সুজয় রায় -এর সব লেখা একত্রে
দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮৪২ সালে নিজস্ব জাহাজ ‘ইণ্ডিয়া ‘-তে ইংল্যাণ্ডের উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন সঙ্গীসাথী সহ। সঙ্গে ছিলেন নিজস্ব চিকিৎসক McGowan , তিনজন হিন্দু চাকর ও একজন মুসলমান বাবুর্চি। এছাড়াও সে যাত্রায় ছিলেন কলকাতার চিফ জাস্টিস এডহার্ড রেয়ান।
যাওয়ার পথে মুগ্ধ হয়ে দেখে নিলেন মিশরের পিরামিড, মাল্টার জগদ্বিখ্যাত গির্জা। ইতালির প্রাসাদ আর শিল্পগরিমা দেখে হতবাক হন। ভ্যাটিকানে পোপের সঙ্গে হয় সাক্ষৎকার। ঠাকুর পরিবারে তিনি প্রথম গেলেন সেন্ট পিটার ব্যাসিলিকা, সিস্টিন চ্যাপেল, মাইকেল এঞ্জেলোর ফ্রেস্কো প্রত্যক্ষ করতে।
ঘোড়ায় টানা কোচে যেতে দেখা গেল জার্মানি ও বেলজিয়মের হরিৎ প্রান্তর যেন পটে আঁকা গ্রাম ও শহর। প্যারিসে যাওয়ার পথে Naples- এ প্রথম ষ্টিম ইঞ্জিন দেখে ভবিষ্যতে ভারতে রেল চালানোর স্বপ্ন মানসপটে এল তাঁর।
লণ্ডনে বাস করার সময় প্রথম চার মাস হল তাঁর নানান পার্টি, মেলামেশা, ভাষণ। রবার্ট পীল, লর্ড ফিটজারল্যাণ্ড, ডিউক অফ ওয়েলিংটন, প্রিন্স আ্যলবার্ট, ডাচেস ওফ কেন্ট ইত্যাদি নেতাদের সঙ্গে দারকানাথের নিত্য মেলামেশা ছিল। রানি ভিক্টোরিয়া তাঁকে প্রাসাদে রাতে আহারে আমন্ত্রণ জানালেন। সে কালে এক বাঙালি ব্রাহ্মণের বাকিংহাম প্রাসাদে ভোজ খাওয়া ছিল এক অভাবনীয় ঘটনা।

ক্যারোলিন নর্টন
রানির সঙ্গে ভারতের নানা ব্যাপারে নিভৃতে পরামর্শ করে তাঁকে প্রভাবিত করেছিলেন। রানির একান্ত সচিবের সঙ্গে হলো তাঁর প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। এই সময় টেমস নদীতে বিরাট স্টিমার ভাড়া করে মহিলা কবি ক্যারোলিন নর্টনের তত্ত্বাবধানে এক পার্টি দেন। নর্টন ছিলেন বিদুষী নারী। সমাজের খ্যাতিমান বহু মানুষ ও কেষ্ট-বিষ্টুরা সেদিন আমন্ত্রিত ছিলেন। স্বনামধন্য চার্লস ডিকেন্স ও থ্যাকারেও বাদ পড়েননি। বিলেত থেকে এক স্থপতি দেশে আনিয়ে এক বৈঠকখানা বাড়ি প্রস্তুত করিয়ে পরবর্তী সময় সেখানেই বাস করতে লাগলেন। ছয় নং ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে তাঁর আগেই সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
দ্বারকানাথের দ্বিতীয়বার সমুদ্রযাত্রা
১৮৪৫ সালে কলকাতার চাঁদপাল ঘাট থেকে দ্বারকানাথ দ্বিতীয়বার ইংল্যান্ড যাত্রা করলেন। তাঁর এবার যাত্রার পেছনে দুই দেশের মধ্যে নব নব বাণিজ্যিক পরিকল্পনা ছিল। রাজকিয় গরিমাও এবার বেশি ছিল। এবার সফরে তিনি মিশরে পাশা মহম্মদ আলির অতিথি হন। দুজনে লোহিত সাগরের উপকুল থেকে ভূমধ্যসাগরের উপকুল পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন। রূপায়ণ হলে ইউরোপের সঙ্গে ভারত তথা প্রাচ্য দেশগুলির যোগাযোগ সহজ ও দ্রুত হতে পারে, আমদানি-রপ্তানির প্রসার হবে। এর থেকে আয় তাঁদের দুজনের কোম্পানির মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে নেওয়া হবে।
মিশরে পাশা লাল ভেলভেটে মোড়া রাজকীয় ঘোড়া ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন, আর সঙ্গে দিয়েছিলেন রাজপুত্র ইব্রাহিমকে মিশরের আশেপাশের জায়গা পরিদর্শন করানোর জন্য।
সেখান থেকে অন্য এক জলযানে মাল্টা হয়ে পৌঁছলেন ফ্রান্সের Marsailles বন্দরে। সেখান থেকে কোচে প্যারিস যাওয়ার পথে Bordeaux-তে সুবিখ্যাত সুরা তৈরির কারখানায় বসে নিজস্ব
‘Car-Tagore Company’-র সুরা আনিয়ে পান করান। এরপর প্যারিস সহরে সাতদিন বিশ্রাম নিয়ে লণ্ডনে পৌছলেন।
লণ্ডনে ১৮৪৫ ডিসেন্বর মাসে প্রচণ্ড শীত পড়ল। সহ্য করতে না পেরে তিনি ফিরে গেলেন প্যারিসে। দ্বারকানাথের যাত্রাপথে এবার অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি। এই সময়ে প্যারিসে থাকতেন সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত জার্মান মনীষী ম্যাক্সমুলার। তখন তিনি জার্মান ভাষায় ঋগ্বেদের অনুবাদে ব্যস্ত। অল্প সময়ের মধ্যে দুজনের মধ্যে বিশেষ প্রীতির সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
এক বিরাট অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। সেখানে ফ্রান্সের প্রথম সারির বহু চিন্তাবিদ,লেখক, শিল্পী, রাজনৈতিক নেতারা আমন্ত্রিত ছিলেন। … সাহেব বিবি গোলাম। সভায় উপস্থিত নির্বিশেষে সকল মহিলাকে আপনার হাতে দ্বারকানাথ উপহার তুলে দিলেন কাশ্মীরী জামিয়ার ও মণিমুক্তা।
কিন্তু অচিরে দ্বারকানাথের জীবনে মৃত্যুর যবনিকা নেমে এল। ১৮৪৬ সালে ৩১ জুলাই মাস, গভীর দুর্যোগের কালরাত্রি। মহানিশায় প্রয়াত হলেন Friend of the British Empire। চোখে তাঁর বড় সাধের স্বপ্ন ভারতের শিল্প জাগরণ। দূর প্রবাসে সাইডার গাছের ছায়ায় তাঁর দেহের সমাধির মুহুর্তে কোনো শাস্ত্রীয় মন্ত্র উচ্চারিত হল না। স্বদেশে যিনি ছিলেন ব্রাম্মধর্মের পুরোধা। সেই কেনসিল-গ্রীন-এ দ্বারকানাথ ও ব্রিস্টলে সমাধিতে রামমোহন, ভারতের রেনেশাঁসের দুই অগ্রদূত সমাধিস্থ হয়ে আছেন, এঁরা পূর্ব পশ্চিমের বিজ্ঞান ভিত্তিক মেলবন্ধন করতে ছিলেন একনিষ্ঠ প্রয়াসী।
জয়ঢাকের টাইম মেশিন সব লেখা একত্রে