আগের পর্বগুলো
পত্র ৩১
১৭৮১ সাল। ক্যাপ্টেন বেকার দ্বিতীয় ব্রিগেডের সেপাইদের সৈনাধ্যক্ষ হলেন। দায়িত্ব নিয়েই লেফটানেন্ট সিম্পসন ও উইলিয়ামসন এবং দু কম্পানি ইউরোপিয়ান সৈন্য আর দু কম্পানি দেশীয় সৈন্য নিয়ে বহরমপুর থেকে কানপুরের দিকে রওনা হলেন দ্বিতীয় ব্রিগেডের সাথে যোগ দেবেন বলে। পদোন্নতি হওয়ার পর তিনি আমাকে বাজার-সরকার নিযুক্ত করেছিলেন। দেনাপুরে (দানাপুর) বিশ্রাম নিতে থামা হল, মাইনে কড়ির মেটানোর ব্যাপারও ছিল। দুজন সেপাই সঙ্গে দিয়ে আমাকে পাঠিয়ে দেয়া হল গোল্ডিংগঞ্জ। তখন ওটাই সবচেয়ে সস্তার বাজার ছিল আর আমারও সৈন্যদলের জন্য শস্যদানা সংগ্রহ করতে হত। এর জন্যে আমার সাথে ছিল চারশ সোনার মোহর, আর সেনাসরবরাহের দোকান থেকে জিনিস পাবার জন্য প্রয়োজনীয় আদেশের কাগজ, সবমিলিয়ে পনেরোশ পাউন্ড স্টার্লিং এর সমান। যাবার পথে হল কী, নদীর পাড়ে তরমুজ খেতে এক সেপাই বেশ কিছু তরমুজ মাড়িয়ে নষ্ট করে ফেলল। জমির মালিক দেখে ফেলেছিল, সে তাকে সাবধান করাতে সেপাইটি খুবই খারাপ ভাষায় তাকে জবাব দিল। ফলে লোকটি তো রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে তার ওপরে চড়াও হলো আর দুজনে খণ্ডযুদ্ধ বেঁধে গেল। সেই লোকের আশেপাশের পাড়াপড়শি খবর পেয়ে তাদের বন্ধুর সাহায্যে এসে জুটল দলে দলে। সেপাইকে স্রেফ কুপিয়েই মেরে দিল তারা। মাঠে পড়ে রইল সেই সৈন্যের মৃতদেহ। বাকি সৈন্যেরা পালিয়ে গেল, কিন্তু আমাকে ধরে ঘোড়া থেকে নামানো হল, আমি গঙ্গার পাড়েই দাঁড়িয়ে কাঁপছিলাম, কপালে কী আছে ভেবে; ঘোড়া তো গেলই, শেষে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে বহু কষ্টে ওপারে পৌঁছলাম। জামাকাপড় পরে, সঙ্গে অত অত ভারী সোনার মোহর নিয়ে সাঁতার দিতে গিয়ে দারুণ পরিশ্রমে প্রায় অজ্ঞান হবার জোগাড়। আমায় ওরকম দেখে কয়েকজন চাষী সাহায্যের জন্যে এগিয়ে এলো আর সাধ্যমতো যা কিছু সম্ভব সাহায্য করল। রাত নামলে আমি আমার যাত্রাপথের বিপদ ভুলে ঘুমের অতলে তলিয়ে গেলাম। পরদিন নিজেকে একটু সুস্থ লাগলে আমি ওই সহৃদয় মানুষগুলোকে বিদায় জানাতে গেলাম। বিপদের সময় তাদের সহানুভূতির জন্যই আমি বেঁচে গিয়েছিলাম। গোল্ডিংগঞ্জে পৌঁছে সেখানকার ফৌজদারের হাতে সোনার মোহর আর কাগজপত্র দিয়ে তাকে গোটা ঘটনা আদ্যোপান্ত বর্ণনা করলাম। শুনে টুনে তিনি বেশ বিচলিতই হলেন। আমাকে আটকে দিলেন যতক্ষণ না সৈন্যদলের জন্য পর্যাপ্ত শস্য কেনা সম্পূর্ণ হয়। তার খানিকটা জলপথে কানপুরে পাঠানো হল। বাকিটা স্থলপথে অনেকগুলি গরুর গাড়ি বোঝাই করে পাঠানো হল। স্থলপথে তাদের সাথে আমিও চললাম, বক্সারে এসে সৈন্যদলের সাথে যোগ দেবার জন্য। যে সেপাইরা আগেই পালিয়ে এসেছিল তাদের কাছে আগেভাগে খবর পেয়ে সকলেই ভেবেছিল মারমুখী জনতার হাতে ওই সেপাইয়ের সাথে আমারও মৃত্যু হয়েছে। তারা আমায় দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। এমনকী আমায় সামনে দেখেও তাদের সন্দেহ গেলনা, মুখ দেখে মনে হচ্ছিল যেন আমাকে নয় আমার ভূত দেখছে তারা।
বক্সার থেকে আমরা কানপুরের দিকে রওনা হলাম; পৌঁছতে পৌঁছতে ফেব্রুয়ারির শেষ। পয়লা মার্চ ক্যাপ্টেন বেকার মেজর রবার্টের রেজিমেন্টের সেনাদলের দায়িত্বভার নিলেন এবং এই পদেই তার পদোন্নতি হয়েছিল। তার সুপারিশেই আমাকে ঐ একই সেনাদলের মধ্যে অন্যতম মুখ্য হিসেবে নিযুক্ত করা হল। যমুনার তীরে কাল্পি র কাছাকাছি মারাঠা বিদ্রোহের খবরে সমস্ত সৈন্যদল কর্নেল মরগ্যানের নির্দেশে এবার সেদিকে অগ্রসর হল। আর তারই একটা ছোট অংশ কাছাকাছি এলাকায় খানাতল্লাশি চালাতে লাগল যাতে সাধারণ মানুষের শান্তিভঙ্গকারীদের পাকড়াও করা যায়। তাদের সাথে ছোটোখাটো দু একটা সংঘর্ষের পর আমাদের অস্ত্রে শস্ত্রে ভয় পেয়েই একরকম সকলেই পালিয়ে গেল।
কাল্পিতে কয়েকদিন কাটিয়ে আমরা কানপুর ফিরে গেলাম, তা অবশ্য বেশিদিনের জন্য নয়।
এসময়েই বড়লাট হেস্টিংস মনে করলেন চৈত সিং এর কাছ থেকে পাওনা খাজনার আশু প্রয়োজন, কেননা হায়দার আলির সঙ্গে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি পূরণের দরকার হয়ে পড়েছিল। এদিকে অপারগই হোক কিম্বা না দেবার ইচ্ছেতেই হোক চৈত সিং এর কাছ থেকে খাজনা আদায় না পেয়ে দু কম্পানি সেনা সহ সিপাহশালার পাঠানো হল রাজাকে বন্দী করবার জন্যে। রাজাকে বন্দি করা হয়েছে এখবর দ্রুত ছড়িয়ে গেল রাজ্য জুড়ে। রাজার সৈন্যরা গেল খেপে; তারা দলে দলে রামনগরের কাছে নদী পার করে যেখানে রাজাকে বন্দী করা হয়েছে সেই রাজপ্রাসাদের দিকে আসতে থাকল। আমাদের দু কম্পানি সৈন্য যারা প্রাসাদের সুমুখের জমিতে পাহারায় ছিল, অতর্কিতে এই শক্তিশালী সৈন্যদলের স্রোতের কাছে বেবাক কচুকাটা হয়ে গেল। যেন অপ্রতিরোধ্য প্লাবন যা সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
রাজার সেনাপতিদের একজন, রামজীবন, সেপাইদের সর্দারকে মেরে প্রাসাদে ঢুকে এল; সেইই প্রথম তাকে ঢুকতে বাধা দিয়েছিল। সেনাপতিই বাকি সৈন্যদের পথ করে দিল, যাতে তারা তাদের রাজাকে সুরক্ষিতভাবে প্রাসাদ থেকে বের করে এক বাগানের মধ্য দিয়ে নদীর পাড়ে পৌঁছে দিয়েছিল। নদী থেকে নদীপাড় অনেক উঁচুতে ফলে পাগড়ি খুলে সেটাকে লম্বা করে দড়ির মতো বেঁধে রাজাকে তার সাহায্যে নামানো হল নীচে। নৌকো ছিলই, সেটা অন্যপাড়ে পৌঁছে দিয়েছিল তাকে। রাতের অন্ধকারের আড়ালে গুটিকয় দেহরক্ষী নিয়ে রাজা তারই অন্যতম শক্তিশালী দুর্গ লতিফগড়ে এসে পৌঁছলেন।