কন-টিকি অভিযান-আগের পর্বগুলো
আগের কথা
ভেলায় ভাসতে ভাসতে থর হেয়ারডালের মনে হল, সত্যি তো কীভাবে এলাম এই মাঝ সমুদ্রে, কেমন করে ঘটল এমন? ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ল দশ বছর আগের কথা। পলিনেশিয় দ্বীপ ফাটু হিভায় স্ত্রীকে নিয়ে এসে রয়েছেন থর। উদ্দেশ্য জীবজন্তু আর প্রাচীন সভ্যতার প্রত্নবস্তু নিয়ে গবেষণা করা। এক সন্ধ্যায় সমুদ্রের পাড়ে বৃদ্ধ টেই টেটুয়ার কথায় নড়ে চড়ে বসলেন থর। তিনি শোনালেন টিকি, সূর্যের ছেলের কথা, তাদের এই দ্বীপের প্রাচীন দেবতার কথা। বললেন, পুব দিক হতে অনেক দূরের মহাদেশ থেকে টিকি তার পূর্বপুরুষদের নিয়ে এসেছিলেন এই দ্বীপভূমিতে। থর হেয়ারডালের ঘুম হল না সে রাতে।
একটি সিদ্ধান্ত
তো এইভাবেই শুরুটা হয়েছিল। তারপর এটা সেটা সাত সতেরো সেরে ছটি প্রাণী আর একটা তোতা এই ভেলায় দক্ষিণ আমেরিকার কূল ছেড়ে ভেসে পড়লাম।
ফাটু হিভা থেকে ফিরে আমি আমার সংগ্রহের সব পোকামাকড়, মাছ-টাছ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী সংগ্রহশালায় দিয়ে দিলাম। আমার মনে আছে, বাবা বেশ ধাক্কা খেয়েছিলেন, মাও কম আশ্চর্য হননি, মায় বন্ধুরাও। আমি জীবজন্তু ছেড়ে প্রাচীন মানুষদের বিষয়ে কাজ করতে চাইছিলাম। দক্ষিণ সাগরের অমীমাংসীত রহস্যগুলো আমাকে টানছিল, আবিষ্ট করেছিল। আমি নিশ্চিত ছিলাম এর একটা যুক্তিযুক্ত সমাধান আছেই। আমি ঠিক করে ফেলেছিলাম, পৌরানিক নায়ক ‘টিকি’ কে শনাক্ত করাটাই আমার লক্ষ্য।
পরবর্তী কয়েকটা বছরে ঢেউভাঙা তট, জঙ্গলের ভাঙাচোরা ধ্বংসাবশেষ এসব ফিকে হয়ে এল, নেপথ্যে চলে গেল; শুরু হয়ে গেল প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানুষদের নিয়ে আমার পড়াশোনা। যদিও আমি মনে করি চার দেয়ালের মধ্যে বসে পড়ুয়া একটি ছেলে কখনই একজন প্রাচীন মানুষের ভাবনা, ঝোঁক, এসবের ধরতাই পেতে পারে না। তবুও সে কী পারে? সে পারে গ্রন্থাগারের নানান বইয়ের মাঝে ঘুরে বেড়াতে, সময়ের বাধাধরা গণ্ডি পেরিয়ে দিগন্তের দিকে চলে যেতে। যে কোন অভিযাত্রীর চেয়ে ঢের বেশি। প্রাচীন অভিযানের বিবরণী, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, ইউরোপ আমেরিকার যাদুঘরগুলোর অসংখ্য সংগ্রহের সাহায্য নিয়ে আমি ধাঁধার টুকরোগুলো জুড়তে চাইছিলাম। দক্ষিণ আমেরিকা আবিষ্কারের পর আমাদের লোকেরাই যেহেতু প্রথম প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলোতে পৌঁছেছিল, তাই গবেষকরা বিজ্ঞানের প্রায় সব শাখাতেই তথ্যের এক বিরাট ভান্ডার তৈরি করে ফেলেছিলেন। দক্ষিণ সমুদ্রের আশপাশে বসবাসকারী সব মানবগোষ্ঠীর তথ্যই ছিল সেখানে। কিন্তু এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপবাসীরা প্রথম কোত্থেকে এল, কী করেই বা এল, এ নিয়ে কেউ একমত ছিলেন না। অথবা প্রশ্নটা রাখা যাক এভাবে, এই মানুষদের অস্তিত্ব কেনই বা শুধুমাত্র প্রশান্তমহাসাগরের এই পুবের দ্বীপগুলিতেই দেখা গেল?
শেষমেশ যখন ইউরোপীয়রা এই বিশাল মহাসাগর পেরোনোর অভিযানে নামল, তারা দেখল যে বিশাল সমুদ্রের মাঝামাঝি এই ছোট্ট ছোট্ট পাহাড়ি দ্বীপ, বাইরের পৃথিবী থেকে তো বটেই নিজেরাও আলাদা আলাদা, আর চারপাশে প্রবাল প্রাচীর। সব দ্বীপেই মানুষ থাকে। এবং তারা অনেককাল আগেই এখানে পৌঁছেছে। বেশ লম্বা, সুন্দর চেহারার মানুষ, সাথে পোষা কুকুর, শুয়োর আর মুরগি। অভিযাত্রীদের তারা অভ্যর্থনাও করল। কোত্থেকে এলেন এই মানুষেরা? তারা এমন ভাষায় কথা বলে যে কোনো ভাষার সাথে তাদের মিল নেই। আমাদের সাদা চামড়ার অভিযাত্রীরা যারা বেশ বুক ফুলিয়েই এই দ্বীপগুলি আবিষ্কারের কথা প্রচার করে তারা দেখেছিল সবকটা দ্বীপেই মন্দির, ঘরবাড়ি, চাষের জমিসহ গ্রাম রয়েছে। কিছু কিছু দ্বীপে তো প্রাচীন পিরামিড, পাকা রাস্তা, প্রায় চারতলা সমান উঁচু পাথর-খোদাই মূর্তি অবধি পাওয়া গেছিল। তবুও পুরো ধাঁধাঁটার উত্তর মেলেনি। এই মানুষেরা কারা? কোত্থেকেই বা এল?
খুব সহজেই বলা যায় যে এদের নিয়ে যত লোক কাজ করেছেন ধাঁধাঁর উত্তরও ততগুলি। একেকজন গবেষক একেকটা সমাধান বাৎলেছেন আর পরবর্তী কেউ এসে যুক্তি তর্ক দিয়ে তা খারিজ করেছেন। মালয়, ভারত, চীন, জাপান, আরবদেশ, মিশর, ককেশাস, আটলান্টিস, এমনকী জার্মানি এবং নরওয়ে যেকোনোটাই পলিনেশিয়ার মানুষদের আদিভূমি হতে পারত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটা না একটা খটকা এসে উপস্থিত হয়েছে আর সমাধান না পাওয়ায় পুরো প্রস্তাবটিই খারিজ হয়ে গেছে।
আর এ তো জানা, যেখানে বিজ্ঞান থেমে যায়, কল্পনা ডানা মেলে। ইস্টার দ্বীপের পাথরের মূর্তিগুলো, ছোটো ছোটো দ্বীপের অন্যান্য ভগ্নাবশেষ, যার ইতিহাস জানা নেই, একদিকে প্রশান্তমহাসাগরের দ্বীপ আর অন্যদিকে দক্ষিণ আমেরিকার উপকূল, দুয়ের ব্যবধান, সম্ভাবনার নানান ভাবনা উসকে দিতে থাকল। অনেকেই ইস্টার দ্বীপের মূর্তিগুলোর সাথে দক্ষিণ আমেরিকার প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতার চিহ্নগুলির সাথে সম্পর্ক খুঁজে পেলেন। হতে পারে এই দুই ভূখণদের মধ্যে একটা যোগসূত্র ছিল, একটা সেতু, পরে সেই জমি জলে ডুবে যায়! হতে পারে এই সব পাহাড়ি দ্বীপগুলো আসলে একটা বড়ো মহাদেশের অংশ। গোটা মহাদেশ ডুবতে ডুবতে এখন শুধু পাহাড়ের মাথাগুলো জেগে আছে জলের ওপর।
সাধারণ লোকে এটা বিশ্বাস করলেও করতে পারে, কিন্তু ভূতাত্ত্বিক বা অন্যান্য বৈজ্ঞানিকেরা তা মানেননি। উলটে, জীববিজ্ঞানীরা স্রেফ প্রমাণ করে দিলেন, দ্বীপের পোকামাকড় আর শামুক ঘেঁটেঘুঁটে, যে, আজীবন এই দ্বীপগুলো নিজেরা ছাড়াছাড়া তো ছিলই, আশেপাশের মহাদেশগুলোর তুলনায় বিলকুল আজকের মতো একই রকম দূরে ছিল। মানুষ যখন থেকে এসেছে পৃথিবীতে তখন থেকেই!
ফলে, নিশ্চিতভাবে জেনে গেলাম, এই পলিনেশিয় লোকেরা ইচ্ছেয় হোক অনিচ্ছেয় হোক আশেপাশের মহাদেশ থেকেই সাগর পাড়ি দিয়ে ভেসে ভেসেই এসেছে। এই মানুষদের আরো খুঁটিয়ে লক্ষ্য করে বোঝা যাবে ঘটনাটা যে কয়েক শতাব্দী আগে হয়েছে এমনটাও নয়। তার কারণ, ইউরোপের প্রায় চারগুণ এলাকার সমান সামুদ্রিক এলাকাতে ছড়ানো ছেটানো দ্বীপগুলোয় ভাষা আলাদা আলাদা নয়। উত্তরে হাওয়াই থেকে দক্ষিণে নিউজিল্যান্ড, পশ্চিমে সামোয়া থেকে পুবের ইস্টার, বিচ্ছিন্ন সব জনজাতিরাই একই ভাষায় কথা বলে, যাকে আমরা নাম দিয়েছি পলিনেশিয়।
লেখার ব্যাপারটা সব দ্বীপেই অজানা ছিল। কেবল ইস্টার দ্বীপে কয়েকটা কাঠের ফলক ছিল, হায়ারোগ্লিফের মতো দুর্বোধ্য কিছু লেখা তাতে। ওরা তো নয়ই, কেউই তার পাঠোদ্ধার করতে পারেননি। কিন্তু ওদের স্কুল ছিল। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ইতিহাস পড়ানো। কবিতার মাধ্যমে। কেন না ইতিহাস আর ধর্ম পলিনেশিয়দের কাছে সমার্থক। এরা ছিল পূর্বপুরুষদের পূজারী। ‘টিকি’-র সময় অবধি মরে যাওয়া সমস্ত মোড়লেরাই ছিল উপাস্য। আর তারা বিশ্বাস করতেন ‘টিকি’ ছিলেন সূর্যের ছেলে।
প্রতিটি দ্বীপেই শিক্ষিত লোকটি গোড়ার দিন থেকে সেদিন অবধি সমস্ত দ্বীপের মোড়লদের নাম বলে দিতে পারত। মনে রাখার জন্য পাকানো দড়িতে গিঁট বেঁধে তারা অদ্ভুত ও জটিল ধরনের উপায় ব্যবহার করত। ঠিক যেমন পেরুর ইনকা সভ্যতার লোকেরা করত। আধুনিককালে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন দ্বীপ থেকে ভিন্ন ভিন্ন বংশলতিকা নিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছেন আশ্চর্যজনকভাবে সেগুলিরতে বংশ পরম্পরায় নামগুলির হুবহু মিল। গড়ে পলিনেশিয়দের একেকটা প্রজন্ম ২৫ বছর ধরে হিসেব করে দেখা গেছে ৫০০ খৃষ্টাব্দের আগে এখানে মানুষ আসেনি। একটা সম্পূর্ণ নতুন ধারার সংস্কৃতি আর মোড়লদের নামের আভাস থেকে অনুমান করা গেছে পরবর্তী সময়ে শেষ আরেকদল এই দ্বীপগুলিতে এসে পৌঁছয় প্রায় ১১০০ খৃষ্টাব্দ নাগাদ।
এই শেষের মানুষেরা কোত্থেকে এল? খুব কম অনুসন্ধানকারীরাই খেয়াল করেছিলেন যে এত পরে আসা মানুষেরা কিন্তু আদতে প্রস্তরযুগের মানুষই ছিলেন। আর সেটাই বড়ো একটা বৈশিষ্ট্য। বুদ্ধিতে, সংস্কৃতিতে যথেষ্ট উন্নত হওয়া সত্ত্বেও সাগর পাড়ি দেওয়া এই মানুষেরা সঙ্গে করে এনেছিলেন বিশেষ একধরনের পাথরের কুঠার আর প্রস্তরযুগের বেশ কিছু যন্ত্রপাতি। সবকটা দ্বীপেই ছড়িয়েছিল এই ধরণের জিনিসপত্র। ভুললে চলবে না, একেবারে জঙ্গলের মধ্যে একক সম্প্রদায় বা খুবই পিছিয়ে পড়া জনজাতিদের কথা বাদ দিলে সারা পৃথিবীতে আর কোথাও প্রস্তরযুগের মানুষ ছিল না, অন্তত ৫০০ বা ১১০০ খৃষ্টাব্দে। একমাত্র ছিল এই নতুন আবিষ্কৃত পৃথিবীতে! ইউরোপীয় অভিযানের সময় অবধি, এমনকী সবচেয়ে উন্নত ইন্ডিয়ানরাও১ ন্যূনতম লোহার ব্যবহার জানত না, পাথরের কুঠার আর অন্যান্য জিনিসপত্র ব্যবহার করত, দক্ষিণ সমুদ্রের এই দ্বীপবাসীদের মতো।
এই ইন্ডিয়ান১ সভ্যতাই পূর্ব দিকে পলিনেশিয়দের নিকটতম আত্মীয় বলা যেতে পারে। পশ্চিমে অস্ট্রেলিয়া এবং মেলানেশিয়ার আদিম কালো মানুষদের বাস, যাদের নিগ্রোদের সঙ্গে মিল আছে। আর তারও পশ্চিমে ইন্দোনেশিয়া আর এশিয়ার ভূখন্ড, সেখানে প্রস্তরযুগের মানুষ বসবাস করত আরো অনেককাল আগে, পৃথিবীর অন্যান্য যেকোনো জায়গার চেয়েই ঢের ঢের আগে।
ফলে আমার সন্দেহ আর মনোযোগ দুইই পুরোনো পৃথিবী থেকে ঘুরে গেল। সেখানে বহু খোঁজাখুজিতেও তো কিছু মিলল না। তবে আমেরিকার ইন্ডিয়ান সভ্যতার জানা অজানা পৃথিবীতে নজর ফেরানো যাক, সেদিকটা যে কেউ এর আগে ভেবেই দেখেনি! পুবদিকে একদম কাছের উপকূল দক্ষিণ আমেরিকার পেরু। একটু নজর করে দেখলেই দেখা যাবে সে দেশে সমুদ্র থেকে পাহাড় অবধি বহু সূত্রের সন্ধান মিলবে। এখানে একদল অজানা মানুষ একসময় বাস করত এবং সবচেয়ে আশ্চর্য, চমৎকার
সভ্যতা স্থাপনও করেছিল, তারপর হঠাৎ, বহুকাল আগেই একদিন, হঠাৎ উবে গেল, যেন পৃথিবীর বুক থেকেই মুছে গেল! রেখে গেল বিরাট বিরাট পাথরে খোদাই করা মানুষের মূর্তি। যেমন কিনা পিটকেয়ার্ন, মার্কোয়েসাস, ইস্টার দ্বীপে । আর ধাপে ধাপে বানানো পিরামিড, যেমনটি তাহিতি কিংবা সামোয়া দ্বীপে! পাহাড়ের বুক থেকে রেলের কামরার সমান আকারের আর হাতির চেয়ে ভারী পাথরের খন্ড কেটে কেটে কেটে বহুদূর বয়ে নিয়ে একের পর এক পাথর সাজিয়ে দেওয়াল, তোরণ, সিঁড়ি বানিয়েছিল এই মানুষেরা, ঠিক যেমন প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলোতেও পেলাম। স্পেনের মানুষেরা প্রথম যখন পেরুতে এল সেখানে তখন ইনকা সভ্যতার বিশাল সাম্রাজ্য। তারা স্পেনীয়দের জানিয়েছিল পাথরের এই বিশাল সৌধগুলি জনমানবহীন জায়গায় সাদা চামড়ার ঈশ্বরেরা বানিয়েছিলেন। তারা এখানে ইনকাদেরও আগে থেকে থাকতেন। ইনকারা বলল, অদৃশ্য হয়ে যাওয়া এই স্থপতিরা এসেছিলেন, উত্তরের দিক থেকে, সভ্যতার সেই শুরুতে। তারা ইনকাদের পূর্বপুরুষদের চাষবাস, স্থাপত্য, আচার-আচরণ, রীতিনীতি সব শিখিয়েছিল। অন্যান্য ইন্ডিয়ানদের চেয়ে তাদের আলাদা করা যেত সাদা চামড়া আর লম্বা দাড়িতে। ইনকাদের চেয়েও খানিক লম্বা ছিল তারা। শেষকালে তারা হঠাৎই পেরু থেকে চলে গেল, যেমন আচমকা এসেছিল তেমনিই। ইনকারা দেশের শাসনক্ষমতা দখল করল আর সাদা চামড়ার জ্ঞানী লোকগুলো দক্ষিণ আমেরিকার তটভূমি থেকে যেন উবে গেল, প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে আরও পশ্চিমে সরে পড়ল তারা।
এখন ব্যাপারটা এই দাঁড়াল যে ইউরোপীয়রা যখন প্রশান্তমহাসাগরের এই দ্বীপপুঞ্জে এল, দেখল, এখানকার বেশিরভাগ মানুষই সাদা চামড়ার, আর অনেকেরই মুখে দাড়ি। অনেক দ্বীপেই গোটা পরিবারকেই সুস্পষ্টভাবে চিনে ফেলা যায়, কারণ তাদের গায়ের হালকা রঙ, লালচে থেকে সোনালি রঙের চুল, নীলাভ-ধূসর চোখ, আর সেমেটিকদের মতো টিকোলো নাক। অন্যদিকে সত্যিকার পলিনেশিয়দের গায়ের রঙ উজ্জ্বল বাদামি, কুচকুচে চুল আর প্রায় থ্যাবড়া নাক। লালচে চুলের লোকেরা নিজেদের ডাকে উরুকেহু বলে। তারা এও বলে যে তারা এই দ্বীপের প্রথম আসা দেবতাদের বংশধর। তারাই ছিলেন এখানকার সাদা চামড়ার ঈশ্বর, যেমন ট্যাংগোরা, কেইন, এবং টিকি। প্রাচীন সেই সাদা চামড়ার মানুষদের নিয়ে অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত রহস্যময় গল্পকথা সমস্ত দ্বীপগুলিতে আজও প্রচলিত। ১৭২২ সালে যখন রগিভিন ইস্টার দ্বীপ আবিষ্কার করেন, সমুদ্রের পাড়ে অন্যান্য মানুষদের মাঝে তিনি সাদা চামড়ার মানুষ দেখে আশ্চর্য হয়ে যান। ইস্টার দ্বীপের মানুষেরা বিশ্বাস করতেন তারা প্রথম আসা সাদা চামড়ার মানুষদেরই বংশধর। তাদের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন সেই প্রাচীন টিকি আর হোটু মাটুয়াদের সময়কার লোক, যারা সূর্যধোয়া পুবের পাহাড়ি দেশ থেকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এসেছিলেন।
যখন খোঁজ করছিলাম সেই সময় পেরুতে আমি আশ্চর্য সব নিদর্শন খুঁজে পাচ্ছিলাম। সভ্যতা, সংস্কৃতি, মিথ, ভাষা কোথায় নয়! ফলে আমি আরো গভীরভাবে এবং আরো ব্যাপক অনুসন্ধান শুরু করলাম। লক্ষ্য স্থানীয় দেবতা টিকি আর পলিনেশিয়দের উৎস খুঁজে পাওয়া।
আর খুঁজেও পেলাম, যা চাইছিলাম। ইনকাদের প্রাচীন কাহিনীতে পড়লাম রাজা ভিরাকোচার গল্প, তিনি ছিলেন পেরুর প্রাচীন গল্পকথার সাদা চামড়ার মানুষদের সর্বময় কর্তা –
…ভিরাকোচা একটি ইনকা (কেচুয়া) নাম এবং খুব একটা পুরোনো নয়। সূর্যদেবতা ভিরাকোচার আসল নাম ছিল কন-টিকি বা ইল্লা-টিকি, যে নামটিই বোধ করি প্রাচীন পেরুতে বেশি ব্যবহৃত হত। এর মানে সূর্য-টিকি বা আগুন-টিকি। কন-টিকি ছিলেন ইনকাদের প্রাচীন সাদা মানুষদের রাজা এবং প্রধান পুরোহিত। যার বিরাট ভগ্নাবশেষ লেক টিটিকাকার পারে দেখা যায়। প্রাচীন গল্পটা এইরকম – ককিম্বো উপত্যকার কারি নামে একজন সর্দার, এই রহস্যময় দাড়িওয়ালা সাদা মানুষদের আক্রমণ করে বসল।। টিটিকাকা হ্রদের মধ্যে এক দ্বীপে সাদা মানুষগুলো যুদ্ধে কচুকাটা হল কিন্তু কন-টিকি আর তার ঘনিষ্ঠ সাঙ্গপাঙ্গরা প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে পালিয়ে গেলো আর শেষমেশ উপকূল ছেড়ে উবেও গেল পশ্চিমের দিকে ……
আমার আর কোনো সন্দেহ ছিল না, যে পেরুর প্রধান সূর্যদেবতা কন-টিকি, যাকে ইনকারা তাদের প্রতিষ্ঠাতা বলে মানে, তাকেই পেরু থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এবং তার সঙ্গে প্রশান্ত মহাসাগরের সমস্ত দ্বীপবাসীদের প্রধান দেবতা, যাকে তারা নিজেদের জাতের প্রতিষ্ঠাতা বলেও মানে, সেই সূর্যের পুত্র ‘টিকি’-র কোনো প্রভেদ নেই। পেরুতে সূর্য-টিকির গল্পে জীবনের যে সব খুঁটিনাটি, টিটিকাকা হ্রদের আশপাশের প্রাচীন জায়গার নামধামগুলো, প্রশান্তমহাসাগরীয় দ্বীপের ইতিহাসের কাহিনীতে এসে দিব্যি খুঁজে পাওয়া গেল।
আমি কিন্তু সমস্ত পলিনেশিয়াতে ঘুরে প্রমান পেয়েছি, যে শান্তিপ্রিয় কন-টিকির লোকজনেরা দ্বীপের দখল দীর্ঘদিন ধরে রাখতে পারেনি। প্রমান পাওয়া গেছে যে সমুদ্রযাত্রায় সক্ষম নৌকো, ভাইকিংদের জাহাজের মতো বড়ো বড়ো এক একখানা, দুটো দুটো নৌকো, উত্তরপশ্চিমের ইন্ডিয়ানদের বয়ে এনেছিল নতুন মহাদেশ থেকে হাওয়াই অবধি এবং আরো দক্ষিনের দ্বীপগুলোতে। কন-টিকি-র মানুষদের সাথে তাদের রক্তের মিশেলে একটা নতুন সভ্যতার জন্ম হল দ্বীপরাষ্ট্রে। এরা সেই দ্বিতীয় প্রস্তর-মানুষেরা, যারা এখানে এসেছিল, ধাতুর ব্যবহার না জেনে, কুমোরের বিদ্যে না জেনে, চাকা বা চরকা ছাড়া, এমনকী শস্যফলানোর জ্ঞান বিনাই, মাত্র ১১০০ খ্রীষ্টাব্দে।
সুতরাং যা ঘটল, আমি প্রাচীন পলিনেশিয় শিলালিপি উদ্ধারে খোঁড়াখুড়ি চালাচ্ছিলাম, ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার উত্তরপশ্চিম উপকূলে, এমন সময় জার্মানরা নরওয়ের ওপর হামলা করে বসল। সেটা ১৯৪০।
***
এক দো তিন এক। ব্যারাকের সিঁড়ি ধোয়া, বুটপালিশ, রেডিও স্কুল, প্যারাশুট, শেষে মারম্যানস্ক বাহিনী ঢুকে এল ফিনমার্ক। সূর্যদেবতার বদলে সারাটা শীতের অন্ধকার জুড়ে প্রযুক্তির যুদ্ধদেবতার রাজত্ব কায়েম হল। একসময় শান্ত হল সব। আমার তত্ত্বও ততদিনে সম্পূর্ণ হয়েছে। এবারে আমেরিকা। এই সিদ্ধান্তটি সকলকে জানানো প্রয়োজন।
————————————————
১। ইন্ডিয়ান বলতে আমেরিকার প্রাচীন অধিবাসীদের বোঝানো হয়েছে। ভারতবাসী নয়।
ক্রমশ
খেলার পাতায় সমস্ত ধারাবাহিক অভিযান একত্রে