ভারত ভ্রমণ-দীন মহম্মদ-আগের পর্বগুলো
পত্র ২৭
পান খাওয়াটা আপনি ভারতের সর্বত্র দেখতে পাবেন। আর এর বর্ণনাটাও আপনার কাছে মোটেই নীরস ঠেকবে না। পান গাছ, আঙুরের মতোই লতানে। যেমন আঙুরের চাষ হয়, অমনিই পানের বরজ। পাতাগুলো লেবুপাতার মতোই, লম্বা তন্তু, কিন্তু দুপ্রান্ত লেবুর চেয়ে লম্বাটে আর সরু মতো। পানপাতা, চুন এবং সুপারি সহযোগে খাওয়া হয়। সুপারি একেবারে জায়ফলের মতোই, শুধু ওর চেয়ে শক্ত। ভেতরের দিকটা লাল সাদায় মার্বেলগুলির মতো দাগ কাটা। একে পানে মুড়ে খাওয়া হয়। চুন আর কিছুই না পোড়া চুনাপাথর, ভালোজাতের ঝিনুকের খোল পুড়িয়ে বানানো। চুন সুপারি পান এর সঙ্গে কখোনো সাধ করে, কাচুন্দা, খয়ের জাতীয় দ্রব্য ব্যবহার করা হয়, সুগন্ধি মশলার সংগে পুরো ব্যাপারটা বেশ খোলতাই হয়। শুরুতে চিবোনোর সময় চকের গুঁড়োর মতো লাগলেও ক্রমে সারা মুখে চমৎকার স্বাদগন্ধে ভরে তোলে। আরেকটা কালো দানা দানা সুগন্ধি জিনিস ব্যবহার করা হয়, কাটচু(খয়ের)। আলাদা ভাবে এই জিনিসটা খুবই উত্তেজক, আর এশিয়ায় এটা মোটেও ছোটোখাটো, তুচ্ছ জিনিস নয়।
তো, পান খাওয়াটা একটা রীতির মত। এবং প্রায় সকলেই, সব স্তরের লোকেরাই পানাসক্ত। আর সত্যি বলতে গেলে, ভদ্রবংশীয়রা পান দিয়ে আপ্যায়ন না করলে বা প্রত্যাখ্যান করে উঠে চলে এলে তীব্র অপমান বলে গণ্য করেন। উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সামনে পান মুখে ছাড়া কথাই বলা যায় না। আর সমান সমান ব্যক্তি একে অন্যেকে পান দিয়ে সৌজন্য না দেখালে চরম অভদ্রতা গণ্য হয়।
নর্তকীরাও পান খেয়ে থাকেন। মুখের সুগন্ধি ও ঠোঁটের রঙের জন্য। খাওয়দাওয়ার পর, সৌজন্য সাক্ষাত, আলোচনা সভা, সমাবেশ কিংবা বিদায়ী সম্বর্ধনা – পান থাকবেই। আর বেশিরভাগ লোকই একমত যে পানের রস পেট শুধু ভালো রাখে তাই না, দাঁত ও মাড়িরও সুরক্ষা দেয়। তামাকের সাথে মিশিয়ে ধূমপানের ব্যাপারটা অবশ্য কেবল নবাব বা অভিজাতদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
দেশের অনেক জায়গাতেই আবহাওয়া এবং মাটির চরিত্র তামাকচাষের উপযুক্ত। খুব ভালো জাতের তামাক উৎপাদনের জন্য যেখানে বীজ বোনা হবে সেখানে মাটিতে ভিজে ভাব দরকার। তারপর তাকে যত্ন করে চাষ দিয়ে বাড়িয়ে তুলতে হয়।
আখের ক্ষেতে হাজার হাজার দেশীয় শ্রমিক কাজ করে । সেখানেও শ্রমিকদের মাথার ওপরে গনগনে সূর্যের প্রখর তাপ তাদের নিংড়ে নেবার পক্ষে যথেষ্ট। আখগাছ মোটামুটি পাঁচ ছ ফুট লম্বা, আধ ইঞ্চি মোটা, কান্ডের ওপর একফুট ছাড়া ছাড়া পরপর গাঁট থাকে। একদম ডগায় লম্বা লম্বা পাতা আর সাদা রঙের ফুল জন্মায়। পুরুষ্টু হলে আখের কান্ড রসে পূর্ণ হয়ে ওঠে (এ থেকেই চিনি প্রস্তুত হয়) আর তখন আখ কেটে বান্ডিল বেঁধে মিলে চালান দেওয়া হয়। সেখানে ছোটো ছোট টুকরোয় কেটে বিরাট বিরাট পাত্রে ইস্পাত লাগানো কাঠের পেষাই যন্ত্রে ঘোরানো হয়। হয় মানুষের হাতে টানা প্রক্রিয়ায় বা বলদ দিয়ে ওই পেষাইকল ঘোরানো হয়ে থাকে। এভাবেই ঘন রস প্রস্তুত হয় ও পাইপ বাহিত হয়ে আরেকটা বড় পাত্রে এসে পড়ে। ঘন রসটাকে ঢিমে আঁচে তামার পাতের ওপর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় যথেষ্ট গরম করে তোলার জন্য। এরপর ছাই ও কলিচুন মিশিয়ে রসের মধ্য থেকে গাদ আলাদা করা হয়। গাদগুলি ভেসে ওঠে ওপরের দিকে ফেনা ফেনা হয়ে, আর অনবরত হাতা দিয়ে তুলে তা ফেলে দিতে হয়। এর পরবর্তী প্রক্রিয়ায় আরো চারচারটি বয়লারের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয় যাতে পঞ্চমটিতে এসে একটি ঘন সিরাপ প্রস্তুত হয়। ছ নম্বর বয়লারে এর সাথে দুধ, চুনজল এবং ফটকিরি মিশিয়ে শেষ মিশ্রণটি বানানো হয়। এভাবে প্রস্তুত দ্রবণটি প্রথম দ্রবণের প্রায় এক তৃতীয়াংশ। শেষকালে ছোটো বালতিতে ঠান্ডা করার জন্য রেখে দেওয়া হয়। এবং ঠান্ডা হলেই ব্যবহারযোগ্য হয়ে ওঠে। এই হল ইস্ট ইন্ডিয়ান চিনি তৈরির কলাকৌশল। লন্ডনে এই চিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় যে তাইই শুধু নয়, স্বীকার করা হয় পৃথিবীতে বিভিন্ন জায়গার তুলনাতে এটিই সবচেয়ে ভালো।
পত্র ২৮
জুয়াখেলাও বেশ চালু আছে, আর তা ভারতে বেশ জনপ্রিয় ও আগ্রহের বিষয়বস্তু, তা যতই কেন তার কুপ্রভাব থাকুক। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে আইনের ছাড়পত্রও মিলে যায়। যদিও কিছু কিছু নিয়ন্ত্রণও বিদ্যমান। যেমন কিনা সামান্য কিছু সময়ের জন্য অনুমতি দেওয়া হল, ধরা যাক দিওয়ালি, পনেরো দিনের জন্য ছাড়পত্র মিলল। সে’সময় জুয়ার টেবিলে হরেক কিসিমের মানুষের দেখা মিলবে। যাদের অনুমতি দেওয়া হয় তাদের থেকে মোটা লাইসেন্স ফি নেয়া হয়। তাছাড়া যথেষ্ট পরিমানে রক্ষি মোতায়েন হয় আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য। এসব দিনে লাইসেন্সধারীদের বাড়ির সামনে পুলিশ প্রহরা বসে। অত্যুৎসাহীদের ঝঞ্ঝাট ঝামেলা যা কিছু হয় তারাই সামলায়। ব্যাবসা শুরুর আগে, ম্যানেজার অথবা জুয়াঘরের ব্যবস্থাপক এর হাতে যথেষ্ট পরিমাণে টাকা দিয়ে রাখা হয়, যাতে প্রয়োজনে আগন্তুক খেলোয়াড়দের চড়া সুদে ধার দেওয়া যায়। বিজয়ী তার জেতা টাকার একটা অংশ জুয়াঘরের মালিককে দিয়ে থাকেন। আর বিজেতা সুদসহ তার টাকা শোধ করেন। ফলে মালিক অতি অল্প সময়ের মধ্যেই প্রচুর টাকা লাভ করে থাকেন।
মানুষের আকাঙ্ক্ষা এবং দ্রুত বিরাট পরিমাণ টাকা হাতবদল হবার দরুণ, এই হইহট্টগোল ডামাডোলে ক্কচিৎ মূল লগ্নির কয়েনটা খুঁজে পাওয়া যায় বিজেতার উপার্জিত অর্থের মধ্যে। এরকম একটা বাজারচালু ঘটনাই যা শুনেছিলাম আর আমার স্মরণে আছে বলছি।
এক সেপাই কলকাতা থেকে পাটনা যাচ্ছিল। সম্বল বলতে পঞ্চাশটি টাকা, তার এক এবং একমাত্র সম্পদ। পথে এক সভ্যভদ্র লোকের সাথে তার আলাপ হল, কথায় কথায় আলাপ জমলে, সেপাইটি বেশ অনেক কথাই বলে ফেলল লোকটিকে আর সেটাই কাল হয়ে দাঁড়াল। লোকটি ছিল মুদ্রা ব্যবসায়ী। সে দেখল, সেপাইয়ের কাছে আছে কলকাতার মুদ্রা, আবার পাটনা যাচ্ছে যখন, সে নিশ্চই মুদ্রা হাতবদলে উৎসাহিতই হবে। আর এ সুযোগে তার বেশ ভাল রকম মুনাফা হবে। পাটনাই মুদ্রা পেয়ে লোকটি কৃতজ্ঞই হবে বলাবাহুল্য। গরিব সেপাই এ প্রস্তাবে রাজি হয়ে পঞ্চাশটি রুপোর মুদ্রা গুনে দিয়ে পরিবর্তে ধূর্ত লোকটির থেকে পঞ্চাশটি চকচকে ধাতব মুদ্রা নিয়ে খুব ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেল। মুর্শিদাবাদে পৌঁছেই টের পেল সেপাইটি যে কী ঘটেছে। ব্যাপারটা ধরা পড়ল প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার সময়; পথের বন্ধুর দেয়া উজ্জল ধাতুর টুকরোগুলো আসলে জাল। সেপাইয়ের অবস্থা সহজেই অনুমেয়, মুষড়ে পড়াটাই স্বাভাবিক, তাইই হল, মুখের হাবে ভাবে স্পষ্ট, শূন্য চাউনি আর মুখে একটাই কথা – “আমায় অচেনা পেয়ে এই ভালোমানুষি দেখাল!”
মুর্শিদাবাদের মতো বড়ো শহরের সমস্ত রাস্তাঘাট, গলি, তস্য গলি, বাজারের অন্ধিসন্ধি চষে ফেলে, খুঁজে পেতে অবশেষে সেপাইটি তার পথের সঙ্গীটিকে এক জুয়ার টেবিলে আবিষ্কার করলে। আর অমনি তাকে ধরে এমন উত্তম মধ্যম দিলে যে তার চেহারা, পোশাকআশাকের দফা রফা হয়ে গেল। সে আমি ভাষায় বর্ণনা করতে অপারগ। প্রথম চোট মিটতে সে তার টাকা ফেরত চাইলে। একটু জোর দিতেই সুড়সুড় করে টাকা বেরিয়েও এল। টাকা ফেরৎ পেয়ে সেপাই ফিরে চলল। তার আগে অবশ্য তার সঙ্গীর চেহারায় বেশ করে দু ঘা দিয়ে ভালোরকম স্মৃতিচিহ্ন এঁকে দিয়ে গেল যাতে তাকে সে মনে রাখে।
ভারতবর্ষে এরকম মানুষ অল্পই আছে যারা ধাপ্পা আর ধোঁকাবাজি করে লোক ঠকিয়েই বেড়ায়; কিন্তু বাজিকর আছেন অসংখ্য যাঁরা নানারকমের জাদুখেলায় দারুণ দক্ষ। ইয়োরোপের বিভিন্ন জায়গায় যেমন জাদুকরদের দেখে থাকেন তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
এমন মানুষদের একজনকে আমি দেখেছিলাম। এক বাজার এলাকায়, শুকিয়ে আসা একটা গাছের পাশে সে বসে সাপুড়ের বীণ বাজাচ্ছিল। বীণ হল একধরণের বাঁশি, যার মাঝের অংশটা লাউয়ের ছোটো খোল দিয়ে বানানো, একদিকে ফুঁ দেবার নল অন্যদিকে আরেকটা ছোটো নল যার ওপরের ছিদ্রগুলো আঙুল দিয়ে চেপে নানান শব্দ বার করতে হয়। লোকটি গাছের ডালে একটা কাপড় চাপা দিয়ে দিল। গাছটি এমনিতেই প্রায় পত্রশূন্য। সামান্য কটা পাতা তিরতির করছে। তো বীণ বাজাতে বাজাতে সে ওই কাপড়টা ভিড়ের মধ্যে একজনকে বলল সরিয়ে নিতে। আর কী আশ্চর্য! কাপড়চাপা জায়গাটা গাছের ডাল ফুল ফলে ভরে উঠেছে। এসব আশ্চর্য মায়ার খেলার কথা বলতে গেলে ফুরোবেই না। আর এমনই অসাধারণ সুন্দর কাজগুলি কোথাও গ্রন্থিত নেই। যেমন সাপের খেলাই ধরুন, আপনার দেশে যাকে লোকেরা ঞ্জাদু, শয়তানি কাজকারবার এসব নামেই কেবল অভিহিত করেছে। ফণা তোলা সাপ বিশেষ ঝুড়িতে (অনুবাদকঃ ঝাঁপি) করে নিয়ে এরা জায়গায় জায়গায় ঘুরে বেড়ায় । খেলা দেখানোর সময় কেবল ঝুড়ি খুলে বের করা হয় সাপেদের। আর বাজিকর বাঁশি বাজাতে শুরু করলেই, ফনা তুলে এই অদ্ভুত সুরের সাথে দুলতে থাকে। থামলেই দুলুনি বন্ধ করে ক্রমাগত মুখে হিসসস হিসসস শব্দ করতে থাকে। সাপে কাটা রোগীকেও এই সাপুড়েরা১ সময়মত আনা হলে সারিয়ে তোলেন। বীণ বাজিয়ে গর্ত থেকে সাপটিকে বার করে আনেন এবং আক্রান্ত লোকটিকে আবার কামড়ে বিষ বার করে নিতে বাধ্য করেন। বিষ সম্পূর্ণ বের হয়ে গেলে সাপটি মরে যায় ও লোকটি বেঁচে ওঠে। এদের মধ্যে কেউ কেউ তো আবার গলায় দু-দুটো সাপ পেঁচিয়েই জনসমক্ষে খেলা দেখান, আঁচড়টিও লাগে না গায়ে। সাপের আরেকটা প্রজাতি আছে বেশ বড়োসড়ো আর লম্বা২। মাথাটা ছোটো বাচ্চাদের মাথার সমান প্রায়, আর সুন্দর মুখটা প্রায় মানুষেরই মতো। এদেরই কেউ হয়ত আমাদের আদিম মাতা ইভকে প্রলোভন দেখিয়েছিল। হয়ত!
ক্রমশ
———————————————————-
অনুবাদকের বক্তব্যঃ
(১) ওঝা, যাদের আমরা সাপের কামড় থেকে বাঁচাতে পারেন বলে মনে করি, আসলে হাতুড়ে তুকতাকওয়ালা ছাড়া কিছুই নয়। এদের সাপে কাটা রোগী বাঁচিয়ে তোলার বর্ণনা প্রায়শ শোনা গেলেও এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। সাপুড়ে মাত্রেই ওঝা নন। প্রকৃত সাপুড়ের সাপ সংক্রান্ত জ্ঞানগম্যি সাধারণের চেয়ে ঢের বেশি। কিন্তু এই ওঝাদের সাপের বিষ ঝেড়ে দিয়ে মানুষ বাঁচিয়ে তোলাটা স্রেফ ধাপ্পা। প্রকৃতপক্ষে বেশিরভাগ সাপেরই বিষ থাকে না, মানুষ না জানার ফলে আতঙ্কিত হয়ে মারা যান বেশি; বিষধর সাপে কামড়ালে একমাত্র চিকিৎসা দ্রুত নিকটবর্তী হাসপাতালে গিয়ে অ্যান্টিভেনাম ইঞ্জেকশন দেয়া। সাপের খেলা বাঁদরখেলা ভালুকখেলা সহ নানান রকম জাদু দেখিয়ে বেড়ানো লোকেদের এককথায় মাদারি বলেও ডাকা হয়। সাপুড়েরা এর মধ্যে বিশেষ গুণের অধিকারী।
(২) অজগর বা ময়ালজাতীয় সাপের কথাই বলা হয়েছে।)