কন-টিকি অভিযান-আগের পর্বগুলো
থর হেয়ারডাল। (অনুবাদঃ ইন্দ্রনাথ)
(৮)
আগের কথা
অবশেষে দক্ষিণ আমেরিকা। গরমে নাজেহাল অভিযাত্রীরা ইকুয়েডরে এসেই শুনল বালসা গাছ একমাত্র পাওয়া যায় দেশের মাঝামাঝি, জঙ্গলে, কিন্তু বর্ষা এসে যাওয়ায় সেখানে পৌঁছনো কার্যত অসম্ভব। বালসা গাছের সবচেয়ে বড়ো ব্যবসায়ি গুস্তাভও পারল না হদিশ দিতে। তার কথায় জানা গেল একমাত্র কুইভেদোয় গেলে গুস্তাভের ভাই কোনো সুরাহা করলেও করতে পারে, কিন্তু বর্ষা ঠেলে জঙ্গলের মাঝে যাবে কে? রাস্তা নেই যে! অভিযাত্রীরা ঠিক করল রাজধানী কুইটো থেকে পাহাড় বেয়ে উলটো দিক থেকে এলে কেমন হয়। যেমন ভাবা, তেমন কাজ; মালবাহী প্লেনে কুইটো। সে প্লেনের পাইলট জর্জ শোনায় মুন্ডু শিকারীদের কথা, যারা জঙ্গলেই থাকে আর জ্যান্ত মানুষের মিনিয়েচার মুন্ডু বানিয়ে বিক্রি করে। কিন্তু জঙ্গলে যাবার উপায় যখন প্রায় নিভে এসেছে, ঠিক তখনই আচমকা সুযোগ জুটে গেল। আমেরিকান দুতাবাসের ভারপ্রাপ্ত সামরিক লোকটিকে বুঝিয়ে বলতেই মুশকিল আসান। জিপ আর ড্রাইভার দুইই জোগাড় হল। আর পায় কে! আন্দিজের পাহাড়ি পথে বেরিয়ে পড়ল অভিযাত্রীরা, প্রাচীন পাহাড়ি ইন্ডিয়ানদের দেশে।
দক্ষিণ আমেরিকায়
পাহাড়ি উঁচুনিচু রোদ্দুরে পথ ধরে কখোনো গাছপালা, মায় আগাছাহীন ঢালে উঠে, কখনো নীচের উপত্যকার বালি ক্যাকটাসের এলাকা পেরিয়ে শেষ অবধি পাহাড়ের মাথায় পৌঁছলাম। চূড়ার চারপাশে বরফের চাদর, আর এমন তীব্র ঠান্ডা হাওয়া বইছে যে জমে যাবার ভয়ে আমরা গাড়ির গতি কমাতে বাধ্যই হলাম; গায়ে খালি শার্ট, কেবল ভাবছি কখন জঙ্গলের গরমে পৌঁছব! পাহাড়ের ঝুরো ঢাল, ঘাসের ধার ধরে বিস্তীর্ণ এলাকা পার হয়েই চলেছি একটুখানি ঠিকঠাক গাড়ি চলার মত রাস্তা পাবার আশায়।
শেষমেশ পাহাড়ের একেবারে পশ্চিম দিকের ঢালে এসে পৌঁছলাম; এখানে আন্দিজ পর্বত স্রেফ খাড়া নেমে গেছে নীচের দিকে, খচ্চর চলার পথটাও খাদের কাছে এসে হারিয়ে গেছে খাড়া খাদের ধারে, ঢালের আলগা পাথরের রাজত্বে; চারপাশে উঁচু পাহাড়ের চূড়া আর পাশে গভীর খাদ, এই হল অবস্থা। এবারে পুরোপুরি ভরসা, আমাদের বন্ধু আগুর্তোর ওপর; সে স্টিয়ারিং –এ চেপে বসল একরকম, খাদের কিনারে এলেই ঠিক ঘুরিয়ে নিচ্ছিল গাড়িটা। হঠাৎই দমকা ঝোড়ো হাওয়া, আন্দিজ পর্বতমালার একেবারে বাইরের দিকে চলে এসেছি, এখানে পাহাড়ের ধার খাড়া নীচের জঙ্গলে গিয়ে মিশেছে এক অতলান্ত খাদের ওপাশে, প্রায় ১২০০০ ফুট তলায়। কিন্তু নীচের আদিগন্ত জঙ্গলের সবুজ নজরে এল না, কেননা ধারের কাছাকাছি পৌঁছতেই তলা থেকে হুড়মুড় করে ঘন মেঘ উঠে চারদিক ঢেকে ফেলল, যেন ডাইনির চিমনির ধোঁয়া! এবারে রাস্তা সিধে নীচে। ঢাল ধরে, পাহাড়ের ধার বরাবর, খাদের ধার ঘেঁষে, সোজা নীচে পাকে পাকে রাস্তা। বাতাসে আর্দ্রতা ক্রমশ বাড়ছে, তাপমাত্রা বাড়ছে, আর নীচের বনভূমি থেকে ভারী দমচাপা গরম হাওয়া উঠে আসছে।
আর এর মধ্যেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। প্রথমে ঝিরঝির তারপরে মুষলধারে, যেন জিপের ওপরে কেউ ড্রাম পিটছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই চারপাশ দিয়ে কাদাগোলা জল বইতে লাগল পাথরের গা বেয়ে। আমরাও খানিকটা বয়েই এলাম বলা চলে, পেছনের শুকনো পাথুরে মালভূমি থেকে নীচের নরম মস আর ঘাসে ঢাকা পাথুরে, কাদামাটি এবং জঙ্গলের পথে। যত নীচে নামছি পাতার আকার বড়ো হচ্ছে ক্রমশ আর অচিরেই সেগুলো পাহাড়ের গায়ে বৃষ্টিভেজা বিশাল বিশাল সবুজ ছাতার মতো হয়ে উঠল। তারপর এল জঙ্গলের শুরুর দিকের গাছগুলো, তত বড়ো নয়, গায়ে মসের আস্তরণ, গা বেয়ে লতানে গাছ। ছপাছপ, গুড়গুড় করে জলের আওয়াজ হয়েই চলেছে চতুর্দিকে। রাস্তার ঢালটা এবারে একটু কমে আসতেই অরণ্য তার রূপ বদলে ফেলল ঝপ করে, বিশাল বিশাল গাছেদের পল্টন, ঘন জঙ্গলের জলজমা কাদামাটির রাস্তায় জল ছিটিয়ে চলা ছোট্টো জিপটাকে যেন গিলে নিল। এবারে আমরা পুরো জঙ্গলের ভেতর। বাতাসে সবুজ গন্ধ, ভারী, উষ্ণ ও ভিজে ভিজে।
পাহাড়ের ধারের ওপর পাম গাছের পাতায় ছাওয়া একসার ঘরের কাছাকাছি পৌঁছলাম যখন ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে গেছে। বৃষ্টিভেজা জিপ ছেড়ে আমরা একটা শুকনো ছাতের তলায় রাতটা কাটালাম; রাতে দলে দলে পোকা কামড়ালো আমাদের, পরদিন বৃষ্টির জলে ভেসেও গেল সেগুলো। জিপ ভর্তি কলা আর নানারকম ফল নিয়ে আমরা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আরো নীচের দিকে চললাম। যদিও আমাদের ধারণা হয়েছিল আমরা পাহাড়ের নীচে অনেক আগেই পৌঁছে গেছি! রাস্তায় কাদা বেড়ে চলল তবু আমাদের থামানো গেল না, আর ডাকাতগুলো যে কতো দূরে রইল, কে জানে!
রাস্তা এসে শেষ হল জঙ্গলের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা এক নদীর কাছে, নদীর জল খুবই ঘোলা আর সেইখানে এসে আমাদের জিপও থামল। ন যযৌ ন তস্থৌ, নদীতীর ধরে না পারছি ওপরে যেতে না পারছি নীচে। কাছেই জঙ্গলের মধ্যে একটুখানি ফাঁকা জায়গায় একটা কুটির, সেখানে দোআঁশলা কয়েকজন ইন্ডিয়ান দেওয়ালে একটা জাগুয়ারের চামড়া শুকোতে দিচ্ছিল; কুকুর আর মুরগিগুলো রোদে শুকোতে দেওয়া কোকো বীজের ওপর দিয়ে মহানন্দে চড়ে বেড়াচ্ছে এধার ওধারে।
আমাদের জিপ এসে থামতেই, বেশ একটা শোরগোল পড়ে গেল। ঐ রেড ইন্ডিয়ানদের মধ্যে যারা স্প্যানিশ জানে তাদের কাছ থেকেই জানা গেল জায়গাটার নাম রিও পালেনক্যু আর নদীর ওপারেই কুইভেদো। পারাপারের কোনো ব্রিজ নেই, আর নদী খুব খরস্রোতা আর গভীর, তবে হ্যাঁ, ওরা ভেলায় করে আমাদের জিপসুদ্ধ পার করে দিতে পারে। বস্তুটা নদীর পাড়েই রাখা ছিল। বাঁশ আর লতা দিয়ে বাঁধা দুহাতের মতো মোটা কাঠের একখানা ভেলা, লম্বা চওড়ায় বড়োজোর আমাদের জিপের দ্বিগুণ। কাঠের পাটাতনের ওপর দিয়ে জিপ চালিয়ে ভেলার ওপর চড়ে পড়ার সময় হৃদপিন্ডটা গলার কাছে এসে ঠেকল আমাদের; ভেলাটা কাদাঘোলা জলে খানিকটা ডুবে গেল বটে কিন্তু জিপ সুদ্ধ আমাদের আর লগি ঠেলার জন্য চারজন তামাটে রঙের রেড ইন্ডিয়ানের ভার নিয়ে দিব্যি ভাসিয়েও রাখল।
“বালসা?” আমি আর হারম্যান একনিশ্বাসে জিজ্ঞাসা করি।
“হ্যাঁ, বালসা।” ওদের একজন ঘাড় নেড়ে কাঠের লগটায় লাথি ঝাড়ে।
স্রোতে পড়ে নদীর জলের ঘূ্র্ণির মধ্যে পড়ে যায় ভেলাটা কিন্তু লোকগুলো লগি দিয়ে ঠিক জায়গায় ঠেলে ঠেলে স্রোতের কোনাকুনি নদী পার করে নদীর অন্য পাড়ে কমস্রোতের জলে এনে ফেলল ভেলাটা। বালসা গাছের সাথে ওইই আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ আর ওইই প্রথম বালসা কাঠের ভেলায় চাপা। নির্বিঘ্নেই ওপারে আসা গেল আর আমরা মহোল্লাসে গাড়ি চেপে কুইভেদোয় ঢুকলাম। দু’সারি আলকাতরা লেপা কাঠের বাড়ি, পাম পাতায় ছাওয়া চালের ওপর নিথর বসে থাকা শকুন, মাঝে একফালি রাস্তা মতো, আর এমনটাই গোটা এলাকাটা। কালো বাদামি, বাচ্চা, বুড়ো, হাতের কাজকম্ম, জিনিসপত্র সব ফেলে রেখে জানলা দিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো। সব্বাই জিপটার কাছে ভিড় করে এলো, ভীতিপ্রদ, অনর্গল বকতে থাকা মানুষের একটা ঢেউ। কেউ কেউ জিপের ওপরে চড়ে বসল, কেউ নীচে সেঁধিয়ে দেখল, কেউবা চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। আমরা প্রাণপনে আমাদের জিনিসপত্র আগলে বসে রইলাম আর আগুর্তো স্টিয়ারিংটা বশে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগল। এর মধ্যে জিপের একটা চাকা পাংচার হয়ে খোঁড়া হয়েই চলল। কুইভেদোয় পৌঁছে এমন আপ্যায়ন আমাদের গেলা ছাড়া কী উপায়!
ডন ফেদেরিকোর প্লান্টেশনটা আরো খানিকটা নদী বরাবর নীচের দিকে। আমাদের জিপটা আগুর্তো, হারম্যান আর আমায় নিয়ে আমগাছের সারির ভেতর দিয়ে একটা রাস্তা ধরে একটা উঠোনে এসে পৌঁছতে, ছিপছিপে জংলি বুড়োটা তার ভাইপো অ্যাঞ্জেলোকে নিয়ে তড়িঘড়ি আমাদের সাথে দেখা করতে এলো; বাচ্চা ছেলেটা ওর সাথেই জঙ্গলে থাকে। ডন গুস্তাভের দেওয়া চিঠিটা দিলাম ওকে আর একটু পরেই আমাদের জিপটা ঐ চত্বরে দাঁড়িয়ে আবার করে বৃষ্টির জলে ভিজতে থাকল। ডন ফেদেরিকোর বাংলোয় তখন উৎসবের মেজাজে খানাপিনা চলছে। শুয়োর আর মুরগীর মাংস ঝলসানো হচ্ছে আগুনে, একটা বড়ো থালায় প্রচুর ফল, সবই গ্রীষ্মপ্রধান দেশের ফল এবং তার চারপাশে গোল হয়ে বসে আমরা বোঝাচ্ছি আমাদের আসার উদ্দেশ্যটা ঠিক কী! বাইরের বৃষ্টির জল জঙ্গলের গাছপালা ভিজিয়ে মাটিতে পড়ে সেখান থেকে ফুলের আর সোঁদা মাটির একটা চমৎকার গন্ধ তুলেছে, বাংলোর জানলা দিয়ে বাতাসে ভেসে আসছে সে গন্ধটা।
ডন ফেদেরিকোর গলা একেবারে বাচ্চা ছেলের মতো খুশিয়াল হয়ে উঠল। কেন? আজ্ঞে হ্যাঁ, ও ছোটোবেলা থেকেই বালসা ভেলার ব্যাপারটা জানে। বছর পঞ্চাশ আগে যখন ও সমুদ্রের পাড়ে থাকত, পেরুর ইন্ডিয়ানরা বড়ো বড়ো বালসা-ভেলায় চেপে গুয়ায়াকুইলে মাছ বিক্রি করতে আসত। ভেলার ওপরে মাঝামাঝি জায়গায় একটা বাঁশের ঘর, সঙ্গে কয়েকটন শুকনো মাছ অথবা তার সাথে বউ বাচ্চা, পোষা কুকুর, মুরগি সব ভেলার ওপরে। ওরা ভেলার জন্যে যেরকম বড়ো বালসা গাছের গুঁড়ি ব্যবহার করত এখন বর্ষায় সেরকম পাওয়া কার্যত অসম্ভব, বন্যার জলকাদায় বনের গভীরে বালসা গাছের প্লান্টেশনের কাছাকাছি যাওয়াও সম্ভব নয়, এমনকী ঘোড়ায় চড়েও! কিন্তু ডন ফেদেরিকো যথাসাধ্য করবে, বাংলোর কাছাকাছি বুনো বালসা গাছ এক দুটো পাওয়া গেলেও যেতে পারে, আর আমাদের তো আর গাদা গাদা দরকার নেই!
সন্ধে আরেকটু গড়ানোর পর বৃষ্টি থামল, আর আমরা এক এক করে বাংলোর পেছনে আমগাছের তলাটা ঘুরে এলাম। সেখানে ডন ফেদেরিকোর আনা সারা পৃথিবীর নানান বন্য অর্কিডের সংগ্রহ রয়েছে, নারকোলের আধখানা মালায় করে গাছের ডাল থেকে ঝোলানো। চাষ করা অর্কিডের তুলনায় বিরল এই গাছগুলো থেকে চমৎকার গন্ধ আসছিল আর হারম্যান নীচু হয়ে একটা গাছে প্রায় নাক ঠেকিয়েছে, আর অমনি ওর মাথার ওপরেই ডালপালার মধ্য থেকে একটা লম্বা, সরু হিলহিলে চকচকে ইলমাছের মতো কী একটা বেরিয়ে এল। বিদ্যুৎগতিতে অ্যানজেলো লাঠি চালালো আর একটা সাপ এঁকেবেঁকে মাটিতে পড়ল। এক সেকেন্ডের মধ্যেই ওটাকে লাঠি দিয়ে মাটিতে চেপে ধরে মুন্ডুটা থেৎলে দেওয়া হল।
“মরণ” বলতে বলতে অ্যাঞ্জেলা বাঁকানো বিষদাঁত দুটো খুলে দেখাল, ঠিক কী বলতে চায়।
তারপর থেকে আমরা তো গাছপালা, লতাপাতার মধ্যে সবতাতেই বিষধর সাপ দেখে ফেলছি, আর এই করতে করতেই বাংলোয় ঢুকে পড়লাম, অ্যাঞ্জেলোর হাতে লাঠির ডগায় সাপটা নিথর হয়ে ঝুলছিল। হারম্যান ওটার ছাল ছাড়াতে বসে গেল আর ডন ফেদেরিকো দারুণ দারুণ বিষাক্ত সাপের গল্প আর ডিনার প্লেটের সাইজের মোটা বোয়া সাপের গল্প বলতে শুরু করল; তক্ষুনি দেখি দেওয়ালে এই এত্তোবড়ো চিংড়ির সাইজের দুটো কাঁকড়া বিছের ছায়া। দুজনে দুজনের দিকে ছুটে এসে মরণপণ লড়াই আরম্ভ করল, সামনের পা দিয়ে একে অন্যেকে আঘাত তো করলই, আর পেছনের লেজের বিষাক্ত বাঁকানো হুল একেবারে তৈরি, মরণকামড় দেবার জন্য। সে এক সাংঘাতিক দৃশ্য, অবশ্য তেলের বাতিটা না সরানো অবধি বুঝিনি, যে ও দুটো সাধারণ বিছে, এক আঙুল মতো, টেবিলের ধারে মারপিট করছিল, দেয়ালে তারই বিশাল ছায়া পড়েছিল।
“ছেড়ে দাও ওদের”, ফেদেরিকো হেসে বলল, “একটা আরেকটাকে মারবে, আর আমি চাই যেটা জিতবে, সেটা থাক, বাড়িটাকে আরশোলা মুক্ত করে রাখবে। খালি শোবার সময় মশারিটা ঠিক করে চারধারে গুঁজে দিও আর জামাকাপড়গুলো পড়ার সময় ভালো করে ঝেড়ে নিও, তাহলেই আর ভয় নেই। আমি অবশ্য অনেকবার বিছের কামড় খেয়েছি, কই, এখনো মরিনি তো!” বলে বুড়োটা হো হো করে হেসে উঠল।
আমি ঘুমোলাম দিব্যিই, কিন্তু মাঝে মধ্যে বালিশের গোড়ায় টিকটিকি বা বাদুরের খচরমচর বা খসখস আওয়াজে ঘুম ভেঙে গিয়ে প্রত্যেকবারই ভাবছিলাম বিষাক্ত কোনোকিছু বোধহয়!
পরদিন ভোর ভোর উঠে বালসা গাছের খোঁজে বেরোলাম।
“জামাকাপড়টা ঝেড়ে নেওয়া ভাল” আগুরতো বলতে বলতেই ওর শার্টের হাতা থেকে একটা বিছে মাটিতে পড়ে তীরের মতো মেঝের ফাটলে সেঁধিয়ে গেল।
ভোর হবার পরপরই ডন ফেদেরিকো ঘোড়ায় করে চারদিকে নিজের লোকদের পাঠালেন বালসা গাছের খোঁজে; যদি যাতায়াতের পথের আশপাশেই পাওয়া যায়! আমাদের দলে আমি ফেদেরিকো আর হারম্যান, খানিকটা খোলা জায়গায় বিশাল পুরোনো একটা গাছের কাছে এসে দাঁড়ালাম, ডন যেটা আগেই জানত। আশপাশের সমস্ত গাছের চেয়ে লম্বা আর গুঁড়িটা তিনফুট। পলিনেশিয় রীতিতে আমরা গাছটার কাছে নতজানু হলাম তারপর স্পর্শ করলাম। আমরা আমেরিকা সঞ্জাত এক পলিনেশিয় দেবতার নামে ওর নাম রাখলাম, “কু”। তারপর কুড়ুল দিয়ে চলল বালসা গাছ কাটা, সারা জঙ্গলে ঐ আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। কিন্তু রসাল বালসা গাছ কাটা আর ভোঁতা কুড়ুল দিয়ে কর্ক কেটে দুখানা করা একই ব্যাপার, কুড়ুল স্রেফ ছিটকে আসছিল গাছের গা থেকে আর আমি তেমন কিছু কুড়ুল চালাবার আগেই হারম্যানকে আমার জায়গা নিতে হল। কুড়ুল ক্রমশ হাত বদল হতে লাগল, এদিক ওদিক চোকলা উড়ল, জঙ্গলে, গরমে ঘাম ঝরল।
দিনের শেষে কু মোরগের মতো এক ঠ্যাঙে দাঁড়িয়ে রইল আর আমাদের কুড়ুলের আঘাতে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল, আর কিছুক্ষণের মধ্যে ভেঙে পড়ল হুড়মুড় করে। চারপাশের জঙ্গলের ছোটো গাছপালা, বড়ো ডালপালা সুদ্ধ এই মহীরুহের সাথে মাটিতে এসে পড়ল। গাছের কান্ড থেকে ডালপালা ছেঁটে ফেলে সবে আমরা ইন্ডিয়ান পদ্ধতিতে খাঁজকাটা করে বাকল ছাড়িয়ে নিচ্ছি, হারম্যান হাতের কুড়ুলটা ফেলে দুহাতে পা টা চেপে ধরে শূন্যে লাফিয়ে উঠল, যেন পলিনেশিয় যুদ্ধের নাচ নাচছে। ওর প্যান্টের একটা পা থেকে বিছের মতো বড়ো চকচকে একটা পিঁপড়ে বেরোলো, সেটার পেছনে আবার লম্বা হুল। চিংড়ির দাঁড়ার মতো নির্ঘাত শক্তপোক্ত একটা খোলাও ছিল ওটার গায়ে, কেননা, পায়ের চাপে ওটাকে পিষে ফেলা গেল না মোটেও।
“ওটা একটা কঙ্গো”, আফসোস করে বলল ফেদরিকো, “খুদে হতচ্ছাড়াটা বিছের চেয়েও বাজে, তবে শক্তপোক্ত জোয়ান লোকের পক্ষে ততটা বিপজ্জনক নয়।”
হারম্যান একটু দুর্বল হয়ে পড়ল বেশ কয়েকদিন, ব্যথাট্যথাও রইল, কিন্তু তাতে ঘোড়ায় চড়ে জঙ্গলের রাস্তায় আমাদের সাথে বড়ো বড়ো আরো কিছু বালসা গাছ খুঁজে বেড়ানো আটকাল না। মাঝে মধ্যেই আমরা, পা-পড়েনি-এমন জঙ্গলের মধ্যে কড়মড় করে ভেঙে পড়ার আওয়াজ আর খুব জোর মাটিতে পড়ার শব্দ শুনছি। ডন ফেদরিকোও বেশ সন্তুষ্টিতে ঘাড় দোলাচ্ছে। মানে হল ওর দোআঁশলা ইন্ডিয়ানরা নতুন আরেকটা বিশাল বালসা গাছ নামিয়ে আনল ভেলা তৈরির জন্য। একসপ্তাহের মধ্যে কু – এর সাথে যোগ দিল, কেন, কাম, ইলো, মাউরি, রা, রাংগি, পাপা, তরংগ, কুরা, কুকারা, এবং হাইতি – বারোটা বিশাল বালসা গাছ। সবকটা গাছই স্থানীয় রীতিতে পূজার পর পলিনেশিয় কিংবদন্তীর দেবতাদের স্মরণ করে তাদের নামে নামকরণ করা হল, যে নামগুলি পেরু থেকে টিকির সঙ্গে সমুদ্র পেরিয়ে ভেসে এসেছিল। রসাল, চকচকে কাঠগুলো, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে প্রথমে ঘোড়া দিয়ে টেনে টেনে আনা হল তারপর ডন ফেদরিকোর ট্রাক্টর সেগুলোকে নদীপাড়ের বাংলোয় এনে ফেলল।
রসাল কান্ডগুলো কর্কের মতো হালকা তো দূর অস্ত বরং একেকটার ওজন কম সে কম এক টন তো হবেই; আমরা ভয়ে ভয়েই ছিলাম যে কী করে এগুলো জলে ভাসবে! ওগুলোকে নদীর পাড় থকে একের পর এক করে নদীর জলে গড়িয়ে দেওয়া হল; তার আগে গাছের গুঁড়িগুলো শক্ত লতা দিয়ে বাঁধা রইল যাতে তা ভেসে না চলে যায়। জলে ফেলতেই ঝুপ্পুস। একটু ঘুরে গিয়েই গুঁড়িগুলো ভেসে রইল, জলের নীচে আধাআধি ডুবে, যতটা জলের ওপরে ততটাই নীচে, আর আমরা চড়লেও ওগুলো ঠিকঠাকই ভেসে রইল। গুঁড়িগুলো জঙ্গলের গাছে ঝুলে থাকা শক্তপোক্ত ঝুরি দিয়ে বেঁধে দুটো ভেলা বানানো হল, একটার পিছে আরেকটা। তারপর যতটা প্রয়োজন হবে ততখানি বাঁশ আর ঝুরি ভেলায় বোঝাই করে আমি আর হারম্যান তাতে দুজন ইন্ডিয়ানের সাথে চড়ে বসলাম, যাদের ভাষা আমরা বুঝি না, আর তারাও আমাদেরটা।
তীরে বাঁধা দড়ি খুলে দিতেই ঘূর্নিজলে তীব্রবেগে আমরা নদীর নীচের দিকে, ভাঁটার টানে চললাম। বৃষ্টির মধ্যে বাঁকের মুখে শেষ একঝলক দেখতে পেলাম বাংলোর শেষ সীমানায় আমাদের অসাধারণ বন্ধুর দল হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে। তারপরেই কলাপাতার ছাউনির তলায় ঢুকে গেলাম আমরা, ভেলা চালানোর দায়িত্ব রইল বাদামি লোকদুটোর হাতে, একজন ভেলার সামনে, আরেকজন পেছনে। দুজনের হাতেই বিরাট দুটো দাঁড়। প্রচন্ড স্রোতেও অবলীলায় ওরা ভেলাটাকে চমৎকার ভাসিয়ে রাখল, আর আমরা নাচতে নাচতে এঁকেবেঁকে ঝুঁকে আসা গাছপালা আর পাড়ের বালির চরের মধ্য দিয়ে নীচের দিকে এগিয়ে চললাম। দুপাড়েই জঙ্গল যেন দুর্ভেদ্য দেওয়াল; টিয়া এবং অন্যান্য রঙীন পাখপাখালি গাছপালার মধ্যে দিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। এক দুটো কুমীর সরসর করে জলে নেমে ঘোলা জলে ডুবে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। অবশ্য শিগগিরই আমরা একটা অত্যন্ত আশ্চর্য জন্তুর দেখা পেলাম। সেটা একটা ইগুয়ানা, বা দৈত্যাকৃতি গিরগিটি, আকারে কুমীরের সমান কিন্তু গলাটা লম্বা আর পুরু চামড়া ঢাকা পিঠ। পাড়ের কাদায় শুয়ে ঝিমোচ্ছিল সেটা, যেন প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই ঘুমোচ্ছে, আমরা পাশ দিয়ে চলে যাবার সময়ও একটুও নড়ল না। দাঁড়ের লোকগুলো ইশারায় বলল, যেন গুলি না করি। একটু বাদেই একই জাতের আরেকটা দেখলাম, লম্বায় ফুট তিনেক হবে। সেটা আবার ভেলার ওপর ঝুঁকে আসা একটা মোটা ডাল বেয়ে তড়িঘড়ি চলে যাচ্ছিল। অনেকটা গিয়ে যখন বুঝল নিরাপদ, তখন থামল, নীল সবুজে মেশা ঠান্ডা চোখ মেলে আমাদের চলে যেতে দেখল।
খানিক বাদে ফার্নে মোড়া একটা পাহাড় পার হলাম আমরা, আর তার মাথাতেই সবচেয়ে বড়ো ইগুয়ানা দেখলাম। যেন পাথরে খোদাই চীনে ড্রাগনের শ্যিলুট, এমনটাই নিশ্চল হয়ে আকাশের গায়ে বুক আর মুখ উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সেটা। আমরা পাহাড়টাকে বেড় দিয়ে জঙ্গলের আড়ালে চলে যাওয়া অবধি ঘাড়ও ঘোরাল না।
আরো খানিকটা দূর যাবার পর ধোঁয়ার গন্ধ পেলাম, নদীর পাড়ে জঙ্গলের মধ্যে খোলা জায়গায় খড়ে ছাওয়া বেশ কতোগুলো কুটীর। ডাঙার অদ্ভুত বিজাতীয় লোকগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে ভেলার ওপরে থাকা আমাদের নজর করছিল। লোকগুলো ইন্ডিয়ান, নিগ্রো আর স্প্যানিশদের মিশেল। ওদের নৌকো, বিশাল বিশাল ক্যানোগুলো নদীর পাড়ে রাখা ছিল।
দুপুরে খাবার সময় আমরা হাল ধরলাম, আর আমাদের সঙ্গীরা, কাদার ওপরে একটু আগুন করে মাছভাজা আর কাঁঠাল (ব্রেডফ্রুট) তৈরী করল। ভেলায় খাবারের তালিকায় ঝলসানো মুরগির মাংস, ডিম আর অন্যান্য ফলও ছিল। গাছের গুঁড়িগুলো দিব্যি আমাদের সমেত সমস্ত মালপত্র নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে স্রোতের টানে সমুদ্রের দিকে বয়ে চলল। চারপাশে জল বাড়ল, ঢেউ দিল, তাতে আর কি আসে যায় এখন? যত জল বাড়বে, স্রোতও ততই বেড়ে চলবে।
নদীতে সন্ধ্যা নামল আর তীরে কান ঝালাপালা করে দেবার মতো অর্কেস্ট্রা শুরু হয়ে গেল। কুনো ব্যাঙ, সোনা ব্যাঙ, ঝিঁঝিঁপোকা, মশা সব মিলে গ্যাঙর গ্যাঙ, কিরিরকিটকিট, ভোঁওওও করে এক লম্বা কোরাস আরম্ভ করে দিল। একটু পরপরই রাতের অন্ধকার চিরে বনবিড়ালের ডাক, এই একটা, আবার একটা, তারপরেই আরেকটা, অন্ধকারে ভয়ার্ত পাখিদের ডানা ঝটপটানির আওয়াজও শুনলাম। অন্ধকারে নদী বেয়ে যেতে যেতে আদিবাসীদের কুটিরে আগুনের আভা দেখি এক দুবার, লোকজনের চেঁচামেচি, কুকুরের চিৎকার। কিন্তু বেশিরভাগ সময় তারাভরা আকাশের নীচে একলা চুপ করে বসে জঙ্গলের কথাই শুনছিলাম আমরা; শেষে বৃষ্টি আর ঢুলুনির চোটে, পাতার ছাউনির মধ্যে ঢুকে, পিস্তলটা হোলস্টারে আলগা করে রেখে, শুয়ে পড়লাম।
ভেসে ভেসে আরো ভাঁটির দিকে আসার পর নদীতীরে ঘরবাড়ির সংখ্যা, আদিবাসীদের চাষবাস বাড়তে লাগল, আর শিগগিরই পরপর গ্রাম দেখা গেল। এখানে নদীর ওপর যাতায়াতের জন্য বেশিরভাগই লম্বা লম্বা লগি আটকানো ক্যানো। আমরা একটু বাদে বাদেই এক একটা বালসা-কাঠে বানানো ভেলা দেখতে পেলাম, কলা বোঝাই করে বাজারে চলেছে।
পালেনক্যু নদী যেখানে রিও গুয়াইয়াতে মিশেছে সেখানে জলের গভীরতা এতটা যে ভিন্সেস আর সমুদ্রপারের গুয়ায়াকুইলের মধ্যে ঘন ঘন স্টিমারবোট চলে। সময় বাঁচাতে আমি আর হারম্যান স্টিমারের এক একটা হ্যামক দখল করে ঘনবসতিপূর্ণ সমতলের দিকে রওনা দিলাম। ওদিকে আমাদের স্থানীয় বন্ধুরা একা একাই কাঠগুলো ভাসিয়ে নিয়ে পেছন পেছন চলে আসবে। গুয়ায়াকুইলে পৌঁছে আমি আর হারম্যান আলাদা হয়ে গেলাম। ও গুয়াইয়া নদীর মুখে অপেক্ষায় থাকবে, বালসা কাঠগুলো ভেসে এলে সেগুলো নিয়ে কোস্টলাইন স্টিমারে তুলে দেবে পেরুর দিকে। ওখানে প্রাচীন ইন্ডিয়ানদের জলযানের মতো হুবহু একটা বালসা কাঠের ভেলা বানাতে হবে ওকে, ওইই নির্দেশ দিয়ে বানাবে সেটা। এদিকে আমি প্লেনে চেপে পেরুর রাজধানী লিমায় চললাম, ভেলা বানানোর একটা উপযুক্ত জায়গা খুঁজে রাখতে।
প্রশান্ত মহাসাগরের তীর বরাবর অনেক উঁচুতে উঠে এল প্লেনটা, একদিকে পেরুর মরু-পর্বত, অন্যদিকে অনেক নীচে চিকচিকে সমুদ্রের জল। এখান থেকেই ভেলা ভাসাতে হবে আমাদের। অনেক উঁচু প্লেন থেকে দেখে সমুদ্রকে সীমাহীন লাগছিল। সমুদ্র আর আকাশ মিলেমিশে একাকার হয়ে অনেক অনেক দূরে পশ্চিমের দিগন্তে বিলীন হয়ে গেছে। দেখতে দেখতে আমি কিছুতেই এই ভাবনা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলাম না যে, ঐ দিগন্তের ওপারেও আরো আরো একশ সমুদ্রের বিস্তার পেরিয়ে, পৃথিবীর এক-পঞ্চমাংশ পাড়ি দিলে তবে এক টুকরো মাটি দেখা যাবে – পলিনেশিয়া – তার আগে নয়। আমি আরো কয়েক সপ্তাহ পরের কথা ভাবার চেষ্টা করলাম যে আমাদের ভেলাটা একরত্তি কণার মতো নীচের বিস্তীর্ণ নীল সমুদ্রের বুকে ভাসমান আর তক্ষুনিই সেটা মাথা থেকে তাড়ালাম; কারণ এমন অস্বস্তি হল, ঠিক যেন প্যারাশ্যুটে করে লাফ দেবার আগের অবস্থা!
লিমায় পৌঁছে একটা গাড়ি নিয়ে কাল্লাও বন্দরের দিকে চললাম একটা জায়গা খুঁজতে যেখানে আমরা ভেলাটা বানাতে পারব। দেখলাম পুরো বন্দর এলাকাটা জাহাজ, ক্রেন আর ওয়্যার হাউসে একেবারে ঠাসাঠাসি। পাশাপাশি সীমাশুল্ক বিভাগ আর বন্দর কর্তৃপক্ষের অফিস আর বাকী যা যা সব। এরপরও যদি সমুদ্রের বেলাভূমিতে একটু ফাঁকা জায়গা থেকে থাকে , সেখানে সমুদ্রস্নান করতে এত লোক থিক থিক করছে যে আমরা চলে এলেই উৎসুক জনতা তক্ষুনি ভেলাটা টানাটানি করে সব খুলে ফেলবে। এ দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর শহর এখন কাল্লাও, সাদা আর বাদামি মিলিয়ে সত্তর লক্ষ লোকের বাস। ইকুয়েডরের থেকেও পেরুতে ভেলা বানিয়েদের জন্য দিনকাল যথেষ্ট পালটে গেছে, এবং আমি দেখলাম একমাত্র সুযোগ উঁচু পাঁচিলঘেরা নৌবন্দরের ভেতরে ঢুকতে পারলে! লোহার গেটের ভেতর বন্দুকধারী রক্ষীর দল আমায় তো বটেই পাঁচিলের কাছাকাছি আসা যেকোনো ঘুরঘুর করা লোককে কটমটে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছে। ওর মধ্যে একবার যাহোক করে ঢুকতে পারলে অবশ্য এক্কেবারে নিরাপদ।
ওয়াশিংটনে পেরুর নৌবাহিনীর সহকারী রাজদূতের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। আমাকে যাতে সাহায্য করা হয়, এই মর্মে ওর একটা চিঠি ছিল আমার কাছে। পরদিন সমুদ্র বিষয়ক মন্ত্রকে চিঠিটা নিয়ে গেলাম, মন্ত্রী ম্যানুয়েল নিয়েতোর সাথে দেখা করার জন্য। সক্কালবেলা মন্ত্রকের রাজকীয় বসবার ঘরে পৌঁছলাম, উজ্জ্বল চারপাশ, সোনালি রঙে মোড়া, আয়না লাগানো। একটু পরে তিনি নিজেই এলেন, পুরোদস্তুর উর্দি গায়ে, গাঁট্টাগোট্টা, নেপোলিয়নের মতো, সোজাসাপটা অল্পকথার মানুষ। কারণ জিজ্ঞেস করলেন, আমিও বললাম কেন। বললাম যে, নৌবন্দরে, ডকইয়ার্ডের ভেতর আমাদের কাঠের ভেলাটা বানানোর অনুমতি চাই।
“ইয়ং ম্যান”, মন্ত্রী এক হাতের মুঠোয় অন্য হাতের আঙ্গুল দিয়ে অস্থিরভাবে তাল ঠুকতে ঠুকতে বললেন, “তুমি দরজার বদলে সরাসরি জানালা দিয়ে ঢুকে পড়েছ। তোমায় সাহায্য করতে পারলে খুশিই হবো কিন্তু আদেশটা বিদেশমন্ত্রীর কাছ থেকে আমার কাছে আসতে হবে; নৌবহরের এলাকাতে তো আমি বিদেশিদের ঢোকার অনুমতি আর সেইসঙ্গে ডকইয়ার্ডও ব্যবহারের অনুমতি দিতে পারি না! বিদেশমন্ত্রকে আবেদন করো, শুভেচ্ছা রইল।”
আশংকা করছিলাম এইবারে কাগজপত্র চালাচালি শুরু হবে আর সাগরের নীলে হারিয়েও যাবে। তার চেয়ে টিকি-র সময়টাই ভালো ছিল, এসব আবেদন-টাবেদনের ঝুটঝামেলা ছিল না!
বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করাটা বেশ শক্ত হল। পেরুতে নরওয়ের কোনো স্থানীয় রাষ্ট্র-প্রতিনিধি ছিল না আর আমাদের সাহায্যকারী কনসাল জেনারেল বাঢ় বড়োজোর বিদেশমন্ত্রকের সহকারী কর্মচারী অবধি পৌঁছে দিতে পারল। প্রেসিডেন্টকে লেখা ডক্টর কোহেনের চিঠিটা এইবারে কাজে আসতে পারে ভেবে আমি অ্যাডজুট্যান্টের মাধ্যমে পেরুর মহামান্য রাষ্ট্রপতি ডন হোসে বাস্তামান্তে ইয়ো রিভেরো-র সাথে সাক্ষাৎ প্রার্থনা করলাম। এক কি দুদিন বাদে প্রাসাদে ডাক পড়ল ঠিক বেলা বারোটার সময়।
লিমা একটা আধুনিক শহর, লাখ পাঁচেক লোকের বাস; মরু-পর্বতের পদদেশে, সবুজ সমতলের ওপর শহরটা ছড়ানো ছেটানো। স্থাপত্যের দিক থেকে, আর বলাই বাহুল্য বাগান বা প্ল্যান্টেশনের ব্যাপারে লিমা বিশ্বের অন্যতম সুন্দর রাজধানী-শহর। যেন নানারকম প্রাচীন স্পেনীয় স্থাপত্য সম্বলিত একটুকরো আধুনিক ক্যালিফোর্নিয়া বা রিভিয়েরা। রাষ্ট্রপতির প্রাসাদ শহরের ঠিক মাঝখানে, উজ্জ্বল আর আকর্ষণীয় পোষাকের সশস্ত্র রক্ষীরা কড়া পাহারায়। এরকম সাক্ষাৎকার, পেরুতে বিশেষত, একটা গুরুতর ব্যাপার আর গুটিকয়েক লোকই পর্দার ছবির বাইরে রাষ্ট্রপতিকে সামনাসামনি দেখেছে। গুলিরাখার চকচকে বেল্ট-আঁটা সৈনিকেরা আমাকে সংগে করে ওপরতলায় করিডোরের শেষপ্রান্তে নিয়ে এল; এখানে আমার নাম নথিভুক্ত করল তিনজন অসামরিক লোক, আর তারপর আমায় একটা বিশাল ওককাঠের দরজা দেখিয়ে দেওয়া হল, যেটা পেরোলেই ঘরের ভেতর একটা লম্বা টেবিল আর দুপাশে সারবাঁধা চেয়ার। সাদা পোষাকের একজন এসে আমায় বসতে বলে চলে গেল। এক মুহূর্ত পর একটা বড়ো দরজা খুলে গেল, আর আমি আরো চমৎকার একটা ঘরে ঢুকলাম আর সেখানে চিত্তাকর্ষক এক ব্যক্তি, ধবধবে পরিষ্কার উর্দি গায়ে আমার দিকে এগিয়ে এলো।
“রাষ্ট্রপতিই হবে”, ভেবে, আমি ঠিকঠাক হয়ে নিলাম। কিন্তু না। সোনার ধার-লাগানো-উর্দি পড়া লোকটা আমায় একটা প্রাচীন লম্বা-পিঠের চেয়ার দিয়ে চলে গেল। চেয়ারের কোনায় এক মিনিট বসেছি কি বসিনি, আরেকটা দরজা খুলে গেল আর একটা চাকর এসে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন করে আমায় আরেকটা ঘরে নিয়ে গেল। সেখানাও চারদিক সোনায় মোড়া, মায় আসবাবপত্রও আর চমৎকারভাবে সাজানো। লোকটা যেমন হঠাৎ উদয় হয়েছিল তেমনিই উবে গেল, আর আমি একলা একটা প্রাচীন সোফায় বসে, সুমুখে একসার পরপর ঘর, দরজা খোলা। এমন নিঃশব্দ চারদিক যে কয়েকটা ঘর পরে কেউ খুব সন্তর্পণে কাশল, পরিষ্কার শুনতে পেলাম। এরপর গটগট পায়ের শব্দ শুনে আমি লাফ দিয়ে উঠে একটু দ্বিধাগ্রস্তভাবেই সম্ভাষণ জানালাম উর্দিধারী সামরিক লোকটিকে। কিন্তু না, ইনিও তিনি নন। কিন্তু সে যা বলল, তাতে বুঝলাম রাষ্ট্রপতি আমায় শুভেচ্ছা পাঠিয়েছেন, আর মন্ত্রীদের সঙ্গে সভা শেষ হলে দেখা করবেন।
দশমিনিট বাদে আবার নৈশব্দ ভেঙে পায়ের শব্দ। এবারে যে ঢুকে এল সে লোকটার কোটে সোনালি ফিতে আর সামরিক ব্যাজ। চট করে সোফা ছেড়ে উঠে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন করলাম। লোকটা তার চেয়েও বেশি ঝুঁকে আমায় অভিবাদন করে আমায় নিয়ে কয়েকটা ঘর পেরিয়ে মোটা কার্পেট-মোড়া একটা সিঁড়ি বেয়ে উপরে এল। সেখানে একটা চেয়ার আর একখানা সোফাওয়ালা একরত্তি একটা ছোট্টো ঘরে সে আমায় রেখে গেল। এবারে একজন ছোটোখাটো সাদা কোট প্যান্ট পড়া মানুষ এলেন এবং আমি হাল ছেড়ে অপেক্ষায় রইলাম সে এবারে কোথায় নিয়ে যায় দেখার জন্য। কিন্তু সে লোকটা আমায় কোত্থাও নিয়ে গেল না, আমায় সম্ভাষণ জানিয়ে দাঁড়িয়েই রইল। এই লোকটাই রাষ্ট্রপতি বাস্তামান্তে ইয়ো রিভেরো।
ছবিঃ মূল গ্রন্থ