আগের পর্বগুলো
মার্চমাসের শুরুতে অভিযাত্রীদল নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু পৌঁছোলেন। অভিযাত্রীরা সমুদ্রপথে এবং কেউ কেউ আকাশপথেও গন্তব্যে পৌঁছোন। অভিযানের সাজসরঞ্জাম বহনের জন্য তিনশো মালবাহক ভাড়া করা হয়েছিল। মাসের শেষে থিয়াংবোচে মঠের কাছাকাছি মূল শিবির স্থাপিত হল।
তিন সপ্তাহ ধরে অভিযাত্রী দলের সদস্যরা ১৯০০০ ফুটের কাছাকাছি শৃঙ্গগুলি আরোহণ করতে করতে নতুন আবহাওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে উঠলেন। ১৩ই এপ্রিল হিলারি, ব্যান্ড, লো, ওয়েস্ট ম্যাকট বিশাল আইসফল ধরে পথ নির্মাণের মত শ্রমসাধ্য কাজ শুরু করলেন। ওয়েস্ট CWM অতিক্রম করে ২১০০০ ফুট উচ্চতায় স্থাপিত অ্যাডভান্স বেসক্যাম্প পর্যন্ত মালবহনের উপযোগী পথ তৈরি করতে চার সপ্তাহের বেশি সময় লাগল।
১৮ই মে জন হান্টের নেতৃত্বে প্রথম পর্বের অভিযানের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হল। সাউথ কলে নির্মিত প্রধান শিবিরে আরোহণ সামগ্রী পৌঁছতে যে উদ্যমের প্রয়োজন তার জন্য অভিযাত্রীদল পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও নিজেদের সম্পূর্ণ প্রস্তুত রাখলেন। অভিযাত্রী দলের সদস্যরা ইতিপূর্বে পরীক্ষামূলকভাবে লোৎসে গাত্রের খাড়াই দেওয়ালে দড়ি লাগিয়ে আরোহণের উপযোগী করে তুলেছেন। অর্ধেক পথ আরোহণের পর একটি শিবির স্থাপন করলেন অভিযাত্রীরা। লোৎসে গাত্রে আরোহণের সময় আরোহীদের কঠিনতম এবং অপ্রত্যাশিত বাধার সম্মুখীন হতে হল ফলে অভিযানের শুরুতেই পর্বতারোহী লো অনুভব করলেন লক্ষ্যে স্থির থাকা ও দক্ষতার জোরেই এই প্রতিকূলতা অতিক্রম করা সম্ভব।
কিন্তু এটিই ছিল প্রকৃত উৎকন্ঠার মুহুর্ত। অভিযানের নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গিয়ে তখন আবহাওয়ার উন্নতি প্রায় অলীক কল্পনা। ২৪শে মে পর্যন্ত সাউথ কলে ষষ্ঠ শিবির স্থাপন সম্ভব হল না।
হান্টের অনুমতিতে দুজন শেরপাকে সঙ্গে নিয়ে বুর্ডিলন এবং ইভান্স ওই দিনই সাউথ কল পৌঁছলেন। সিদ্ধান্ত হল তাঁরা সরাসরি কল থেকে নতুন উদ্যমে অগ্রসর হবেন। এর পর তাঁরা আরোহণ করলেন আরো ৩০০০ ফুট উচ্চতা। এই প্রথম এত উচ্চতায় পৌঁছে অভিযাত্রীদের কাছে খুব জনপ্রিয় ক্লোজ সার্কিট অক্সিজেন ব্যবহার শুরু করলেন।
পর্বত অভিযাত্রীরা বিশ্বাস করতেন এই বিশেষ ধরনের অক্সিজেন সরবরাহকারী যন্ত্র ব্যবহারের ফলে শৃঙ্গে দ্রুতবেগে আরোহণ সম্ভব। এই যন্ত্রটি নির্মাণের কৃতিত্বের দাবিদার টম বুর্ডিলন এবং তাঁর পিতা। এর আগেও পর্বতারোহীরা এই যন্ত্রের ওপরে ভরসা করতেন।
২৬শে মে বুর্ডিলন এবং ইভান্সের সাউথ কল অভিমুখে যাত্রা শুরু হল। প্রথম ১৩০০ ফুট উচ্চতা আরোহণ করলেন মাত্র ঘন্টা দেড়েকের ব্যবধানে। অত উচ্চতায় দ্রুততম আরোহণের সাক্ষ্য বহন করে এই অগ্রগতি।
কিন্তু উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে ক্রমশ আবহাওয়ার অবনতি হতে থাকল। অধিকাংশ শৈলশিরা আরোহণের পক্ষে বিপজ্জনক না হলেও ঝুরো বরফের উপস্থিতিতে প্রতি মুহুর্তে সতর্কতা প্রয়োজন।
ভোরবেলা আবহাওয়ার অবনতি তখন নিত্যদিনের ঘটনা। এছাড়া অক্সিজেন ব্যবহারের সরঞ্জামেও বিঘ্ন ঘটতে থাকায় এই উচ্চতায় পর্বতারোহীরা তখন কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন। দ্রুত সূর্যের উত্তাপ বৃদ্ধি পেতে থাকল। অভিযাত্রীরা এক ভয়াবহ খাড়াই প্রাচীরের মুখোমুখি। প্রথম ৪০০ ফুট আরোহণের পক্ষে এতই কঠিন যে পূর্বে কোন পর্বতারোহীর পক্ষে এমন খাড়াই প্রাচীর আরোহণ সম্ভব হয়নি। আকস্মিক ধ্বসপ্রবণতা এ প্রাচীরের অন্যতম বৈশিষ্ট।
কিন্তু এই অসম লড়াই সত্ত্বেও বুর্ডিলন এবং ইভান্স ২৮৭০০ ফুট উচ্চতায় এভারেস্টের দক্ষিণ শীর্ষে পৌঁছে গেলেন নিজেদের অজান্তেই। বেলা তখন একটা। ইতিপূর্বে কোন অভিযাত্রীর পক্ষেই ওই উচ্চতা আরোহণ সম্ভব হয়নি। দক্ষিণ শীর্ষের শৈলশিরার সংকীর্ণ পথ অতিক্রম করে এভারেস্ট মুকুটে তুষারাবৃত শীর্যবিন্দু নজরে এল।
সাকুল্যে বাকি আর মাইলখানেক পথ। অভিযাত্রীরা তবুও শংকিত ছিলেন, অন্তিম শৈলশিরা অতিক্রম করে শীর্ষে পৌঁছনো খুবই কঠিন হতে পারে। এত কাছে এসে পৌঁছেও সে আশঙ্কা তাঁদের দৃঢ়তর হচ্ছিল। আর ১ ঘন্টা অর্থাৎ ৩০০ ফুট আরোহণ করলেই এভারেস্ট শীর্ষে পৌঁছতে পারবেন –এই বিশ্বাস নিয়েই আরোহণ শুরু হল। ইভান্সের অক্সিজেন সরবরাহকারি যন্ত্রে আবার বিঘ্ন ঘটল। বোঝা গেল এ অবস্থায় এগিয়ে যাবার অর্থ কবরগর্ভে প্রবেশের ঝুঁকি নেওয়া।
অক্সিজেনের সরঞ্জামের বিঘ্নকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে অবশেষে শীর্ষবিন্দুর খুব কাছ থেকে ধীরে ধীরে ফিরে যেতে বাধ্য হলেন ইভান্স। এই পরিস্থিতিতে অবসন্নতার শেষ সীমায় পৌঁছেও সন্তর্পণে অগ্রসর হতে থাকলেন। কারণ সাউথ কলের উপরের খাড়াই পথ অতীব পিচ্ছিল। অবতরণের মুহুর্তেই ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। এই প্রত্যাবর্তনের পথে সহাভিযাত্রীকে মৃত্যুমুখ থেকে ফিরিয়ে আনলেন ইভান্স তাঁর অসামান্য শারীরিক দক্ষতায়। শৃঙ্গারোহণের প্রয়াস হয়তো ব্যর্থ হল, কিন্তু এভারেস্ট অভিযানের সুদীর্ঘ ইতিহাসে পর্বতারোহী চার্লস ইভান্সের দুঃসাহসিক অভিযানের কাহিনী স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে গেল।
জয়ঢাকের খেলা ও অভিযান লাইব্রেরি