্চা মেয়ের চিৎকারের শব্দ শুনে বাইরে বের হয়ে এলাম আমি। দেখি গফুর খান একটা কমবয়েসি মেয়েকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসছে। তার মুখটা চকচক করছিলো। আমায় দেখে সে চেঁচিয়ে বলে, “মীর সাহেব, এই দেখ কেমন শিকার পেয়েছি দেখেছ? একেবারে বেহেস্তের পরীর মত রূপ। তাই না? এর বোকা মা টা বাধা দিতে গিয়েছিল। তলোয়ারের একটা খোঁচায় সেটাকে নিকেশ করে দিয়েছি হা হা। কীগো মেয়ে, গফুর খানকে পছন্দ না?”
গফুর খান সাবধান ছিল না। তাকে আমি সেইখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই মেরে ফেলতে পারতাম, কিন্তু তলোয়ারটা অর্ধেক বের করেও আমি ফের সেটাকে ঢুকিয়ে দিলাম। মনেমনে আমি তার শাস্তির কথা তখন ভেবে নিয়েছি। লাভ নেই জেনেও বেশ কয়েকবার তাকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম আমি যাতে মেয়েটাকে সে ছেড়ে দেয়। কিন্তু সে শুধু আমার মুখের ওপর হাসল খানিকটা, তারপর মেয়েটাকে টানতে টানতে ফের নিয়ে চলে গেল।
বেচারি মেয়েটা ব্রাহ্মণের ঘরের মেয়ে ছিল। সেদিনের পরে তার সমাজ আর তাকে ছুঁয়েও দেখত না। কিন্তু সে অসম্মানের হাত থেকে সে বেঁচে গিয়েছিল সেদিন। পরদিন সকালে গফুর খান আমায় হাসতে হাসতে বলেছিল, মেয়েটা নাকি তার কোমর থেকে ছুরিটা টানতে গেছিল নিজের বুকেই বসাবে বলে। মেয়েটার হয়ে সে কাজটা গফুর খানই করে দিয়েছে। “মেয়েটার খাটুনি বাঁচিয়ে দিলাম,কী বলো,” এই বলে সে আমার দিকে তাকিয়ে ফের হেসেছিল খানিকক্ষণ।
সেদিন গোটা রাতটাই সেই শহরের মা-মেয়েদের আর্তনাদে বাতাস ভারি হয়ে থেকেছিলো। গোটা রাতটা ধরেই আমি বারবার ভেবেছিলাম এই নরপিশাচদের সঙ্গ ছেড়ে ফিরে যাব নিজের বাড়িতে। কিন্তু তারপরেই মনে হয়েছিল, পেছনদিকে গ্রামশহরের লোকজন এখন পিন্ডারিদের ওপর ভয়ানক রেগে রয়েছে। কয়েকটা লোককে একত্রে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঘোড়ায় করে ফিরতে দেখলে তাদের তারা পিন্ডারি বলে ধরে নেবে। প্রাণে বাঁচবার আশা থাকবে না আর তাহলে। সেই ভয়ের পাশাপাশি আবার ছিল নতুন নতুন অভিযানের উন্মাদনা। কাজেই চিতুর দল ছেড়ে চলে যাওয়া আর হল না আমাদের।
সকালে সেই দুর্ভাগা শহরের ছাই পেছনে ফেলে আমরা ফের এগিয়ে চললাম। কিছুদূর এসে মুংলুর শহর ছাড়িয়ে হঠাৎ দেখি আমার প্রথম শিকারটা করেছিলাম যেখানে সেই জায়গাটার পাশ দিয়ে চলেছি। নদীটার ধারে হালকা ঝোপঝাড়। তার মধ্যে একটা সামান্য উঁচু হয়ে থাকা জায়গার দিকে ইশারায় একবার দেখালো পীর খান। ওইখানে আমার মারা সেই সাহুকারের ভিলটা রয়েছে।
সে জায়গা ছাড়িয়ে আমরা একেবারে বেসিম-এ এসে থামলাম। ভয় হচ্ছিল এখানেও না ফের না গতরাতের মত তান্ডব শুরু করে পিন্ডারিরা। কিন্তু দেখা গেল এখান তারা বেশি লাফঝাঁপ করল না আর। এ শহরে লোকজন আগে থেকেই বেশ মোটা একটা নজরানা তৈরি রেখেছিল বলে কোন সমস্যা তৈরি হয়নি আর।
এখান থেকে বের হয়ে পাঁচদিনের রাস্তা পার হয়ে আমরা গিয়ে পৌঁছোলাম গোদাবরী নদীর ধারে নান্দের-এ। ভেবেছিলাম, এখানকার রইস লোকজন আগে থেকে খবর পেয়ে পালিয়ে গিয়ে থাকবে। কিন্তু পৌঁছে অবাক হয়ে দেখি তারা আমাদের কোন খবরই জানে না। শহরে পাহারা টাহারাও বিশেষ ছিল না। সৈন্য যে কজন ছিল তারা আমাদের আসতেই পালিয়ে গিয়ে একটা পুরনো দুর্গে ঢুকে দরজা বন্ধ করে লুকিয়ে বসে ছিল। সেদিকে এগোলেই ভেতর থেকে তারা গাদাবন্দুক দিয়ে দু একটা গুলি ছুঁড়ছিল শুধু। আমরা তাদের বিরক্ত না করে শহর থেকে যতটা পারা যায় টাকাপয়সা তুলে নেবার কাজে লাগলাম।
চেষ্টাচরিত্র করে সেখান থেকে প্রায় লাখ দেড়েক টাকা ওঠানো গেল। আমার নিজের রোজগার হল হাজারতিনেক টাকা আর কিছু দামি পাথর। শহরটার বিশেষ ক্ষতি আমরা করলাম না। আসলে ক্ষতি করতে চাইলেও সেটা সহজ হত না। তার প্রত্যেকটা বাড়িরই দেয়াল ছিল পাথরের তৈরি। তবে শহরটা বেঁচে গেলেও শহরতলির লোকজনের কিন্তু ঘরবাড়ি পুড়ল অনেক। বিশেষ করা তাঁতীদের বাড়ি। এ অঞ্চলের তাঁতের কাজ খুব বিখ্যাত। ফলে তাঁতীদের ওপরেই আমাদের নজরটা বেশি করে পড়েছিল। তাতে ফলও হল খুব ভালো। পরদিন দলের অর্ধেকের বেশি লোক দেখা গেল নতুন পাগড়ি আর কোমরবন্ধ পরে ঘোরাফেরা করছে।
নদী পাড় হতে গিয়ে দেখা গেল মাত্র একখানা নৌকো রয়েছে। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল কাছেই গুঙ্গা খের বলে একটা জায়গায় নৌকোটৌকো পাওয়া যাবে। সেখানে গিয়ে নৌকোয় করে লুটের মালপত্র ওপারে পাঠিয়ে লোকজন যার যার ঘোড়া নিয়ে জল পেরিয়ে উল্টোপাড়ে গিয়ে উঠল। সেখানে যে শহরটা তার শখানেক লোক মিলে আমাদের বাধা দেবার জোর চেষ্টা করে হার মানল। তাতে আমাদের কয়েকটা লোক মারা গেল। আমার পায়েও একটা বুলেট লাগতে আমি আর সে শহরের লুটপাটে অংশ নিতে পারিনি। তবে মোতিরাম আর পীর খান অবশ্য ভালোই জিনিসপত্র জুটিয়ে এনেছিল। সেখান থেকে বের হয়ে একে একে বিদর, ভালকি লুট করে আমরা পৌঁছোলাম হুমনাবাদে। হুমনাবাদ লুট করবার পর আমি শ’তিনেক লোকের একটা দল নিয়ে কয়েক ক্রোশ দূরের কুলিয়ানি শহরে গিয়ে উঠলাম। জায়গাটা সমৃদ্ধিতে একেবারে দ্বিতীয় অমরাবতী। কিন্তু সেখানকার সাহুকাররা সব আগে থেকেই খবর পেয়ে শহরের দুর্গে গিয়ে লুকিয়েছে। ফলে বড় শিকারগুলো হাতছাড়া হয়ে গেলেও বাকি শহরটা লুটপাট করে একদিন পরে আমি আবার মূল দলে ফিরে এলাম। এখান থেকে একটা গিরিখাত ধরে পাহাড় পেরিয়ে চিঞ্চোলি গ্রাম লুট করে আমরা সটান দক্ষিণ দিকে ছুটলাম। পথে ছোট ছোট অনেক জনপদ লুটতে লুটতে অবশেষে আমরা এসে পৌঁছোলাম কৃষ্ণা নদীর পাড়ে। ঠিক হল এখানে কদিন বিশ্রাম নেয়া হবে। দলের সবার হাতেই তখন মোটারকম টাকাপয়সা জমেছে। অতএব খাঁটি পিন্ডারি কায়দায় আনন্দ-ফুর্তি চলল কদিন ধরে। এলাকার যত নাচনেওয়ালি ছিল সবগুলোকে ধরে এনে নাচগান,খানাপিনা চলল কদিন। তাদের ওপর আমরা কোন অত্যাচার করিনি অবশ্য। উলটে আমরা ফের রওনা হবার সময় মোটা পুরস্কার পেয়ে তারা সবাই খানিক আফশোসই করল আমাদের সঙ্গে যেতে পারছে না বলে।
এই কয়েকদিন থেমে যাওয়াটা চিতুর একটা বড় ভুল হয়েছিল। আমাদের আসবার খবর তখন হাওয়ার আগে ছড়াচ্ছে। কাজেই গুলবর্গা পৌঁছে দেখি সেখানে বড়োসড়ো একটা সৈন্যদল আমাদের অভ্যর্থনার জন্য অপেক্ষা করছে। ফলে সে এলাকার শোলাপুর বারসি আর ওয়াইরাগ শহরের আশা ছেড়ে আমাদের ভীর, পৈথান আর ঔরঙ্গাবাদের দিকে এগিয়ে যেতে হল।
তবে আমি কিন্তু ভীর আর ওয়াইরাগের আশা পুরোপুরি ছাড়িনি তখনো। চিতুকে গিয়ে বললাম, একটা ছোট দল আমায় দিতে। গফুর খানের তাতে বেজায় আপত্তি থাকলেও চিতু আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। শ তিনেক লোকের একটা দল জুটে গেল আমার। তাদের নিয়ে আলুন্দ শহরের কাছে মূল দলটাকে ছেড়ে তোলাজপুরের দিকে ছুটলাম। তোলাজপুর এমনিতে বিশেষ ধনী শহর নয়। কিন্তু সেখানকার ভবানীমন্দির বেশ নামকরা তীর্থস্থান। তার ব্রাহ্মণ পুরুতদের হাতে সোনাদানার লেখাজোখা নেই। কিন্তু আমার দলের বেশির ভাগই হিন্দু। মন্দিরে তারা প্রাণ থাকতেও হাত দেবে না। ফলে সেযাত্রা শহর থেকে হাজারকয়েক টাকার বন্দোবস্ত করেই ফিরতে হল আমাদের।
আমাদের পরের লক্ষ্য ছিল ওয়াইরাগ। এইখানে ভাগ্য আমাদের সহায় হল।ওই সময় একদল মারাঠি সৈনিক কাছাকাছিই কোথাও ছিল। আমরা শহরের কাছে আসতে আমাদের তারা সেই মারাঠি সৈনিকের দল বলে ধরে নিয়ে আদর অরে ডেকে নিয়ে গেল শহরের ভেতরে। লুটপাট করে বেশ ভালোরকম টাকাপয়সা জুটল আমাদের এখান থেকে। আমার ইচ্ছে ছিল এখানেও একটু আলাপ আলোচনা করে টাকাপয়সার জোগাড় করব। কিন্তু সময়ের অভাবে সে আর করা গেল না। কারণ, শহরে ঢোকবার পরে খবর জোগাড় করে দেখা গেল, সেই মারাঠা সৈনিকের দলটা তখন বারসিতে বসে আছে। এই বারসি হয়েই ফিরব ঠিক করে রেখেছিলাম। কাজেই সেটা আর হবে না। পুরেনদা হয়েও ফেরা যেত, কিন্তু সেখানে নিজামের একদল সৈন্য রয়েছে তখন। কাজেই সে পথও বন্ধ। ফিরে যাবার একটামাত্র পথ ছিল। যে পথে এসেছি সেই পথে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফের তোলাজপুর ফিরে গিয়ে মূল দলটার পেছন ধরা। কাজেই ওয়াইরাগে আলাপ আলোচনা করে টাকা আদায়ের সময় ছিল না আমার। তবে হ্যাঁ, লুটপাট করলেও শহরের লোকজন সহযোগিতা করবার ফলে খুনখারাপি বা আগুন টাগুন লাগাবার দরকার পড়েনি। কাজকর্ম শেষ করে ঘন্টাকয়েক বিশ্রাম করে নিয়ে আমরা ফের দৌড় শুরু করলাম তোলাজপুরের দিকে। অন্যেরা সবাই ঘোড়াদের দৌড় করাবার জন্য আফিং খাইয়ে দিয়েছিল এক দলা করে। আমার ঘোড়াটা অবশ্য তেজি ছিল খুব। তাকে সে সব করাবার কোন দরকার পড়েনি।
তোলাজপুর পৌঁছে একদিন বিশ্রাম নিয়ে আমরা ভীর-এ পৌঁছে মূল দলটার নাগাল ধরে নিলাম। সেখানে চিতুর খোলা দরবারে গিয়ে আমার ওয়াইরাগ লুটের ভাগ হিসেবে তাকে নগদে আর দামি পাথরে দশ দশ বিশ হাজার টাকার নজরানা দিয়ে পুরষ্কার হিসেবে পেলাম একটা রাজসিক পোশাক আর চিতুর আস্তাবল থেকে একটা দামি ঘোড়া।
ক্রমশ