দেশ ও মানুষ সব পর্ব একত্রে
তুরীয়ানন্দ
বাসব চট্টোপাধ্যায়
সেদিন জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা উপলক্ষে বন্ধু পার্থর বাড়ি নিমন্ত্রণ। অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম। শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছে চেপে বসলাম শিয়ালদা-আসানশোল ইন্টারসিটি এক্সপ্রেসে। সারাদিনে কাজের চাপে খবরের কাগজ দেখার সময় হয় নি। TOI-এর পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে খেয়াল করলাম আমার পাশে জানলার ধারে বসা ক-বাবু মোবাইল অন্বেষণে ব্যস্ত। বাকি সিটগুলি ফাঁকা।
কিছুক্ষণ এভাবে কাটার পর কাঁধে একটা ঢাউস ব্যাগ নিয়ে উপস্থিত হলেন লি-বাবু।
এসেই প্রশ্ন— দাদা এই ট্রেনটা আসানসোল কখন পৌঁছোয়?
আমি বললাম, “রাত ন’টা বাজবে।”
লি-বাবু— আপনি নিশ্চিত?
আমি— হ্যাঁ। এই দেখুন। বলে আমার মোবাইলের রেল অ্যাপটি লি-বাবুকে দেখালাম।
আবার আমি কাগজে মন দিলাম। ট্রেন ছাড়তে তখনও দশ মিনিট বাকি। খ এবং গ-বাবু পাশের ফাঁকা সিটে এসে বসলেন। এরপর ঘ-বাবুর আগমন।
ঘ-বাবুর প্রথম প্রশ্ন— দাদা, এই ব্যাগটা কার?
খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে দেখলাম লি-বাবুর ব্যাগটির উদ্দেশে এই উক্তি। কিন্তু ব্যাগের মালিক অনুপস্থিত।
অগত্যা আমি বললাম— একজন আছেন। হয়তো ব্যাগ রেখে বাথরুমে গেছেন।
খ, গ এবং ঘ-বাবুরা তিনজনেই পরিচিত। নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা-ইয়ার্কিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমি ও ক-বাবু যথাক্রমে নিউজপেপার ও মোবাইলে মগ্ন।
ট্রেন দুলে উঠল। যথাসময়ে বিকেল পাঁচটায় ট্রেন ছাড়ল। ট্রেন ছাড়ার চার-পাঁচ মিনিট বাদেই ঘ-বাবু বলে উঠলেন— আরে এই ভদ্রলোক ব্যাগ রেখে গেলেন কোথায়?
গ-বাবু— বাথরুমে গেছেন হয়তো।
ঘ-বাবু— প্ল্যাটফর্মে নেমে জল খেতে গিয়ে ট্রেন ফেল করলেন না তো?
খ-বাবু— ব্যাগ সরিয়ে জানলার ধারে বসে যান। (ঘ-কে উদ্দেশ করে বললেন) হয়তো অন্য কম্পার্টমেন্টে শেষ মুহুর্তে উঠে পড়েছেন।
ঘ-বাবু— ব্যাগ সরিয়ে বসতে গিয়ে সকলের নামের আগে চন্দ্রবিন্দু বসার উপক্রম না হয়।
আমারও চোখের সামনে মুহুর্তে ফুটে উঠেছে টেলিভিশনে দেখা বিস্ফোরণের ফুটেজ। আমি কল্পনায় আমার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন পদখণ্ড স্পষ্ট দেখতে পেলাম।
সকলে সমস্বরে হেসে উঠলাম। যদিও হাসিতে স্বতস্ফূর্ততা তেমন ছিল না। ব্যতিক্রম ক-বাবু, কটমট করে সকলের দিকে তাকালেন।
খ-বাবু বলে উঠলেন — আরে এত ভয়ের কিছু নেই। বাথরুমে গেছেন। বড়-বাইরেতে একটু বেশি সময় লাগে তো। অহেতুক আমরা অনিষ্ট আশঙ্কা করছি।
আমি বললাম— আশ্চর্য লোক তো! নিজের মূল্যবান ব্যাগ রেখে চলে গেলেন। কোনো তাপ-উত্তাপ নেই! উনি রবীন্দ্রনাথের আদর্শ মনে-প্রাণে মেনে চলেন, “মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।”
মুখ খুললেন ক-বাবু— আরে ওসব ছাড়ুন মশাই রবীন্দ্রনাথের আদর্শ! লোকটা আস্ত একটা বেয়াদব। এরা আসলে ড্রাগ পেডলার বুঝেছেন! দূর থেকে নিজের ব্যাগের দিকে নজর রেখেছে, পুলিশ যাতায়াত করছে তো। আরে মশাই, তিরিশ বছর ডেলি প্যাসেঞ্জারি করছি। এসব লোককে আমার আপাদমস্তক চেনা আছে। অচেনা লোকজনের মধ্যে নিজের ব্যাগ রেখে কেউ অন্যত্র যেতে পারে?
পরিস্থিতি কিছুটা অজানা আশঙ্কায় থমথমে হলেও আবার প্রত্যেকে নিজের নিজের মোবাইল বা খবরের কাগজে মন দিলাম। কিন্তু প্রত্যেকের মধ্যেই কেমন যেন অন্যমনস্ক ভাব। যেমন আমি। কাগজ পড়ছি কিন্তু মাঝে মাঝেই আমার চোখ কম্পার্টমেন্টে লি-বাবুকে খুঁজে মরছে।
ক-বাবুর মোবাইলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যস্ত থাকা সম্ভব হল না। অগত্যা লগ আউট করে চোখ বুজে ফেললেন। আমি নিশ্চিত তিনি জেগে ঘুমোচ্ছেন। খ, গ এবং ঘ-বাবু চুটিয়ে আড্ডা দিতে দিতে ব্যাগ বিষয়ক উত্তেজনাকে আমল না দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলেন।
কিন্তু সম্ভব হল না। মাঝে মাঝেই তাদের মধ্যে ‘ব্যাগের মালিক কোথায় গেলেন’ সেই নিয়ে আলোচনা গড়াতে থাকল। হঠাৎ গ-বাবু লাফিয়ে উঠে গেটের দিকে দু’জন ব্যক্তিকে সম্বোধন করে বলে উঠলেন— ও দাদারা, এই ব্যাগটা কি আপনাদের কারোর?
গেটের ধারের বাতাসভক্ষক বাবুরা সমস্বরে ব্যাগের মালিকানা অস্বীকার করলেন।
এদিকে ট্রেন তখন টিটাগড় ছাড়িয়ে ব্যারাকপুরের দিকে। আস্তে আস্তে ট্রেনের গতি কমতে থাকল। কারণ ইন্টারসিটির প্রথম স্টপেজ ব্যারাকপুর।
হঠাৎ খেয়াল করলাম দূর থেকে গদাইলশকরি চালে এগিয়ে আসছেন আমাদের আরাধ্য লি-বাবু। আমাদের সিটের কাছে এসে দাঁড়ালেন। বিনয়ের সাথে বললেন— একটু সরে বসবেন? আমি বসব।
খ-বাবু উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমি ইশারায় বুঝিয়ে দিলাম ইনিই সেই ব্যক্তি।
সমস্বরে আমরা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ব্যাগ ফেলে আপনি কোথায় গেছিলেন? ব্যাগ চুরি হতে পারত।”
“দাবিদারহীন ব্যাগ তো পুলিশ তুলে নিয়ে যেতে পারত। আর জানেনই তো পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা,” আমি বললাম।
উদাসীন লি-বাবুর প্রথম উত্তর, “পাশের কম্পার্টমেন্টে মোবাইলে চার্জ দিতে গেছিলাম। এই কম্পার্টমেন্টের প্লাগ পয়েন্টটা খারাপ তো তাই।”
শুনে ক-বাবু প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে মুখ খিঁচিয়ে উঠলেন, “আরে মশাই, আমাদের তো বলে যেতে পারতেন! আমরা আপনার ব্যাগ পাহারা দিতাম।”
লি-বাবুর উত্তর— না মানে আমি একবার ভেবেছিলাম। আপনি ও উনি (আমার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে) মোবাইল আর কাগজ পড়ায় ব্যস্ত ছিলেন তো! তাই আর বিরক্ত করলাম না।
ক-বাবুর গন্তব্য ব্যারাকপুর কিনা জানি না। প্রচণ্ড ক্রোধে তোতলাতে তোতলাতে বলে উঠলেন, “ধুর মশাই! ভূ…ভারতে আপনার মতো ভ…দ্দরলোক দেখিনি। বলেই সটান স্টেশনে নেমে হনহন করে হাঁটতে থাকলেন।”
ওই মুহুর্তে খ, গ, ঘ-বাবু এবং আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ট্রেন ছাড়ল। আমার গন্তব্য নৈহাটি। গ-বাবু লি-বাবুকে বললেন, “আপনার মোবাইল চার্জ দেওয়া যখন হয়ে গেছে এবার নিশ্চিন্তে বসুন।”
লি-বাবু বললেন, “না মানে চার্জ সম্পূর্ণ হয়নি। ওই কম্পার্টমেন্টে মোবাইল চার্জ হচ্ছে।”
আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম, “মোবাইল চার্জে বসিয়ে চলে এলেন!”
লি-বাবু— না মানে ব্যাগটা আছে কিনা দেখতে এলাম।
আমি— আরে আপনার মোবাইলটা তো এতক্ষণে চুরি হয়ে গেল।
লি-বাবু— না না চুরি হবে কেন? চুরি করে চোর আর যাবে কোথায়? চলন্ত ট্রেন থেকে তো আর নামতে পারবে না! গ-বাবু— আরে দাদা কথা না বাড়িয়ে আপনি তাড়াতাড়ি আপনার মোবাইলটা নিয়ে আসুন।
“তাহলে মোবাইলটা নিয়ে আসি ভাই, আমার ব্যাগটা রইল, হ্যাঁ?” বলেই লি-বাবু পুনরায় মোবাইল উদ্ধারে প্রস্থান করলেন।
এদিকে ইছাপুর ছাড়িয়ে ট্রেন শ্যামনগরের উদ্দেশে যাত্রা করেছে। হঠাৎ ঘ-বাবুকে গ-বাবু বলে উঠলেন, “ওই দেখুন উনি দরজায় হেলান দিয়ে এক ঠোঙা মুড়ি খাচ্ছেন। ওঁকে ডাকুন তো! নিজের জায়গায় এবারে বসুন। আমরা তো নৈহাটি নামব।”
সবাই মিলে আমরা ওঁকে ডাকতে লাগলাম। দ্রুত গতিতে ট্রেন তখন কাঁকিনাড়া ছাড়িয়ে নৈহাটির উদ্দেশে। আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে তলানি মুড়ি চিবোতে চিবোতে একহাতে চার্জার নিয়ে লি-বাবু এলেন।
গ-বাবু বললেন, “মোবাইল চার্জ হয়ে গেছে তো?”
লি-বাবু বললেন, “হ্যাঁ।”
খ-বাবু বললেন, “তাহলে নিজের ব্যাগ বাঙ্কে রেখে নিশ্চিন্তে জানলার ধারে বসে হাওয়া খেতে খেতে যান। আমরা নামব এবারে।”
লি-বাবু বললেন, “না মানে একটা সমস্যা হয়েছে।”
খ-বাবু বললেন, “কী সমস্যা?”
লি-বাবু— না মানে আমার মোবাইলটা ট্রেনের ঝাঁকুনিতে স্যুইচ বক্সের ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেছে।”
উদাসীন ভঙ্গিতে কথাটি বলে জানলার বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগলেন লি-বাবু।
“বিত্তে নিস্পৃহতা ও বৃহৎ ক্ষতিকে তাচ্ছিল্য” করতে পারার মতো রক্তমাংসের এহেন দার্শনিক মানুষ আমার জীবদ্দশায় এই প্রথম দেখলাম। লি-বাবুর উদ্দেশে আমার সবচেয়ে অপছন্দের প্রস্তাবটাই অজান্তে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, “দাদা, আপনার সাথে একটা সেলফি তুলব?”
লি-বাবু যারপরনাই লজ্জিত মুখে বললেন —-যাঃ!
যা তা..দারুণ মজা পেলাম 😉
LikeLike
chamtkar,oshadharan
LikeLike