কন-টিকি অভিযান-আগের পর্বগুলো
আগের কথা
হোটেলে ভাড়া বাকি পড়েছিল। টাকা পয়সা আসা শেষ অবধি বন্ধ হতে থর হেয়ারডেল তল্পিতল্পা গুটিয়ে জাহাজিদের ডেরায় এসে উঠলেন সস্তায় থাকা যাবে বলে। সেখানে প্রতিদিন তার মোলাকাত হত পোড়খাওয়া নাবিকদের সঙ্গে। সমুদ্রের হাল হকিকৎ সম্বন্ধে অনেক কথা জানলেন তাদের কাছে, নৌবিদ্যার খুঁটিনাটি। কিন্তু ভেলায় ভাসা, নাহ, সকলেই ব্যাপারটাকে ততটা ভরসাযোগ্য মনে করল না।
সপ্তাহান্তে বন্ধু উইলহেল্ম এর বাড়ি অসিনিং যাবার সময় এক সপ্তাহে বগলে একখানা প্রশান্ত মহাসাগরীয় মানচিত্র নিয়ে হাজির হলেন। অনেক টালবাহানার পর, ম্যাপে গতিপথ নির্দিষ্ট হল, সময় গণনা করে দেখা গেল সাতানব্বই দিন, পেরুর তট থেকে থেকে টুয়ামাটু। এক্সপ্লোরারস ক্লাবেও ইতিমধ্যে অভিযানের জন্য নতুন সামগ্রী প্রদর্শন হচ্ছিল। সেখানকার সদস্য হবার সুবাদে থর এক অদ্ভুত প্রস্তাব পেলেন। প্রদর্শিত জিনিসের যেকোনো একটি পরবর্তী অভিযানে নিয়ে যেতে পারবেন।
(৫)
তো তাই হল। আমি ক্লাব ছাড়লাম সবার শেষে। তার আগে সমস্ত নতুন জিনিসগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখে নিতে হল কেন না আমার ওপরেই আচমকা ভার পড়ল এগুলো বিলি-বন্দোবস্তের। আমিও এটাই চাইছিলাম। এমনকিছু চাইছিলাম যা দিয়ে আপৎকালে, যদি সত্যিই ঘটে তেমন কিছু, আমরা আমাদের জীবন বাঁচাতে পারি। ধরা যাক আমাদের কাঠের ভেলা ভেঙে পড়বার উপক্রম হল আর কাছাকাছি অন্য আরেকটা ভেলা নেই!
পরদিন জাহাজির বাড়িতে প্রাতরাশের সময় টেবিলে বসেও আমার মাথায় ওই যন্ত্রপাতিগুলোই ঘুরঘুর করছিল। এসময় সুবেশ একজন লোক, বেশ খেলোয়ারের মতো চেহারা, খাবার প্লেট নিয়ে আমার টেবিলেই এসে বসল। আমরা অল্পস্বল্প কথা বলছিলাম, দেখা গেল সেও আমার মতোই সমুদ্রে যাওয়া লোক নয়, বরং ট্রন্ডহেম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে এখন আমেরিকাতে যন্ত্রপাতি কেনাকাটা, ঘাঁটাঘাঁটি করছে যাতে রেফ্রিজারেটারে ঠান্ডা করার যাবতীয় কলাকৌশলগুলো তার আয়ত্বে আসে। বেশি দূরে থাকেও না, আর ভালো নরওয়ের খাবার পাওয়া যায় বলে এখানে প্রায়শই খেতে আসে।
সে এবারে আমার ব্যাপারে জানতে চাইল। আমিও আমার পরিকল্পনার কথা ছোট্ট করে তাকে বললাম। আমি বললাম একসপ্তাহের মধ্যে আমার তত্ত্বের তেমন তেমন জবাব না পেলে আমি ভেলা-অভিযানের কাজ শুরু করে দেব। আমার নতুন সাথীটি কিছু বলল না, কিন্তু দারুণ আগ্রহভরে শুনল আমার কথাটা।
চারদিন বাদে ওই খাবার হলঘরেই ফের আমাদের দেখা হল।
“ঠিক করলে কিছু? অভিযানে যাচ্ছ না যাচ্ছ না?” আমায় জিজ্ঞাসা করল সে।
“হ্যাঁ, যাচ্ছি।” আমি উত্তর দিলাম।
“কখন?”
“যত তাড়াতাড়ি পারি। বেশিদিন এখানে পড়ে থেকে সময় নষ্ট করলে আন্টার্কটিকার দিক থেকে প্রবল বাতাস, “গেইল” চলে আসবে আর তখন দ্বীপগুলোতেও সামুদ্রিক ঝঞ্ঝা শুরু হয়ে যাবে। শিগগিরই আমায় পেরু থেকে রওনা হতে হবে, কিন্তু আগে টাকার জোগাড় করে গোটা ব্যাপারটাকে গুছিয়ে নেওয়াও দরকার।”
“কজন হবে?”
“সব মিলিয়ে মোট ছজনার মতো ভেবেছি। ছজন মানে একটা চমৎকার দল আর চব্বিশ ঘন্টায় পালা করে চার ঘন্টা হাল ধরে বসার জন্য এক্কেবারে সঠিক সংখ্যা।”
এক দু মিনিট কী যেন ভাবল লোকটা, বেশ মনোযোগ দিয়েই ভাবল। তারপর দুম করেই বলে বসল, “শয়তানের দোহাই! আমাকে ভিড়িয়ে নাও, আমি তোমার কাজে আসব। যাবতীয় কারিগরি মাপজোক, পরীক্ষা নিরীক্ষা, তোমার তত্ত্বের খাতিরে, বাতাসের, ঢেউয়ের, সামুদ্রিক স্রোতে্র যথাযথ নিঁখুত মাপ চাই কিনা! মনে রেখো তোমার যাত্রাপথ কিন্তু বিশাল সমুদ্রের এমন জায়গা দিয়ে যে পথে কোনো জাহাজ চলাচল করে না। তোমার অভিযানে জল ও আবহাওয়া বিষয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধান চালাতে পারো। আমি আমার তাপগতিবিদ্যার যাবতীয় জ্ঞান কাজে লাগাতে পারব।”
লোকটা সম্বন্ধে কিছুই জানিনা। মুখ দেখে যেটুকু বোঝা যায়! ধরা যাক যা হল ভালোই হল।
“বেশ ঠিক আছে। একসাথেই যাব আমরা।”
ওর নাম হারম্যান ওয়াটজিঙ্গার। সমুদ্র বিষয়ে আমার মতোই অজ্ঞ।
এর কিছুদিন বাদে আমার অতিথি হিসেবে আমি হারম্যানকে আমাদের অভিযাত্রী সংঘে নিয়ে গেলাম। সোজা মেরু অভিযাত্রী পিটার ফ্রাউসেন-এর কাছে। ফ্রাউসেন চট করে ভিড়ে মিশে যাবার মতো লোক নয়। পেল্লায় বপু, তেমনি দাড়িগোঁফ, লোকটাকে দেখলে মনে হয় উত্তর শীতের দেশের দূত যেন। তার চারপাশে সবসময় আলাদারকম পরিবেশ – যেন তখুনি একটা গ্রিজলি ভালুকের পেছনে চলেছেন।
আমরা তাকে দেয়ালে ঝোলানো বড়ো ম্যাপের কাছে নিয়ে এসে আমাদের ইন্ডিয়ানদের ভেলায় চেপে প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দেবার পরিকল্পনাটা খুলে বললাম। শুনে তার খুদে নীল চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। মেঝেতে কাঠের পা ঠুকে বেল্টটা আরো কয়েকঘর এঁটে চেঁচিয়ে উঠলেন, “ওহোহো, ছেলেরা, আমিও যাব তোমাদের সঙ্গে!”
বয়স্ক গ্রিনল্যান্ড অভিযাত্রী লোকটি আমাদের নিয়ে পড়লেন। বললেন এই প্রাচীন লোকেদের নৌবিদ্যার ওপর তার গভীর আস্থা। প্রাচীন লোকেরা অবলীলায় প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে সহজেই তাদের পথ করে নিতে পারতেন, কি জলে কি ডাঙায়! তিনি নিজে সাইবেরিয়ার বিশাল নদীতে ভেলায় চেপেছেন। উত্তর মহাসাগরের তীর বরাবর আদিবাসীদের ভেলা তার জাহাজের পেছনে বেঁধে ঘুরে বেরিয়েছেন। দাড়ি চুমরোতে চুমরোতে ভদ্রলোক বলেই ফেললেন, “একটা দারুণ সময় কাটাতে যাচ্ছি আমরা!”
ফ্রাউসেনের আগ্রহ ও সমর্থনে আমাদের পরিকল্পনাটা এবারে তীব্র মোড় নিল , স্ক্যান্ডিনেভিয়ান প্রেস অবধি গড়াল ব্যাপারটা। ফলাও করে ছাপা হল।
পরদিন সক্কালেই আমার দোতলার ছোটো ঘরের দরজায় দুমদাম ধাক্কা। কী ব্যাপার? না নীচে আমার টেলিফোন এসেছে। কথাবার্তার ফল দাঁড়াল এই যে হারম্যান এবং আমাকে সেই সন্ধ্যাতেই শহরের কেতাদূরস্ত এলাকার এক ফ্ল্যাটে গিয়ে ডোরবেল বাজাতে হল। দরজা খুলে আমাদের আপ্যায়ন করলেন এক তরুণ, পায়ে দামি চামড়ার চটি, পরনে নীল শার্ট এর ওপরে সিল্কের ড্রেসিং গাউন। ভদ্রলোকের উপস্থিতিটাই যথেষ্ট পেলব; একটা সুগন্ধি রুমাল নাকে চেপে ধরা, ঠান্ডা লেগেছে বলে মার্জনা চাইলেন। আমরা জেনে গেছিলাম ভদ্রলোক ইতিমধ্যেই আমেরিকাতে বেশ নাম টাম করেছেন যুদ্ধে বৈমানিক হিসেবে সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে। উনি ছাড়া ঘরে আরো দুজন অত্যুৎসাহী ও চনমনে সাংবাদিক ছিলেন, যাদের একজনকে আমরা আগে থেকেই বেশ এলেমদার দক্ষ লোক হিসেবেই চিনতাম।
গৃহকর্তা খাতির টাতির করে বসিয়ে বললেন যে উনি আমাদের অভিযানে সবিশেষ উৎসাহী। উনি প্রস্তাব দিলেন অভিযানের প্রয়োজনীয় টাকা জোগাড়ের দায়িত্ব নেবেন। বিনিময়ে আমাদের খবরের কাগজে নিবন্ধ লিখতে হবে আর ফেরত আসার পর বক্তৃতা দিতে হবে বেশ কিছু জায়গায়। বিস্তারিত আলোচনার পর, আমরা সহমত হলাম আর অভিযানের সাহায্যকারী আর অংশগ্রহনকারীদের পারস্পরিক সহায়তার বিষয়ে সাফল্য কামনা করলাম। এখন থেকে টাকা পয়সার আর ভাবনা রইল না। এটা আমাদের সমর্থকেরা ভাববে, আমাদের মাথা ঘামাতে হবে না। হারম্যান আর আমি তক্ষুণি লেগে পড়লাম লোক আর যন্ত্রপাতি সংগ্রহে, ভেলা বানাতে, আর শেষাবধি ঝড়-ঝঞ্ঝার মরসুম শুরু হবার আগেই ভেসে পড়তে।
পরদিনই হারম্যান ইস্তফা দিল চাকরিতে আর আমরা আমাদের কাজে আদাজল খেয়ে লেগে পড়লাম। ইতিমধ্যেই বিমানবাহিনীর গবেষনাগার থেকে অধিকর্তার সম্মতি পেয়েছিলাম, যে আমাদের যা যা দরকার হবে পাবো, অভিযাত্রী ক্লাবের মাধ্যমেও আরো কিছু জিনিস প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়েছিল। তারাও জানিয়েছিল এরকম অভিযানই তাদের যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করবার আদর্শ হতে পারে। শুরুটা জমে গেছিল। এখন আমাদের মূল কাজটা হল উপযুক্ত চারটে লোক খুঁজে বের করা যারা আমাদের সাথে যেতে রাজি হবে। পাশাপাশি চলবে অভিযানের রসদ সংগ্রহ।
যে মানুষগুলো একসাথে ভেলায় ভেসে যাবে তাদের বেছে নিতে হবে খুব সাবধানে। নয়ত একমাস পর সমস্যা দেখা দেবে, আর মাঝসমুদ্রে একঘেয়েমির চোটে বিদ্রোহ করে বসবে। আমি নাবিকদের সঙ্গে নিতে একেবারেই চাইনি। ওরা ভেলা চালানোর ব্যাপারে আমাদের মতোই প্রায়, আর প্রকৃতপক্ষে আমি এটাও চাইনি যে পরে লোকে বলুক যে আমাদের সাফল্য এসেছে কেন না আমরা পেরুর প্রাচীন ভেলা-বানিয়েদের থেকে বেশি দক্ষ নাবিক ছিলাম। এছাড়াও আমরা এমন একজন কাউকে চাইছিলাম যে ভেলাতে বসে সেক্সট্যান্ট ব্যবহার করে আমাদের অবস্থান মানচিত্রে নির্দেশ করতে পারবে যাতে তার ওপর নির্ভর করে আমাদের অভিযানের বিজ্ঞানভিত্তিক বিবরণ দেওয়া যায়।
“আমি একজন শিল্পীকে জানি, ছবি আঁকে, ভালো লোক”, হারম্যানকে বললাম। “বিশাল চেহারা, আমুদে আর গিটারটা বাজায় বেশ। ইস্কুলে নৌচালনাবিদ্যা শিখে সারা পৃথিবী বেশ কয়েকবার ঘুরেছে ব্যাটা। শেষমেষ থিতু হয়েছে রঙ তুলি নিয়ে। ছোটবেলা থেকে চিনি ওকে। দেশে, পাহাড়ে একসাথে কতবার ক্যাম্পিং করেছি। দাঁড়াও ওকে লিখছি আমি। আমি নিশ্চিত ও যাবে।”
“বেশ ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের আরো একজন চাই, যে বেতার সংকেতে যোগাযোগ করতে জানে।”
“বেতার? রেডিও? আমি চেঁচিয়ে উঠি। কেন সেটা দিয়ে কী হবে আমাদের? প্রাগৈতিহাসিক ভেলায় ওটার কোনো জায়গাই নেই।”
“মোটেও না। এটা স্রেফ একটা আপৎকালীন ব্যবস্থা। তোমার তত্ত্বের ওপর এর কোনোই প্রভাব পড়বে না যতক্ষণ না এসওএস পাঠিয়ে সাহায্য চাইছি। আর হ্যাঁ, আমাদের আবহাওয়া সংক্রান্ত বা অন্যান্য প্রতিবেদন পাঠানোর কাজেও লাগবে সেটা। কিন্তু “গেইল” এর ব্যাপারে কোনো আগাম খবর মিলবে না, কেননা ওদিককার সমুদ্রের কোনো খবর কারো কাছে নেই, আর যদি থাকেও, ভেলায় তা কোন কাজে আসবে আমাদের?”
ওর যুক্তির কাছে ক্রমে আমি নিস্তেজ হয়ে পড়ি, আসলে এসব চাবি টেপা, নব ঘোরানো ব্যাপারগুলোই আমার না-পসন্দ।
“মজার ব্যাপার হল”, আমি স্বীকার করি, “ছোটো বেতারযন্ত্রে অনেক দূর দূরের সঙ্গে নির্ভুল যোগাযোগের ব্যাপারে সবচেয়ে দক্ষ লোকটি আমিই। যুদ্ধে আমায় বেতার বিভাগে রাখা হয়েছিল। সঠিক লোককে সঠিক জায়গাতে, বুঝলে কিনা! কিন্তু আমি ন্যুট হল্যান্ড আর টরস্টাইন র্যাবিকে চিঠি লিখব।”
“চেনো ওদের?”
“হ্যাঁ। ১৯৪৪ সালে ন্যুটের সাথে প্রথমবার ইংল্যান্ডে দেখা হয়। ইংরেজরা ন্যুটকে তার সম্মান জানিয়েছিল প্যারাশ্যুট অভিযানে থাকার জন্য। যে অভিযান জার্মানদের পরমাণু বোমার পরিকল্পনাটা ভেস্তে দেয়। জানো তো ও ছিল বেতারচালক, জুকানের ভারী জলের ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিল ব্যাটা। যখন ওর সাথে দেখা হয় ও নরওয়ে থেকে অন্য একটা কাজ সেরে এসেছে। অসলোর এক প্রসূতিসদনের চিমনির ভেতরে গেস্টাপোরা ওকে গোপন বেতারযন্ত্র সহ ধরে ফেলে প্রায়। নাৎসিরা খোঁজ পেয়ে গেছিল ওর। জার্মান সেনারা সারা বাড়ি ঘিরে ফেলেছিল। সবকটা দরজার সামনে মেশিনগান নিয়ে মোতায়েন ছিল সেনা। ফেমার বলে গেস্টাপোদের এক কর্তা, সামনেটায় দাঁড়িয়েছিল নিজে, ন্যুটকে নামিয়ে আনার অপেক্ষায়। উলটে ওর সেনাদেরই নামিয়ে আনতে হল। পিস্তল দিয়েই ন্যুট লড়াই চালিয়ে ছাত থেকে নীচের গুদামঘরে আসে তারপর পেছনের উঠোনে নেমে হাসপাতালের দেওয়ালের ওপারে স্রেফ হাওয়া হয়ে যায়। পেছনে জার্মানদের অঝোর গুলিবৃষ্টি সত্ত্বেও।
“ওর সঙ্গে আমার দেখা হয় ইংরেজদের এক পুরোনো দুর্গে, গোপন জায়গায়। সে তখন এসেছিল অধিকৃত নরওয়ের একশখানা বেতার কেন্দ্রের সাথে গোপন যোগাযোগ গড়ে তোলার জন্য।
“আমি তখন সবে আমার প্যারাশ্যুট-এ কীভাবে লাফ দেয় সেই শিক্ষা শেষ করেছি, আমাদের পরিকল্পনাটা ছিল অসলোর কাছে নর্ডমার্কে ঝাঁপ দিয়ে নামা। কিন্তু ঠিক সেসময় রাশিয়ানরা খিরকিনেস অঞ্চলে ঢুকে এল আর একটা ছোটো নরওয়ের সৈন্যদলকে স্কটল্যান্ড থেকে ফিনমার্কে পাঠানো হল যুদ্ধের কার্যভার বুঝে নেওয়ার জন্য। প্রকৃতপক্ষে তারা রাশিয়ানদের হাত থেকে গোটা ব্যাপারটাই বুঝে নিল। আমাকেও ওখানে পাঠানো হল। আর ওখানেই টরস্টাইনের সাথে আলাপ।
“তখন উত্তরের হাড়কাঁপানো ঠান্ডা। উত্তর আকাশের আলো তারাভরা আকাশে ঝলক দিয়ে উঠছে মাঝে মাঝে। মাথার ওপর অন্ধকার আকাশ, সারা দিন সারা রাত। পোড়া ফিনল্যান্ডের ছাইয়ের স্তূপের কাছে এসে পৌঁছোলাম। ঠান্ডায় নীল, গায়ে ফারের পোশাক, একটা হাসিখুশি ছেলে পাহাড়ের ছোটো কুঁড়েঘর থেকে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে বেরোল। তার নীল চোখ, এলোমেলো চুল। ওইই টরস্টাইন র্যাবি।ও প্রথমে ইংল্যান্ডে পালিয়েছিল। ওখানে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে ট্রুমসার কাছাকাছি অঞ্চল দিয়ে আবার চোরাপথে নরওয়েতে ঢোকে। তিরপিজ নামে একটা যুদ্ধ জাহাজের কাছে লুকোনো ডেরা থেকে বেতারে ইংল্যান্ডে খবর পাঠাতো দীর্ঘ দশমাস, জাহাজে কী ঘটছে না ঘটছে, প্রতিদিন। এক জার্মান অফিসারের লাগানো এরিয়ালের সাথে নিজের গোপন বেতার যন্ত্রটা যুক্ত করে রোজ রাতে ও খবর পাঠাত। ওর প্রতিদিনকার খবরের ভিত্তিতেই ব্রিটিশ বোমারুরা “তিরপিজ”কে উড়িয়ে দিতে পেরেছিল।
“টরস্টাইন এরপর সুইডেনে পালায়, সেখান থেকে আবার ইংল্যান্ডে। সেখান থেকে একটা নয়া বেতারযন্ত্র নিয়ে প্যারাশুটে করে জার্মান বাহিনীর পেছনদিকে ফিনল্যান্ডের জঙ্গলে এসে নামে। জার্মানরা পিছু হটলে ও যখন দেখল যে ও আমাদের দলের আওতায় এসে গেছে তখন গোপন ডেরা থেকে বেরিয়ে আমাদের ওর ছোটো বেতারযন্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিল। আমাদের মূল বেতারকেন্দ্র আগেই মাইন বিস্ফোরণে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
“আমি নিশ্চিত বাড়িতে থেকে থেকে এদ্দিনে ন্যুট আর টরস্টাইন হেজে গেছে; আমাদের কাঠের ভেলায় যেতে ওরা খুশি মনে রাজি হয়ে যাবে।”
“ওদের লিখে দাও।” হারম্যান বলে।
আমি বেশি না বকে ছোটো চিঠি লিখলাম, এরিক, ন্যুট আর টরস্টাইনকে।
“একটা কাঠের ভেলায় চেপে প্রশান্তমহাসাগর পাড়ি দিতে যাচ্ছি এটা প্রমাণ করতে যে দক্ষিণ সাগরের দ্বীপের মানুষেরা প্রকৃত প্রস্তাবে পেরু থেকেই ভেসে এসেছিলেন। তুমি যাবে? তোমায় পেরু থেকে দক্ষিণ সাগরের দ্বীপ অবধি বিনিপয়সায় যাওয়া আসা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারব না। কিন্তু তোমার দক্ষতার যাচাই করে নিতে পারো এই অভিযানে। তাড়াতাড়ি জানাও।”
পরদিনই টরস্টাইনের টেলিগ্রাম হাজির।
“যাচ্ছি – টরস্টাইন।”
বাকি দুজনও হ্যাঁ বলল।
ছ নম্বর লোকটাকে নিয়ে ভাবছি, একবার একে আরেকবার ওকে। কিন্তু প্রত্যেকবারই একটা না একটা বাধা সামনে চলে আসছে। এর মধ্যে আমাদের রসদের ব্যাপারটাও আছে, আমি আর হারম্যান সেটা নিয়েও পড়লাম। আমরা লামার শুকনো মাংস বা মিষ্টি আলু খেয়ে কাটানোর কথা মোটেই ভাবছিলাম না। আমরা একসময় ইন্ডিয়ান ছিলাম, এটা তো আর প্রমাণ করতে চাইছিলাম না! আমাদের উদ্দেশ্য ছিল ইনকাদের বানানো ভেলাটাকে পরখ করে দেখা, তার কার্যকারীতা আর গুণাগুণ, সমুদ্রে সেটা কতটা টেঁকে, কতটা ভারবহন করতে পারে আর সত্যি সত্যিই মানুষজন জীবিত অবস্থায় এতে চড়ে সাগরপাড়ি দিয়ে পলিনেশিয়ায় পৌঁছতে পারে কিনা! আমাদের আদিবাসী পূর্বঅভিযাত্রীরা শুকনো মাংস, মাছ আর মিষ্টি আলু খেয়ে জীবনধারণ করতে পেরেছিল, কেননা ওদের মূল খাবারই ছিল তাই। আমরাও আমাদের সমুদ্র অভিযানে দেখার চেষ্টা করব ওরা সমুদ্রের টাটকা মাছ ধরে, বৃষ্টির জল ধরে ওদের অতিরিক্ত রসদ জোগাড় করেছিল কিনা! আমাদের খাবারের ব্যাপারে আমি সাধারণ সৈনিকদের খাবারের রেশন এর কথা ভেবেছিলাম, যুদ্ধের সময় থেকেই যা আমাদের অতি পরিচিত।
ঠিক এই সময়ে ওয়াশিংটনে নরওয়ের সেনাবাহিনীর রাষ্ট্রদূত অফিসে একজন নতুন সহকারী এলেন। আমি ওঁর অধীনে ফিনমার্কে সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে কাজ করেছি। ওঁকে জানতাম খুব ভালো করে, উনি ছিলেন একটা “আগুনের গোলা”, যে সমস্যাই দেওয়া হোক না কেন দানবীয় ক্ষমতায় তা সমাধান করতে তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। বিয়র্ন রোরহলট ছিলেন এমন মানুষ যিনি একের পর এক সমস্যা মেটাতেই অভ্যস্ত এবং তাতেই স্বস্তি পেয়ে থাকেন নইলেই কেমন একটা খেই হারান।
আমি আমাদের সমস্যাটা ওঁকে বিস্তারে লিখে জানালাম, আর সেইসঙ্গে ওঁকে ওঁর নিজস্ব কায়দায় মার্কিন সেনার সরবরাহ বিভাগের একটা উপযুক্ত লোক খুঁজে দিতে বললাম। সুযোগটা নিতে চাইছিলাম কেননা সেসময় নতুন ফিল্ড-রেশন নিয়ে গবেষণা চলছিল, সেটা একইরকমভাবে আমরা পরীক্ষা করে দেখতে পারি, যেমন বায়ুসেনার গবেষণাগারের যন্ত্রপাতিরও পরীক্ষা করব মনস্থ করেছিলাম।
দুদিন বাদে বিয়র্ন ওয়াশিংটন থেকে ফোন করল। ও আমেরিকার সামরিক দপ্তরের বিদেশ-মৈত্রী বিভাগে যোগাযোগ করেছিল, তারা ব্যাপারটা বিশদে জানতে চায়।
হারম্যান আর আমি ওয়াশিংটন যাব বলে প্রথম ট্রেনেই চেপে বসলাম।
ক্রমশ