আগের পর্বগুলো
পত্র ৩৮
ভারতের নানান প্রদেশে ঘুরে বেরিয়ে শেষকালে ১৭৮৪ সালের জানুয়ারি কলকাতা ছেড়ে নদীপথে বারো মাইল দক্ষিণে একটা ছোটো গ্রাম, বেলকুড়ে(!) [এই গ্রামটি সম্ভবত হুগলি নদীর তীরে বাউরিয়া কটন মিল তথা ফোর্ট গ্লস্টার এলাকার কাছাকাছি, বর্ননায় দূরত্বের হিসেবও এই জায়গাটিই সুপ্রযুক্ত মনে হয়, বোলখালি বা বুড়িখালি নামের এলাকাকে সম্ভবত উচ্চারণের ভিন্নতায় অমন নাম লেখা হয়েছেঃ অনুবাদক] এলাম; কোপেনহেগেন যাবে বলে ক্যাপ্টেন ডাকের ড্যানিশ জাহাজ সেখানে নোঙর ফেলে যাত্রীর অপেক্ষায় ছিল, আমাদের সাথে সেও পাল তুলে ভিড়ে গেল ইউরোপ যাত্রায়। ভালো আবহাওয়া আর অনুকূল বাতাসে আমরা সাতদিনে মদপল্লম পৌঁছে নোঙর ফেললাম। ক্যাপ্টেন আর যাত্রীরা ডাঙায় নেমে গেল, বাকীরা রয়ে গেল আর আমি যাদের সাথে এসেছিলাম তারা মাদ্রাজ শহর দেখার কৌতূহলে আট মাইল দূরের শহরে চলল। (অনুবাদকঃ মদপল্লম অন্ধ্রপ্রদেশের নরসাপুরমের কাছের একটি বন্দর শহর ছিল, ড্যানিশ লোকেরা তাদের জাহাজ বানানোর কাজ করত এখানে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এখানে কাপড়ের কারখানা বানায় ও রপ্তানি শুরু করে। মাদ্রাজ রেসিডেন্সির অন্তর্গত দুর্গশহর মদপল্লম তার সূক্ষ্ম মসলিন কাপড়ের জন্য বিখ্যাত। যদিও বন্দর আজ আর নেই।) জাহাজ এখানে দিন পনেরো থাকবে, আর বেশ কিছু ছিট আর ক্যালিকোর গাঠরি ভরে নেবে।
মাদ্রাজ বা ফোর্ট সেন্ট জর্জ একটা চতুর্ভুজের মতো এলাকা। প্রতিটা ধার একশ গজ চওড়া, চারকোণে কালোপাথরের গম্বুজ, কাঁচা লোহার রঙের মতো বলে লোহা-পাথর বলা হয়, বাইরের দিকটা খুবই এবড়োখেবড়ো, মৌচাকের বাইরের মতো অনেকটা। দুর্গের বাইরে কোনো পরিখা নেই, দেয়ালগুলো আর্চ করা আর ফাঁপা ফলে কামানের গোলা প্রতিহত করতে পারবে না। দুখানি তোরণ, একটা পূর্বে আর একটা পশ্চিমে। পশ্চিমের তোরণ, যেদিকে ডাঙা, সেটা বেশ বড়ো, প্রধান রক্ষীরা এদিকেই মোতায়েন, বাকী সৈনিকরা ডানদিক বাঁদিকে দেয়ালের নীচ বরাবর। আলাদা কামরার বদলে ফাঁপা চওড়া দেয়ালের ভেতরেই রক্ষীদের থাকার ব্যবস্থা। পূর্ব তোরণ সমুদ্রের দিকে, কিন্তু ছোটো, মাত্র কয়েকজন মাস্কেটিয়ার্স থাকে পাহারায়। মাঝে গভর্নর বা লাটসাহেবের কুঠি, তার মধ্যেই চাকরবাকরদের থাকার জায়গা। এটা বেশ উঁচু, বড়ো, পাথরে তৈরি চৌকো একটা বাড়ি। দুর্গের প্রথম সারির ঘরগুলো দশ বারোটা সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়। এরপর আরো দু’সারি সিঁড়ি বেয়ে মন্ত্রণাকক্ষ বা লাটসাহেবের থাকার জায়গা অর্থাৎ গভর্নরের বাসস্থান।
দুর্গটা শ্বেতাঙ্গদের শহরের প্রায় কেন্দ্রে, যেখানে ইউরোপীয়দের বাস। এটা অনেকটা আয়তাকার একটা জায়গা, দৈর্ঘ্যে এক মাইল প্রস্থে অবশ্য অর্ধেকও নয়। দুর্গের উত্তরদিকে তিনটে চওড়া রাস্তা, দক্ষিণদিকেও তাই। বাড়িগুলি ইঁটের এবং বেশিরভাগ বাড়িই, দোতলা। ছাতগুলি সমতল, সামুদ্রিক ঝিনুক গুঁড়ো করে প্রস্তুত প্লাস্টারে মোড়া, ফলে বৃষ্টির জল ঢোকে না। দুর্গের পশ্চিম গেটের উল্টোদিকে লম্বা একখানা ঘর, সৈন্যদের থাকার এবং অবসর সময়ে বিশ্রাম নেবার জন্য। এর পাশেই উত্তরদিকে খোলামেলা একটা হাসপাতাল, অন্যপ্রান্তে টাঁকশাল, কম্পানির সোনা রুপার মুদ্রা তৈরির জন্য। দুর্গের উত্তরভাগে পোর্তুগিজ গির্জা আর দক্ষিণে ইংরাজ গির্জা, যেটি একটি অসামান্য সৌধ, এবং যথেষ্ট বড়ো। সাদা কালো শ্বেত পাথরের মেঝে, বসার জায়গা আরামদায়ক ও সাধারণ, আর সব মিলিয়ে, যেকোনো জায়গার তুলনায়, খুব আলো হাওয়া সম্বলিত একটা নির্মানবিশেষ, কেননা এর জানলাগুলো বেশ বড়ো বড়ো আর পালিশ করা নয় ফলে গরমকালে ঠান্ডা হাওয়া সহজেই আসতে পারে।
এখানে একটা অবৈতনিক বিদ্যালয়ও চালু আছে, যেখানে শিশুরা লিখতে পড়তে শেখে। এর পাশেই আছে গ্রন্থাগার, একদল বন্দুকধারী দ্বারা সুরক্ষিত। পুবের দিকে একটা ছোটো পাথরের দেয়াল রয়েছে, খানিকটা উঁচু জমির ওপর নির্মিত। জাহাজ থেকে খুব একটা বিশাল ব্যাপার মনে হয় সেটাকে। অবশ্য এখানে দুর্গসুরক্ষার তেমন কিছু ঘটেনি। সমুদ্র, শহরের বেশ কাছে, আর কোনো বড়ো জাহাজই এ জায়গাটার দুমাইলের মধ্যে আসতে পারে না, কারণ সমুদ্র ততটাই অগভীর। সেদিকটাতে আঘাটাও নেই, লাগাতার উঁচু ঢেউ এসে তীরে ভেঙে পড়ে; কেবল দেশি নৌকো আসতে পারে। শহরের উত্তর এবং দক্ষিণ জুড়ে সুরক্ষা প্রাচীর, পাথরে তৈরি এবং ভেতরটা ফাঁপা, ঠিক দুর্গের মতো, তবে বড়োজোর একদিন একদল সৈন্যকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব। দক্ষিণের দিকে থাকে কালা আদমি জেলেরা। তাদের জীর্ণকুটির, কষ্টেসৃষ্টে সেগুলোকে বাড়ি বলা চলে। আরও খানিক এগিয়ে কালা আদমি-রক্ষীদল। এদের কাজই ছিল, দুর্গে গোপন খবর পৌঁছে দেয়া; কিন্তু এদিকটাতে দুর্গ রক্ষার বন্দোবস্ত কিছুই নেই।
সাদা চামড়াদের লাগোয়া উত্তরদিক ঘেঁষে কালা আদমিদের শহর, আর সেটা বেশ বড়োই। এখানে পোর্তুগিজ, ভারতীয়, আর্মানি এবং অন্যান্যদের বাসস্থান। এজায়গাটাও চৌকো মতো, পরিধি বরাবর প্রায় দেড় মাইল আর সতেরো ফুট পুরু ইঁটের দেয়াল দিয়ে ঘেরা। দেয়াল বরাবর কিছু দূর দূরই বড়ো বড়ো গম্বুজ, আধুনিক সমস্ত দুর্গের মতো। এর পশ্চিমে নদী, পূর্বে সমুদ্র, উত্তরদিকে একটা খাল কেটে নদীকে সমুদ্রের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে। এইদিকে এটাই দুর্গরক্ষার কাজে লাগছে। কালোদের শহরে রাস্তাগুলো বেশ চওড়া, আর কোনোকোনোটার দুপাশে গাছের সারি। একদিকে নদী আর অন্য পাশে সাগর থাকার ফলে, খুব কম শহরই আছে এতো মনোরম আর মালপত্র সরবরাহের জন্য অতি উত্তম। কয়েকটা ইঁটের তৈরি বাড়ি ছাড়া সবটাই মাটি আর খড় দিয়ে তৈরি বাসস্থান। স্বচ্ছল ভারতীয়দের বাড়িগুলি একরকমের, একই ধাঁচে এবং একই জিনিসে তৈরি। বাড়ির মাঝখানে একফালি চৌকো উঠোনমতো জায়গা যাতে আলোর অভাব না হয়। একজন আগন্তুককে বাড়ির অন্দরমহলে কদাচিৎ ঢুকতে হয় কেননা দরজার কাছেই একটা খুঁটি দিয়ে ছাউনি করা থাকে, যেখানে বাড়ির লোকেরা সকাল সন্ধ্যায় বাবু হয়ে বসে কাজকম্ম সারে বা বন্ধুদের সাথে আলাপ সালাপ করে, আড্ডা দেয়। বড়ো রাস্তা আর বাজার, সবসময় মানুষের ভিড়ে সরগরম। বাড়িগুলো ছোটো ছোটো আর উচ্চতায় খাটো কিন্তু এক সারিতে সুবিন্যস্ত। আর এখানকার লোকেরা, তা ধনী দরিদ্র যাইই হোক, অসম্ভব পরিষ্কার, দিনের মধ্যে একাধিকবার পরিচ্ছন্ন হয় সকলে। এখানে একটা আর্মেনিয় গির্জা আছে, আর আছে অসংখ্য ছোটো ছোটো ভারতীয় মন্দির। সব মন্দিরেই বহুসংখ্যক গায়িকা রয়েছে যাদের অধিকাংশই দিনের অর্ধেকটা সময় বিগ্রহের সামনে গান গেয়ে কাটান। আর বাকী সময়ে দলবদ্ধভাবে বড়ো মানুষেরা কেউ এলে বা রাস্তা দিয়ে গেলে, তাদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য উঁচুস্বরে স্তোত্রপাঠ করেন।
মাদ্রাজের গভর্নর বা লাটসাহেবের ঠাটবাট দেখার মতো। একশজন দেশীয় রক্ষীদল সবসময় তার চারপাশে; তিনি যখনই কোনো সমারোহে যোগ দিতে বাইরে যান, তূর্য (ট্রাম্পেট), বাঁশি, কাড়া-নাকাড়া-বাদ্য সহ তাকে বিদায় সম্বর্ধনা জানানো হয়, এছাড়া ঘোড়ার পিঠে তার মূখ্য কর্মচারীরা ও পালকিতে তাদের বাড়ির মহিলারা অবধি হাজির থাকেন।
মদপল্লমে সময়মতো ফিরে আসা গেল, জাহাজও ভেসে পড়ল; উত্তমাশা অন্তরীপের কাছাকাছি পৌঁছনোর আগে সব স্বাভাবিক ছিল, অস্বাভাবিক কিছুই ঘটেনি। এর মধ্যে নানারকম জলজ প্রাণী দেখেছি, কিন্তু আপনার মতো মান্য লোকের কাছে তার সাদামাটা বর্ণনা অতিরিক্ত ও বাড়াবাড়ি হবে বিবেচনা করে বিরত থাকলাম। দিগন্তে এইবারে একটা একচিলতে ঘন বস্তু দেখা গেল, আর নজরদার বলল, এ নিশ্চিত ঝড়ের পূর্বাভাস। খুব দ্রুত সেই ঘনকৃষ্ণবস্তু বাড়তে বাড়তে আকাশ ছেয়ে ফেলল আর আমাদের ওপর অক্লান্তভাবে আছড়ে পড়ল। তিনদিন ধরে চলল তান্ডব। ঝড়ের আওয়াজ, সমুদ্রের গর্জন, নিকষ কালো রাত্তির, আকাশচেরা বিদ্যুতশিখা, বাজের গুরুগুরু সবমিলিয়ে এমন ভীতিপ্রদ অবস্থায় আমি আগে কখনো পড়িনি।
দুঃখের পর যেমন সুখ, তেমনি এই প্রবল ঝড়বৃষ্টির পর অনুকূল আবহাওয়ায় ভর করে আমরা সেন্ট হেলেনাতে এক সপ্তাহের মধ্যেই পৌঁছোলাম। সেখানে ফক্স নামের জাহাজটিকে দেখলাম। তীরের কাছে পাথরে ধাক্কা লেগে খানিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আরও তিনটে জাহাজ নোঙর করা ছিল এখানে, যার মধ্যে একটাতে গভর্নর হেস্টিংসের স্ত্রী ইউরোপে ফিরছিলেন। বাকীগুলোর একখানাতে দুর্ধর্ষ সেনা অফিসার স্যর আয়ার কুট ছিলেন। ওখান থেকে আমরা নতুন রসদ, পানীয় জল ভরে নিয়ে ভেসে পড়লাম। ইংল্যান্ডের ডার্টমাউথে পৌঁছলাম ১৭৮৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে।
সমাপ্ত