কন-টিকি অভিযান-আগের পর্বগুলো
থর হেয়ারডাল। (অনুবাদঃ ইন্দ্রনাথ)
আগের কথা
ভেলার নীচটা সামুদ্রিক শ্যাওলায় ভরে এক সমুদ্র-দানোর রূপ নিয়েছে। পাইলট মাছের ঝাঁকও জুটে গিয়েছিল সঙ্গে। অভিযাত্রীদের সাবধান করে দেওয়া ছিল অক্টোপাস সম্বন্ধে। ভেলা তখন সমুদ্রের যে অংশ দিয়ে যাচ্ছিল সে অঞ্চলটা অক্টোপাস সমৃদ্ধ। রাক্ষুসে খিদে অক্টোপাসদের। ফসফরাসের মতো জ্বলজ্বলে চোখ, শুঁড়গুলো ভয়ানক আর এত বড়ো যে ভেলার প্রতিটি কোনায় পৌঁছে যেতে পারে। অভিযাত্রীরা বহুদিন স্কুইডের দেখা পাননি; তারপর একদিন সকালে কেবিনের বাইরে বাইরে, দেখা গেল বাঁশের ওপর শুঁড় পেঁচিয়ে একটা স্কুইড। তার চারপাশে ঘন কালো কালির মতো একটা তরল বাঁশের ডেকের ওপরে ছড়ানো। তারপর একদিন দেখা গেল কেবিনের ছাতের ওপর। ওরা আশ্চর্য হয়ে গেলেন। দিনে রাতে কখনোই বড়ো ঢেউ ছিল না, অথচ ওটা ওখানে গেল কী করে? হতবাক হয়ে পড়লেন অভিযাত্রীরা। এরপর থেকে ছোটো স্কুইডের আনাগোনা বেড়ে গেলেও বড়োদের অস্তিত্ব ওরা দেখতে পাননি। তবে কেবিনের ছাতের উঠে পড়ার রহস্যভেদ হল। ওরা দেখলেন ছোটো ছোটো স্কুইডরা খাদকের হাত থেকে বাঁচতে উড়ুক্কু মাছেদের মতো বাতাসে লাফ দিয়ে উঠতে পারে। রকেটের নীতি অনুযায়ী সমুদ্রের জল বিশেষ কায়দায় পাম্প করে এবং বার করে দিয়ে ওরা প্রচণ্ড গতিবেগে জল ছেড়ে লাফিয়ে উঠে কিছুটা দূর অবধি খুব জোরে উড়েও যেতে পারে। অভিযাত্রীরা পরে জানতে পেরেছিলেন প্রাণীবিজ্ঞানীদের কাছেও এটা একটা অজানা বিষয় ছিল। স্কুইডরা অবশ্য খাবার হিসেবে ততটা আকর্ষণীয় ছিল না। অপরিচিত আরো বহু প্রাণীর সাক্ষাতও পেয়েছিলেন ওরা। ডায়েরিতে নথিবদ্ধ করে রাখা ছিল সেসব। পর্যায়ক্রমে ভেলার পাটাতন পরীক্ষা করা হত। এমনই একদিন একটা উল্লম্ব পাটাতন ঠিক করতে গিয়ে প্রায় হাঙরের আক্রমণের মুখে পড়েছিলেন ন্যুট। তখন একটা ডাইভিং বাস্কেট বানানো হল। ভেলার তলাটা যেন এক আশ্চর্য অ্যাকোরিয়ামের যাদুজগৎ। শ্যাওলাধরা উজ্জ্বল লগের ফাঁকে ডলফিন, দল বেঁধে বেড়ানো মাছের ঝাঁক, সোনালি পাখনার টুনিমাছ আরো কত কী! প্যাসিফিক চার্টে একটা দ্বীপের হদিশ দেয়া ছিল। এইবারে অভিযাত্রীরা তার কাছাকাছি এসে পড়লেন। কিন্তু দু’দিন সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে, ভারবাহী দড়ি নামিয়ে, দূরবীনে চোখ লাগিয়েও সে দ্বীপের অস্তিত্ব পাওয়া গেল না। ওরা পেরিয়েও এলেন ম্যাপে দেখানো সে জায়গাটা। এরই মধ্যে ভেলার পাটাতন উঠিয়ে নামিয়ে গতিপথ বদলানোর কায়দাটা আচমকাই আবিষ্কার করে ফেললেন ওরা। সে ছিল প্রাচীন ইনকাদের সুদক্ষ ভেলা চালানোর একটা অঙ্গ।
সাগরপাড়ি
সমুদ্র যখন খুব একটা উত্তাল থাকত না, আমরা ছোটো রাবারের ডিঙিটা নিয়ে ভেসে পড়তাম ছবি তোলার জন্য। প্রথমবারটা তো আমি ভুলব না; সমুদ্র একদম শান্ত দেখে আমাদের দুজন বেলুনের মতো ডিঙিটা ভাসিয়ে একটু বেয়ে আসবে বলে জলে নেমেছে। ভেলা থেকে একটু দূরে গেছে কী যায়নি, বৈঠা বাওয়া ছেড়ে উদ্দাম হাসতে শুরু করেছে ওরা। ঢেউয়ের ধাক্কায় ওরা একবার ওঠে একবার ডোবে, একবার দেখা যায়, পরক্ষণেই অদৃশ্য, আর আমাদের দেখতে পাওয়া মাত্রই প্রবল হাসি, নির্জন সাগরের বুকে ওদের কথা মিলিয়ে যাচ্ছিল। আমরা এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছিলাম, আমাদের দাঁড়িগোঁফওয়ালা মূর্তি ছাড়া হাস্যকর কিছুই চোখে পড়েনি। কিন্তু ডিঙির দুজন এই মূর্তির সঙ্গে ইতিমধ্যেই বেশ পরিচিত, ফলে আমাদের মনে একটা চাপা সন্দেহ উঁকি দিল যে ওই দুজন হঠাৎই পাগল হয়ে গেছে। সানস্ট্রোক, বোধহয়। ওরা হেসে কুটিপাটি, চোখে প্রায় জল এসে গেছে, কোনোমতে ভেলায় উঠে আমাদের বলল, একবার যাও গিয়ে দেখো ব্যাপারটা।
আমাদের মধ্যে অন্য দুজন দুলতে থাকা ডিঙিটায় লাফ দিয়ে উঠলাম, আর অমনি ঢেউ আমাদের তুলে ফেলল শূন্যে। সঙ্গে সঙ্গেই আমরা ধপাস করে বসে পড়লাম আর হো হো করে হেসে উঠলাম। হাঁচড়পাচড় করে ভেলায় উঠে পড়লাম আর বাকি দুজন, যারা তখনও যায়নি, তাদেরকে ঠাণ্ডা করলাম; ওরা ভেবেছিল আমরা সকলেই বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছি। আমাদের ওরকমটা পাগল পাগল অবস্থা হয়েছিল একটু দূর থেকে আমাদের সাধের ভেলাটাকে গোটাটা একসাথে প্রথমবার দেখে। খোলা সমুদ্রে আমরা এর আগে গোটাটা একসাথে বাইরে থেকে দেখিনি। কাঠের গুঁড়িগুলো ছোটো ছোটো ঢেউয়ের আড়ালে পড়ে যতটুকু নজরে এল, তা হল নীচু কেবিন, তার খোলা দরজা, আর পাতায় ছাওয়া ছাত ঢেউয়ে উঠছে নামছে। ভেলাটাকে অবিকল নরওয়ের পুরোনো খড়ছাউনির মতো লাগছিল, অসহায় একটা কুঁড়ের মতো সমুদ্রে ভাসছে; রোদেপোড়া কতগুলো দাড়িমুখো বদমাশদের নিয়ে একটা বেঁকাতেরা খড়ছাউনি। আমাদের পেছন পেছন যদি কেউ বাথটাবে চড়ে সমুদ্দুর বাইতে বাইতে আসত, আমাদেরও অমনিই হাসি ভুসভুসিয়ে উঠত। সাধারণ মাঝারি মাপের ঢেউ কেবিনের দেওয়ালের উচ্চতায় উঠে এলে মনে হয় এইবারে দরজার ভেতর দিয়ে হাঁ করে শুয়ে থাকা লোকগুলোর ওপর অবাধে হুড়মুড় করে গিয়ে পড়বে। কিন্তু তখুনি পাগলাটে ভেলাটা ঢেউয়ের ওপরে উঠে পড়ছে আর ভবঘুরে লোকগুলো শুকনো খটখটে, তেমনিই হাঁ করে, খোঁচাখোঁচা দাড়িগোঁফ নিয়ে আগের মতোই শুয়ে আছে। বড়ো ঢেউ এলে, কেবিন, ভেলার পাল, মায় মাস্তুল অবধি পাহাড়প্রমান জলের পেছনে চাপা পড়ে যাচ্ছে কিন্তু নিশ্চিতভাবে পরমুহূর্তেই কেবিন আর তার ভবঘুরেদের অমনিই দেখা যাচ্ছে। ঘটনাটা দেখতে যথেষ্টই খারাপ আর ভেলার ওপরে আমরা কিছুই বুঝতেই পারতাম না; বিদঘুটে ভেলায় সবই ঠিকঠাক থাকত।
পরের বার ডিঙিতে ভেসে নিজেদেরকে দেখে খুব একচোট হাসাহাসি করতে গিয়ে প্রায় একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছিলাম। যতটা ভেবেছিলাম বাতাস আর ঢেউ তার চেয়ে বেশিই ছিল, কনটিকিও ঢেউ চিরে আমাদের ধারণার চেয়ে দ্রুতগতিতেই এগোচ্ছিল। খোলা সমুদ্রে প্রাণ বাঁচাতে আমরা তড়িঘড়ি বাইতে শুরু করলাম যাতে অনিয়ন্ত্রিত ভেলাটায় উঠে পড়তে পারি, কেননা ভেলাটা থামা তো দূর সম্ভবত ঘুরেও আসতে পারত না। কনটিকিতে আমাদের ছেলেরা পাল নামিয়ে দিলেও বাঁশের কেবিনে বাতাস এসে এমনভাবে ধাক্কা দিচ্ছিল যে ভেলাটা পশ্চিমদিকে ভেসে চলেছিল আর আমরা পেছনে পেছনে ডিঙি চেপে নাচতে নাচতে ছোট্ট বৈঠা নিয়ে যত জোরে পারি এগোচ্ছিলাম। সকলের মাথায় একটাই চিন্তা ছিল, আমাদের বিচ্ছিন্ন হওয়া চলবে না। কোনোমতে হামাগুড়ি দিয়ে ভেলায় ওঠার আগে কয়েক মুহূর্ত বিভিষিকাময় কেটেছিল – শেষমেশ নিজেদের ঘরে।
সেদিন থেকে লম্বা দড়ি না বেঁধে ডিঙি ভাসানো একেবারে নিষিদ্ধ হল, এতে করে দরকারে ভেলায় যারা থাকবে তারা ডিঙিটা টেনে আনতে পারবে। এরপর থেকে কেবল বাতাস না থাকলে আর সমুদ্রের ঢেউ প্রায় না থাকার মতো না হলে, আমরা ভেলা ছেড়ে কখনোই খুব দূরে যাইনি। কিন্তু ভেলা যখন পলিনেশিয়ার মাঝপথ অবধি, ততক্ষণ এই শর্তটা রাখা ছিল; এখানে কর্তৃত্ব শুধুই সমুদ্রের, সেটা চতুর্দিকেই ঢালু হয়ে গড়িয়ে গেছে। এরপর থেকে অবশ্য আমরা নিরাপদেই কনটিকি ছেড়ে আকাশ আর সমুদ্রের মধ্যবর্তী নীলে ভেসে যেতে পারতাম।
যখন আমাদের ভেলাটার শ্যিলুট দূরে ক্রমশ ছোটো হতে হতে শেষমেশ ওর বিরাট পালটা অবধি দিগন্তে কালো অস্পষ্ট চৌকো হয়ে দেখা যেত, সেসময়ও একটা অদ্ভুত একাকীত্ব আমাদের পেয়ে বসত। আমাদের নীচে সাগরের নীল জল ঢাল হয়ে গড়িয়ে গেছে, আকাশের নীল আর সাগরের নীল মিলেমিশে একাকার। মনে হত যেন শূন্যে ঝুলে আছি আমরা। আমাদের জগৎটা যেন শূন্য এবং নীলাভ; চারপাশে কোনো নির্দিষ্ট স্থির বিন্দু নেই, কেবল আমাদের ঘাড়মাথা পুড়িয়ে দেয়া উজ্জ্বল সোনালি সূর্য ছাড়া। এরপর একলা ভেসে থাকা দূরের ভেলাটার পাল আমাদের চুম্বকের মতো দিগন্তের দিকে আকর্ষণ করে নিত। আমরা ক্রমে বৈঠা বেয়ে এসে ভেলায় উঠে পড়তাম, মনে হত যেন আমাদের পৃথিবীতে, নিজেদের ঘরে ফিরে এলাম। যদিও ভেলায়, তবু শক্ত জমিতে। বাঁশের কেবিনের ভেতর বাঁশের আর পাম-পাতার ছায়া আর গন্ধ। চারপাশের কেবিনের দেয়ালের ফাঁক দিয়ে রৌদ্রস্নাত নীলের স্নিগ্ধতা আমরা যথাযথ দেখতে পেতাম। তাতেই আমরা অভ্যস্ত ছিলাম, আর কিছু সময় অবধি ভালই লাগত সেটা, যতক্ষণ না বাইরের আদিগন্ত নীল আবার আমাদের হাতছানি দিয়ে ডেকে নিত।
আমাদের ওপর নড়বড়ে বাঁশের কেবিনের কী যে অসাধারণ মানসিক প্রভাব ছিল, বলাই বাহুল্য। ওটার মাপ ছিল আট ফুট বাই চোদ্দ ফুট আর বাতাস আর ঢেউয়ের থেকে বাঁচাতে এতটা নীচু করে বানানো হয়েছিল যে ভেতরে ছাতের তলায় আমরা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতাম না। দেয়াল আর ছাত বানানো হয়েছিল শক্ত বাঁশ পরস্পর দড়ি দিয়ে বেঁধে, সেটাকে ঢেকে কঞ্চির বেড়া। সবুজ আর হলুদ খুঁটি, ছাত থেকে ঝুলে পড়া পাতার ঝালর সব মিলিয়ে বেশ চোখের আরাম হত, সাদা দেয়ালের কেবিন কখনোই হয়তো তা দিতে পারত না। স্টারবোর্ডের দিকে দেয়ালের এক তৃতীয়াংশই ফাঁকা, রোদ কিংবা জ্যোৎস্নার অবারিত দ্বার; তা সত্ত্বেও এই সেকেলে ছাউনিটাই আমাদের বেশ নিরাপত্তার বোধ দিত, যা জাহাজের মধ্যেকার গোল গোল জানলাওয়ালা সাদা দেয়ালের জলরোধক কেবিন কখনো দিতে পারত না বলেই মনে হয়।
এই অদ্ভুত বোধ যে কেন, তার ব্যাখ্যা করতে চেয়ে আমরা নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম। আমাদের চেতনা কিছুতেই পাম গাছের পাতায় ছাওয়া বাঁশের কেবিনের সঙ্গে সমুদ্রযাত্রাকে মেলাতে পারেনি। উত্তাল সমুদ্রের সঙ্গে সমুদ্রে ভাসতে থাকা পামপাতার কুটিরের কোনো প্রাকৃতিক সাজুয্যই ছিল না। সুতরাং হয় ওই কুঁড়েঘরটা চারপাশের ঢেউয়ের মাঝে একদম বেমানান অথবা কুঁড়ের দেয়ালের চারপাশের ঢেউগুলোই আদতে বেমানান ছিল। যতক্ষণ ভেলার ওপরে আছি বাঁশের কুঁড়ে আর তার ঝোপজঙ্গলের গন্ধটাই বাস্তব আর বিক্ষুব্ধ ঢেউগুলি মনে হত কল্পদৃশ্য। কিন্তু রাবারের ডিঙি থেকে দেখার সময় ঢেউ আর কুঁড়েটা তাঁদের অবস্থান বদল করে নিত।
বালসা কাঠ সবসময় ঢেউয়ের ওপর সিগালের মতই ভাসত, আর ওপরে এসে ঢেউ ভাঙলে ভেলার পেছন দিক দিয়ে জল বেরিয়ে যেত। এর ফলে মাঝের শুকনো জায়গাটায়, যেখানে কেবিনটা ছিল তার ওপর আমাদের একটা স্থির প্রত্যয় জন্মেছিল। আমাদের সমুদ্রযাত্রায় যত দিন গড়িয়েছে, ওই জায়গায় তত আমরা নিরাপদ বোধ করেছি। দরজার বাইরে বয়ে যাওয়া সাদা চূড়ার ঢেউগুলো কোনোই ভয়ের ব্যাপার নয়, বরং সেদিকে তাকিয়ে ভেবেছি একটা চমৎকার চলচ্চিত্র যেন। যদিও ফাঁকা ফাঁকা দেয়ালটা ভেলার ধার থেকে মাত্রই পাঁচ ফুট দূরে আর জলতল থেকে ফুট দেড়েক ওপরে, তবু কুঁড়েটার মধ্যে ঢুকে পড়লেই মনে হত সমুদ্র থেকে বেশ দূরত্ব রেখেই আমরা বহু বহু মাইল ভ্রমণ করে এসেছি আর যেন সমুদ্রের বিভীষিকার থেকে বহুদূর জঙ্গলের মধ্যে বাসা বেঁধে আছি। ওর ভেতরে আমরা চিত হয়ে শুয়ে বিচিত্র ছাদের দিকে চেয়ে থেকেছি। বাতাসের ঝোঁকে গাছের ডালের মতো বেঁকে এসেছে ছাদটা; কাঁচা কাঠ, বাঁশ আর ছেঁড়াখোঁড়া পাম পাতার থেকে ভেসে আসা জঙ্গলের গন্ধ উপভোগ করেছি।
মাঝেমধ্যে রাত্তিরেও রাবারের ডিঙি নিয়ে ভেসে পড়ে কেমন লাগে দেখেছি। মিশকালো সমুদ্রের জল চারদিক থেকে উঠছে, চিকমিক করা অগুনতি ক্রান্তীয় আকাশের তারার আলোয় সমুদ্রের জলে প্ল্যাংকটনের আবছা প্রতিফলন। এটা খ্রিস্টপূর্ব ১৯৪৭ না কি ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ তাতে কিছুই যায় আসে না। বেঁচে যে আছি এইটেই প্রবলভাবে টের পেয়ে চলেছি। আমাদের উপলব্ধি হল যে কারিগরী যুগের আগে মানুষের জীবন একেবারে পরিপূর্ণ ছিল, প্রকৃত প্রস্তাবে আধুনিক মানুষের তুলনায় অনেক বেশি পূর্ণ আর সমৃদ্ধ। সময় আর বিবর্তন একরকম থেমে আছে, মোটের উপর অন্য সবকিছু বাদে বাস্তবটা ছিল আজকের মতোই, আগেও যা ছিল, আগামীতেও তাইই থাকবে। ইতিহাসের শর্তহীন বিবরণের মধ্যে যেন বিলীন হয়ে আছি – অগুনতি তারাভরা আকাশের নীচে অসীম নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের ভেতর।
রাত্রে দেখেছি, কনটিকি ঢেউয়ের মাথায় উঠে পড়ছে আর পরক্ষণেই নেমে আসছে আমাদের দুজনের মধ্যে থাকা পাহাড়প্রমাণ কালো জলরাশির আড়ালে। চাঁদের আলোয় ভেলার চারপাশের আবহটা চমৎকার। টানটান, শ্যাওলা-লাগা চকচকে কাঠের লগ, চৌকো, মিশকালো পরিধির ভাইকিং পাল, এবড়োখেবড়ো বাঁশের কুটির, ভেলার পেছনে হলদে আলোর প্যারাফিনের বাতি, গোটাটা মিলিয়ে যেন একটা রূপকথার ছবি, আদৌ প্রকৃত বাস্তব নয়। মাঝে মাঝেই কালো সমুদ্রের পেছনে ভেলাটা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, আর তার পরেপরেই উঠে আসছে তারার আলোয় স্পষ্ট শ্যিলুটের মতো, কাঠের ফাঁক দিয়ে চিকচিকে জল নেমে যাচ্ছে।
একলা ভেলাটার চারপাশ দেখার সময় মনে মনে দিব্যি দেখতে পেতাম এমন জলযানের একটা গোটা নৌবহর; সমুদ্রপাড়ি দেবার জন্য প্রথম মানুষ যখন বেরোলো, দিগন্তের জুড়ে পাখার মতো ছড়ানো জলযান, যাতে ডাঙা খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা আরো বেড়ে যায়। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জনমানসে কথিত আছে যে স্প্যানিয়ার্ডরা আসার আগে পেরু আর ইকুয়েডরের শাসক ইনকা টুপাক ইউপাঙ্কি বালসা ভেলায় হাজার হাজার মানুষের বিশাল নৌবহর নিয়ে সাগরে ভেসে পড়েছিলেন। তিনি দুটো দ্বীপ খুঁজে পেয়েছিলেন, কেউ কেউ ভাবেন হয়তো ওটা গ্যালাপ্যাগোস হবে, এবং শেষে আটমাস অনুপস্থিতির পর তিনি আর তাঁর অসংখ্য দাঁড়বাহকেরা বহু কষ্টে ইকুয়েডরে ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। কনটিকি আর তার অনুসারীরাও একশো বছর আগে নিশ্চিতভাবেই এরকম অভিযানে নেমেছিলেন আর পলিনেশিয়ান দ্বীপ খুঁজে পাওয়ার পর আবার যুদ্ধ করে ফিরে আসার কোনো কারণ ছিল না।
ভেলায় একত্র হলে আমরা মাঝেমধ্যেই বাঁশের ডেকের ওপর, প্যারাফিন বাতিটার চারপাশে গোল হয়ে বসে দেড় হাজার বছর আগেকার পেরুর সমুদ্র-অভিযাত্রীদের কথা বলাবলি করতাম, ওদেরও হয়তো একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। বাতির পেছনে দাড়িওলা লোকেদের বিরাট ছায়া দুলছে পালের ওপর, পেরুর সাদা চামড়ার দাড়িওলা লোকেদের কথা মনে পড়ায়, মেক্সিকো থেকে মধ্য আমেরিকা অবধি আর দক্ষিণ আমেরিকার উত্তরপশ্চিমাঞ্চল, মায় পেরু অবধি যাদের কথা মিথ ও স্থাপত্যবিদ্যায় পেয়েছি। এখানে এই রহস্যময় সভ্যতা হঠাৎই অদৃশ্য হয়ে গেল, যেন ভোজবাজি, ইনকাদের আসার আগেই যাদুকাঠির ছোঁয়ায় উধাও, আবার হঠাৎ করেই তারা উদয় হল পশ্চিমের বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোতে, যেদিকে আমরা এখন চলেছি। এই ভ্রামণিক শিক্ষকরা কি অতলান্তিক পার হয়ে আসা প্রাচীন সভ্যতার মানুষ ছিলেন যারা আরো বহু বহু আগে একইরকমভাবে পশ্চিমা সাগরের স্রোত ও বাণিজ্যবায়ুতে ভর করে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ থেকে মেক্সিকোর উপসাগরে ভেসে এসেছিলেন? আমাদের অভিযানের পথ থেকে নিঃসন্দেহে ওটা অনেক অনেক কম ছিল, আর সেখানে সমুদ্রই একমাত্র বিচ্ছিন্নতাকারী শর্ত এমনটা আমরা আর ভাবতাম না।
অনেক পর্যবেক্ষক খুব জোরালো কারণেই মনে করেন যে মেক্সিকোর অ্যাজটেক থেকে পেরুর ইনকা অবধি, মহান ইন্ডিয়ান সভ্যতা, পূর্ব সমুদ্রের অনুপ্রবেশকারীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। অন্য দিকে সমস্ত আমেরিকার ইন্ডিয়ানরাই প্রধানত এশিয়ার শিকারী বা মাছধরিয়ে লোকেরা যারা কুড়ি হাজার বছর ধরে সাইবেরিয়া থেকে ক্রমে ক্রমে আমেরিকায় এসে ঢুকেছিল। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে একসময়ের মেক্সিকো থেকে পেরু অবধি বিস্তৃত উন্নত সভ্যতার ক্রমোন্নতির কোনো চিহ্ন কোথাও নেই। পুরাতত্ত্ববিদরা যত খোঁড়াখুঁড়ি করেছে তত উন্নত সভ্যতা আবিষ্কার করেছে, শেষমেশ একটা বিন্দুতে পৌঁছেছেন তারা যেখানে বোঝা যাচ্ছে প্রাচীন সভ্যতাটা পুরোনো সংস্কৃতির মাঝে হঠাৎ করে মাথা উঁচিয়ে রয়েছে।
মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার মরুভূমি আর জঙ্গলের মাঝখানে যেখানে আটলান্টিকের ঢেউ এসে লাগছে, সেখানেই সভ্যতার উন্মেষ হয়েছিল। অথচ প্রাচীন এবং বর্তমান, দুই সময়েই, অতিরিক্ত নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে সভ্যতার বিকাশলাভ অনেক সহজে হতে পারত, হয়নি।
দক্ষিণ সাগরের দ্বীপগুলোতেও একইরকম সভ্যতার বিন্যাস লক্ষ্য করা যায়। পেরুর সবচেয়ে কাছের দ্বীপ, ইস্টার দ্বীপে, সভ্যতার গভীর নিদর্শন দেখা যায়, যদিও এই নগন্য ছোট্ট দ্বীপটা শুকনো আর ঊষর,আর প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে এই দ্বীপটা এশিয়া থেকে সবচেয়ে দূরতম দ্বীপ।
আমরা যখন সমুদ্রযাত্রার মাঝামাঝি পেরিয়ে এসেছি, সেটা পেরু থেকে ইস্টার দ্বীপ অবধি দূরত্বের সমান, আর দ্বীপটা তখন ঠিক আমাদের দক্ষিণ বরাবর। পেরুর সৈকতের মাঝামাঝি একটা সুবিধেমতো জায়গা থেকে আমরা ভেলা ভাসিয়েছিলাম, সাগরপাড়ি দেওয়া সাধারণ ভেলার মতো হিসেবনিকেশ করে। আমরা যদি আরো খানিকটা দক্ষিণে, কনটিকির ধ্বস্ত শহর টিয়াহুয়ানাকো থেকে রওনা দিতাম, আমরা একই বাতাসের পাল্লায় পড়তাম কিন্তু সমুদ্রস্রোতটা খানিক দুর্বল হত, আর দুয়ে মিলে আমাদের ইস্টার দ্বীপের দিকে নিয়ে যেত।
১১০ডিগ্রি পশ্চিম দ্রাঘিমাংশ পেরোনোর পর আমরা পলিনেশীয় সামুদ্রিক অঞ্চলে ঢুকে পড়েছিলাম আর প্রকৃতপক্ষে পলিনেশীয় ইস্টার দ্বীপ তখন আমাদের চেয়ে পেরুর বেশি কাছে। তখন আমরা দক্ষিণ সমুদ্রের দ্বীপমালার প্রথমটার সঙ্গে একই সরলরেখা বরাবর, সবচেয়ে প্রাচীন দ্বীপসংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু যেটা। রাত্তিরে আমাদের উজ্জ্বল পথপ্রদর্শক সূর্যবাবাজি যখন তার সমস্ত রঙ নিয়ে পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের পেছনে অদৃশ্য হয়ে যেতেন, মৃদু বাণিজ্য বায়ু ইস্টার দ্বীপের রহস্যময় গল্পগুলোতে প্রাণসঞ্চার করত। রাত্রের আকাশ যখন সময়ের ধারণা মুছে একাকার করে দিত, আমরা বসে বসে গল্প করতাম, পালের ওপর আবার বিরাট বিরাট দাড়িওলা মাথা দোল খেত।
অনেকটা দক্ষিণে ইস্টার দ্বীপে পাথর কুঁদে তৈরি আরো বিরাট মাথার মূর্তিরা তাদের দাড়িওলা চিবুক আর সাদা চামড়ার বৈশিষ্ট্য নিয়ে অজ্ঞাত শতাব্দীর পর শতাব্দী ধ্যানরত অবস্থায় তাকিয়ে আছে।
১৭৭২ সালে ইউরোপীয়রা দ্বীপটা আবিস্কারের সময় থেকেই ওরা অমনিভাবে দাঁড়িয়ে আছেন; দেশজ কাহিনিতে বলা আছে, পলিনেশীয়দের বাইশ প্রজন্ম আগে, বর্তমান বাসিন্দারা যখন বড়ো বড়ো ক্যানোতে করে এখানে এসে দ্বীপভূমির সমস্ত পুরোনো বাসিন্দাদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলেন, তখনও এই পাথরের মূর্তিরা এমনিই দাঁড়িয়েছিলেন। প্রাচীন আগন্তুকেরা আরো পশ্চিম দিক থেকে এসেছিলেন কিন্তু ইস্টার দ্বীপের প্রাচীন কথা অনুযায়ী সবচেয়ে পুরোনো অধিবাসী এবং দ্বীপের প্রকৃত আবিষ্কর্তারা বহুদূরের ‘উদিত সূর্যের দেশ’ থেকে এসেছিলেন। ওইদিকে দক্ষিণ আমেরিকা ছাড়া অন্য কোনো ভূখণ্ড নেই। প্রাচীনতম অধিবাসীরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়াতে, এই পাথরের মূর্তিগুলো, সবচেয়ে পুরোনো, পুরাকালের ব্যাখ্যাতীত রহস্যের চিহ্ন হিসেবে রয়ে গেছে। গাছপালাহীন দ্বীপের ঢালু জমিতে এখানে ওখানে ছড়ান তাদের বিরাট মূর্তিগুলো আকাশের দিকে উঁচিয়ে আছে; পাথরের বিশাল প্রতিমূর্তিগুলো পুরুষ মানুষের প্রতিকৃতি আর এক একটা বিচ্ছিন্ন ব্লক হিসেবে বসানো, তিন চার তলা বাড়ির সমান উঁচু। প্রাচীন লোকেরা কী করে ওই দৈত্যাকৃতি মূর্তিগুলো বানালো, কী করেই বা নিয়ে এসে ওইখানে স্থাপন করল? যেন সমস্যাটা তত বড়োসড়ো কিছু ছিল না, কেননা বেশীরভাগ মূর্তির মাথার ওপরে, মাটি থেকে ছত্রিশ ফুট উঁচুতে, আরো একটা করে প্রকান্ড লাল পাথর টুপির মতো ভারসাম্য রেখে বসানো হয়েছিল। এসবকিছুর মানেটা কী, প্রাচীন স্থপতিরা এমন একটা সমস্যা কীভাবে সমাধান করলেন যা কিনা আজকের দিনের অগ্রণী ইঞ্জিনিয়ারদের কাছেও যথেষ্ট কঠিন একটা সমস্যা?
আমরা যদি এরকম সমস্ত টুকরোগুলো জোড়া দিয়ে দেখি, পেরুর ভেলা-অভিযাত্রীদের সাপেক্ষে, ইস্টার দ্বীপের রহস্যটা আর ততটা ব্যাখ্যাতীত থাকে না। প্রাচীন সভ্যতা এই দ্বীপে তার চিহ্ন ছেড়ে গেছে, ইতিহাসের দাঁতনখ যাকে মুছে দিতে পারেনি।
ইস্টার দ্বীপ একটি প্রাচীন মৃত আগ্নেয়গিরির মাথা। দ্বীপের উপকূলে নোঙর করার জায়গাটা সংরক্ষিত, আর সে বরাবর দ্বীপের ওপর পাথর বেছানো রাস্তা; দেখা গেছে সেসময়েও সমুদ্রের জলতল আজকের দিনের মতই একই উচ্চতায় ছিল। ডুবতে থাকা মহাদেশের অংশ নয় বরং একটা ছোট্ট বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, সেকালের অবিস্মরণীয় সভ্যতার কেন্দ্রভূমি, ঠিক আজকের মতোই ছোট্ট এবং নির্জন।
কাঠের গোঁজের মতো আকৃতির দ্বীপটার পূর্ব দিকে রয়েছে ইস্টার দ্বীপের মৃত আগ্নেয়গিরির একটা জ্বালামুখ, আর তার মধ্যেই ভাস্করদের আশ্চর্য পাথরের খনি আর কারখানা। অবিকল একশো বছর আগে প্রাচীন শিল্পী ও স্থপতিরা যেভাবে ছেড়ে গিয়েছিলেন, সেভাবেই আছে; সেসময়ে এরা পালিয়ে দ্বীপের আরো পূর্বপ্রান্তে চলে গিয়েছিলেন এবং প্রাচীন লোককথা অনুযায়ী সেখানে তাদের সঙ্গে ভয়ানক যুদ্ধ হয় আর বর্তমান পলিনেশীয়রা জয়লাভ করে এই দ্বীপের শাসক হয়ে ওঠে। পুরোনো আদিবাসীদের সমস্ত পূর্ণবয়স্কদের কচুকাটা করে একটা পরিখার মধ্যে ফেলে পুড়িয়ে ফেলা হয়। শিল্পীদের কাজ আচমকা থেমে যাওয়ায় জ্বালামুখের ভেতরটা একটা সাধারণ কর্মব্যস্ততার পরিস্কার ছবি তুলে ধরে। কাজের জায়গায় পড়ে থাকা ভাস্কর শিল্পীদের প্রচণ্ড শক্ত পাথরের কুঠার প্রমাণ করে এই উন্নত মানুষেরাও কনটিকির ভাস্করদের মতো লোহার ব্যবহার জানত না; ওরাও পেরু ছেড়ে পালিয়ে আসার সময় আন্দিজ অধিত্যকায় একইরকম দৈত্যাকার পাথরের মূর্তি ছেড়ে এসেছিল। দুজায়গাতেই পাথরের খাদ খুঁজে পাওয়া গেছে যেখানে সাদা চামড়ার পৌরানিক লোকেরা পাহাড়ের গা থেকে আরো শক্ত পাথরের কুঠার দিয়ে কেটে তিরিশ বা তার চেয়েও বেশি লম্বা পাথরের খণ্ড কেটে নিত। আর দুজায়গাতেই মূর্তি তৈরি করে বসানোর আগে, অথবা পরপর বসিয়ে দুর্বোধ্য সোপান বা দেয়াল বানানোর আগে এরকম বিশাল বিশাল কয়েক টন ওজনের পাথরের টুকরো এবড়োখেবড়ো জমির ওপর দিয়ে বেশ কয়েক মাইল বয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে।
অনেক অসমাপ্ত বিরাট বিরাট মূর্তি, যেখানে তৈরি হচ্ছিল, ইস্টার দ্বীপের সেই জ্বালামুখের দেয়ালেই এখনো রয়ে গেছে। এগুলো থেকেই বোঝা যায় বিভিন্ন স্তরে কীভাবে কাজ হত। কারিগরেরা পালানোর ঠিক আগে প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে আসা সবচেয়ে বড়ো মানুষের মূর্তিটার দৈর্ঘ্য দেখা গেছে ছেষট্টি ফুট। ওটা সম্পুর্ণ হবার পর বসানো হলে, মূর্তিটার মাথা আট তলা বাড়ির সমান উঁচু হত। প্রতিটা আলাদা আলাদা মূর্তি এক একটা পাথরের খণ্ড থেকে কুঁদে তৈরি করা হত এবং ভাস্করদের কাজের জায়গাতে শায়িত পাথরের মূর্তিগুলো থেকে বোঝা যায় একই সঙ্গে খুব বেশি লোক একটা মূর্তি তৈরিতে লেগে থাকত না। দক্ষিণ আমেরিকার পাথরের বিরাট প্রতিকৃতিগুলোর মতো, চিত হয়ে শোয়া, হাত দুটো ভাঁজ করে পেটের ওপরে রাখা ইস্টার দ্বীপের মূর্তিগুলোর সূক্ষাতিসূক্ষ্ম সমস্ত অংশই, দ্বীপের অন্যপ্রান্তে বয়ে নিয়ে যাওয়ার আগে, কারিগরেরা কারখানাতেই সম্পূর্ণ করত। শেষ পর্যায়ে, কারখানার ভেতরে দৈত্যাকার মূর্তিগুলোর পেছনের একটা সরু অংশ পাহাড়ের দেয়ালের সঙ্গে আটকানো থাকত; তারপর সেটাও কেটে নেওয়া হত, ইতিমধ্যে অবশ্য মূর্তিটাকে পাথরের চাঁই দিয়ে ঠেকনা দিয়ে নেওয়া হত।
তৈরি করা এমন বহু মূর্তি স্রেফ জ্বালামুখের তলায় জড়ো করে সেখানকার ঢালে রাখা হত। কিন্তু সবচেয়ে বড়ো মূর্তিগুলোর অনেকগুলোই জ্বালামুখের দেয়ালের ওপরে তুলে আনা হত এবং তারপর বন্ধুর জমির ওপর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হত দ্বীপের অন্যপ্রান্তে ওগুলোকে খাড়া করার জন্য আর তারপর তার মাথার ওপর আরেকটা বিরাট লাল পাথরখণ্ড বসান হত। এই পাথরের মূর্তিগুলো বয়ে নিয়ে যাওয়াটাই সম্পূর্ণ বিস্ময়কর আর রহস্যময় কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই যে এঘটনা ঘটেছিল অথবা যে স্থপতিরা আন্দিজ পর্বতে এমন বিশাল বিশাল মূর্তি ফেলে রেখে পেরু থেকে উধাও হয়েছিলেন, তারা এই বিষয়টাতে সবিশেষ দক্ষ ছিলেন। ইস্টার দ্বীপের পাথরের মূর্তিগুলো সবচেয়ে বড়ো, বিরাটকায় এবং বিশিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও, এই একই লুপ্ত সভ্যতা আরো অনেক প্যাসিফিক দ্বীপেই একইরকম দৈত্যাকার মূর্তি স্থাপন করেছিল, যদিও সেগুলো শুধুমাত্র আমেরিকার কাছাকাছি দ্বীপগুলোতেই। আর সমস্ত জায়গাতেই মূর্তিগুলো যেখানে দাঁড়ানো, সেখান থেকে পাথরের খাদান একশো যোজন দূরে। মার্কুইসে, আমি ওদের লোককথায় শুনেছি কী কৌশলে এই দৈত্যাকার পাথরের মূর্তিগুলো স্থাপন করা হয়েছিল। আর যেহেতু এই লোককথার সাথে হুবহু মিলে যায় টোঙ্গাটাবুর প্রবেশপথে পাথরের স্তম্ভগুলো বয়ে আনার প্রাচীন লোককথা, এটা ধারণা করাই যায় যে ইস্টার দ্বীপেও একই লোকেরা একই পদ্ধতিতে পাথরের মূর্তিগুলো দাঁড় করিয়েছিল।
পাথর খাদানে ভাস্করদের কাজে সময় লাগত প্রচুর কিন্তু দক্ষ লোক লাগত অল্পই। অন্যদিকে প্রতিটা ক্ষেত্রেই বয়ে আনার কাজটা অনেক তাড়াতাড়ি হত, আর লোকও লাগত অনেক। ছোটো ইস্টারদ্বীপে মাছের অভাব ছিল না, পেরুর মিষ্টি আলুর চাষও হত যথেষ্ট; বিশেষজ্ঞরা মনে করেন সমৃদ্ধির দিনগুলোতে দ্বীপের লোকসংখ্যা ছিল প্রায় সাত থেকে আট হাজার। জ্বালামুখের খাড়াই ঢাল ধরে মূর্তিগুলো তুলতে বড়োজোর হাজারখানেক লোক লাগত আর দ্বীপের অন্যপ্রান্তে বয়ে নিয়ে যাবার জন্য শ’পাঁচেক।
শণ আর আঁশ দিয়ে পাকিয়ে মজবুত দড়ি বানানো হত এবং কাঠের খাঁচার ওপরে রেখে অনেকে মিলে বড়ো মূর্তিগুলোকে গাছের গুঁড়ি আর নুড়ি পাথরের ওপর দিয়ে টেনে নিয়ে যেত; কচুর মূল থেতো করে তলাটা পিচ্ছিল করে নেওয়া হত। প্রাচীন সভ্যতার লোকেরা দড়ি আর কাছি বানানোতে যে দক্ষ ছিল সেকথা দক্ষিণ সমুদ্রের দ্বীপ তো বটেই, পেরুতেও জানা গেছে। প্রথমবার ইউরোপীয়রা যখন এখানে আসে তারা দেখেছিল খরস্রোতা নদী আর গিরিখাতের ওপর মানুষের কোমরের মতো মোটা কাছি দিয়ে ঝুলন্ত সেতু বানানো রয়েছে।
পাথরের মূর্তিগুলো নির্দিষ্ট জায়গায় এনে দাঁড় করানোর আগে আসত পরবর্তী সমস্যাটা। সকলে মিলে পাথর আর বালি দিয়ে একটা অস্থায়ী ঢাল তৈরি করে তার অপেক্ষাকৃত কম ঢালের অন্যপাশ দিয়ে বিশাল মূর্তিগুলো পায়ের দিক থেকে টেনে তোলা হত তার ওপরে। এরপর খাড়া ঢালের ওপর দাঁড় করিয়ে ঠেলে দেওয়া হত ঢালের নীচে আগে থেকে খুঁড়ে রাখা গর্তের মধ্যে যাতে মূর্তির পায়ের দিকটা প্রথমে ওখানে গিয়ে পড়ে। মূর্তিটা ঢালে হেলান দেওয়াই থাকত। এবারে আরেকটা পাথর গড়িয়ে ঠেলে তুলে মূর্তির মাথার ওপরে বসানোর পর অস্থায়ী ঢালটা সরিয়ে নেওয়া হত। ইস্টারদ্বীপে এরকম তৈরি করে রাখা বহু ঢাল দেখতে পাওয়া যায় যেখানে কোনো মূর্তি শেষ অবধি আর আসেনি। পদ্ধতিটা নিঃসন্দেহে প্রশংসার কিন্তু রহস্যময় মোটেও নয়, যদি না আমরা প্রাচীন লোকেদের বুদ্ধিবৃত্তিকে খাটো করে দেখা বন্ধ না করি আর হ্যাঁ একথাও যে, তাঁদের কাছে সময় আর লোকবল যথেষ্টই ছিল।
কিন্তু ওঁরা এরকম মূর্তি বানালোই বা কেন? আর কেনই বা মূর্তির মাথায় বসানোর বিশেষ ধরণের লাল পাথরের খোঁজে আরেকটা খাদান খোঁজ করতে হল যেটা মূর্তি তৈরি করার খাদানের থেকে চার মাইল দূরে? দক্ষিণ আমেরিকা এবং মার্কুইস দ্বীপে, দুজায়গাতেই গোটা মূর্তিটাই কখনো কখনো এই লাল পাথরে তৈরি এবং আদিবাসীরা অনেক দূর অবধি যেত এই পাথর সংগ্রহের জন্য। পেরু আর পলিনেশিয়া দুজায়গাতেই লাল পাগড়ি মানেই বোঝাতো উচ্চপদস্থ লোক।
প্রথমেই দেখা যাক মূর্তিগুলি কাদের প্রতিনিধিত্ব করত। ইউরোপীয়রা যখন প্রথম এই দ্বীপপুঞ্জে এসেছিল, তারা তীরভূমিতে অদ্ভুত “সাদা চামড়ার পুরুষ” দেখেছিল, অথচ সাদা চামড়ার লোকেদের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যের বিপরীতে, এখানকার পুরুষদের মুখে লম্বা লম্বা দাড়ি ছিল; এরাই দ্বীপপুঞ্জের প্রাচীন জাতের নারী ও শিশুদের বংশধর, যাদের আক্রমণকারীরা রেহাই দিয়েছিল। আদিবাসীরা জানিয়েছিল তাদের পূর্বপুরুষেরা কেউ কেউ সাদা চামড়ার ছিলেন, বাকিরা বাদামি। এরা মোটামুটি হিসেব করে বলেছিল শেষ যারা অন্য জায়গা থেকে দেশান্তরী হয়ে পলিনেশীয়ায় এসেছিল সেটা বাইশ প্রজন্ম আগে আর প্রথম যাঁরা এসেছিলেন পূর্বদিক থেকে বড়ো বড়ো ভেলায় চেপে সেটা প্রায় সাতান্ন প্রজন্ম আগে (অর্থাৎ ৪০০-৫০০ খ্রিস্টাব্দে)। পূর্ব দিক থেকে যে জাতি এসেছিল তাদের নাম দেওয়া হয়েছিল “লম্বকর্ণ” কেননা ওই জাতের লোকেরা কানের লতিতে কাঁধ অবধি ওজন ঝুলিয়ে কৃত্রিমভাবে তাদের কান লম্বা করত। এরাই ছিলেন সেই রহস্যময় “লম্বকর্ণ”রা যাদের “ছোটো কান”রা দ্বীপে আসার পর খতম করে দিয়েছিল। ইস্টার দ্বীপের সবকটা মূর্তিরই কাঁধ অবধি লম্বা কান, যেমনটা ভাস্করদের নিজেদেরই ছিল।
পেরুর ইনকা কিংবদন্তী বলে যে সূর্য দেবতা কনটিকি দাড়িওলা সাদা চামড়ার লোকেদের শাসনকর্তা ছিলেন যাদের ইনকারা বলত “লম্বকর্ণ” কারণ তারা নিজেদের কান কৃত্রিমভাবে কাঁধ অবধি লম্বা করত। ইনকারা জোরালো ভাবেই বলেছে টিটিকাকা হ্রদের একটা দ্বীপে ইনকাদেরই সঙ্গে যুদ্ধে নিকেশ হয়ে যাবার আগে কিংবা সেখান থেকে পালিয়ে যাবার আগে কনটিকির এই “লম্বকর্ণ”রাই আন্দিজ পর্বতের পরিত্যক্ত দৈত্যাকার মূর্তিগুলো বানিয়েছিলেন।
মোটের উপর ব্যাপারটা দাঁড়াল এইরকমঃ কনটিকির সাদা “লম্বকর্ণ”রা এই বিশাল মূর্তি তৈরির কলাকৌশল জেনেই পেরু থেকে পশ্চিমের দিকে উধাও হয়ে গিয়েছিল এবং ‘টিকি’র এই সাদাটে “লম্বকর্ণ”রাই পূর্ব দিক থেকে ইস্টার দ্বীপে এসে উঠেছিল মূর্তি বানানোর হুবহু একই কলাকৌশল রপ্ত করে। এসেই পূর্ণ দক্ষতার সাথে তারা মূর্তি বানাতে আরম্ভ করে, ফলে ইস্টার দ্বীপে এই উচ্চ শিল্পকর্মটির কোনো ক্রমবিকাশের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
দক্ষিণ সমুদ্রের দ্বীপগুলোতে পাওয়া মূর্তিগুলোর পারস্পরিক শৈলীর চেয়ে দক্ষিণ আমেরিকায় পাওয়া মূর্তিগুলোর সঙ্গে কিছু কিছু দ্বীপের একপ্রস্তর-মূর্তির সাদৃশ্য অনেক বেশি। মার্কুইস আর তাহিতি দ্বীপপুঞ্জে এই মূর্তিগুলোকে এক লপ্তে ‘টিকি’ বলে ডাকা হয়। এরাই প্রাচীন পূর্বপুরুষ হিসেবে দ্বীপের ইতিহাসে পুজিত হন, মৃত্যুর পর যাদের দেবতাদের সমকক্ষ মনে করা হয়। আর এখানেই নিঃসন্দেহে ইস্টার দ্বীপের মূর্তির মাথার অদ্ভুত লাল পাথরের টুপির রহস্যের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। ইউরোপীয়ানদের অভিযানের সময় পলিনেশীয়ার সমস্ত দ্বীপেই লাল চুল ও সাদা চামড়ার এক আধটা মানুষ অথবা পরিবারের অস্তিত্ব ছিল, দ্বীপের অধিবাসীরাই জানিয়েছিলেন যে এরাই দ্বীপে আসা প্রথম সাদা চামড়ার মানুষদেরই বংশধর। কিছু কিছু দ্বীপে ধর্মীয় উৎসব অনুষ্ঠিত হত, যেখানে অংশগ্রহণকারীরা প্রাচীন পূর্বপুরুষদের নকল করে তাদের দেহ সাদা আর চুল লাল রঙ করত। ইস্টার দ্বীপের বার্ষিক সমারোহ অনুষ্ঠানে উৎসবের প্রধান কর্তা তার মাথা মুড়িয়ে ফেলত যাতে মাথাটা পুরো লাল রঙ করা যায়। ইস্টার দ্বীপের দৈত্যাকার মূর্তিগুলোর মাথার লাল পাথরগুলোও স্থানীয়দের চুলের ধরণেই কাটা হত।
ইস্টার দ্বীপের মূর্তিগুলোর কানগুলো বেশ লম্বা ধরনের কেননা ভাস্করদের নিজেদের কানই বেশ লম্বা ছিল। মূর্তির মাথায় চড়ানোর জন্য লাল পাথর পছন্দ করার কারণ তাদের নিজেদের চুলও ছিল লালচে। মূর্তিগুলোর চিবুক ছুঁচোলো আর সামনের দিকে বার করা কেননা ভাস্করেরা নিজেরাই দাড়ি রাখত অমন। মূর্তিগুলোর চেহারার বৈশিষ্ট্য একেবারে সাদা চামড়ার লোকেদের মতো, খাড়া টিকোলো নাক, পাতলা খরশান ঠোঁট, কেননা ভাস্কররা নিজেরাই ইন্দোনেশীয় জাতের ছিল না। মূর্তিগুলোর বিরাট মাথা, ছোটো ছোটো পা আর হাত দুটো ভাঁজ করে বুকের নীচে রাখার কারণ হল দক্ষিণ আমেরিকায় লোকে বড়ো বড়ো মূর্তিগুলো এভাবেই দেখতে অভ্যস্ত ছিল। ইস্টার দ্বীপের মূর্তিগুলোর একমাত্র অলঙ্কার ছিল কোমরবন্ধনী। লেক টিটিকাকায় কনটিকির প্রাচীন ধ্বংসস্তূপে প্রতিটা মূর্তিতেই এই কোমরবন্ধনীর বৈশিষ্ট্য দেখা গেছে। সূর্য দেবতার পৌরানিক প্রতীক এই রঙধনু বন্ধনী। মঙ্গারেভার দ্বীপে একটা মিথ চালু ছিল যে সূর্যদেবতা নিজের এই জাদু কোমরবন্ধনী, রঙধনুটা খুলে মঙ্গারেভার সাদা চামড়ার সন্তানদের জন্য আকাশ থেকে নীচে পাঠিয়ে দেন। এই সমস্ত দ্বীপে, এমনকি পেরুতেও, সূর্যকে সবচেয়ে আদিম ও প্রাচীন পূর্বপুরুষ বলে মনে করা হত।
রাতের তারাভরা আকাশের নীচে ডেকের ওপরে বসে আমরা ইস্টার দ্বীপের অদ্ভুত ইতিহাস বলাবলি করতাম, যদিও আমাদের ভেলা সোজা পলিনেশীয়ার কেন্দ্রের দিকে যাচ্ছে ফলে আমরা ম্যাপে ওই দূরবর্তী দ্বীপটার নাম ছাড়া আর অন্য কিছুই দেখব না। পুবের এত চিহ্ন ইস্টার দ্বীপের সারাটা শরীরে যে এর নামটাই একটা দিকনির্দেশ হিসেবে কাজ করে।
“ইস্টার দ্বীপ”-এর উল্লেখ ম্যাপে আছে কারণ এক ওলন্দাজ হঠাৎ করেই দ্বীপটা এক ইস্টারের রবিবার আবিষ্কার করে। এবং আমরা ভুলেই গেছি যে এখানে আগে থেকেই বসবাসকারী আদিবাসীরা, নিজেদের বাসস্থানের অনেক বেশি সুপ্রযুক্ত ও সার্থক নাম দিয়েছিল। পলিনেশীয়ায় এই দ্বীপের কমপক্ষে তিনটি নাম ছিল।
একটা নাম ছিল ‘তে-পিতা-তে-হেনুয়া’, মানে ‘দ্বীপপুঞ্জের নাভি’। এই কাব্যিক নামটাই পশ্চিমের দ্বীপগুলোর মধ্যে ইস্টার দ্বীপকে একটা আলাদা অবস্থান দিয়েছে এবং এটাই পলিনেশীয়ানদের দেয়া ইস্টার দ্বীপের সবচেয়ে পুরোনো নাম। দ্বীপের পূর্বদিকে, যেখানে প্রথম “লম্বকর্ণ”রা এসে নেমেছিল বলে পুরুষানুক্রমে মনে করা হয়, তার কাছে যত্নে কুঁদে রাখা একটা গোলাকার পাথরের বল আছে, নাম ‘সোনালি নাভি’ এবং সেটাই পরবর্তীতে ইস্টার দ্বীপের নাভি বলে গণ্য করা হয়। যখন কাব্যময় প্রাচীন পলিনেশীয়রা এই নাভি পাথরখানা দ্বীপের পূর্বতটে যত্নে কুঁদে রাখছিল এবং পেরুর সবচেয়ে কাছের দ্বীপটাকে পশ্চিমের অগণ্য দ্বীপগুলোর নাভি হিসেবে নির্বাচন করেছিল তার একটা প্রতীকি কারণ ছিল। এবং আমরা এও জানি যেহেতু পলিনেশীয় ট্রাডিশন অনুযায়ী তাদের দ্বীপ আবিষ্কারের ঘটনাটাকে তাদের দ্বীপের জন্ম হিসেবে মনে করা হয়, তখন অন্য সবার মধ্যে ইস্টার দ্বীপকে নাভি মনে করার ধারণাটা আরো জোরদার হয়, যেন দ্বীপের জন্মদাগের প্রতীক ওটা, তাদের মূল মাতৃভূমির সঙ্গে একটা যোগসূত্র।
ইস্টার দ্বীপের দ্বিতীয় নামটা রাপা নুই যার মানে “মহান রাপা” আর রাপা ইতি অর্থাৎ “ছোট্ট রাপা” – সেটা ইস্টার দ্বীপের বেশ অনেকটা পশ্চিমে আরেকখানা একই মাপের দ্বীপ। এখন, এই লোকেরা স্বাভাবিক ভাবেই নিজেদের প্রথম ভূমির নাম বলে ‘মহান – ’ আর তার পরেরটাকেই বলে ‘নতুন –’ অথবা ‘ছোট্ট –’, দুটো যদি একই মাপের হয় তবুও। ‘ছোট্ট রাপা’র আদিবাসীরা ঠিক ঠিক নিজেদের ট্রাডিশন ধরে রেখেছিল যে দ্বীপের প্রথম অধিবাসীরা মহান রাপা থেকে, অর্থাৎ পুবদিকে, আমেরিকার সবচেয়ে কাছের ইস্টার দ্বীপ থেকে এসেছিল। একথা পরিষ্কার ভাবে নির্দেশ করে যে মূল অভিবাসীরা পুবদিক থেকেই এসেছিল।
এই মুখ্য দ্বীপটার তৃতীয় আর শেষ নামটা হল ‘মাতা-কিতে-রানি’, মানে ‘স্বর্গের দিকে তাকিয়ে থাকা চোখ’। একঝলকে ব্যাপারটা ধাঁধার মতো গোলমেলে কেননা অপেক্ষাকৃত নীচু ইস্টার দ্বীপ অন্য উঁচু উঁচু দ্বীপ, যেমন তাহিতি, মার্কুইস কিংবা হাওয়াই – এদের তুলনায় স্বর্গের দিকে মোটেই বেশিরকম তাকিয়ে নেই। কিন্তু পলিনেশীয়দের কাছে ‘রানি’, অর্থাৎ স্বর্গের মানে দু’রকম। এর মানে তাদের পূর্বপুরুষদের আদি বাসভূমি, সূর্যদেবতার পবিত্র ভূমি, টিকির ফেলে আসা পার্বত্য রাজ্য। আর এটাও খুব লক্ষ্যণীয় বিষয় যে সমুদ্রে ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে একদম পূর্বপ্রান্তের দ্বীপটাকেই ‘স্বর্গের দিকে তাকিয়ে থাকা চোখ’ বলে। আরো আকর্ষণীয় ব্যাপারটা হল, ‘মাতা-রানি’ শব্দবন্ধটার পলিনেশীয় ভাষায় মানে ‘স্বর্গের চোখ’ আর সেটা একটা প্রাচীন পেরুভিয়ান জায়গার নাম। জায়গাটা পেরুর সমুদ্রতটে প্রশান্ত মহাসাগরের লাগোয়া একটা স্থান, ইস্টার দ্বীপের ঠিক উল্টোদিকে, এবং আন্দিজে কনটিকির পুরোনো শহরের ধ্বংসস্তূপের ঠিক তলায়।
ইস্টার দ্বীপের আকর্ষণীয় ব্যাপারগুলো ছিল নানাবিধ আর তাতে আমাদের বিস্তর কথাবার্তার সুযোগ করে দিয়েছিল, আমরা তারাভরা আকাশের নীচে ডেকে বসে বহু আলোচনা করতাম, নিজেদের ওই প্রাগৈতিহাসিক অভিযানের অংশ বলেই মনে হত। আমাদের এরকম মনে হত যেন টিকির সময় থেকে শুরু করে আমরা প্রায় বিশেষ কিছুই করিনি, শুধু দিন রাত ভেসে চলেছি ডাঙার খোঁজে।
সমুদ্র আর তার ঢেউ নিয়ে আমাদের আর বিশেষ মাথাব্যথা ছিল না। আমরা তদ্দিনে সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে আমাদের ভেলার সম্পর্কটা বুঝে নিয়েছিলাম। এমনকি হাঙরেরাও দৈনন্দিন ছবির অংশ হয়ে গিয়েছিল, আমরা ওদের সমস্ত হাবভাব জেনে গিয়েছিলাম। আমরা আর হাত-হারপুনের কথা ভাবতাম না, এমনকী একটা হাঙর পাশে চলে এলেও ভেলার ধার থেকে সরে যেতাম না। বরঞ্চ ভেলার কাঠের গুঁড়ির পাশ দিয়ে আরামসে চলে যাবার সময় আমরা চেষ্টা করতাম ওর লেজের পাখনাটা ধরে ফেলা যায় কিনা। শেষে ক্রমশ এটা একটা খেলা হয়ে দাঁড়াল, হাঙরের সঙ্গে দড়ি ছাড়া টাগ অব ওয়ার।
বেশ হালকা চালেই শুরু করেছিলাম। যতটা খেতে পারি তার চেয়ে বেশি ডলফিন সহজেই ধরছিলাম। খাবার নষ্ট না করে এই মাছ ধরার খেলাটা আমরা শুরু করলাম হুক ছাড়াই; তাতে ডলফিন আর আমাদের দুপক্ষেরই আমোদ হত। অব্যবহৃত উড়ুক্কু মাছের টুকরো সুতোয় বেঁধে আমরা ওদের জলের ওপরের দিকে টেনে নিয়ে আসতাম। ডলফিনগুলো জলের ওপরে ছোঁ মেরে উঠে মাছটা ধরত, আর অমনি নিজের নিজের দিকে দড়ি টানাটানি শুরু হয়ে যেত আর সে এক দারুণ মজার ব্যাপার। একটা ডলফিন হাল ছেড়ে দিলে আরেকটা এসে তার জায়গা নিত। আমাদের খুব মজা হত আর ডলফিনরাও শেষকালে মাছটা পেয়েই যেত।
এরপর আমরা খেলাটা হাঙরদের সাথে শুরু করলাম। একটা দড়ির মাথায় একটুকরো মাছ অথবা একটা ব্যাগে রাতের খাবারের উচ্ছিষ্ট বেঁধে ফেলে রাখতাম। পেছন ফিরে চলে যাবার বদলে হাঙরেরা জলের ওপর নাক উঁচু করে হাঁ করে সাঁতরে আসত টোপটা গিলতে। ঠিক মুখ বন্ধ করার মুহূর্তে আমরা দড়ি টেনে টোপটা ওর মুখের সামনে থেকে বার করে নিতাম, ঠকে যাওয়া প্রাণীটা আবার বোকার মতো সাঁতরে এসে চোয়াল হাঁ করে ফের একবার টোপটা গেলার চেষ্টা করত আর প্রত্যেকবারই ওর মুখের মধ্য থেকে টোপটা লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসত। শেষে ব্যাপারটা দাঁড়াত এই যে ভেলার গুঁড়িগুলোর কাছে এসে নাকের ডগায় ঝুলতে থাকা খাবারের ব্যাগটা লক্ষ করে হাঙরগুলো কুকুরের মতো নাক উঁচিয়ে লাফালাফি করত। চিড়িয়াখানায় হাঁ করা জলহস্তীদের খাওয়ানো হয় যেমন অমনি কতকটা, আর একদিন, জুলাইয়ের শেষে, ভেলায় ভেসে পড়বার মাস তিনেক বাদে, ডায়েরিতে নীচের অংশটা লেখা হয়েছিল।
-যে হাঙরটা আজ আমাদের পিছন পিছন এল ওকে আমরা বন্ধু বানিয়ে নিয়েছি। রাতের বেলা খাবার সময় আমরা টুকরো টাকরা উচ্ছিষ্ট স্রেফ সোজা ওর হাঁ করা মুখের মধ্যে ফেলে খাইয়েছি। আমাদের পাশে পাশে সাঁতরানোর সময় ওকে আধা হিংস্র, আধা-ভালোস্বভাবের এবং পোষা কুকুরের মতো লাগছিল। এটা ঠিক যে ওর চোয়ালের মধ্যে নিজেরা না পড়া অবধি হাঙরদের দিব্যিই লাগে। মোটের ওপর চারপাশে ওদের ঘোরাঘুরিটা বেশ মজাদারই ছিল, শুদ্ধু আমাদের স্নানের সময়টা ছাড়া।
একদিন একটা বাঁশের ডগায় একটা হাঙরের খাবার ভর্তি ব্যাগ আটকে, দড়ি বেঁধে, ভেলার একপাশে তৈরি করে রাখা ছিল, এমন সময় একটা ঢেউ এসে ওটা ভাসিয়ে নিয়ে গেল। বাঁশের টুকরোটা ভেলার পেছনে কয়েকশ গজ দূরে ভাসছিল, হঠাৎ ওটা খাড়া হয়ে খুব দ্রুত আপনা থেকেই ভেলার দিকে আসতে শুরু করল। যেন আবার এসে নিজের জায়গাতে থিতু হবে। মাছ ধরার লাঠিটা ভাসতে ভাসতে আমাদের কাছাকাছি এলে দেখলাম ওর ঠিক নীচেই একটা দশফুটি হাঙর আর বাঁশের লাঠিটা জলের ওপর জেগে আছে পেরিস্কোপের মতো। হাঙরটা খাবারের ব্যাগটা সুতো না ছিঁড়েই গিলে নিয়েছে। মাছধরা লাঠিটা আলগোছে আমাদের পেরিয়ে গেল এবং একটু এগিয়েই অদৃশ্য হয়ে গেল।
ক্রমশ হাঙরগুলোকে আমরা অন্য চোখে দেখতে শুরু করলেও ওদের দুপাটি চোয়ালে পাঁচ-ছসারি ধারালো দাঁতের প্রতি সমীহটা কিন্তু আমাদের রয়েই গেল, কখনোই উবে গেল না।
একদিন ন্যুট অজ্ঞাতসারেই একটা হাঙরের পাশাপাশি সাঁতার দিচ্ছিল। যদিও ভেলা থেকে দূরে সাঁতরানোর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল, এক ভেলা সাঁতারুকে ছেড়ে ভেসে যেতে পারে, দুই হাঙরদের জন্য। কিন্তু একদিন সমুদ্র বেশিরকম শান্ত আর যে হাঙরগুলো পেছন পেছন আসছিল সেগুলো সদ্যই ধরে ভেলায় তুলে ফেলার দরুণ চট করে সমুদ্রে ডুব দিয়ে নেবার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ন্যুট সমুদ্রে ডুব দিয়ে একটু বেশিই দূরে চলে গিয়েছিল; ভেসে উঠে ও আবার সাঁতরে ফিরে আসছিল। আমরা যতটা সম্ভব গলা উঁচিয়ে শান্তভাবে ওকে সতর্ক করলাম যাতে হঠাৎ ঘাবড়ে না যায়। ন্যুট প্রাণপনে ভেলার পাশের দিকে সাঁতরে আসছিল। কিন্তু নীচের ছায়াটা ওর থেকেও দক্ষ সাঁতারু, নীচ থেকে দ্রুত উঠে আসছিল, ন্যুটকে ধরে ফেলে প্রায়। দুজনেই ভেলার কাছে একই সময়ে পৌঁছলো। ন্যুট যখন হাঁচড়পাঁচড় করে ভেলায় উঠছিল হাঙরটা ঠিক ওর পেটের তলা দিয়ে সাঁতরে গিয়ে ভেলার পাশে এসে দাঁড়াল। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আমরা ওকে একটা সুস্বাদু ডলফিনের মাথা দিলাম, কামড়ে না দেবার জন্য।
দেখার চেয়েও গন্ধ হাঙরদের আকৃষ্ট করে বেশি। আমরা পা ঝুলিয়ে বসে ওদের পরীক্ষা করতাম, আর ওরা আমাদের দিকে প্রায় দু-তিনফুট দূরত্ব অবধি সাঁতরে এসে নিঃশব্দে লেজ ঘুরিয়ে চলে যেত। কিন্তু জলে এক বিন্দুও রক্তের আভাস থাকলে, ধরা যাক আমরা মাছ ধুয়ে পরিষ্কার করছি, হাঙরদের পাখনাগুলো চঞ্চল হয়ে উঠত, ভিনভিনে মাছির মতো দূর থেকে এসে জড়ো হত। আর যদি হাঙরদের নাড়িভুঁড়ি ফেলা হত তাহলে তো কথাই নেই, পাগলের মতো ছুটে এসে অন্ধের মতো হুড়োহুড়ি করত! রাক্ষসের মতো এসে নিজের প্রজাতির মেটে আর নাড়িভুঁড়ি খেয়ে নিত এবং তারপর যদি আমাদের পা সমুদ্রে ডোবাতাম, রকেটের গতিতে ছুটে এসে কাঠের লগে দাঁত ফোটাত, ঠিক যেখানে একমুহূর্ত আগেই পাটা ছিল। হাঙরদের মতিগতি খুব দ্রুত বদলায়, প্রাণীটা একেবারেই আবেগসর্বস্ব বলা চলে।
আমাদের মোলাকাতের শেষ পর্যায়ে আমরা হাঙরদের লেজ ধরে টানতাম। প্রাণীদের লেজ ধরে টানার ব্যাপারটা, যদিও, নীচুস্তরের খেলা বলেই গণ্য হয় কিন্তু সেটার কারণ বোধকরি হাঙরদের বেলায় কেউই পরীক্ষা করে দেখেনি বলেই। সত্যি বলতে গেলে এটা বেশ একটা প্রাণবন্ত খেলা।
হাঙরের লেজ ধরার জন্য প্রথমে ওকে খানিকটা মুখরোচক খাবার দিতে হবে। ও জলের অনেকটা ওপরে মুখ উঁচিয়ে ধরবে খাবারটা নেবার জন্য। সাধারণভাবে একটা ব্যাগে ঝুলিয়ে খাবারটা দেওয়া হত। কেননা কেউ যদি হাতে করে হাঙরকে খাওয়ায়, ব্যাপারটা আর তত মজাদার থাকবে না। কেউ পোষা কুকুর বা ভালুককে হাতে করে খাওয়ালে ওরা মাংসের ওপরেই দাঁতটা বসায় আর একটু টুকরো ছিঁড়ে নেবার জন্য টানাটানি করে কিংবা যতক্ষণ না মাংসের পুরো খণ্ডটা শেষ হচ্ছে। কিন্তু কেউ যদি হাঙরের মুখ থেকে নিরাপদ দূরত্বেও একটা গোটা ডলফিন হাতে ধরে রাখে হাঙরটা ওপরে উঠে ঝপ করে দুটো চোয়াল একসাথে বন্ধ করবে আর হাতে একবিন্দু টান পড়ার আগেই দেখা যাবে অর্ধেক ডলফিন গায়েব, লেজটা ধরা অবস্থায় বাকী আধখানা হাতে ঝুলছে। আমরা দেখেছি ছুরি দিয়ে একটা ডলফিন আধখানা করাটা বেশ কঠিন, অথচ সেকেন্ডের এক ভগ্নাংশে হাঙরেরা তেকোনা ধারালো দাঁত পাশাপাশি চালিয়ে এক ঝটকায় শিরদাঁড়াসহ বাকী সবকিছু সসেজ মেশিনের মতো কেটে আলাদা করে দেয়।
হাঙরটা যখন চুপচাপ আবার জলের ভেতরে ফিরে যাচ্ছে, ওর লেজটা ঝাপটা দিয়ে জলের ওপরে উঠে আসে আর তখন লেজটা ধরা খুবই সহজ। হাঙরের চামড়াটা হাতে ধরলে খসখসে বালিকাগজের মতো লাগে আর লেজের ওপরের দিকে একটা খাঁজ থাকে যেটা সম্ভবত ধরার জন্য খুব সুবিধেজনক। ওখানটা চেপে ধরতে পারলে মুঠো ফসকে যাবার কোনো সুযোগই নেই। হাঙরটা সামলে নেবার আগেই ঠিক এসময়েই একটা ঝটকায় ওর লেজটা যতখানি সম্ভব কাঠের লগের ওপরে তুলে ফেলতে হয়। এক দু-সেকেন্ড হাঙরটা কিছুই বুঝতে পারে না আর তারপরেই শরীরের সামনের অংশটা দিয়ে শুরু হয় মোচড়ানো আর নির্জীব দাপাদাপি, কেননা লেজ ছাড়া ওরা কিছুতেই গতি সঞ্চয় করতে পারে না। অন্য পাখনাগুলো ভারসাম্য রাখে আর দিক বদলে সাহায্য করে মাত্র। হাঙরটা মরিয়া হয়ে ঝটকা দেয় বেশ কয়েকটা, ততক্ষণ শক্ত হাতে ধরে রাখতে হয় ওটাকে, আর তারপরেই হতচকিত হাঙরটা হতোদ্যম আর নিস্পৃহ হয়ে পড়ে। আর পেটটা চুপসে যেতেই হাঙরটা স্থির হয়ে যায়।
হাঙ্গরটা শান্ত হয়ে যেতে এবং হাতে ঝোলা অবস্থাতে পরবর্তী ঘটনার অপেক্ষায় থাকার সময়, আমাদের পালা ওটাকে সর্বশক্তি দিয়ে টেনে ওপরে তুলে নেওয়া। প্রায়শই আমরা ভারী মাছটার অর্ধেকটার বেশী জলের ওপরে তুলে আনার পর মাছটা জেগে উঠত আর বাকী কাজটা ওইই করত। প্রবল ঝাঁকুনি মেরে মাথাটা বেঁকিয়ে নিজেই কাঠের লগের ওপর উঠে পড়ত। আমরা সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ওটাকে ভেলার ভেতর টেনে এনেই খুব তাড়াতাড়ি পা বাঁচাতে লাফ দিয়ে অনেকটা পাশে সরে যেতাম। কেননা তখন হাঙরের মেজাজ মোটেই ভাল থাকত না। ঝটাপটি মেরে হাঙরটা লেজখানাকে বিশাল হাতুড়ির মতো ব্যবহার করে বাঁশের দেয়ালে আছড়ে পড়ত। এখন আর সে তার লোহার মতো মাংসপেশীকে কোনো রেয়াত করছে না। বিরাট চোয়াল হাঁ করা, তার মধ্যে সারি সারি দাঁত, নাগালের মধ্যে বাতাসে যাহোক কিছু কামড়ে ধরতে চাইছে। এমনটাও কখনো হত যে হাঙরটা লজ্জাজনকভাবে নাকাল হবার পরে একটা ঝটাপটির মধ্যেই ভেলার বাইরে জলে পরেই ভালোয় ভালোয় অদৃশ্য হয়ে গেল আর রণনৃত্যেরও পরিসমাপ্তি ঘটল। কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই হাঙরটা ছিটকে ভেলার পেছনদিকে যেতে যেতেই অথবা ওর দাঁত কড়মড় পুরোপুরি বন্ধ হবার আগেই আমরা ওর লেজের গোড়ায় একটা ফাঁস আটকে দিতাম।
ক্রমশ