দেশ ও মানুষ সব পর্ব একত্রে
অন্য নীল
শুভাশিস বিশ্বাস
আন্দামান বেড়াতে গিয়ে এবার বেশ সমস্যাই পড়ে গেলাম। এয়ারপোর্টে নেমেই দেখলাম মেঘের মুখ গোমড়া, আটো নিয়ে হোটেলে যাবার পথেই বৃষ্টি শুরু হল, ডিসেম্বরে তো এমনটি হবার কথা নয়!
খানিক পর বৃষ্টি থেমেও গেল দেখা দিল ঝকঝকে রোদ। নীল আকাশের নিচে নীল রঙা সমুদ্র রূপালী টোপর পরে হুটোপুটি করছে। হোটেলের ব্যালকনি এই ছবি দেখে মন ভাল হয়ে গেল। কিন্তু এই ভাল লাগা বেশিক্ষন স্থায়ী হল না। বিকেলে আবার ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হল এবং আমার পুরো আন্দামান টুরে রোদ-বৃষ্টির এই খেলা চলেছিল। তারই মধ্যে পোর্টব্লেয়ার-ডিগলিপুর-হ্যানলক ঘুরে নীল-এ পৌঁছালাম।
নীল-এ একদিন থেকে পরদিন সকালে পোর্টব্লেয়ার ফিরতে হবে ফেরার ফ্লাইট ধরতে। রোদ-বৃষ্টির খেলার মধ্যেই নীল বেড়িয়ে পরদিন সকালে জাহাজ ঘাটে ছুটলাম ফেরার ক্রুজ ধরতে। আজ যেন বৃষ্টির তোড় একটু বেশি, সঙ্গে হওয়া। জাহাজ ঘাটে পৌঁছে ক্রুজ কোম্পানির অফিসে রিপোর্ট করতে গিয়ে শুনলাম জাহাজ বন্ধ, সাইক্লোনের সঙ্কেত দিয়েছে, কখন চালু হবে কেউ জানে না। সরকারি জাহাজের ও কোন খবর নেই।
ক্রমে দাবানলের মত এই খবর ছোট্ট দ্বীপে ছড়িয়ে পড়ল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ও বাড়তে শুরু করল। সবাই উদ্বিগ্ন মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে কী করে পোর্টব্লেয়ার পৌঁছাবে, ফেরার ফ্লাইট ধরতে পারবে কিনা?
আমারও একই অবস্থা। ইতিমধ্যে পুলিশ ও আন্দামান ট্যুরিজমের লোকজন চলে এসেছে। জাহাজঘাটাতে যেন লোক ভেঙে পড়েছে। লোকাল লোক আর টুরিস্ট সব মিলে একাকার। কাছের পুলিশ স্টেশনে লাইন দিতে হল। নাম লেখাতে হবে। শ’য়ে শ’য়ে লোক সে লাইনে, বেশির ভাগই এজেন্ট ধরে বেড়াতে এসেছে, তারাই সবকিছু করে দিচ্ছে। আমি আর আমার স্ত্রী ঘুরে বেড়াই নিজেদের খেয়ালে, ওখানে কাউকে মাথা গলাতে দিই না। বহু কষ্টে পুলিশের খাতায় নিজের আর বউ এর নাম উঠল। বেড়াতে এসে এ কী বিড়ম্বনা! শেষে কিনা পুলিশের খাতায়…
পুলিশ এখানে বেজায় ভাল, এমন নরম পুলিশ দেখা ভার। ইতিমধ্যে টুরিস্টরা বেশ উত্তেজিত, তারা চিন্তিত তাদের ফেরার ফ্লাইট নিয়ে। মিস হয়ে গেলে অনেক টাকার ক্ষতি হয়ে যাবে, আমারও ঐ-একই চিন্তা। পুলিশ বাবাজি ঠান্ডা মাথাই বললেন “You are worried with your money, we are worried with your life” যতক্ষণ না সমুদ্র শান্ত হচ্ছে আপনাদের ছাড়া যাবে না।
বুঝলাম ব্যাপার ঘোরতর। ফেরার ফ্লাইট আর পাচ্ছি না। কিন্তু টিকিট ক্যানসেল করব কী করে? নেট এখানে নেই। বি.এস.এন.এল চলে বটে কিন্তু সে-ও না চলার মত। কাউকে লাইনে পাওয়া বেশ মুশকিল।
সরকারি জাহাজ কোম্পানির লোকটাকে ধরলাম। তিনি জানালেন তিনদিনের এলার্ট আছে। যা করবেন তিনদিন পরে করুন। সেটাই সেফ।
আমি আর দ্বিতীয়বার চিন্তা করিনি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল, এবার একটা হোটেল খুঁজতে হবে। যত কমে হয় ততই মঙ্গল। পয়সা বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে জাহাজঘাটার কাছেই একটা হোটেলে গিয়ে দাঁড়ালাম। মালিক বাঙালি। উনি আর ওঁর বউ সানন্দে আমাদের বাক্স-প্যাঁটরা বয়ে ঘরে পৌঁছে দিলেন। আমি কিছু বলার আগেই উনি বললেন ঘর ভাড়া ১২০০ টাকা করে দিলেই হবে।
বিপদে ওঁর এই ব্যবহারে আমার চোখ ভিজে এল। পরিচয় করলাম, নাম অমিয় বিশ্বাস। আমিও বিশ্বাস দুই বিশ্বাসে বেশ মিল হয়ে গেল। উনিই বললেন চিন্তা করবেন না, বরং দু-তিনদিন এখানে কাটিয়ে সমুদ্র শান্ত হলে বাড়ি ফিরুন, ঘুরে দেখুন ভাল লাগবে। প্রস্তাবটা মন্দ নয়, বিশ্বাসবাবুর কথাটা বেশ মনে ধরল। কিন্তু ফ্লাইটের টিকিটটা ক্যানসেল করে আগে ফেরার টিকিটটা কাটার দরকার, না হলে চিন্তামুক্ত হতে পারছি না।
বহু কষ্টে ভাইকে ফোনে পেলাম, ও টিকিট ক্যানসেল করে ১৯ তারিখ টিকিট করল। এবার একটু নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। আজ ১৪ তারিখ। আমার হাতে অনেক সময়। স্নান করে বেরিয়ে পড়লাম। এখানে বাজার-হাট মূলত রাতের দিকেই জমে। আসলে দিনে পোর্টব্লেয়ার থেকে মাল আসে, সেই মাল ছাড়িয়ে বাজার বসতে বেলা হয়ে যাই। জমজমাট বাজারে চায়ের দোকানে লোকের ভিড়। সুযোগ বুঝে চায়ের দোকানে বসে পড়লুম। দেখলাম আমাদের নিয়েই আলোচনা চলছে। আমি নতুন লোক দেখে ওরা এগিয়ে এল। আটকে পড়েছি জেনে ওরা আশ্বস্ত করল। কিছু একটা ব্যবস্থা নিশ্চয় হবে। প্রয়োজনে কোস্টগার্ড আর নেভাল-শিপ্ নাকি আমাদের রেসকিউ করবে।
এরা বেশির ভাগই পুর্ব বঙ্গের মানুষ। এদের পূর্বপুরুষরা, ওই বঙ্গ থেকে এসে এখানে ঠাঁই গেড়েছিলেন। আমার পূর্বপুরুষও ওই বাংলার জানার পর বন্ধুত্বটা যেন আরো জোরদার হল। চা-বিস্কুটের পয়সা কিছুতেই দিতে দিল না। বলল আপনি হলেন গিয়া আমাগো দেশের লোক। পয়সা নিলে পাপ হইব।
একদা ছিন্নমূল এই মানুষগুলোর বাপ ঠাকুরদাদার ভিটের প্রতি এখন এই টান দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। আমার চা-বিস্কুটের পয়সা দিয়ে যেন কিছুটা ঋণ মেটাল।
ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সব্জি বাজারে গেলাম ঘুরতে। খুব ভাল কলা আর পেঁপে পাওয়া যায় এখানে। কিনলাম। যতটা পারা যায় কম দামে দিয়ে দিল। খেয়ে-দেয়ে রাতে যখন শুলাম গভীর নিদ্রা যেন সারাদিনের দুশ্চিন্তা আর পরিশ্রমকে গ্রাস করল।
***
কে যেন দরজা খট-খট করছে। চোখ কচলে দেখি ঘড়িতে রাত সাড়ে তিনটে। আবার খট-খট, ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে দেখি হোটেলের কেয়ার টেকার। স্যার পুলিশ এসেছিল, নেভি আর কোস্টগার্ড এর শিপ্ আসছে। আপনাদের জাহাজঘাটে গিয়ে লাইন দিতে বলেছে। কিন্তু আমার তো আর তাড়া নেই! ঠিক করলাম যাব না। ঘুমটা চটকে গেল, রাস্তা দিয়ে শুধু গাড়ি আর অটোর আওয়াজ। সবাই চলেছে জাহাজঘাটে লাইন দিতে, এ-ও যেন এক বাঁচার লড়াই। এ-ও এক যুদ্ধক্ষেত্র, আর আমরা যেন যুদ্ধক্ষেত্রে দুই পরাজিত সৈনিক। আমার অবশ্য এই নীল দ্বীপে বিলীন হয়ে যেতে কোন আপত্তি নেই।
ঘন্টাখানেক পরে আবার ঠক ঠক, কেয়ার টেকার এসে হাজির, আমাকে নাকি যেতেই হবে কারণ ওকে নাকি পুলিশকে রিপোর্ট করতে হবে। অগত্যা স্নান টান সেরে ব্যাগ ট্যাগ গুছিয়ে চললাম লাইন দিতে। সবাই আমাদের তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে, যেন কী অন্যায় করে ফেলেছি। পুলিশ আর ট্যুরিজুম এর লোক ছুটে এল, কেন এত দেরি করলাম!
এরা কিন্তু বেশ হেল্পফুল, যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। আজ হওয়ার গতিও একটু কম মনে হচ্ছে। সামনে প্রায় হাজার দেড়েক লোক, পুরো ভারত এক লাইনে। প্রচুর নিউ কাপল, হানিমুনে এসে বিপদে পড়েছে। লাইনের সামনে গিয়ে দেখলাম এজেন্ট আর আম-আদমির মধ্যে লড়াই চলছে। এজেন্টরা তদের লোকদের আগে পাঠিয়ে দিতে চাইছে, না হলে তদের লস। কিছু মানুষ চাইছে ফ্লাইটের টিকিটকে প্রয়োরিটি দিতে হবে। জাহাজের অবশ্য কোন পাত্তা নেই। একটা জিনিস দেখে ভাল লাগল হাজার টাকা থেকে কুড়ি হাজার টাকার সব লোক একই লাইনে গড়াগড়ি যাচ্ছে। ঘাটের কাছে একটা দক্ষিণ ভারতীয় মন্দির, দেখলাম সেখানে অনেকে জোড়হাত করে দাঁড়িয়ে আছে। বিপদে তুমিই ভরসা ঠাকুর।
পুলিশের লোক গলা উঁচিয়ে কী যেন বলছে! সবাই দৌড়াল। সঙ্গে আমিও। তিনটে জাহাজ আসছে। প্রতিটাতে ৩৫ জন করে তোলা হবে। এখান থেকে হ্যাভলকে নিয়ে যাওয়া হবে, ওখান থেকে বড় জাহাজে পোর্টব্লেয়ার।
দুপুর দুটো নাগাদ জাহাজ এল। হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। যা অবস্থা বুঝলাম আগামী তিনদিনের মধ্যে আমার চান্স নেই। দিল্লি থেকে আসা সরকারী কর্মচারীদের একটা টিমকে দেখলাম, কী একটা প্রোজেক্টের কাজে এসেছে, সেখান থেকে কেটে নীল-এ বেড়াতে এসে ফেঁসে গিয়েছে। এখন শুধু চুল ছিঁড়তে বাকি রেখেছে।
একটা লোক ডাব বেচছে। তা, আলুর চপের মত উড়ে যাচ্ছে। ডাল-ভাত আর সিম ভাজা ১০০ টাকা, তাতেও লাইন। শেষ জাহাজ ছাড়তে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। বুঝলাম থেকে লাভ নেই, অতএব হোটেলে ফিরে যাওয়াই শ্রেয়। কিন্তু পুলিশ আমাকে যেতে দেবে না। মহা ফাঁপরে পড়া গেল, আমি জোর করেই হোটেলে চলে এলুম। খানিক বিশ্রাম নিয়ে আবার চায়ের দোকানে। এখন ওরাই আমার ভরসা, বিপদের বন্ধু।
অনেক লোক জুটে গেল। সবাই আমাকে ভরসা দিল। কাল আবহাওয়ার উন্নতি হযে যাবে, হওয়ার গতি তাই বলছে। চা খেতে খেতে অনেক কথা হল। এরা অনেকেই মেনল্যান্ডে ঘুরে গিয়েছে। মেনল্যান্ডের ভিড় আর পলিউশন ওদের একেবারে পছন্দ নয়।
অনেকক্ষণ সময় কাটিয়ে বিদায় নিলাম, ওরা আবার ভরসা দিল, দেখবেন কাল আবহাওয়ার উন্নতি হবে। হোটেলে ফিরে এলাম। আবার কাল সকালে লাইন দিতে হবে, ইচ্ছা না থাকলেও দিতে হবে, আসলে পুলিশও চাইছে আমরা যেন চলে যাই। শুনলাম রুটি আর ডিম পাওয়া যাচ্ছে না। আসলে এখানে রেশন সীমিত। খেয়ালই নেই আজ প্রায় দু-দিন আমরা দুজন ভাত খাইনি, খাবার ইচ্ছেটাও চলে গিয়েছে।
এ-সব ভাবতে ভাবতে শুয়ে পড়লাম। ঘুমের মধ্যে বউ এর বি এস এন এল মোবাইলটা বেজে উঠল। হ্যালো, স্যার আমি গ্রিন-ওশান থেকে বলছি, কাল আবহাওয়া পরিষ্কার হয়ে যাবে। সাইক্লোন আর নেই। সরে গিয়েছে, আপনার পুরোন টিকিটে আপনি যেতে পারবেন। কাল সকাল ৮টায় আমাদের অফিসে চেক ইন করবেন প্লিজ।
মুহুর্তের মধ্যে আমার শরীরের সব ক্লান্তি উধাও। খিদেটাও যেন চাগিয়ে উঠল। তবে কি একেই বাঁচার আনন্দ বলে, কী জানি, হয়ত বা…
ছবিঃ লেখক
শীর্ষচিত্রঃ সংগৃহীত