মহম্মদ আলি জিন্না বললেই আমাদের মনে ভেসে ওঠে অবিভক্ত ভারতবর্ষ থেকে পাকিস্তান নামের দেশ আলাদা করে তৈরির দাবি তোলা মুসলিম লিগের সেই দোর্দন্ডপ্রতাপ রাজনৈতিক নেতার নাম। যাঁর সাথে জওহরলাল, সর্দার প্যাটেল সহ অন্যান্য ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসীদের তীব্র মতানৈক্য ছিল দেশভাগ নিয়ে।
কিন্তু একান্তভাবে রাজনীতির মানুষ মহম্মদ আলি জিন্নার মধ্যে ছিল আরেকটি বিপুল বৈপরিত্যের দিক। উনি ছিলেন প্রবলভাবে শিল্প-কলা অনুরাগী। এমনকি ইংলন্ডে আইন পড়াকালীন উনি মনস্থিরও করে ফেলেছিলেন রসকষহীন আইন পাঠ ছেড়ে একটি শেক্সপেরিয়ান নাট্যদলের সাথে যুক্ত হয়ে নাট্যমঞ্চে অভিনয় শুরু করবেন। কিন্তু উনি হেরে যান ওঁর প্রবল ব্যাক্তিত্বশালী বাবার তীব্র জেদের কাছে এবং আইন পাঠ শেষ করে আইনী পেশায় মন দেন। বছরকয়েক ইংলন্ডেই আইনজীবী হিসেবে কাটিয়ে ভারতবর্ষে ফিরে এসে মুম্বই-এ আইন ব্যাবসায় মন দেন। পরবর্তীকালে উনি হয়ে ওঠেন অবিভক্ত ভারতবর্ষের এক দুঁদে রাজনীতিবিদ।
কিন্তু ইতিহাস অন্য গল্পও বলে। তাই শুধু রাজনীতি নয়, অবিভক্ত ভারতবর্ষে আরো এক কৃতিত্বের সাথেও ওঁর নাম জড়িয়ে আছে। শোনা যাক সে গল্প।
১৯৩০ সাল। মুম্বাই এর সিনেমা ব্যক্তিত্য এ এম ইরানীর ভাবনায় এল ভারতীয় ভাষায় এক “টকি” সিনেমা তৈরির কথা। এতদিন সিনেমা ছিল নিঃশব্দ, নির্বাক। কিন্তু ইরানী সাহেবের স্বপ্ন দেখতে লাগলেন সংলাপ ও শব্দে ভরা পূর্ণাঙ্গ এক ‘সবাক’ সিনেমার। সিনেমার নাম স্থির হল ‘আলম আরা’। শব্দের কারিগরি বিভাগে সাহায্য নেওয়া হল আমেরিকান বিশেষজ্ঞের। নায়ক ও নায়িকার চরিত্রে খোঁজা হতে লাগল উপযুক্ত শিল্পীদের। জুবেইদা নামক অভিনেত্রী সুযোগ পেলেন ভারতীয় এই ‘প্রথম সবাক সিনেমার’ নায়িকার চরিত্রচিত্রণের। নায়ক হিসেবে বাছা হল মাস্টার ভিথালকে, যিনি নির্বাক যুগের সিনেমায় ছিলেন খ্যাতনামা ‘নায়ক’। এদিকে মাস্টার ভিথাল তখন ‘সারদা ষ্টুডিও’র সাথে ‘নায়ক’ হিসেবে চুক্তিবদ্ধ, তাই তিনি অন্য কোন ছবিতে অভিনয় করতেই পারেন না আইনীভাবে। অথচ উনি নিজে চান, তাঁর নাম প্রথম ভারতীয় টকি সিনেমার ‘নায়ক’ হিসেবে ইতিহাসে থেকে যাক। তাই ‘চুক্তি ভঙ্গ’ করলেন সারদা-স্টুডিওর। কিন্তু সারদা-স্টুডিও ছেড়ে দেবে কেন? দিল একটা মামলা ঠুকে মাস্টার ভিথালের বিরুদ্ধে।
ঠিক এই সময় মাষ্টার ভিথালের পাশে এসে দাঁড়ালেন মুম্বাই এর নামকরা আইনজীবী, মহম্মদ আলি জিন্না। আইনী নানা সওয়াল জবাবের পরে এ আইনী লড়াই এ জিতে গেলেন জিন্না এবং মাষ্টার ভিথাল যাতে “আলম আরা”র নায়ক হিসেবে কাজ করতে পারেন তা সুনিশ্চিত করলেন।
অবশেষে শ্যুটিং শুরু হল ‘আলম আরা’র। মুক্তি পেল ১৯৩১ সালে।
আর এভাবেই মহম্মদ আলি জিন্না জুড়ে গেলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসের ‘প্রথম সবাক সিনেমার’ সঙ্গে।