কন-টিকি অভিযান-আগের পর্বগুলো
(১৬)
থর হেয়ারডাল
(অনুবাদঃ ইন্দ্রনাথ)
আগের কথা
তোতাটা অভিযাত্রীদের একজন হয়ে উঠেছিল। মাস্তুলের দড়িতে সারাদিন নানারকম কেরদানি দেখিয়ে খুব মজা দেখাত। মাস্তুলের দড়ি টানাটানির সময় ওর উত্তেজনা দেখে কে! চেঁচামেচি করে একশেষ করত। রেডিও অপারেটররা শুরুতে বেতারের এরিয়েল খাটানো নিয়ে বেশ ব্যতিব্যস্ত থাকত। কখনো ঘুড়ির সাথে বেঁধে কখনো বেলুনের সাথে বেঁধে। সেসময়েই আবিষ্কার করা গেল তোতাটা অসুস্থ আর ওর পটির মধ্যে এরিয়েলের তারের ধাতব খণ্ড। তোতাটা এরিয়েলের তার কেটে দিয়েছিল। রেডিওঅপারটেরদের সঙ্গেই ওর যত ভাব ছিল। তারপর একদিন একটা দুর্ঘটনা ঘটল। মস্ত একটা ঢেউ কিছু বোঝার আগেই দড়ির ওপরে বসা তোতাটাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল সমুদ্রে। তোতাটাকে হারিয়ে অভিযাত্রীরা বেশ বিমর্ষ হয়ে পড়েছিল। রেডিও কর্নারটা শূন্য হয়ে ছিল ওর অভাবে। ভেলায় সবচেয়ে জরুরি কাজটা ছিল রেডিও কর্নারটা শুকনো রাখা। ক্যানভাস দিয়ে যথাসম্ভব ওর চারপাশ ঢেকে রাখা থাকত। সেখানে বসে বসেই টরস্টাইন হঠাৎ করেই একদিন যোগাযোগ করে ফেলল লস অ্যাঞ্জেলিসের এক শখের রেডিও অপারেটরের সাথে। তারপর থেকে পালা করে সে আর তার বন্ধু যোগাযোগ রাখছিল অভিযাত্রীদের সঙ্গে। একদিন গভীর রাতে অসলোর এক ব্যক্তির সাথে রেডিওতে যোগাযোগ হল, তার মাধ্যমে রাজা হাকোনকে ৭৫ বছরের জন্মদিনের শুভেচ্ছা বার্তা পাঠানো হল। তিনিও পাল্টা শুভেচ্ছা জানালেন। তারপর আরেক সমস্যা হল ছবি ডেভেলপ করা নিয়ে। তারও সমাধানের রাস্তা পাওয়া গেল রেডিও মারফৎ হলিউডের কাছাকাছি এক ব্যক্তির কাছ থেকে। প্রাচীন কনটিকির অভিযাত্রীদের মতোই এই অভিযাত্রীরা আকাশের তারা দেখে দেখে দিক ঠিক করে ভেলা বেয়ে চলল পশ্চিমের দ্বীপমালার দিকে আর এমন সময়ে উঠল ঝড়। উথাল পাথাল ঝড়ের মধ্যেও কনটিকি অবলীলায় টিকে রইল ঢেউয়ের মাথায় চড়ে, ঢেউয়ের ওপর দুলতে দুলতে, রাশি রাশি জলের পাহাড় ঠেলে অবশেষে পশ্চিম দ্বীপমালার আরো খানিকটা কাছে। হালে বসা লোকটিকে কেবল বিশেষ নজরে রাখতে হচ্ছিল ভেলার দিক ঠিক রাখতে। এদিকে প্রবল ঝড়ের দাপটের মাঝেই হারম্যান বাতাসের বেগ মাপার যন্ত্র নিয়ে মাস্তুলে চড়ে বসে মাপজোখ নিয়ে নিচ্ছিল।
সাগরপাড়ি
ভেলার পেছনে বসে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছিলাম, এমনসময় বিশ্রি একটা ধাক্কা খেলাম, পরে আমি নিজেই নিজের ভ্যাবাচেকা ভাব নিয়ে না হেসে থাকতে পারিনি। ঢেউয়ের ধাক্কা টাক্কা নিয়ে আমরা মোটামুটি সড়োগড়ো ছিলাম কিন্তু এটা একবারেই অন্যরকম, সম্ভাব্য যা যা হতে পারে তার চেয়ে আলাদা। পেছন থেকে এসে খুব ভারী আর ঠান্ডা কিছু, অনেকটা হাঙরের মাথার মতো, জল থেকে উঠে এসে আমায় ঢুঁসো মারল যেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই, পেছনে একটা হাঙর কামড়ে ঝুলছে ভেবে, আমি মাস্তুলের দিকে দৌড় দিলাম। হালে বসে ছিল হারম্যান, সে তো হেসেই কুটিপাটি। ওইই হাসতে হাসতে কোনোমতে বলল, আমার পাছায় যেটা এসে ধাক্কা মেরেছে সেটা ১৬০ পাউন্ডের একটা ঠান্ডা এবং বিরাট টুনিমাছ, পাশ থেকে এসে ঢুঁ মেরেছে। পরে হারম্যান আর টরস্টাইন পাহারায় থাকার সময় ওই মাছটাই ঢেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে ভেলায় ওঠার চেষ্টা করেছিল আর দু-দুবার কাঠের গুঁড়ির খুব কাছাকাছি চলেও এসেছিল কিন্তু আমরা ওর পেছল দেহটা ধরে ফেলার আগেই আবার লাফ দিয়ে ভেলার বাইরে চলে গেছে।
তার পরপরই একটা মোটাসোটা ভ্যাবলা বনিটো ঢেউয়ের সাথে ভেলায় উঠে এল, এরই মধ্যে একদিন আগে ধরা একটা টুনিও ছিল, সবমিলিয়ে আমরা ঠিক করলাম তবে এবারে মাছই ধরা যাক, তাতে আমাদের চারপাশে মাছেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে একটু লাগাম পড়বে।
ডায়েরি থেকে
প্রথমে একটা ছ’ফুট লম্বা হাঙর বঁড়শিতে গেঁথে ভেলায় তোলা হল। বঁড়শিটা আবার ফেলতে না ফেলতেই আটফুটি একটা হাঙর গিলল সেটা, ওটাকেও ভেলায় তুলে আনা গেল। বঁড়শিটা ফের জলে ফেলতে আরেকটা নয়া ছ’ফুটি হাঙর পাওয়া গেল, ভেলার কিনারায় আনতে আনতেই সেটা বঁড়শি ছাড়িয়ে নিয়ে ডুব দিল। আবার বঁড়শি ফেলা হল, এবারে একটা আটফুটি হাঙর এসে বেশ বেগ দিল আমাদের। ওর মাথাটা ভেলার গুঁড়ির ওপরে তুলে এনেছিলাম এমনসময়েই আমাদের চারটে স্টিলের সুতো ছিঁড়ে ব্যাটা লাফ দিয়ে জলের নীচে চলে গেল। নতুন বঁড়শি ফেলে সাতফুটি একটা হাঙর তুললাম ভেলায়। পেছল গুঁড়িগুলোর ওপরে ভেলার পেছনদিকটায় দাঁড়িয়ে মাছ ধরাটা ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠছিল;বিশেষ করে যখন ভেলার ওপরে তিনটে হাঙর মরেই গেছে ধরে নিয়েছি অথচ তারা আছাড়ি-পিছারি করেই চলেছে। আমরা হাঙরগুলোর লেজ ধরে টেনে সামনের দিকে ডাঁই দিয়ে রাখলাম। তারপরপরই একটা টুনি ধরা পড়ল, সেটা হাঙরগুলোর চেয়েও বেশি লড়াই দিল ভেলায় তোলার আগে অবধি। ওটা এত মোটা আর ভারী ছিল যে আমাদের মধ্যে কেউই লেজ ধরে ওটাকে তুলতে পারেনি।
চারপাশের সমুদ্র তখনও উন্মত্ত মাছে ভর্তি। আরেকটা হাঙর ধরা পড়েছিল কিন্তু ভেলায় ওঠানোর মুহূর্তে ওটা সুতো ছিঁড়ে পালিয়ে গেল। অবশ্য তারপরেই একটা ছ’ফুটি হাঙর ধরে নির্বিঘ্নে ভেলায় তুললাম। তারপর আরেকটা, পাঁচফুট মতো। তারপরে আবার আরেকটা ছ’ফুট লম্বা। পরের বার বঁড়শি তুললাম একটা সাতফুট লম্বা হাঙরসহ।
ডেকের ওপর সর্বত্র বড়োবড়ো হাঙরগুলো লেজ মুচড়ে উঠছে, বাঁশের কেবিনের দেয়ালে আছড়াচ্ছে। ঝড়ের পর মাছ ধরে ধরে যখন আমরা খুবই ক্লান্ত আর নিঃশেষিত,তখন একেবারেই মাথা কাজ করছিল না, কোন হাঙরটা যে সত্যি সত্যিই মরেছে, কোনটা কাছে গেলে লেজ আছড়াচ্ছে আর কোনটাই বা সবজেটে বেড়াল-চোখ নিয়ে মরণকামড় দেবে বলে ঘাপটি মেরে আছে! রাক্ষসগুলোর সাথে দড়ি টেনেটেনে আর লড়াই করে করে যখন আর পারছি না, এবং চারদিকে ছড়ানো ন’খানা বড়ো বড়ো হাঙর, তখন, প্রায় পাঁচঘণ্টার পরিশ্রমের পর, আমরা রণে ভঙ্গ দিলাম।
পরদিন দেখি ডলফিন আর টুনি সংখ্যায় কম কিন্তু হাঙরদের সংখ্যা একইরকম আছে। আবার হাঙর ধরা শুরু করলাম বটে কিন্তু অচিরেই সেটা বন্ধ করে দিলাম কেন না বুঝতে পেরেছিলাম ভেলা থেকে গড়ানো হাঙরের তাজা রক্ত আরো আরো হাঙরদের আকর্ষণ করে আনছে। আমরা তাই মরা হাঙরগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিলাম আর সমস্ত ডেক থেকে রক্ত পরিষ্কার করে ফেললাম। বাঁশের বাতাগুলো হাঙরের দাঁতে আর খসখসে চামড়া লেগে লেগে ছিঁড়ে গিয়েছিল। যেগুলো রক্তে বেশিরকম মাখামাখি হয়ে গিয়েছিল আর ছিঁড়েখুঁড়েও গিয়েছিল সেগুলো ফেলে দিয়ে সোনালি-হলুদ রঙের নতুন বাঁশের বাতা পেতে দেয়া হল। সামনের দিকের ডেকে একাধিক বাঁশের চাটাই পরপর একসাথে বেঁধে রাখা ছিল।
মনে মনে ওই সন্ধ্যাগুলোর কথা যখন ভাবি দেখতে পাই হাঙরগুলোর লোভী, হাঁ-করা চোয়াল আর রক্ত। নাকে তখনও হাঙরের মাংসের গন্ধ লেগে। হাঙর খাওয়া যেত, হ্যাডকের মতো খেতে, কেবল চব্বিশঘণ্টা সমুদ্রের জলে চুবিয়ে অ্যামোনিয়ামুক্ত করে নিতে হত; অবশ্য বনিটো আর টুনি অনেক অনেক ভালো খেতে।
সেই সন্ধ্যায়, প্রথমবারের জন্য আমাদের মধ্যে কেউ একজন বলে উঠল খুব শিগগির একটা পামগাছে ঘেরা দ্বীপে ঘাসের ওপর টানটান হয়ে শুয়ে আরাম করতে পারলে বেশ হত। আরো বলল, ঠান্ডা মাছ আর বিক্ষুব্ধ সমুদ্র ছাড়া অন্য কিছু দেখতে পেলে এইবার সে খুশিই হবে।
আবহাওয়া আবার বেশ শান্ত হয়ে এসেছে, কিন্তু কখনোই আগেকার মতো স্থির এবং নির্ভর করার মতো নয়। হঠাৎ হঠাৎ বেমক্কা ভয়ানক বাতাসের ঝাপটা আর তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। তাতে আমরা অবশ্য বেশ আনন্দিত কেন না আমাদের খাবার জলের রসদ নষ্ট হতে বসেছে আর তা পচা ডোবার জলের মতো বিস্বাদ হয়ে উঠেছে। তাই তুমুল বৃষ্টি পড়তে শুরু করলে আমরা কেবিনের ছাত থেকে জল সংগ্রহ করলাম আর বিবস্ত্র হয়ে ডেকে দাঁড়িয়ে খুব আরাম করে নোনা জল ধুয়ে ফেললাম শরীর থেকে।
পাইলট মাছেরা আবার দেখা দিল, তাদের নিজেদের জায়গাতেই, কিন্তু সে-মাছগুলো রক্তারক্তি কাণ্ডের পর ফিরে আসা পুরোনো মাছেরাই নাকি যুদ্ধ-পরবর্তী নতুন অনুসরণকারী মাছের দল, তা বলতে পারি না।
২১ জুলাই, বাতাস আবার থেমে এল। অস্বস্তিকর, এক্কেবারে স্থির; পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি এর মানে কী! আর সত্যি করেই পুব, পশ্চিম আর দক্ষিণ থেকে ভীষণ বাতাসের পরপর কয়েকটা ঝাপটার পর দক্ষিণ থেকে নতুন করে বাতাস বইতে আরম্ভ করল আর দিগন্তের আকাশ ঘন কালো থমথমে মেঘে ঢেকে যাচ্ছিল। হারম্যান সারাক্ষণ ওর অ্যানিমোমিটারটা নিয়ে বাইরেই ছিল, বাতাসের বেগ সেকেন্ডে সর্বোচ্চ পঞ্চাশ ফুট অবধি মেপে ফেলেছিল ও। হঠাৎ টরস্টাইনের স্লিপিং ব্যাগটা গেল উড়ে। তার পরের কয়েক মুহূর্তে যা ঘটল তা বলতে যত সময় লাগবে তার চেয়ে কম সময়ে সেটা ঘটে গিয়েছিল।
হারম্যান উড়ে যাওয়া ব্যাগটা ধরতে গিয়েছিল, তাড়াহুড়োয় ভুল পা ফেলে, একেবারে জলে। ঢেউয়ের আওয়াজের মধ্যে আমরা হালকা একটা আর্তচিৎকার শুনলাম এবং দেখতে পেলাম হারম্যানের মুন্ডু এবং নাড়তে থাকা একটা হাত আর সেইসঙ্গে জলের মধ্যে ওর কাছাকাছি ঘুরতে থাকা সবুজ রঙের একটা কিছু। বাঁচার জন্য ও ঢেউয়ের মধ্যে দিয়ে প্রাণপণ ভেলায় উঠে আসতে চেষ্টা করছিল; ভেলার বাঁদিকে উত্তাল ঢেউয়ের মাঝে পড়েছিল ও। পেছনের হালে টরস্টাইন আর ভেলার ডগায় আমি এই দুজনই খালি বুঝতে পেরেছিলাম ঘটনাটা, তাতে শরীর হিম হয়ে গিয়েছিল আমাদের। আমরা যতটা জোরে পারি চেঁচিয়ে উঠেছিলাম,‘একজন জলে পড়ে গেছে!’, বলেই কাছাকাছি থাকা লাইফসেভিং জিনিসগুলোর দিকে ছুটে গেলাম। সমুদ্রের আওয়াজে বাকিরা হারম্যানের গলা শুনতে পায়নি। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই সকলে সজাগ হয়ে যেতে ডেকের ওপর ছোটাছুটি আরম্ভ হয়ে গেল। হারম্যান দুর্দান্ত সাঁতারু ছিল, ফলে যদিও বুঝেছিলাম যে ওর জীবন বিপন্ন, তবু অনেকটা আশা ছিল যে খুব দেরি হয়ে যাবার আগেই ও ঠিক ভেলার কিনারায় চলে আসতে পারবে।
সবচেয়ে কাছাকাছি ছিল টরস্টাইন, ও বাঁশের চোঙাটা বাগিয়ে ধরল, ওটার মধ্যে আমাদের লাইফবোটের দড়ি গুটিয়ে রাখা থাকত; আর ওটাই ওর নাগালের মধ্যে ছিল। হল না, গোটা যাত্রায় ওই একবারই দড়িটা আটকে গিয়েছিল চোঙায়। হারম্যান এবার ভেলার পেছনদিকে শেষপ্রান্ত বরাবর কয়েক গজ তফাতে ভাসছে। এখন ওর শেষ আশা, যদি সাঁতরে এসে হালের চওড়া অংশটা আঁকড়ে ধরতে পারে! ভেলার পেছনের গুঁড়িগুলোর শেষপ্রান্তটাও হাতছাড়া হবার পর ও হালটা ধরার চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু সেটাও ফসকে গেল। আর এই মুহূর্তে ও যে জায়গায় ভাসছে, সেখান থেকে, অভিজ্ঞতায় জানি, কোনোকিছুই আর ফেরানো অসম্ভব। এরই মধ্যে আমি আর বেঙ্গট ডিঙিটা নামিয়ে দিয়েছি, ন্যুট আর এরিক লাইফবেল্টটা ছুঁড়ে দিয়েছে। ওটা একটা বড়ো দড়ি বাঁধা অবস্থায় কেবিনের ছাদের একটা পাশে ঝোলানো থাকত, যাতে দরকারে চট করে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু বাতাস এত জোর বইছিল যে ওটা ছোঁড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের ধাক্কায় ফের ভেলায় ফেরত চলে এল।
কয়েকবার ব্যর্থ চেষ্টা হতে হতেই হারম্যান হাল থেকে অনেকটা পেছনে চলে গেছে, আর প্রাণপনে সাঁতরে চলেছে ভেলার সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য; এদিকে একের পর এক হাওয়ার ধাক্কায় ওর দূরত্ব ক্রমে বেড়েই চলেছে। ও বুঝতে পারছিল এরপর এই দুইয়ের ফাঁকটা স্রেফ বেড়েই চলবে, কিন্তু তবুও ওর মনে ক্ষীণ আশা টিকে রইল, হয়তো জলে নামানো ডিঙিটা অবধি কোনোমতে পৌঁছতে পারা যাবে। ডিঙির ব্রেকের মতো দড়িটা বাঁধা না থাকলে হয়তো রাবারের নৌকোটা নিয়ে বেয়ে বেয়ে সাঁতরাতে থাকা লোকটার কাছে পৌঁছনো যেত কিন্তু সেটা বেয়ে ফের কনটিকিতে ফিরে আসা যেত কিনা তা বলা যায় না। এতদসত্ত্বেও ডিঙির ওপরে থাকা তিনটে লোকের তবু বা একটু আশা থাকে ফেরার কিন্তু সমুদ্রের জলে পড়ে যাওয়া লোকের ক্ষেত্রে কোনো আশাই নেই।
তখন হঠাৎ ন্যুট সমুদ্রে সটান ঝাঁপ দিয়ে পড়ল। একহাতে লাইফবেল্ট নিয়ে ও সরাসরি সাঁতরে যাচ্ছিল। প্রত্যেকবার পেছনের ঢেউয়ের মাথায় হারম্যানের মাথা দেখা গেলে ন্যুটকে দেখা যাচ্ছিল না, আবার ন্যুট ভেসে উঠলে হারম্যান নেই। তারপর একসময় দুটো মাথাই একসঙ্গে দেখা গেল, দুজনেই সাঁতরে কাছাকাছি চলে এসে লাইফবেল্ট আঁকড়ে ধরেছে। ন্যুট হাত নাড়ল, আর রাবারের ডিঙিটা ইতিমধ্যে টেনে ডেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল বলে আমরা চারজনে মিলেই ওদের উদ্ধারের জন্য লাইফ বেল্টের দড়ি ধরে টেনে তুলতে লাগলাম। ওই দুজনের পেছনে একটা গাঢ় রঙের কিছু ভাসছিল, দড়ি টানার সময় বরাবর সেদিকেই আমাদের নজর ছিল। জলের এই অদ্ভুত জন্তুটাই ঢেউয়ের মাথায় একটা বড়ো কালচে সবুজ রঙের ত্রিকোন তৈরি করেছিল। হারম্যানের কাছাকাছি পৌঁছনোর সময় ন্যুটকে প্রায় একটা ঝটকা দিয়ে ফেলেছিল সেটা। কেবল হারম্যানই জানত যে ওই ত্রিকোনটা কোনো হাঙর বা অন্য কোনো সমুদ্র-দানো নয়। ওটা টরস্টাইনের জলনিরুদ্ধ স্লিপিং ব্যাগের একটা কোনা। অবশ্য এই দুজনকে টেনে তোলার পর স্লিপিং ব্যাগটাকে আর ভাসতে দেখা গেল না। ওটা যেইই জলের গভীরে টেনে নিয়ে যাক, বলাই যায় সে অল্পের জন্য ভালো শিকার ফস্কেছে।
“সুখের কথা, আমি ওটার মধ্যে ছিলাম না।” এই বলে টরস্টাইন ছেড়ে আসা হাল ধরতে চলে গেল।
সেই সন্ধ্যায় অত হাসিঠাট্টা আর কিছু হয়নি। বহুক্ষণ অবধি আমাদের স্নায়ু আর হাড়ের মধ্যে দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেছে। অবশ্য এই শীতল স্রোতের পাশাপাশি একটা নিশ্চিন্তির ওমও আমাদের ঘিরে ছিল, যে যাক ভেলার ওপরে শেষ অবধি আমরা ছ’জনই আছি।
ন্যুটকে অনেক ভালো ভালো কথা বলার ছিল সেদিন, হারম্যানের তো বটেই, আমাদের বাকিদেরও।
কিন্তু যা ঘটে গেছে তা নিয়ে চিন্তা করার মতো সময় আমাদের হাতে ছিল না। মাথার ওপরের আকাশ ইতিমধ্যেই ঘন কালো মেঘে ঢেকে গেছে আর বাতাসের বেগও পাল্লা দিয়ে বেড়ে গেছে। রাত নামার আগেই ঝড় এসে গেল। শেষ অবধি আমরা লাইফবেল্টটা লম্বা দড়িসহ ভেলার পেছনদিকে বেঁধে রাখলাম, যাতে হালের পেছনেও কিছু একটা রাখা যায় যাতে ঢেউয়ের ধাক্কায় আবার কেউ জলে পড়ে গেলে সাঁতরে গিয়ে সেটা ধরতে পারে। তারপর রাত নামল, চারপাশ নিকষ কালো অন্ধকারে ঢেকে গেল আর সমুদ্র এবং ভেলাটাও চোখের সামনে ঢেকে গেল। অন্ধকারে পাগলের মতো ওপরে নীচে ওঠা-নামার মধ্যে আমরা কেবল শুনছিলাম আর অনুভব করতে পারছিলাম প্রবল বাতাস আছড়ে পড়ে আওয়াজ উঠছে মাস্তুলে আর টানা দেওয়া দড়িদড়ায়। বাতাসের প্রবল ঝাপটা বাঁশের কেবিনের ওপর মুহূর্মুহু এত জোরে আছড়ে পড়ছিল যে আমরা ভাবছিলাম এবার ওটা উড়েই যাবে। যদিও ওটা ক্যানভাস দিয়ে ভালোমতো ঢেকেঢুকে দড়ি দিয়ে খুব শক্ত করেই বাঁধা ছিল। ফুঁসে ওঠা সমুদ্র কনটিকিকে উপরে ছুঁড়ে দিচ্ছিল বলে ঢেউয়ের চোটে ভেলার কাঠের গুঁড়িগুলো কোনো যন্ত্রের চাবির মতো ওঠা-নামা করছিল। আমরা আশ্চর্য হয়েছিলাম দেখে যে ভেলার মেঝের কাঠের গুঁড়িগুলোর ফাঁক দিয়ে জলস্রোত উঠে আসছিল না বরং ওগুলো একটা বেলোর মতো কাজ করে তার ভেতর থেকে ভেজা বাতাস ওপর নীচে বইয়ে দিচ্ছিল।
পাঁচ পাঁচটা দিন আবহাওয়া কখনো ঝড় কখনো প্রবল বাতাসের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে লাগল। ছড়ানো উপত্যকার মতো ধূসর নীল সমুদ্রের খাত থেকে ওঠা ধোঁয়ায় ভরে রয়েছে চারপাশের সমুদ্র, যেন বাতাস ওঠার সময়ে ঢেউগুলো তাতে ভর দিয়ে একঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। অবশেষে পাঁচদিনের দিন মাথার ওপরে এক চিলতে নীল দেখা গেল। ঝড় কেটে যেতে প্রবল কালো মেঘও সরে গিয়ে উজ্জ্বল নীল আকাশ বেরিয়ে পড়ল। ঝড়ে আমাদের হাল ভেঙে গিয়েছিল, পালের অবস্থাও তথৈবচ; সেন্টারবোর্ডগুলো আলগা হয়ে ঝুলে কাঠের গুঁড়িগুলোর মাঝে তেরছাভাবে আটকে ছিল। ইতিমধ্যে জলের মধ্যে বাঁধনের দড়িগুলো ক্ষয়ে বেশ আলগা হয়ে গিয়েছিল। অথচ আমাদের নিজেদের আর আমাদের মালপত্রগুলোর কোনো ক্ষতি হয়নি।
দু’খানা ঝড় সামলে কনটিকির জোড়গুলির বাঁধন কমজোরি হয়ে পড়েছিল। উঁচু উঁচু ঢেউ পেরোনোর জন্য যে পরিমান ঝক্কি গেছে তাতে সমস্ত দড়িগুলোয় বেশ টান পড়েছিল, আর কাঠের গুঁড়িগুলোর ক্রমাগত নড়াচড়ায় বালসা কাঠে দড়ি কেটে বসে গিয়েছিল। আমরা আমাদের দূরদর্শীতাকে ধন্যবাদ দিলাম যে আমরা ভেলা বানানোয় কঠোরভাবে ইনকাদের নীতি অনুসরন করেছিলাম আর ধাতব তার ব্যবহার করিনি। সেটা করলে ঝড়ের দাপটের সময় তারগুলো স্রেফ কাঠের মধ্যে বসে কেটে গিয়ে গোটা ভেলাটাকেই দেশলাইকাঠের মতো টুকরো টুকরো করে ফেলত। আবার যদি শুরুতেই খটখটে শুকনো বালসা কাঠ ব্যবহার করতাম ভেলাটা যাত্রার শুরুতে জলের অনেকটা ওপরে ভাসত ঠিকই, কিন্তু এই সময়ের ঢের আগেই তাতে সমুদ্রের জল ঢুকে গিয়ে ডুবে যেত। কেবলমাত্র কাঁচা কাঠের রস সংপৃক্ত থাকায় সচ্ছিদ্র বালসা কাঠের মধ্যে জল ঢুকতে পারেনি।
কিন্তু এখন দড়িগুলো এতই আলগা হয়ে গেছে যে দুটো কাঠের মধ্যের ফাঁকে যে কারো পা গলে যাবে আর ফের কাঠদুটো কাছাকাছি আসার সময় চেপটে গিয়ে পা ভেঙে যাবে। সামনে পেছনে যেখানে বাঁশের বাতা পাতা নেই, আমরা দুটো কাঠের ওপর ভর দিয়ে থাকার সময় হাঁটুগেড়ে বসতাম। পেছনের দিকের কাঠগুলো সামুদ্রিক শ্যাওলায় ঢেকে কলাপাতার মতো পেছল হয়েছিল, তবুও ওর মধ্যে দিয়েই আমরা যাতায়াতের পথ করে নিয়েছিলাম আর হাঁটাহাঁটিও করতাম; হালের কাছে আমরা একটা চওড়া পাটাতন পেতে রেখেছিলাম দাঁড়াবার জন্য, যদিও সমুদ্রের ঢেউ ভেলায় আঘাত করবার সময় দাঁড়ানোটা অত সহজ ছিল না মোটেই। ভেলার ন’টা বিশাল কাঠের গুঁড়িগুলোর একটার পর একটা সারারাত সারাদিন ধরে আড়াআড়ি কাঠের ওপর ক্রমাগত ধাক্কা দিয়ে দিয়ে চলেছে আর একটা ভোঁতা আওয়াজ উঠছে। আবার একটা নয়া উপসর্গ – যে দড়িদুটো হেলে থাকা মাস্তুল দুটোকে মাথায় মাথায় ধরে রেখেছিল, তা থেকে ভীতিজনকভাবে ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ উঠছিল। দুটো মাস্তুলে ওঠার ব্যবস্থা আলাদা আলাদা ভাবে করা ছিল কেননা ওদুটো দুখানা ভিন্ন ভিন্ন কাঠের ওপরে আটকানো ছিল। হালের বৈঠাটাকে শক্ত লোহার মতো ম্যানগ্রোভ কাঠের চেলা দিয়ে খুব শক্ত করে বাঁধা হল এবং এরিক আর বেঙ্গটের মতো দক্ষ পাল মেরামতকারীদের দাক্ষিণ্যে কনটিকি আবার মাথা তুলে বুক ফুলিয়ে পলিনেশীয়ার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। ওদিকে অনুকূল আবহাওয়ায় শান্ত ও নরম হয়ে আসা সমুদ্রের বুকে পেছনের হালের বৈঠা চমৎকার খেলে বেড়াতে লাগল। কিন্তু সেন্টারবোর্ডগুলো আর আগের মতো নিঃশব্দ রইল না। জলের ধাক্কা পুরোপুরি আটকানোর বদলে ওরা ভেলার তলায় ঝুলেই রইল, আলগা এবং বাঁধনছেঁড়া অবস্থায়। নীচে গিয়ে বাঁধন পরীক্ষা করাটা বেকার হত কারণ তার ওপরে প্রচুর সামুদ্রিক শ্যাওলা জমে ঢেকে ফেলেছে। পুরো বাঁশের ডেকটা ভালোভাবে পরখ করে নিয়ে দেখা গেল মূল দড়িগুলোর মধ্যে মাত্র তিনখানা ছিঁড়েছে। দেখলাম ওগুলো গুটিয়ে গিয়ে মালপত্রগুলো যেখানে বাঁধা ছিল সেখানে চেপটে আছে। স্পষ্টতই কাঠের গুঁড়িগুলো বেশ অনেকটা জল শুষে নিয়েছিল কিন্তু মালপত্র অনেকটা হালকা হয়ে যেতে একটার খামতি অন্যটা পুষিয়ে দিয়েছিল। আমাদের খাবার জলের ভাণ্ডারও প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল, যেমন রেডিওর ড্রাই ব্যাটারিও।
যাইই হোক, শেষ ঝড়টার পর এটা বোঝা গেছিল যে সামনের দ্বীপে পৌঁছনো অবধি মাঝের সময়টুকু আমরা ভেসেও থাকব একত্রেও থাকব। কিন্তু আরেকটা সমস্যা সামনে এসে উপস্থিত হল, আমাদের অভিযাত্রাটা শেষ হবে কীভাবে?
কনটিকি অপ্রতিরোধ্য গতিতে পশ্চিমে এগোতে থাকবে যতক্ষণ না ওর ডগাটা গিয়ে কোনো পাথর বা শক্ত কোনো কিছুতে গিয়ে আঘাত করে থেমে যাবে। কিন্তু তাতেও আমাদের যাত্রা সত্যিসত্যি শেষ হবে না যতক্ষণ না আমরা নিরাপদে অক্ষত শরীরে গিয়ে পলিনেশীয়ার অসংখ্য দ্বীপের কোনো একটায় গিয়ে নামতে পারব।
শেষ ঝড়টা যখন পেরিয়ে এলাম খানিকটা দ্বিধাই ছিল যে কোথায় না কোথায় ভেলাটা গিয়ে থামবে। আমরা টুয়ামাটো দ্বীপমালা আর মাকুইস দ্বীপপুঞ্জ থেকে সমান দূরত্বে ছিলাম আর এমন একটা অবস্থানে, যে হতেই পারে আমরা দুটোর মাঝখান দিয়ে গলে গেলাম, একটা দ্বীপও নজরে এল না। মার্কুইস দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে কাছের দ্বীপটা ৩০০ সামুদ্রিক মাইল উত্তরপশ্চিমে আর টুয়ামাটো দ্বীপমালার সবচেয়ে কাছের দ্বীপটা ৩০০ সামুদ্রিক মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে। এদিকে বাতাসের গতি এলোমেলো, অস্থির, সাধারণভাবে পশ্চিমাভিমুখী আর বাতাস, দুই দ্বীপপুঞ্জের মাঝে, সমুদ্রের এই লম্বা ফাঁকটার দিকেই বইছে।
উত্তরপশ্চিমে সবচেয়ে কাছের দ্বীপটার নাম ফাটু হিভা, জঙ্গলে ঢাকা ছোট্ট পাহাড়ি দ্বীপ। ওখানকার সৈকতে আমি একসময় কুঁড়েঘর বানিয়ে ছিলাম আর সেসময় ওখানকার এক বৃদ্ধের স্মৃতিতে অমলিন পূর্বপুরুষ টিকির গল্পগুলো শুনতাম। কনটিকি যদি ওটায় গিয়ে ভেড়ে তাহলে অনেক পরিচিতদের সঙ্গে দেখা হবে, কিন্তু বৃদ্ধ মানুষটার সঙ্গে হয়তো হবে না। বহু আগেই, সত্যিকার টিকির সঙ্গে দেখা হবে বলে, হয়তো উনি চলে গিয়েছেন। ভেলাটা যদি মার্কুইস দ্বীপপুঞ্জের পাহাড়ি দ্বীপগুলোর দিকে মুখ ফেরায়, আমার জানাই ছিল ওখানে কিছু কিছু দ্বীপের মধ্যে দূরত্ব বিস্তর আর সমুদ্রও সেখানে খুবই বিক্ষুব্ধ হয়ে খাড়া পাথরের দেয়ালে গিয়ে আছড়ে পড়ে। ফলে সেখানে খুব সতর্কভাবে নজর রেখে আমাদের হাল ধরতে হবে যাতে ছড়ানো কয়েকটা উপত্যকার মুখে মুখে আমরা ঢুকতে পারি যার শেষমাথা একচিলতে সৈকতে গিয়ে শেষ হচ্ছে।
অন্যথায়, যদি টুয়ামাটো দ্বীপমালার প্রবাল প্রাচীরের দিকে চলে যায় ভেলাটা, ওদিকে অনেকটা বিস্তৃত সমুদ্রের মধ্যে কাছাকাছি অনেক দ্বীপ। কিন্তু এই দ্বীপগুলো নীচু অথবা বিপজ্জনক দ্বীপপুঞ্জ নামেও পরিচিত ছিল কেননা এর পুরোটাই প্রবালকীট দিয়ে তৈরি আর ভয়ানক ডুবোপ্রাচীরে ভর্তি; কোনো কোনো প্রবালদ্বীপ পুরোই পামজাতীয় গাছে ছাওয়া আর সমুদ্রতল থেকে কেবল ছয় থেকে দশ ফুট মাত্র উঁচু। এরকম প্রতিটা দ্বীপের চারপাশে রক্ষাকারী বিপজ্জনক গোলাকার প্রবালপ্রাচীর রয়েছে আর সেগুলো যাতায়াত করা জাহাজের ক্ষেত্রে বিভীষিকার সমান। কিন্তু টুয়ামাটু, প্রবালদ্বীপ এবং মার্কুইস, আগ্নেয়দ্বীপ হলেও দুটোতেই একই পলিনেশীয় লোকেরা বসবাস করত আর দুজায়গার অভিজাত পরিবারেরাই ‘টিকি’কে তাঁদের আদি পূর্বপুরুষ বলেই গণ্য করত।
এরও আগে, জুলাইয়ের তিন তারিখ নাগাদ, আমরা যখন পলিনেশীয়া থেকে ১০০০ সামুদ্রিক মাইল দূরে, প্রকৃতি নিজে থেকেই আমাদের বলে দিল, যেমন কিনা সে প্রাচীনকালের পেরুর ভেলাযাত্রীদেরও বলে দিতে পারত যে সামনের সমুদ্রে কোথাও না কোথাও ডাঙা আছে। পেরুর সৈকত ছেড়ে ১০০০ মাইল পেরোনোর পরই আমরা একটা ছোটো গাঙচিলের ঝাঁক লক্ষ করেছিলাম। ১০০ ডিগ্রি পশ্চিম দ্রাঘিমায় ওরা অদৃশ্য হয়ে গেল আর তারপরে কেবল ছোটো ছোটো পেট্রেলই দেখেছি, যাদের সমুদ্রেই বাসা। কিন্তু জুলাইয়ের তিন তারিখে ১২৫ ডিগ্রি পশ্চিম দ্রাঘিমাংশে আবার গাঙচিলের ঝাঁক দেখা গেল এবং তার পর থেকে ছোটো ছোটো গাঙচিলের ঝাঁক প্রায়ই দেখা যেতে লাগল, তারা হয় আকাশের খুব উঁচুতে উড়ছিল অথবা ঢেউয়ের ওপরে ছোঁ মেরে উড়ুক্কু মাছ ধরছিল। মাছগুলো ডলফিনের হাত থেকে বাঁচতে জল ছেড়ে বাতাসে লাফিয়ে উঠছিল। পাখিগুলো যেহেতু আমাদের পিছু পিছু আমেরিকা থেকে উড়ে আসেনি, ওদের বাসা নিশ্চিতভাবেই সামনের কোন ডাঙায়।
জুলাইয়ের ষোলো তারিখ প্রকৃতি আরো নিশ্চিতভাবেই নিজের বিরুদ্ধাচারণ করল। ওইদিন আমরা একটা ন-ফুটি হাঙর ধরেছিলাম। ওটার পেট থেকে একটা আধখাওয়া বড়োসড়ো তারামাছ বেরিয়ে এল। সেটা ওই সমুদ্দুরের কোনো তীর থেকেই বয়ে এনেছিল হাঙরটা।
ঠিক তার পরদিনই সিধে পলিনেশীয়ার দ্বীপপুঞ্জ থেকেই নিশ্চিতভাবে আমাদের প্রথম অতিথির আগমন ঘটল।
ভেলার ওপরে সেটা একটা দারুণ মুহূর্ত, পশ্চিম দিগন্তের ওপরে দুটো বড়ো ববিপাখি দেখা গেল এবং ক্রমশ ও দুটো খুব নীচু দিয়ে উড়তে উড়তে আমাদের মাস্তুলের ওপরটায় এসে পড়ল। পাঁচ ফুটের ওপর ডানা মেলে আমাদের ওপরে অনেকক্ষণ চক্কর কাটল আর তারপর ডানা মুড়ে আমাদের পাশেই সমুদ্রের ওপর এসে বসল। ডলফিনগুলো তড়িঘড়ি ওই জায়গায় ছুটে গিয়ে কৌতূহলে বিরাট পাখিগুলোর চারপাশে ঘুরঘুর করতে লাগল, কিন্তু কেউ কাউকে ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখল না। তারাই ছিল প্রথম সজীব দূত যারা আমাদের পলিনেশীয়ায় অভ্যর্থনা জানাতে এসেছিল। সন্ধেয় তারা ফিরে না গিয়ে সমুদ্রেই বিশ্রাম নিতে থাকল এবং মাঝরাতের পর শুনতে পেলাম ওরা তখনও মাস্তুলের ওপরে চক্কর কাটতে কাটতে কর্কশভাবে ডাকছে।
এখনকার উড়ুক্কু মাছগুলো বড়ো বড়ো আর অন্য প্রজাতির। চিনতে পারলাম, ফাটু হিভায় সমুদ্র উপকূলে এখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে মাছ ধরতে গিয়ে ওরকম দেখেছি।
তিন দিন তিন রাত আমরা সোজা ফাটু হিভার দিকেই চললাম কিন্তু তারপর উত্তরপূর্ব দিক থেকে আসা একটা জোরালো বাতাস আমাদের আরো নীচে টুয়ামাটোর প্রবালদ্বীপের দিকে ঠেলে দিল। এবারে আমরা প্রকৃত দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোতের পাল্লায় পড়েছি, আর মোটেই সে সামুদ্রিক স্রোতটা তত নির্ভরযোগ্য ছিল না। একদিন আছে, পরদিনই নেই। স্রোতটা যেন অদৃশ্য নদীর মতো শাখাপ্রশাখায় সমুদ্রের মধ্যে ছড়িয়ে ছিল। স্রোত বেশি হলে সমুদ্রে ঢেউও বেশি হচ্ছিল আর তাপমাত্রা সাধারণত এক ডিগ্রি কমে যাচ্ছিল। এরিকের গণনা এবং তার স্থানাঙ্কের পরিমাপের তফাৎ থেকে প্রতিদিন স্রোতের শক্তি ও অভিমুখ বোঝা যাচ্ছিল।
পলিনেশীয়ার দোরগোড়ায় বাতাস আমাদের দুর্বল একটা সমুদ্র-স্রোতের শাখায় ঠেলে দিয়ে বলল, “যাও”, কিন্তু মুশকিল হল আমাদের, স্রোতটার অভিমুখ আন্টার্কটিকার দিকে। বাতাস একদম স্থির হয়ে গেছে। এমনটা আমাদের গোটা যাত্রাপথে আমরা পাইনি, এবং বাতাস খুব দুর্বল হয়ে এলেও, পাল খাটানোর জন্য যত কাপড় আছে সব খাটিয়ে ফেললাম যাতে যতটুকুই হোক পালে বাতাস পাওয়া যায়। আর হ্যাঁ,একদিনের জন্যও আমরা আমেরিকার দিকে একটুও পিছিয়ে যাইনি; আমাদের যাত্রাপথে চব্বিশ ঘণ্টায় ন্যুনতম যে পথ পেরিয়েছিলাম তা হল ৯ সমুদ্র মাইল। গোটা সমুদ্রযাত্রায় আমাদের যাত্রাপথের গড় নিয়ে দেখা যাচ্ছে প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় ৪২ ১/২ সমুদ্র মাইল অতিক্রম করেছি। শেষ মুহূর্তে আমাদের ঝুলিয়ে দেবে, বাণিজ্যবায়ু এতটা নিষ্ঠুর হতে পারেনি। যথারিতী তিনি হাজির হয়ে আমাদের জীর্ণ ভেলাটাকে ঠেলে নিয়ে চললেন, পৃথিবীর অন্য এক অজানা এবং নতুন অঞ্চলের দিকে।
ক্রমশ প্রতিদিনই সামুদ্রিক পাখিদের বড়ো বড়ো ঝাঁক উড়ে আসতে লাগল আর উদ্দেশ্যহীনভাবে আমাদের মাথার ওপরে নানানদিকে চক্কর কাটতে লাগল। একদিন সন্ধ্যায় যখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে, দেখি পাখিগুলো মারাত্মক কোনো ঝটকা খেয়েছে। ওরা পশ্চিমের দিকে তড়িঘড়ি উড়ে যাচ্ছিল, আমাদের দিকে কিংবা উড়ুক্কু মাছের দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না। মাস্তুলের ওপর থেকে ওদের দেখেছিলাম, ওরা উড়ে আসছে, আর প্রত্যেকেই এক সরলরেখা বরাবর উড়ে আসছে। সম্ভবত ওরা কিছু দেখতে পেয়েছিল যা আমাদের নজরে আসেনি। সহজাত প্রবৃত্তি থেকেই ওরা এটা করছিল। যেকোনো কারনেই হোক ওরা একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ীই উড়ছিল, কাছাকাছি দ্বীপে সোজা নিজেদের বাসার দিকে, ওদের প্রজননভূমিতে।
আমরা হাল ঘোরালাম আর যেদিকে পাখিগুলো উড়ে গেল সেদিকে লক্ষ্যস্থির করলাম। এমনকী অন্ধকার হয়ে যাবার পরেও আমরা আমাদের মাথার ওপরে তারাভরা আকাশে দলছুট পাখিদের ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম। এখন আমরা যেদিকে যাচ্ছি ওরাও সেদিকেই। রাতটা চমৎকার, কনটিকির গোটা যাত্রাকালে তৃতীয়বার এমন সুন্দর নিটোল প্রায় গোলাকার চাঁদ উঠেছে।
পরদিন আরো অনেক অনেক পাখি আমাদের মাথার ওপরে, কিন্তু সন্ধেয় আবার আমাদের পথ দেখানোর জন্য আমরা ওদের অপেক্ষা আর করিনি। এসময় দিগন্তরেখার ঠিক ওপরে একটা অদ্ভুত থম মেরে থাকা মেঘ দেখতে পেলাম। অন্য মেঘগুলো, ছেঁড়া ছেঁড়া, পেঁজা তুলোর মতো ছড়ানো, বাণিজ্য বায়ুতে ভর করে দক্ষিণ দিক থেকে বয়ে আকাশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ঘুরে পশ্চিমদিগন্তে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল। ফাটু হিভাতে থাকার সময়েই বাণিজ্যবায়ু নির্ভর এই ভাসমান মেঘের কথা আমার জানা ছিল, আর এখন কনটিকিতে তাদের আমরা দিনরাত আমাদের মাথার ওপর দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু দক্ষিণ-পশ্চিম দিগন্তে ওই একলা মেঘের কোনো নড়নচড়ন নেই। একঠায় রয়েছে স্থির ধোঁয়ার কুন্ডলীর মতো আর এদিকে বাণিজ্যবায়ুবাহিত মেঘ ভেসে ভেসে চলেছে। পলিনেশীয় লোকেরা জানত এমন মেঘের নীচেই ডাঙা থাকে। কারণ সূর্যের তাপে ডাঙার বালি খুব গরম হয়ে গেলে, লাগোয়া বাতাসও গরম হয়ে উপরে উঠে যায় আর ওপরের ঠান্ডা বাতাসের সংস্পর্শে এসে জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়ে মেঘে রূপান্তরিত হয়।
ভেলা ঘুরিয়ে দিলাম, সন্ধে অবধি যতক্ষণ দেখা গেল ততক্ষণ ওই মেঘটার দিকেই চললাম। অনুকূল একটানা বাতাসে, হালটা শক্ত করে বাঁধা থাকায় কনটিকি তরতর করে নিজের অভিমুখে এগিয়ে যাচ্ছিল। হালের লোকটার এখন কাজ হল মাস্তুলের পাটাতনে বসে, ডাঙা দেখা যাচ্ছে কিনা সেদিকে নজর রাখা।
সেদিন সারারাত মাথার ওপরে পাখিদের চিৎকারে কান ঝালাপালা হবার জোগাড়। আকাশে প্রায় পরিপূর্ণ গোলাকার পূর্ণিমার চাঁদ।
ক্রমশ