সুজয় রায় -এর সব লেখা একত্রে
মারাঠা ডিচ
সুজয় রায়
মারাঠা ডিচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তৈরি করেনি। গড়ে তুলেছিল তখনকার কলকাতার মানুষ। এই বস্তু চিনদেশের গ্রেট ওয়ালের মর্যাদার সমতুল্য নয়। দেওয়াল নয়, ডিচ মানে পরিখা। চব্বিশ গজ চওড়া, সাত মাইল লন্বা।
‘মহারাষ্ট্র পুরাণ’ অনুযায়ী বর্গিদের আতঙ্কে বাংলার গ্রামবাসী পালিয়ে বাঁচছে, ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা তাদের পুঁথিপত্র ফেলে, স্বর্ণবণিকেরা দাঁড়িপাল্লা ফেলে, কামার হাতুড়ি হাতে পালাচ্ছে। ভদ্র রমণী যাঁরা চৌকাঠও পার হননি তাঁরা মাথায় মালপত্র নিয়ে, গোঁসাই-মোহান্ত পাল্কি চড়ে পালাল। কৈবর্ত, শেখ, মুঘল, পাঠান সকলে তথৈবচ। কাউকে যদি প্রশ্ন করা যায় বর্গীদের দেখেছ কি? সে বলবে দেখেনি। কিন্তু আর সবাই পালাচ্ছে, তাই সেও। আফসোস, পালাতে বুঝি বড্ড দেরি হল। নবাব আলিবর্দির ভূমিকায় যতই আপনি ভালো অভিনয় করুন না কেন, সিরাজ যতই কেন ভাবের বাষ্পে পুরে বীরের ভাবাপ্লুত সংলাপ বলুক না কেন, অপেরার ‘বঙ্গে বরগী’ সেদিন অজানা আতঙ্ক বয়ে এনে দিয়েছিল। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি দায়িত্বহীন বণিক। বাংলাকে বাঁচানোর দায় ছিল বংলার নবাবের। বাংলার মানুষ বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি কাগজ-আঁটা জানালার ফাঁক দিয়ে যেমন দেখেছিল তেমন অভিজ্ঞতা তখন দেখেনি। সেদিনের ভয়ানক দুর্দিনের কথা অকল্পনীয়।
কোম্পানি বিপদে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখার স্বার্থে বিলাতে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে লেখালেখি পরামর্শ করল। সেখান থেকে নির্দেশ এল কলকাতায় আত্মরক্ষার ব্যবস্থা নাও, বেশি ব্যয় কোরো না, বেশি বাড়াবাড়ি নয়, নবাব বাহাদুরকে বিরক্ত করা চলবে না। সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল নেটিভদের কাঁধে বন্দুক রেখে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। আবার নেটিভদের খানিকটা দেখতেও হবে বটে। নইলে কোম্পানির ব্যবসা-বাণিজ্যের গণেশ থাকবে না, ঘট উল্টে যাবে। নেটিভরা আগ্রহে কানাঘুষা শোনেন, কী হতে চলেছে।
কোম্পানি বাগবাজারের ঘাটে মোতায়েন করলেন এক জাহাজ, নাম তার টাইগ্রিস। পেরিন্স পয়েন্টে রাখা হল আরেকখানি জাহাজ। এছাড়া সাতটি জায়গায় কামান বসিয়ে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি বর্গির আতঙ্কে কাঁপলেন ও অস্ট্রিচ পাখির মতো বালিতে মাথা গুঁজে রইলেন।
রেল ছিল না, ছিল না নিরাপদ আশ্রয়। আফিস-আদালত খালি করে লোকে পালিয়েছে। খোকাকে ঘুম পাড়ানো যাচ্ছে না। কলকাতার মানুষ মিটিং করলেন। স্থির করা হল শহরে পরিখা কাটা হবে, বর্গিরা ঘোড়াসমেত তলিয়ে যাবে সেই খাদের গভীরে। কোম্পানি থেকে ধার নেওয়া হল পঁচিশ হাজার টাকা। জনসাধারণ শোধ করবে সেই অর্থ। দায়ী রইলেন শেঠেদের বৈষ্ণবচরণ, রামকৃষ্ণ, রাসবিহারী আর উমিচাঁদ। সতেরশো তেতাল্লিশ সাল তেইশে মার্চ। অবিরাম মাটি কেটে চলল শহরবাসী। ছয়মাস চলেছিল অক্লান্ত পরিশ্রম। অবশেষে সংবাদ এল মারাঠিদের সঙ্গে নবাবের বোঝাপড়া হয়ে গেছে। এবার খাল কাটায় ভাটা পড়ল। ইতিমধ্যে বাগবাজার থেকে জানবাজার স্ট্রিট পর্যন্ত খনন করা হয়েছে। অনুমান করা হয় টালির নালা তার অপভ্রংশ। গোবিন্দ মিত্তির আর উমিচাঁদের বাগানবাড়ি তখন হালসিবাগানে। তার কাছে আজ যেখানে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের অফিস পর্যন্ত এসেছিল সেই খাদ।
অবশেষে বর্গি আর এল কই? খাদ আর বিস্তৃত হল না। ষাট বছর পরে মরা খাদের উপর দিয়ে তৈরি হল রাস্তা। বাগবাজারের মারাঠা ডিচ লেন আর আপার ও লোয়ার সার্কুলার রোড সেই রাস্তা। সার্কুলার রোড তৈরি হয়েছিল সতেরোশো নিরানব্বই সালে। তারপরেও ছিল অবশিষ্ট একটু খাদ, পাল লেন আর কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের মাঝামাঝি। কয়েক পুরুষের সঞ্চিত মানিক শহরের আবর্জনা, তার তলায় মারাঠা ডিচের ভরাডুবি হল। এত জঞ্জাল ছিল? বাংলার উপসাগরও ভরে যেতে পারত অফুরান জঞ্জালের দাক্ষিণ্যে।
মারাঠা সত্যই কিন্তু এসেছিল সেদিন। একথা ক’জন জানেন? সামান্য দূরে গঙ্গার অপর পাড়ে। মারাঠা ডিচ ইংরেজ নয়, তৈরি করেছিল তথাকথিত উদ্যমহীন কর্মবিমুখ কলকাতার ‘নেটিভ’। কিন্তু সেদিনের কলকাতা বিশ্বের কাছে শিরোপা পেল ‘ডিচার’। অর্থাৎ ঠক। ইতিহাস তুমি কথা বল।
টাইম মেশিন সব লেখা একত্রে