কন-টিকি অভিযান-আগের পর্বগুলো
কনটিকি অভিযান
ইন্দ্রনাথ
মূল: থর হেয়ারডাল
আগের কথা
একদিন প্রাতঃকৃত্য করার সময় থরের পেছনে এসে একটা টুনা মাছ সজোরে আঘাত করল। হাসির খোরাক হলেও খারাপ কিছু ঘটেনি। অভিযাত্রীদের ভেলার চারপাশে মাছের ঝাঁকে মারপিট বেড়ে যেতে ওঁরা বেশি করে মাছ ধরতে শুরু করলেন। ডায়েরির এন্ট্রি থেকে দেখা যাচ্ছে বঁড়শি দিয়ে ছফুটি, সাতফুটি, আটফুটি একাধিক হাঙর ধরে তাঁরা ভেলায় তুলেছিলেন। সেগুলো ভেলার একধারে ডাঁই করা ছিল। কিন্তু মুশকিল হল হাঙরদের রক্তের গন্ধে আরো আরো হাঙর আকর্ষিত হচ্ছিল। সেকথা ওঁরা বুঝতে পারলেন দ্বিতীয়দিন। বুঝতে পেরে ডেক থেকে মৃত হাঙর আর রক্তের দাগ সাফ করে ফেললেন। শুধু হাঙরই নয় টুনা বনিট প্রভৃতি মাছও ওরা ধরতেন। এর মধ্যেই একদিন আর একটা মারাত্মক বিপত্তি ঘটে গেল। হাওয়ার দমকায় টরস্টাইনের স্লিপিং ব্যাগ উড়ে যেতে সেটা ধরার চেষ্টা করতে গিয়ে হারম্যান পড়ে গেলেন জলে। অভিযাত্রীরা শত চেষ্টাতেও তার নাগাল পাচ্ছিলেন না। হারম্যান দক্ষ সাঁতারু হলেও, ক্রমশ ভেলা থেকে পিছিয়ে পড়তে লাগলেন। এমনসময় দড়ি বাঁধা লাইফবেল্ট নিয়ে ন্যুট লাফিয়ে পড়লেন জলে আর সাঁতরে হারম্যানের কাছে পৌঁছে গেলেন। হারম্যানকে উদ্ধারের প্রায় পরপরই প্রবল ঝড়ে পড়লেন অভিযাত্রীরা। যথেষ্ট নাকাল হলেও, কনটিকি দিব্যি ভেসে রইল ঢেউয়ের ওপরে কিন্তু ওর বাঁধনগুলো আলগা হয়ে পড়েছিল। এবারে চিন্তা হল ভেলা কোনো পাথরে বা পাথরের দেয়ালে ধাক্কা না খেলে তো থামবে না বরং ভেসেই চলবে। আরেকটা সমস্যা হল, মার্কুইস আর টুয়ামাটো দ্বীপপুঞ্জের মাঝের সমুদ্রের ফাঁক দিয়ে গলে গেলে কী হবে? এসবের মধ্যেই, পলিনেশীয় দ্বীপ থেকে দূত হয়ে একঝাঁক গাংচিল দেখা দিল। ক্রমে পাখিদের সংখ্যা বাড়তে থাকল, আর পশ্চিম দিগন্তে দেখা গেল একটুকরো জমাট মেঘ। ডাঙার ওপরে যেমন থাকে। তাহলে ওইদিকেই ডাঙা? ভেলার মুখ সেদিকেই ঘোরানো হল।
১৭
দক্ষিণসাগরের দ্বীপে
তিরিশে জুলাইয়ের আগের রাতে কনটিকির আশপাশে অদ্ভুতরকম নতুন একটা আবহাওয়া। আমাদের মাথার ওপরে উড়তে থাকা অজস্র পাখির ঝালাপালা করে দেওয়া ডাক থেকে এটা বোঝা যাচ্ছিল, নতুন কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। গত তিন মাস যাবৎ সমুদ্রের আওয়াজ আর নিস্প্রাণ দড়িগুলোর ক্যাঁচকোঁচ ছাড়া কিছুই শুনিনি, এখন নানারকম পাখিদের ডাক আমাদের কাছে খুবই উল্লাসের আর পার্থিব ব্যাপারস্যাপার মনে হচ্ছিল। মাস্তুলের ওপর থেকে নজরদারের কাছে চাঁদটা আরো বড়ো আর গোলাকার লাগছিল। সমুদ্রের মাছের ওপরে প্রতিফলিত হলদে আলোর চেয়ে পাম গাছের পাতায় প্রতিফলিত আলো আর উষ্ণ রোমান্সের কথাই আমাদের কল্পনায় ধরা দিচ্ছিল।
ছটা নাগাদ বেঙ্গট মাস্তুল থেকে নেমে এল, হারম্যানকে ডেকে তুলল, এবং কেবিনে ঢুকে পড়ল। হারম্যান যখন নড়বড়ে মাস্তুলটায় উঠছে, সবে ভোর হচ্ছে তখন। দশ মিনিট বাদেই ও দড়ির মই বেয়ে নীচে এসে আমার পা ধরে ঝাঁকাতে লাগল।
“বাইরে এসে তোমার দ্বীপটাকে দেখ।”
ওর মুখ চকচক করছিল; আমি লাফ দিয়ে উঠলাম, পেছন পেছন বেঙ্গট। তখনও ও ঘুমোয়নি। গুঁতোগুঁতি করে যতটা চড়া যায়, মাস্তুলদুটোর জোড় অবধি আমরা উঠলাম। চারপাশে অনেক পাখি, শেষরাতের চিহ্ন হিসেবে নীল বেগনি রঙে আকাশ ছেয়ে আছে তার ছায়া পড়েছে সমুদ্রে। কিন্তু দূরে পূর্ব দিগন্তে হালকা একটা লাল আভা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে আর অনেকটা দক্ষিণপূর্বে ক্রমশ গাঢ় লাল আকাশের প্রেক্ষাপটে আবছা ছায়ার মতো, সমুদ্রের কিনারায় পেন্সিলের সরু ডগার মতো, নীল ছোট্ট একটা দাগ।
ডাঙা! একটা দ্বীপ! লোভীর মতো ওদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে দেখতে অন্যদের ডেকে তুললাম। ওরাও চোখ ডলতে ডলতে উঠে এসে চারদিকে দেখতে লাগল ভেবেছিল যেন, আমাদের ভেলার সামনেটা কোনো সৈকতে গিয়ে ঠেকতে যাচ্ছে। যেদিকে দ্বীপ দেখা যাচ্ছে, ডাকতে-থাকা-পাখিগুলো আকাশ জুড়ে সেদিকে একটা ব্রিজ তৈরি করেছে। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দিনের আলোয় আকাশের লাল আভা কেটে গিয়ে ঝকঝকে সোনালি রোদে দক্ষিণপূর্ব দিগন্তে ক্রমশ দ্বীপটা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম যে দ্বীপটা যেখানে থাকার কথা ঠিক সেখানটায় নেই। দ্বীপটা তো আর নিজে ভেসে আসতে পারে না, নিশ্চিতভাবে আমরাই রাতের বেলা উত্তুরে হাওয়ায় ভেসে চলে এসেছি। চারপাশের সমুদ্রে তাকিয়ে, সমুদ্রের ঢেউয়ের গতিপথ দেখে বুঝতে পারলাম যে অন্ধকারেই আমরা সুযোগ হারিয়েছি। এখন আমরা যে অঞ্চল দিয়ে ভেসে চলেছি, বাতাস আমাদের আর ওই দ্বীপের দিকে ঠেলে নিয়ে যাবে না। টুয়ামাটো দ্বীপপুঞ্জের চারপাশে স্থানীয় সমুদ্রের স্রোত খুবই প্রবল ছিল, এবং ডাঙায় এসে আছড়ে পড়ে বলে বিভিন্ন দিক বরাবর বইত। আবার প্রবাল প্রাচীর আর হ্রদ বরাবর জোরালো ঢেউয়ের আনাগোনায় এইরকম কোনো কোনো সামুদ্রিক স্রোতেরও দিক বদলে যেত।
আমরা হাল নামিয়ে দিলাম, যদিও ভালোভাবেই জানতাম যে, কোনো কাজের হবে না সেটা। সাড়ে ছটায় সূর্য উঠল, আর সমুদ্র ছেড়ে লাফিয়ে আকাশে অনেকটা উঠে গেল যেমনটা নিরক্ষীয় অঞ্চলে হয়। দ্বীপটা কয়েক সামুদ্রিক মাইল দূরে রয়েছে, দিগন্তরেখায় জঙ্গলের রেখার একটা ক্ষীণ আভাস। একচিলতে হালকা সৈকতরেখার ওপাশে গাছগুলো ঘেঁষাঘেষি করে দাঁড়িয়ে আছে। পুরোটাই এত ছোটো আর নীচু যে সমুদ্রের ঢেউয়ের পেছনে মাঝে মাঝেই ওটা আড়ালে পড়ে যাচ্ছে। এরিকের স্থানাঙ্ক অনুযায়ী এই দ্বীপটা হল পুকা পুকা, টুয়ামাটো দ্বীপমালার একেবারে প্রথম দ্বীপ। আমাদের কাছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপে নৌচলাচলের জন্য ১৯৪০ সালে প্রকাশিত যে দুটো আলাদা চার্ট আছে সে অনুযায়ী এবং এরিকের পর্যবেক্ষণ, দুইই মিলিয়ে এই দ্বীপটার চারটে আলাদা আলাদা স্থানাঙ্ক দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কাছাকাছি আর কোনো দ্বীপ না থাকায় কোনো সন্দেহই ছিল না যে দ্বীপটা দেখছি সেটা পুকাপুকাই।
ভেলার ওপরে তেমন কোনো উচ্ছ্বাস বা উল্লাস শোনার মতো কিছু ছিল না। পাল গুটিয়ে হাল নামিয়ে আমরা নিঃশব্দে মাস্তুলের ওপরে বা ডেকের ওপরে চুপচাপ ওই একটুকরো ডাঙার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ডাঙাটা হঠাৎ করেই নিঃসীম প্রবল সমুদ্রের মাঝে যেন গজিয়ে উঠেছিল। এত মাস ধরে যে আমরা সত্যিই ভেসে এসেছি অবশেষে এবারে তার একটা সাক্ষাৎ প্রমান আমাদের কাছে হাজির। এমনটা নয় যে আমরা কেবলই অনন্ত সমুদ্রের কেন্দ্রে স্থির হয়ে ভাসছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন দ্বীপটাই গতিশীল আর যে নীল সমুদ্রের বৃত্তের কেন্দ্রে আমাদের বাস সেখানে হঠাৎ করেই দ্বীপটা ঢুকে এসেছে। যেন দ্বীপটাই ধীরে ধীরে পূর্ব দিগন্তের দিকে ভাসতে ভাসতে আমাদের এলাকায় ঢুকে এসেছে। আমরা সবাই দারুণ সন্তুষ্ট হয়েছিলাম এটা ভেবে যে শেষমেষ আমরা পলিনেশীয়াতে পৌঁছেছি। একটাই হালকা আক্ষেপ, অসহায়ের মতো দেখছি দ্বীপটা মরীচিকার মতো একদিকে রয়ে গেল আর আমরা সমুদ্রে পশ্চিমদিকে ক্রমাগত ভেসে চললাম।
সূর্যোদয়ের একটু পরে দ্বীপের মাঝবরাবর একটু বাঁদিক ঘেঁষে গাছগুলোর ওপর দিয়ে ঘন কালো একরাশ ধোঁয়া দেখা গেল। আমরা ওটা দেখতে দেখতে মনে মনে ভাবছিলাম স্থানীয় মানুষেরা ঘুম থেকে উঠেছে, এখন প্রাতরাশ বানাচ্ছে হয়তো। আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না আসলে ওখানকার লোকেরা দুর থেকে আমাদের দেখে ধোঁয়ার সংকেত দিয়ে দ্বীপে আমন্ত্রণ জানাচ্ছিল। সাতটা নাগাদ বাতাসে পোড়ানো বোরাও কাঠের হালকা গন্ধ আমাদের নুনে ভেজা নাকে এসে লাগল। ফাটু হিভার সৈকতে আগুন করার ঘুমন্ত স্মৃতি উসকে দিচ্ছিল ওটা। আধ ঘণ্টা পর জঙ্গলের এবং নতুন কাটা কাঠের গন্ধ পেলাম। দ্বীপটা এখন ছোটো হতে হতে পেছনে পড়ে রইল, ফলে ওদিক থেকেই বাতাসে ভেসে ভেসে আসা ধোঁয়ার গন্ধ পেতে থাকলাম। প্রায় পনেরো মিনিট আমি আর হারম্যান মাস্তুলে ঝুলে রইলাম যাতে সবুজ সজীব উষ্ণ ঘ্রাণ আমাদের নাকে এসে ঢোকে। এই হল পলিনেশীয়া, তিরানব্বই দিন শুধুই ঢেউয়ের মধ্যে নোনতা আবহাওয়ায় কাটানোর পর চমৎকার শুকনো ডাঙার টাটকা গন্ধ। বেঙ্গট স্লিপিংব্যাগে ঢুকে যথারিতী আবার নাক ডাকাচ্ছিল। এরিক আর টরস্টাইন কেবিনের মধ্যে শুয়ে শুয়ে ধ্যান করছিল আর ন্যুট দৌড়দৌড়ি করে পাতার গন্ধ শুঁকছিল এবং ডায়েরি লিখছিল।
সাড়ে আটটা নাগাদ পুকা পুকা আমাদের পেছনে সমুদ্রে মিলিয়ে গেল, কিন্তু বেলা প্রায় এগারোটা অবধি মাস্তুলের ওপর থেকে পূর্ব দিগন্তের ওপরে হালকা নীল একটা দাগ দেখা যাচ্ছিল। তারপর সেটাও মিলিয়ে গেল এবং যেদিকে পুকা পুকা দ্বীপটা ছিল সেদিকে আকাশে একটা বিরাট সাদা স্তূপমেঘ স্থির হয়ে ঝুলে রইল। পাখিরাও এখন অদৃশ্য। ওরা স্বভাবতই দ্বীপের দিকে বওয়া বাতাসের কাছাকাছিই ছিল কেননা বেলাশেষে পেটভর্তি খাবার খেয়ে যাতে বাতাসে ভর করে বাসায় ফিরতে পারে। ডলফিনও লক্ষণীয়ভাবে কমে গিয়েছিল এবং ভেলার নীচে আবারও কেবলমাত্র কিছু পাইলট মাছ। সেরাতে বেঙ্গট বলল, শুয়ে শুয়ে বই পড়ার সময় চিত থেকে উপুড় হতে এত পরিশ্রম হয় যে এখন ওর একটা টেবিলচেয়ার খুবই প্রয়োজন। নয়তো আমরা যে ডাঙায় ভিড়তে পারিনি তাতে ও বেশ খুশিই হয়েছিল কেননা ওর তখনো তিনটে বই পড়া বাকি ছিল। টরস্টাইনের হঠাৎ একটা আপেল খাবার ইচ্ছে হল আর আমি মাঝরাতে ঘুম ভেঙে উঠে বসলাম, নিশ্চিতভাবে মাংসের আর পেঁয়াজের সুস্বাদু গন্ধ পেয়ে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ওটা একটা নোংরা শার্টের গন্ধ।
ঠিক পরের দিন লক্ষ করা গেল দুটো নতুন মেঘের স্তূপ আকাশে উঠছে, যেন দিগন্তরেখার নীচে রাখা দুখানা রেলইঞ্জিন থেকে বাষ্প উঠছে। ম্যাপ থেকে জানতে পারা গেল যে প্রবালদ্বীপ দুটো থেকে ওগুলো উঠছে সেগুলোর নাম ফাংগাহিনা আর আঙ্গাটাউ। বাতাসের গতিবিধি অনুযায়ী আঙ্গাটাউয়ের ওপরের মেঘটাই আমাদের কাছে বেশি সুবিধেজনক বোধ হল সুতরাং ওইদিকেই লক্ষ করে, দ্রুত হাল বেঁধে নেওয়া হল সেইমতো আর প্রশান্তমহাসাগরের এমন বাঁধনহারা শান্তিতে গা ভাসিয়ে দিলাম। এমন একটা দিনে কনটিকির বাঁশের ডেকের ওপর জীবন আহ্লাদে ভরপুর কেননা সকলেই একরকম বুঝে নিয়েছিলাম, যাইই অপেক্ষা করুক না কেন, নিশ্চিতভাবেই আমাদের যাত্রা এবারে শেষ হবে।
তিন দিন তিন রাত আঙ্গাটাউয়ের মেঘের দিকে ভেলা চালিয়ে চললাম; চমৎকার আবহাওয়া, হালটা একলাই আমাদের গতিপথ নিশ্চিত করে রেখেছিল আর স্রোতও আমাদের সঙ্গে কোনো ছলচাতুরী করেনি। চতুর্থদিন সকালে ৪-৬ টার নজরদারীর শেষে হারম্যানের বদলি হল টরস্টাইন। হারম্যান ওকে জানাল চাঁদের আলোয় ও একটা দ্বীপের ক্ষীণ রেখা দেখেছে। তার কিছুক্ষণ পরেই সূর্য উঠলে, টরস্টাইন কেবিনের মধ্যে মুন্ডুটা ঢুকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল,
“ডাঙা দেখা যাচ্ছে।”
আমরা লাফিয়ে বাইরের ডেকে এলাম, আর যা দেখলাম, তাতে আমরা আমাদের সমস্ত পতাকাগুলো তুলে দিলাম। প্রথমে পেছনের নরওয়ের পতাকাটা আর তারপর মাস্তুলের ফরাসি পতাকাটা কেননা আমরা ফরাসি উপনিবেশের দিকেই চলেছি কিনা। শিগগিরিই আমাদের ভেলায় যত পতাকা ছিল সবগুলোই ফুরফুরে বাণিজ্য বায়ুতে পতপত করে উড়তে শুরু করে দিল। এক্সপ্লোরার ক্লাবের পতাকার পাশাপাশি আমেরিকান, ব্রিটিশ, পেরুভিয়ান আর সুইডিশ পতাকা, সুতরাং কোনো সন্দেহই নেই কনটিকি তখন সেজেগুজে এক্কেবারে তৈরি। দ্বীপটা এইবারে একদম সঠিক জায়গায়, একদম আমাদের ভেলার গতিপথে, আর চারদিন আগে সূর্যোদয়ের সময় প্রথমবার দেখা পুকা পুকা যতটা দূরে ছিল তার চেয়ে আরো খানিকটা দূরে। আমাদের পেছনের আকাশে যখন সূর্য উঠল, সামনে দ্বীপটার ওপরের ঘোলাটে আকাশে স্পষ্ট সবজেটে একটা আভা দেখা গেল। ওটা চারপাশের প্রবাল প্রাচীরের মাঝের সবুজ হ্রদের স্থির জলের প্রতিফলন। নীচু প্রবালদ্বীপের এরকম মরীচিকা বাতাসে প্রায় হাজার ফুট ওপরে অবধি দেখা যায় ফলে প্রাচীন অভিযাত্রীদের কাছে, দিগন্তরেখায় দ্বীপটা দেখতে পাওয়ার বহু আগেই তার অবস্থান নিশ্চিত হয়ে যেত।
দশটা নাগাদ আমরা নিজেরাই হালের বৈঠা ধরলাম। এখন আমাদের ঠিক করতে হবে দ্বীপের কোন অংশের দিকে ভেলা ঘোরাবো। ইতিমধ্যেই আমরা প্রতিটা গাছের মুড়ো একটার চেয়ে অন্যটাকে আলাদা করতে পারছিলাম আর দেখতে পাচ্ছিলাম পেছনের ছায়াছায়া জঙ্গলের চালচিত্রে পরপর সার দিয়ে দাঁড়ানো গাছের কান্ড সূর্যের আলোয় চকচক করছে।
জানতাম যে দ্বীপ আর আমাদের মধ্যে কোথাও না কোথাও বিপজ্জনক একটা ডুবোপাহাড় ওঁত পেতে আছে, দ্বীপের দিকে কোনোকিছু এগোলেই হামলায় তৈরি। প্রবাল প্রাচীরটা ছিল পুব দিক ওঠা ঢেউয়ের ঠিক নীচেই, প্রাচীরের ওপরে এসে গভীরতা কমে যেতে ঢেউটা ছিতরে গিয়ে, উঁচু হয়ে আকাশে উঠে শব্দ করে ভেঙে পড়ছিল, ধারালো প্রবাল-প্রাচীরের ওপরে ফেনা ছড়িয়ে পড়ছিল। টুয়ামাটো দ্বীপপুঞ্জে ডুবোপাহাড়ের কাছে জলের টানে পড়ে এমনভাবে বহু জলযান প্রবাল প্রাচীরে লেগে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে।
সমুদ্রের ওপর থেকে এমন প্রতারক ফাঁদের কিছুই বোঝার উপায় নেই। ঢেউয়ের সাথে সাথেই আমরা ভেসে চললাম; দ্বীপের দিকে ঢেউগুলো মিলিয়ে যাওয়ার পর সমুদ্রের ফুলে থাকা চকচকে পিঠটাই কেবল চোখে পড়ে। প্রবালপ্রাচীর আর তার ওপরে ঢেউয়ের ফেনার উদ্দাম নাচানাচি আমাদের সামনে উঁচু উঁচু ঢেউগুলোর আড়ালেই পড়ে ছিল। কিন্তু দ্বীপের উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্ত বরাবর, যেটুকু আমাদের নজরের আওতায় আসছিল, সেদিকে ডাঙা থেকে কয়েকশো গজ দূরে সমুদ্রের মাঝে সাদা একটা ফেনার ফোয়ারা আকাশের দিকে ছিটকে উঠছিল। আমরা এমনভাবে ভেলাটার দিক ঠিক করলাম যাতে দ্বীপের দক্ষিণপ্রান্তে ডাইনির রান্নাঘরের ফুটন্ত ফেনা এড়িয়ে যেতে পারি। আশায় ছিলাম ওখানে পৌঁছে গেলে প্রাচীরের গা বরাবর ভেলা বেয়ে একেবারে শেষপ্রান্ত দিয়ে ঘুরে অথবা পুরো ভেসে চলে যাওয়ার আগেই প্রবাল প্রাচীরের খানিকটা অগভীর কোনো জায়গায় নোঙর করে ফেলতে পারব আর তারপর সুবিধেজনক বাতাসের অপেক্ষায় থাকব যাতে আমরা দ্বীপের নীচু অংশের দিকে গিয়ে পড়তে পারি।
দুপুর নাগাদ দূরবীন দিয়ে তীরের গাছপালা দেখা যাচ্ছিল, সবুজ নারকেল গাছেদের মাথাগুলো একত্রে ঘেঁসাঘেঁসি করে রয়েছে। তীর বরাবর সামনে ঘন সবুজ ঝোপের ঢেউখেলানো আবছা রেখা। তারও সামনে বালির ওপর পরপর প্রবালের স্তূপ রয়েছে একাধিক। গাছের ওপরে সাদা রঙের পাখিদের ওড়াউড়ি বাদে আর কোনো প্রাণের চিহ্ন অবধি নেই।
দুটো নাগাদ আমরা দ্বীপের এতটাই কাছে এলাম যে গোলমেলে প্রবাল প্রাচীরটার ঠিক বাইরে দিয়ে ওর তীর বরাবর আমরা ভেসে চললাম। যত কাছে এগোচ্ছি প্রাচীরের ওপরে ঢেউ ভেঙে পড়ার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি, ফোয়ারার মতো ক্রমাগত ছিটকে উঠছে জল, যেন ভেলার ডান পাশে কয়েকশো গজ দূর দিয়ে একটা অনন্ত রেলগাড়ি গর্জন করে ছুটে চলেছে। ওই রেলগাড়ির অঞ্চলেই ভেঙে পড়া ফনার মতো ঢেউয়ের আড়ালে মাঝে মাঝে জলের বিন্দুগুলো ছিটকে ছিটকে উঠছে, আর এখন সেটা আমরা পরিষ্কার দেখতেও পাচ্ছি।
হালের বৈঠায় দুজন দাঁড়িয়ে ছিল, ওরা বৈঠা ঘোরানোর কাজটা করছিল। বাঁশের কেবিনের পেছনে ছিল বলে সামনেটায় ওরা কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। আমাদের ন্যাভিগেটর এরিক রান্না করার প্যাকিংবাক্সটার ওপরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পেছনের দুজনকে, যারা ভারী বৈঠাটা টানছিল, তাদের নির্দেশ দিচ্ছিল। আমাদের পরিকল্পনাটা ছিল নিরাপদে বিপজ্জনক প্রবালপ্রাচীরের যতটা সম্ভব কাছে যাওয়া। মাস্তুলের ওপর থেকে নজর রাখা হচ্ছিল প্রাচীরের কোথাও কোনো ফাঁকা অংশ দেখা যায় কিনা, সেখান দিয়ে ভেলাটা গলিয়ে দেবার চেষ্টা করা হবে। স্রোতের টান স্থিরভাবে প্রাচীরের দৈর্ঘ্য বরাবর আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে চলেছিল, কোনো এদিক-ওদিক ছাড়াই। আলগা সেন্টারবোর্ডগুলোর জন্য আমরা বাতাসের সাথে দুদিকেই ২০ ডিগ্রি কোণ করে ভেলাটাকে ঘোরাতে সক্ষম হলাম। বাতাসও প্রাচীর বরাবরই বইছিল।
এরিক যখন আমাদের আঁকাবাঁকা গতিটা নির্দেশ করছিল, আর জলের ঘূর্ণির যতটা সম্ভব কাছাকাছি এসে ঘুরিয়ে আনছিল আমাদের ভেলাটা, যাতে জলের টানে না পড়ে যায় সেসময়ও আমি আর হারম্যান দড়িতে বাঁধা রাবারের ডিঙিতে চেপে বেরোলাম। ভেলা যখন ভেতরের দিকে, আমরা ডিঙিতে দড়িবাঁধা অবস্থায় উদ্দাম প্রাচীরের এতটা কাছে চলে এলাম যে একঝলক দেখলাম আমাদের দিক থেকে কাচের মতো সবজে জল ঢেউয়ের মতো সামনে আছড়ে পড়ছে, আর লক্ষ্য করলাম সমুদ্র সেই জলের ঢেউটা গভীরে টেনে নিতেই প্রবালপ্রাচীরের খানিকটা উন্মুক্ত হয়ে পড়ছে, একেবারে ভাঙাচোরা জংধরা আকরিক লোহার প্রাচীর যেন। তীর বরাবর যতদূর দেখা যায় প্রাচীরের কোনো অংশে কোনো ফাঁক বা গলে যাবার রাস্তা নেই। সুতরাং এরিক বাঁদিকের পাল আরো শক্ত করে টানটান করে ডানদিকেরটা আলগা করে দিল আর সেইমতো হালের বৈঠাও টানা শুরু হল যাতে কনটিকি আবার মুখ ঘুরিয়ে বিপজ্জনক প্রবালপ্রাচীর থেকে বেশ খানিকটা দূরে সমুদ্রের গভীরে সরে গেল পরবর্তী পর্যায়ে ফের ভেতরের দিকে ঘুরে আসার জন্য। যতবার কনটিকি ভেতরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে আসছে বা বাইরের দিকে সরে যাচ্ছে, আমরা দুজন পেছনের ডিঙিতে দড়ি বাঁধা অবস্থায় বসে থেকেছি, গলার কাছে হৃৎপিন্ডটা এসে আটকে থাকছে, কেননা সমুদ্রের ঢেউ উঁচু আর এতটা ভয়ানক হয়ে উঠছে যে আমরা পরিষ্কার তার প্রতিটা স্পন্দন টের পাচ্ছিলাম। প্রতিবারই আমরা নিশ্চিত হয়ে পড়ছি যে এবারে এরিক নির্ঘাত এতটা ভেতরে নিয়ে গেছে যে কনটিকিকে আর ফেরানো সম্ভব হবে না আর মৃত্যুদূতের মতো লাল প্রবালপ্রাচীরের দিকে টেনে নেবে আমাদের। কিন্তু প্রতিবারই এরিকের চমৎকার দক্ষতার জেরে জলের টান এড়িয়ে কনটিকি আবার নিরাপদেই খোলা সমুদ্রে এসে পড়েছে। সারাক্ষণই আমরা দ্বীপের তীর বরাবর এত কাছ দিয়ে ভেসে চলেছি যে তীরের পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখতে পাচ্ছি তবুও স্বর্গীয় সেই সৌন্দর্য আমাদের কাছে অধরাই রয়ে গেল মাঝখানের অশান্ত জলের পরিখার কারণে।
বেলা তিনটে নাগাদ তীরের জঙ্গলের গাছপালা খানিকটা ফাঁকা ফাঁকা হল আর ওই ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ল নীল জলের একটা হ্রদ। কিন্তু চারপাশের প্রবালপ্রাচীর একই রকম নিরেট, ঢেউয়ের ফেনার মধ্যে ভীতিজনকভাবে লাল দাঁত বার করে রয়েছে। প্রাচীরের মধ্যে গলে যাবার কোনো পথ নেই, পেছনের বাতাসের ধাক্কায় দ্বীপ বরাবর আরো এগিয়ে যেতে জঙ্গলের ফাঁকটাও বুঁজে গেল। পরের দিকে অবশ্য জঙ্গল ক্রমশ পাতলা হতে লাগল আর আমরা প্রবালদ্বীপের ভেতরটা দেখার সুযোগ পেলাম। এর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর আর উজ্জ্বল লোনাজলের হ্রদ রয়েছে। নারকেল গাছে ঘেরা, উজ্জ্বল বেলাভূমি ঘেরা বিরাট নিস্পন্দ একটা হ্রদ। মোহময়ী সবুজ পামগাছের দ্বীপ আর শান্ত হ্রদের মাঝে নরম হলদে একটা গোল বলয় তৈরি হয়েছে আর দ্বিতীয় বলয়টা গোটা দ্বীপের চারপাশ জুড়ে, স্বর্গের প্রবেশদ্বারের রক্ষক, মরচে-লাল তীক্ষ্ণ তরবারির মতো।
সারাদিন ধরে আঙ্গাটাউয়ের পাশ দিয়ে আঁকাবাঁকা হয়ে ভেসে চললাম, আর কেবিনের দরজার বাইরে বসে বসে, খুব কাছ থেকেই ওর সৌন্দর্য দেখলাম। পাম গাছের ওপরে সূর্যের আলো এসে পড়েছে, গোটা দ্বীপটাই যেন স্বর্গ আর আনন্দের পীঠ। আমাদের ভেলা চালানোর হরকৎটা খানিক রুটিনের মধ্যে পড়ে যেতে এরিক ওর গিটারটা বার করে বিরাট একটা পেরুভিয়ান রোদ-টুপি মাথায় দিয়ে বাজাতে আরম্ভ করল আর দক্ষিণ সমুদ্রের দ্বীপের মরমী গানগুলো গাইতে শুরু করল আর বেঙ্গট একটা দারুণ ডিনার বানিয়ে আমাদের পরিবেশন করল। ভেলায় নারকেল চারায় ঝুলতে থাকা ছোটো ছোটো নারকেলগুলোকে উদ্দেশ্য করে আমরা পেরু থেকে আনা পুরোনো নারকোল ফাটিয়ে পান করলাম। পুরো পরিবেশটাই আমাদের আপ্লুত করে রেখেছিল, আমাদের দিকে দুহাত বাড়ানো উজ্জ্বল সবুজ পামগাছের জঙ্গলের প্রশান্তি, তার ওপরে উড়ে বেড়ানো সাদা পাখির ঝাঁকের প্রশান্তি, স্বচ্ছ কাচের মতো জলের হ্রদ আর বালির সৈকতের প্রশান্তি, প্রবালপ্রাচীরের লাল চোখ, বাতাসে ভেঙেপড়া ঢেউয়ের গর্জনের শব্দ সব মিলিয়ে সমুদ্র পাড়ি দেওয়া আমাদের ছজনকে বিমুগ্ধ করে রেখেছিল। এমন একটা প্রভাব যা স্মৃতি থেকে মুছে ফেলা যাবে না কখনোই। কোনো সন্দেহই নেই আমরা অন্য পাড়ে এসে পৌঁছেছি, এটা ঠিক, এর চেয়ে নিশ্চিতভাবে দক্ষিণ সামুদ্রিক দ্বীপ আর দেখব না। নামতে পারি আর নাইই পারি, আমরা পলিনেশিয়ার সবচেয়ে কাছের দ্বীপটায় পৌঁছে গেছি।
পাঁচটা নাগাদ গাছপালার মাঝে দুটো পামপাতায় ছাওয়া কুঁড়ের পাশ দিয়ে ভেসে চললাম। কোনো ধোঁয়া বা নড়াচড়া অবশ্য লক্ষ করা গেল না।
সাড়ে পাঁচটা নাগাদ আবার ঘুরে প্রবালপ্রাচীরের দিকে ঘুরলাম। পুরো দক্ষিণ তীর বরাবর ভেসে ভেসে দ্বীপের পশ্চিম প্রান্তে চলে এসেছি, সম্পূর্ণ আওতার বাইরে যাবার আগে এখনই শেষবারের মতো একবার দেখে নেওয়া দরকার প্রাচীরের কোনো ফাঁক গলে ঢুকে যাওয়া যায় কিনা। সূর্য এখন এতটা ঢলে পড়েছে যে সামনে তাকালে রোদ্দুর সোজা এসে চোখের ওপর পড়ছে। সমুদ্র যেখানে প্রাচীরের ওপর ভেঙে পড়ছে, দ্বীপের শেষবিন্দু ছাড়িয়ে আরো কয়েকশো গজ দূরে, সেখানে অবশ্য বাতাসে একটা রঙধনু দেখতে পেলাম। আমাদের সামনে এখন ওটা শ্যিলুটের মতো। ভেতরের দিকে, সৈকতের ওপর খেয়াল করলাম কতগুলো স্থির কালো কালো বিন্দু। তাদের মধ্যে হঠাৎ একটা বিন্দু আস্তে আস্তে জলের দিকে এগিয়ে এল আর বাকিরা তীরবেগে জঙ্গলের ধারে ছুটে গেল। ওহ, ওরা মানুষ! আমরা যতটা সম্ভব প্রাচীরের কাছাকাছি চলে এসেছি; বাতাস মরে এসেছিল, তাতে মনে হল দ্বীপের কাছের অংশের কয়েক ইঞ্চির মধ্যে চলে এসেছি। এবারে দেখি একটা ক্যানো নেমেছে জলে, আর দুজন মানুষ লাফ দিয়ে তাতে চড়ে প্রাচীরের অন্য পাশ থেকে বেয়ে পেছনের দিকে যাচ্ছে। খানিকটা বাওয়ার পর বাইরের দিকে ক্যানোর মুখটা ঘুরল আর একটা উঁচু মতো ঢেউ নৌকোটাকে শূন্যে তুলে ফেলল আর সেটা প্রাচীরের একটা ফাঁক গলে ছিটকে বেরিয়ে সোজা আমাদের দিকে আসতে লাগল।
তার মানে, প্রাচীরের ফাঁকটা ওই জায়গায় আর সেটাই আমাদের একমাত্র আশা। এবারে আমরাও দেখতে পেলাম, গোটা গ্রাম ভেঙে এসেছে পামগাছের জঙ্গলের সারির পাশে পাশে। কিন্তু ছায়ারা ততক্ষণে অনেকটা লম্বা হয়ে পড়েছে।
ক্যানোর লোকদুটো হাত নাড়ল। আমরাও খুব আগ্রহ নিয়ে পালটা হাত নাড়লাম আর অমনি ওরা গতি বাড়িয়ে দিল। ওটা ছিল বিশেষভাবে নির্মিত পলিনেশীয়দের আউট্রিগার ক্যানো। দুজন বাদামি লোক পরপর একদিকে মুখ করে বসে বসে দাঁড় বাইছে। এবারে আবার নতুন করে ভাষাসমস্যা। আমাদের মধ্যে একা আমারই, ফাটু হিভায় থাকার সময় মার্কুইসীয় কিছু শব্দ মনে ছিল, কিন্তু পলিনেশীয় ভাষা মনে রাখা খুবই শক্ত, বিশেষত আমাদের উত্তরের দেশগুলোতে চর্চার অভাব থাকে বলে।
ক্যানোটা আমাদের ভেলার একপাশে ঠোক্কর খেয়ে ভিড়ে যেতে দুজনেই ভেলায় উঠে এল আর ওদের একজন একগাল হেসে বাদামি হাত বাড়িয়ে ইংরিজিতে বলল, “গুড নাইট”। শুনে আমরা একঝলক স্বস্তিই পেয়েছিলাম।
“গুড নাইট”, খুব অবাক হয়েই আমি উত্তর দিলাম, “তুমি ইংরিজি বলতে পারো?”
লোকটা আবার হাসল, মাথা নেড়ে বলল, “গুড নাইট।”
বিদেশি ভাষায় ওর বুৎপত্তি এটুকুই। ফলে ওর নিরীহ বন্ধুটির তুলনায় ওর কদর স্বভাবতই অনেকটাই বেড়ে গেল। সে বেচারা পেছনে দাঁড়িয়ে খালি হাসে, অভিজ্ঞ সঙ্গীটির জন্য মুগ্ধতা তার চোখেমুখে।
“আঙ্গাটাউ?” দ্বীপের দিকে আঙুল দেখিয়ে আমি জিজ্ঞেস করি।
“হাঙ্গাটাউ,” লোকটা মাথা নাড়ে।
এরিকও গর্ব করে মাথা ঝাঁকায়। ও সঠিক বলেছিল। সূর্যের অবস্থান মেপে ও যেখানে বুঝেছিল, আমরা এখন ঠিক সেখানেই।
‘মাই মাই হি ইউতা,” আমি একটু চেষ্টা করি।
ফাটু হিভায় যেটুকু শিখেছিলাম তাতে মোটামুটি একথার মানে দাঁড়ায়, “ডাঙায় যেতে চাই।”
ওরা দুজনেই প্রাচীরের অদৃশ্য ফাঁকটার দিকে দেখাল। আমরাও হালের বৈঠা নামিয়ে ঠিক করলাম একবার দেখাই যাক।
সেই সময়েই দ্বীপের মধ্যে থেকে আবার একটা বাতাস বইতে শুরু করল। হ্রদের ওপরে একটুকরো বাদল মেঘ। বাতাস আমাদের ধাক্কা দিয়ে প্রাচীর থেকে দূরে নিয়ে যেতে চাইছিল এবং আমরা দেখলাম কনটিকি হালের কথা খুব একটা শুনছে না যাতে গোল হয়ে ঘুরে আমরা প্রাচীরের চওড়া ফাঁকটার দিকে চলে যেতে পারি। আমরা জলের তলাটা মাপতে চাইলাম কিন্তু নোঙরের দড়ি ততটা বড়ো ছিল না যাতে নীচ অবধি পৌঁছয়। আমরা দ্রুত পালটা নামিয়ে রেখে প্রত্যেকে হাতে বৈঠা তুলে নিলাম।
লোকদুটো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছিল, আমি ওদের হাতেও একটা করে বৈঠা তুলে দিতে চাইলাম। ওরা প্রবলভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে শুধু যেদিকে যাব সেদিকে দেখিয়ে দ্বিধাগ্রস্তভাবে তাকিয়ে রইল। আমি আকারে ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে আমাদের সবাইকে মিলেই বৈঠা বাইতে হবে আর আরো একবার কথাগুলো বললাম যে “ডাঙায় যেতে চাই।” ওদের মধ্যে বুদ্ধিমান লোকটা একটু ঝুঁকে ডান হাত দিয়ে বাতাসে ইঞ্জিন চালু করার মতো ভঙ্গী করে মুখে শব্দ করল,
“বরররররর!”
কোনো সন্দেহই নেই ও চাইছিল যাতে আমরা ইঞ্জিন চালু করি। ওরা ভেবেছিল ওরা একটা অদ্ভুত ধরনের মালবাহী নৌকোয় দাঁড়িয়ে আছে। আমরা ওদের পেছনের দিকে নিয়ে গিয়ে কাঠের গুঁড়িগুলোর নীচটা দেখালাম, যে, ওখানে কোনো স্ক্রু বা প্রপেলার নেই। ওরা হতবাক হয়ে পড়ল আর হাতের সিগারেটটা নিভিয়ে ফেলে ভেলার দুপাশে কাঠের গুঁড়িগুলোর প্রান্তে গিয়ে বসে পড়ল; এক একদিকে বৈঠা নিয়ে চারজন করে। তক্ষুনি সূর্যটা অস্ত গেল সমুদ্রে, আর দ্বীপের ভেতরের দিক থেকে আরো একবার দমকা বাতাস দিল। দেখাই যাচ্ছিল আমরা এক ইঞ্চিও এগোতে পারিনি। স্থানীয় লোকদুটো ভয় পেয়ে, লাফ দিয়ে ওদের ক্যানোতে উঠে পড়ে বেমালুম উবে গেল। অন্ধকার গাঢ় হয়ে এল আর আরো একবার আমরা একলা হয়ে পড়লাম। প্রাণপনে বৈঠা বাইছিলাম যাতে আবার সমুদ্রের গভীরে ভেসে না যাই।
দ্বীপের ওপর অন্ধকার নেমে এলে প্রাচীরের ওপাশ থেকে চারটে ক্যানো ঢেউয়ে নাচতে নাচতে সামনে এসে পড়ল, আর কয়েকমুহূর্তে ভেলার ওপরে পলিনেশীয়দের ভিড় লেগে গেল। সকলেই হাত মেলায় আর সিগারেট চায়। ভেলায় লোকগুলো থাকায় এবং যেহেতু স্থানীয় হাল-হকিকৎ সবকিছুই ওদের জানা, আর কোনোই ভয় ছিল না। ওরা আর আমাদের সমুদ্রে ভেসে যেতে দেবে না, বা চোখের আড়াল হতে দেবে না আর সন্ধের মধ্যেই আমরা ঠিক ডাঙায় নেমে যেতে পারব!
চটপট কনটিকির সামনের দিকটা দড়ি দিয়ে চারটে ক্যানোয় বেঁধে দেওয়া হল যাতে কাঠের ভেলার সামনে পাখার মতো চারটে শক্তপোক্ত ক্যানো সমুদ্রে ছড়িয়ে থাকল, যেমন স্লেজের সামনে কুকুর বাঁধা থাকে। ন্যুট আমাদের ডিঙিটা নিয়ে ওদের মাঝে ভেসে পড়ল; ক্যানোগুলোর মাঝে ডিঙিটা যেন একটা বিচ্ছিন্ন কুকুরের মতো আর এদিকে আমরা বৈঠা হাতে বাইরের গুঁড়িগুলোয় দুদিকে দুজন করে। এইবার প্রথমবারের মতো পুব বাতাসের সাথে যুদ্ধ শুরু হল যা এতদিন ধরে আমাদের পেছনে থেকে আমাদের সাহায্যই করে এসেছে।
যতক্ষণ না চাঁদ উঠল, ততক্ষণ নিকষ অন্ধকার, আর আবার নতুন করে বাতাস বইতে আরম্ভ করল। পাড়ে, গ্রামের বাসিন্দারা কাঠকুটো জড়ো করে বড়ো একটা আগুন করেছে যাতে আমরা প্রবালপ্রাচীরের ফাঁকটা বুঝে সেদিকে এগোতে পারি। প্রবালপ্রাচীরের ওপর ঢেউয়ের মাতামাতি অন্ধকারের মাঝে আমাদের ঘিরে রয়েছে এখন, যেন কোনো অবিশ্রান্ত জলপ্রপাতের মধ্যে রয়েছি আমরা আর ক্রমশ আওয়াজটা আরও আরও প্রবল হয়ে উঠছে।
যারা আমাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছিল ক্যানোয় বসা সেই দলটাকে অন্ধকারের মধ্যে দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল না কিন্তু ওদের গলা ফাটিয়ে গাওয়া পলিনেশীয় যুদ্ধের গান আমাদের কানে আসছিল। আমরা জানতাম ন্যুটও আছে ওদের মধ্যে, পলিনেশীয় গানের আওয়াজ মাঝে মাঝে কমে এলে পলিনেশীয়দের কোরাসের মধ্যে আমরা ন্যুটের একলার গলা পাচ্ছিলাম, নরওয়ের পল্লিগীতি গাইছিল ও। চেঁচামেচিটা সম্পূর্ণ করতে আমরা ভেলার ওপর থেকে “টম ব্রাউনের ছেলের নাকের ডগায় ফোঁড়া ছিল” গানটা ধরলাম আর সাদা এবং বাদামি চামড়ার দুদলই হাসি গানের মধ্যেই জোরদার বৈঠা বাইছিল।
আমরা দারুণ উজ্জীবিত ছিলাম। সাতানব্বই দিন। পলিনেশীয়াতে পৌঁছেছি। গ্রামে সেসন্ধ্যায় ভোজ হবে। স্থানীয়রা উল্লাসে চিৎকার করে বৈঠা বাইছিল। আঙ্গাটাউতে বছরে একবারই মালপত্র নামে যখন মালবাহী নৌকো কোপরা-স্কুনার তাহিতি থেকে নারকেলের শাঁস নিতে আসে। সুতরাং সেসন্ধ্যায় আগুন ঘিরে খানাপিনা তো হবেই হবে।
কিন্তু রাগী বাতাস অবাধ্যের মতো বইছিল। আমরা শরীরের শেষ শক্তি নিংড়ে লড়ছিলাম। জমি আঁকড়ে ছিলাম, কিন্তু আগুনটা একটুও কাছাকাছি এল না, প্রবাল প্রাচীরে ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ আগের মতোই রইল। গান ক্রমে থেমে গেল। সবকিছু স্থির হয়ে এল। এই অবস্থায় আরও যদি কিছু করার থাকে তা হল কেবল বৈঠা বাওয়া। আগুনটা একটুও সরল না, সাগরের ঢেউয়ে ওঠানামার সঙ্গে সঙ্গে শুধু ওপরে নীচে হতে থাকল। তিন ঘণ্টা কেটে গেল, প্রায় নটা বাজে। আমরা ক্রমে হাল ছেড়ে দিতে থাকলাম। ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম।
স্থানীয়দের বোঝালাম যে আরো লোক দরকার। ওরা বলল পাড়ে অনেক লোক আছে বটে কিন্তু গোটা দ্বীপে সাগর বাওয়ার নৌকো মোটে চারটেই।
এমন সময় অন্ধকারের মধ্য থেকে ডিঙি নিয়ে ন্যুট আবির্ভুত হল। ও একটা উপায় বাতলালো। ও রাবারের ডিঙি বেয়ে ভেতরে গিয়ে আরো লোক আনতে পারে। খুব দরকারে একেকবারে পাঁচ ছজন লোক গাদাগাদি করে ডিঙিতে বসতে পারে।
এটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। ন্যুটের কোনো স্থানীয় অভিজ্ঞতা ছিল না। ওই নিকষ কালো অন্ধকারে প্রবাল প্রাচীরের ফাঁক খুঁজে ওর পক্ষে যাওয়া কখনোই সম্ভব হবে না। ও তখন প্রস্তাব দিল স্থানীয়দের সর্দারকে ওর সাথে নিয়ে যাবে, যাতে সে পথ দেখাতে পারে। আমি এটাও খুব নিরাপদ বলে মনে করলাম না। কেননা ওই সরু আর বিপজ্জনক ফাঁক দিয়ে রাবারের বিদঘুটে ডিঙিটা টপকে চালিয়ে নিয়ে যাবার কোনো অভিজ্ঞতা স্থানীয় লোকটার নেই। তবু আমি ন্যুটকে দিয়ে সর্দারকে ডেকে পাঠালাম। সে অন্ধকারে আমাদের অনেকটা সামনের দিকে বসে বৈঠা বাইছিল। জানা যাক তার কি মতামত এ-ব্যাপারে। পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে পেছনের দিকে ভেসে যাওয়া আমরা আর ঠেকাতে পারব না।
ন্যুট অন্ধকারে সর্দারের খোঁজে গেল। কিছুক্ষণ পর সর্দারকে নিয়ে ফিরে এল না বলে আমরা দুজনকেই চেঁচিয়ে ডাকলাম কিন্তু কোনো উত্তর পেলাম না, খালি পলিনেশিয়দের খানিক হৈ চৈ শুনলাম। ন্যুট অন্ধকারে মিলিয়ে গিয়েছিল। সেমুহূর্তে বুঝতে পারলাম কী ঘটেছে। হৈ হট্টগোল, চেঁচামেচি, হুড়দুড়ের মাঝে ন্যুট নির্ঘাত বুঝতে ভুল করেছে আর সর্দারের সঙ্গে দাঁড় বেয়ে তীরের দিকে চলে গেছে। আমাদের চেঁচামেচি বৃথা, কেননা ন্যুট এখন যেখানে, সেখানে প্রবাল-প্রাচীরের সমুদ্র-গর্জনে অন্য সব শব্দই চাপা পড়ে যাবে।
আমরা চট করে মর্স ল্যাম্পটা জ্বালালাম, একজন মাস্তুলে উঠে গেল আর সংকেত দিতে থাকল। “ফিরে এসো, ফিরে এসো।”
কিন্তু কেউই ফিরে এল না।
দুজন চলে গেছে আর একজন মাস্তুলে চড়ে সংকেত দিয়ে চলেছে, এঅবস্থায় আমাদের ভেলা পিছিয়েই চলেছে; আমরা বাকিরা সত্যি সত্যিই খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। জলে কাঠের টুকরোর মার্কা ফেলে দিয়ে বোঝা গেল যে আমরা খুব আস্তে আস্তে ভেসে চলেছি বটে কিন্তু নিশ্চিতভাবেই ভুল দিকে। আগুনটা ছোটো হয়ে আসছে, ঢেউ-ভাঙার আওয়াজও কমে আসছে। আর যত দ্বীপের গাছপালার ভিড় থেকে আমরা দূরে সরে আসছি তত নিরবচ্ছিন্ন পুবের বাতাস আরো আরো জোরালোভাবে ভেলায় এসে পড়ছে। এখন আবার আমরা বুঝতে পারলাম, গভীর সমুদ্রে আমাদের যা অবস্থা ছিল এখন ঠিক সেরকম। ক্রমশ বুঝতে পারছিলাম আমাদের সব আশা শেষ – আমরা সমুদ্রের দিকে ভেসে চলেছি। কিন্তু বৈঠা বাওয়া থামালে চলবে না। পেছনদিকে ভেসে চলে যাওয়া আটকাতে সর্বশক্তি দিয়ে এটা আমাদের করতেই হবে, অন্তত ন্যুট নিরাপদে ফিরে আসা অবধি।
পাঁচ মিনিট গেল। দশ মিনিট। আধ ঘণ্টা। আগুনটা আরো ছোটো হয়ে এল; ঢেউয়ের তলার দিকে পড়ে গেলে মাঝে মাঝে সেটা অদৃশ্যও হয়ে যাচ্ছে। ঢেউভাঙার শব্দ এখন প্রায় মৃদু গুঞ্জনে এসে ঠেকেছে। চাঁদ উঠল, পাম জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে আমরা তার আভাস দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু আকাশে খানিকটা মেঘ আছে আর বেশ ঘোলাটে। শুনলাম স্থানীয়রা গুনগুন করে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। হঠাৎ খেয়াল করলাম একটা ক্যানো দড়ি খুলে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। অন্য তিনটে ক্যানোর লোকগুলোও খুব পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিল, ভয়ও পেয়েছিল, সেভাবে জোর দিয়ে টানছিলও না। কনটিকি খোলা সমুদ্রের দিকে ভেসেই চলল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্য তিনটে দড়ি ঢিলে হল আর তিনটে ক্যানোই ভেলায় এসে ভিড়ল। একজন ওপরে উঠে এসে শান্তভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
“ইয়ুটা(ডাঙার দিকে)”
খুব উদ্বিগ্ন হয়ে ও আগুনটা দেখালো, এখন আর একটানা বহুক্ষণ ধরে ওটাকে দেখা যাচ্ছে না, কেবল কখনো সখনো দেখা যাচ্ছে, ঝিলিক দিয়ে উঠছে। আমরা দ্রুত ভেসে যাচ্ছিলাম। প্রবালপ্রাচীরে ঢেউভাঙার শব্দ নেই; শুধু সমুদ্রের ওপর ঢেউয়ের শব্দ যেমন হয় তেমন; কনটিকি ভেলায় দড়িতে টান পড়ে ক্যাঁচকোঁচ করছে।
স্থানীয় লোকগুলোকে সিগারেট দিয়ে পাঠানো হল আর আমি তাড়াহুড়ো করে একটা চিরকুট লিখে ওদের সঙ্গে পাঠিয়ে দিলাম, ন্যুটকে খুঁজে পেলে ওকে দেবে বলে। ওতে লেখা ছিল,
“দুজন স্থানীয় লোককে নিয়ে ক্যানোয় ডিঙিটা পেছনে বেঁধে নিয়ে এসো, একলা ডিঙি চড়ে খবরদার এসো না।”
আমরা উপকারী দ্বীপবাসীদের ওপর ভরসা রেখেছিলাম ওরা ন্যুটকে ক্যানোয় চড়িয়ে আনবে নিশ্চই, আদৌ যদি ওরা সমুদ্রে নামতে পারে। ওরা যদি সেটা উচিত না মনে করে তাহলে ন্যুটের পক্ষে একলা ডিঙি বেয়ে সাগরে ভেসে যাওয়া ভেলাটাকে ধরে ফেলার আশা করা পাগলামিরই নামান্তর হবে।
স্থানীয় লোকেরা চিরকুটটা নিল, লাফ দিয়ে ক্যানোয় উঠল আর অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল। শেষ যেটা শুনলাম, সেটা অন্ধকারের মধ্যে থেকে আমাদের প্রথম বন্ধুটির তীক্ষ্ণ গলার স্বর, বিনীত ভাবে সে বলল,
“শুভ রাত্রি।”
অমার্জিত আধাআধি ভাষায় কয়েকটা বিড়বিড় করা তারিফ শোনা গেল, ব্যস তারপরেই সব চুপচাপ, কোনো শব্দ নেই, যেমনটা ডাঙা থেকে ২০০০ মাইল দূরে থাকার সময় ছিল।
এত জোরালো বাতাসে বৈঠা দিয়ে আমাদের চারজনের পক্ষে খোলা সমুদ্রে কিছু করা নিরর্থক তবুও আমরা মাস্তুল থেকে আলোর সংকেত দেখাতে থাকলাম। “ফিরে এসো” এই সংকেতটা ভয়ে ভয়ে আর পাঠাইনি; এখন নিয়মিত ব্যবধানে কেবল আলোর সংকেত পাঠাতে থাকলাম। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। সম্ভবত আঙ্গাটাউয়ের ওপরে থাকা পুঞ্জমেঘ।
দশটা নাগাদ ন্যুটকে ফিরে পাবার শেষ ক্ষীণ আশাটাও ত্যাগ করলাম। ভেলার কিনারে চুপচাপ বসে বসে কটা বিস্কুট চিবোচ্ছি আর পালা করে মাস্তুলে উঠে আলোর সংকেত দেখাচ্ছি। চওড়া পালটা ছাড়া, খাড়া একটা প্রক্ষিপ্ত অংশের মতো দাঁড়িয়েছিল ওটা।
ঠিক করলাম আলোর সংকেতটা সারা রাত ধরেই পাঠানো হবে, যতক্ষণ না ন্যুট কোথায় সেটা জানতে পারছি। মানতেই পারছি না ও প্রবাল প্রাচীরের প্রবল ঢেউয়ে তলিয়ে গেছে। ন্যুট বরাবরই বিপদের মুখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা সে অগাধ জলই হোক কি প্রবল ঢেউ; ও বেঁচেবর্তে আছেই। কেবল বিচ্ছিরি ব্যাপারটা হল প্রশান্তমহাসাগরের একটা একটেরে দ্বীপে পলিনেশীয়দের মাঝে ওর আটকে পড়াটা। একটা জঘন্য ব্যাপার! এতখানি পথ উজিয়ে এসে শেষমেষ আমরা বিচ্ছিন্ন দক্ষিণসাগরের একটা দ্বীপে একটু খোঁচা মেরে একটা লোককে নামিয়ে আবার ভেসে চলেছি। প্রথম পলিনেশীয় লোকটি হাসি হাসি মুখে ভেলায় আসতে না আসতেই ওরা তড়িঘড়ি পালিয়েও গিয়েছিল পাছে কনটিকির বন্য এবং অনিয়ন্ত্রিত পশ্চিমে ভেসে যাওয়ার মধ্যে আটকে পড়ে যায়। একেবারে দুর্ভাগ্যজনক অবস্থা। দড়িগুলোও ভয়ঙ্করভাবে ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ করছিল সেরাতে। আমাদের কারোর চোখেই ঘুমের চিহ্ন ছিল না।
ক্রমশ