রুটি ব্যাঙ্কার->উমা ভট্টাচার্য
আমরা এবারের দেশ ও মানুষ পর্বে জানবো আমাদের ভারতবর্ষেরই একটি প্রদেশের কিছু সাধারণ মানুষের কথা, যাঁরা সাধারণ,দীনদরিদ্র,নিরন্ন,অভুক্ত মানুষের কথা শুধুই ভাবেনই নি,বাস্তবে তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের মুখে ক্ষুধার অন্ন তুলে দিচ্ছেন। দেশের সরকারের শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যেখানে ভারতের কোন অঞ্চলেই আজ পর্যন্ত নিরন্ন মানুষের সংখ্যা নির্মূল করা যায়নি, সেখানে দাঁড়িয়ে এঁদের কাজ দেখলে বলতেই হবে আঞ্চলিকভাবে হলেও এঁরা সেটা করতে পেরেছেন। সেখানকার অভুক্ত, পথবাসী,বস্তিবাসী, স্টেশনবাসী, সব খাদ্যহীন মানুষের মুখে প্রতিদিন কিছু খাদ্য জোগাচ্ছেন।
আমরা সকলেই টাকা রাখার ব্যাঙ্ক, রক্ত রাখার ব্যাঙ্ক, আই ব্যাঙ্ক এরকম নানা ব্যাঙ্কের কথা শুনেছি। কিন্তু ‘রুটি ব্যাঙ্ক’-র কথা কিছুদিন আগে পর্যন্ত শুনিনি। হ্যাঁ, এই নামেই একটি ব্যাঙ্ক খুলেছেন বুন্দেলখণ্ডের এক অনগ্রসর অঞ্চল ‘মাহোবা’-র কাজপাগল ,সমাজসচেতন কিছু ছেলেমেয়ে। এটি একটি স্বেচ্ছাসেবী দল, যাঁদের উদ্দেশ্য এলাকার অভুক্ত মানুষের জন্য দৈনন্দিন সামান্য খাদ্যের ব্যবস্থা করা।
‘রুটি ব্যাঙ্ক’এ রুটি সংগ্রহ করে জমা করা হয়, আর সংগ্রহ করার সঙ্গে সঙ্গেই তা বিতরণ করা হয়। এই স্বেচ্ছাসেবী দলে আছেন পাঁচজন বর্ষীয়ান মানুষ আর চল্লিশজন যুবকযুবতী। এই দলের প্রধান হাজি সুদ্দানের কথা থেকে জানা গেছে যে, তাঁরা কোন ফেলে দেবার মত উদ্বৃত্ত খাবার বা বাসি খাবার নেন না। দলের সদস্যরা সচ্ছল মানুষদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আবেদন করেছিলেন যে, তাঁরা যদি প্রতিদিন অন্তত দুটি করে টাটকা রুটি আর একটু সবজি তাদের দেন তবে খুব উপকার হয়। তাঁদের উদ্দেশ্য বুঝিয়ে বলার পর প্রায় সব পরিবারই রাজি হয়। তারপর থেকে শুরু হয়ে যায় এই রুটি সংগ্রহ অভিযান। ২০১৫ সালের এপ্রিল মাস থেকে চালু হয়েছে এই রুটি ব্যাঙ্ক ।
দলের সদস্যরা এদের কাজের এলাকাটিকে আটটি টুকরোয় ভাগ করেছে। সকাল থেকেই রুটি ব্যাঙ্কের সদস্যদের মধ্যে সংগ্রহকারীদের দল নিজের নিজের নির্দিষ্ট এলাকার বাড়িগুলি থেকে রুটি, সবজি সংগ্রহ করে আনে। সেগুলি একটি নির্দিষ্ট স্থানের ভাঁড়ারে রাখা হয়। বিতরণকারী দলের সদস্যরা সঙ্গেসঙ্গেই সেখান থেকে খাবার নিয়ে নিজ নিজ নির্দিষ্ট এলাকায় চলে যান, সেই খাবার বিতরণ করতে। ক্রমাগত সংগৃহীত খাবার আসতে থাকে আর সঙ্গে সঙ্গেই সেগুলি বিলি হতে চলে যায়। যন্ত্রের মত এক সুশৃংখল পদ্ধতিতে পুরো কাজটি হয়ে চলে, যতক্ষণ না তালিকাভুক্ত প্রত্যেকটি মানুষের হাতে খাবার পৌঁছোয়।
প্রথমে এঁদের কাজ শুরু হয়েছিল ভিখারি, গৃহহীন, পথবাসী, পঙ্গু অসহায় মানুষ ,আর স্টেশনচত্বরে বসবাসকারী অভুক্ত মানুষদের হাতে খাবার তুলে দেওয়া দিয়ে। আজ মাহোবার অনেকটা এলাকায় এঁদের কাজ চলছে। বর্তমানে এঁদের খাদ্য প্রাপকদের তালিকায় আছেন হাসপাতালের রোগীরা যাঁদের বাড়ি থেকে খাবার আসে না, হাসপাতালের রোগীদের অপেক্ষমাণ দরিদ্র আত্মীয়েরা, অ্যাটেনডেনটদের মধ্যে যাঁরা দুঃস্থ তাঁরা, এছাড়া নতুন যে কোনও দরিদ্র ক্ষুধার্ত মানুষেরা। কত মানুষ যে এই রুটি ব্যাঙ্কের ফলে উপকৃত হচ্ছেন তার হিসাব নেই।
মানুষ যে রুটি ব্যাঙ্কের সদস্যদের দেবদূতের মত ভাবছেন ,তা বোঝা গেছে রামপ্রকাশ নামে একজন টিবি আক্রান্ত প্রায় অকর্মণ্য মানুষের কথায় -“এঁরা ঈশ্বর, ঈশ্বরই এসেছেন এঁদের বেশে। আমার তো দেবার মত কিছু নেই,তাই এঁদের প্রাণভরে আশীর্বাদ করি”।
বর্তমানে অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এঁদের সাহায্য করতে চাইছে,এঁদের কাজের এলাকা বাড়াতে বলছে। কিন্তু এঁদের বক্তব্য, যে সদস্যরা আছেন তাঁরা এলাকায় সংগৃহীত খাদ্য তালিকাভুক্ত মানুষদের মধ্যে ঠিকঠাক বিতরণ করতে পারছেন। এর থেকে বেশি করতে গেলে বিশৃঙ্খলা হতে পারে। তাঁদের সীমিতসংখ্যক সদস্য দিয়ে এলাকার তালিকাভুক্ত মানুষদের সঠিকভাবে খাদ্য বিতরণ করায় বিশৃংখলা দেখা দেবে। সংগৃহীত খাদ্যের অপচয় হতে পারে, যেটা তাঁদের নীতি নয়। যে কাজ তাঁরা আরম্ভ করেছেন সেটুকুই তাঁরা সুষ্ঠুভাবে করে যেতে চান। এমনই অভিমত তারা পাটকরের, যাঁর ‘মস্তিষ্ক -প্রকল্প ‘এই ‘রুটি ব্যাঙ্ক’।
আজ এই একবিংশ শতাব্দীতেও সংবিধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার সব মানুষের ‘খাদ্যের অধিকার’ সারা দেশে বাস্তবায়িত করা যায়নি কিছু মানুষের স্বার্থপরতায় আর আমাদের মত নাগরিকদের উদাসীনতায়। বুন্দেলখন্ডি সমাজের প্রেরণায় মাহোবাতে যাঁরা এই অভিনব ও উপযোগী কাজটি করছেন তাঁদের উদ্দেশ্যে সম্মান জানাই আর ভাবতে চেষ্টা করি আমরাও এরকম কিছু করতে পারি কিনা!
অভাবনীয় এবং স্যালুট
LikeLike