আগের পর্বগুলো
আগের কথা
কীভাবে মানুষেরা এসে পৌঁছলো এই দক্ষিণ সাগরের দ্বীপগুলোতে তা নিয়ে নানান মতবাদ চালু ছিল, কিন্তু কোনোটাই জুৎসই আর জোরালো ভাবে প্রমানিত হয়নি। থর হেয়ারডাল এইবারে উঠে পড়ে লাগলেন। নিজের গবেষণার জন্য সংগৃহীত যাকিছু সব কিছু যাদুঘরে দান করে দিলেন। মা বাবা তো বটেই বন্ধুরাও অবাক হল। কিন্তু তিনি লক্ষে স্থির। পরবর্তী সময়ে চলল পড়াশোনা আর তথ্য সংগ্রহ। ক্রমশ জোরালো হয়ে উঠছিল বিশ্বাসের ভিত। মনোযোগ কেড়ে নিল ইনকাদের প্রাচীন কাহিনী। মিলে গেল দেবতা “টিকি”-র হদিশ। পেরু-র প্রধান সূর্যদেবতা আর দ্বীপভূমির সূর্যদেবতায়, শেষমেষ দেখা গেল, কোনো প্রভেদ নেই। এসব তথ্য জমা হতে হতেই লেগে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
(৩)
একটি অভিযানের শুরু
তো শুরুটা করে দিল বৃদ্ধ টেটুই, দক্ষিণ সাগরের এক নির্জন দ্বীপে আগুনের পাড়ে বসে স্রেফ উস্কে দিল ব্যাপারটা। আর তার বেশ কয়েক বছর বাদে আমি নিউ ইয়র্কের এক যাদুঘরের ওপরতলায় আরেক বৃদ্ধের অন্ধকার অফিসঘরে বসে।
আমাদের চারপাশে সুদৃশ্য কাচের শোকেসে প্রাচীনকালের মাটির পাত্রের ভগ্নাবশেষ। যেগুলির সূত্র ধরে হয়তো অতীতের আবছায়ায় পৌঁছনো যায়। দেওয়াল জোড়া বই আর বই। তার কিছু একজন মানুষেরই লেখা আর বড়োজোর দশটি লোকের পড়া। বুড়ো লোকটার এ সমস্ত বইই পড়া, আর কিছু আবার ওনারই লেখা। এই মুহূর্তে আমার উল্টোদিকে সাদা দাড়িওয়ালা রসিক লোকটা নিজের কাজের টেবিলে বসে। কিন্তু এখন বিলক্ষণ মনে হচ্ছে আমি তার পা-খানা মাড়িয়ে দিয়েছি, কেননা যেভাবে চেয়ারের হাতল খামচে ধরে আমার দিকে চাইলেন, যেন তার একলার তাসখেলা ভন্ডুল করে দিলাম সবেমাত্র।
“নাঃ” চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি, “কক্ষণো নয়।”
আমার মনে হল সান্তাক্লজকে কেউ যদি বলত যে পরের ক্রিসমাসটা জুনের চব্বিশে পড়েছে তার মুখের চেহারাটাও অনেকটা এইরকম হত।
“ডাহা ভুল করছ তুমি, এক্কেবারে নিশ্চিতভাবেই ভুল,” মাথা নাড়তে নাড়তে আমার ভাবনাটা উড়িয়ে দিলেন তিনি।
“কিন্তু আপনি তো এখনো আমার যুক্তিগুলো পড়েও দেখেননি!” আমি টেবিলের ওপর আমার পান্ডুলিপিটার দিকে দেখালাম।
“যুক্তি-তক্কো!” আবার বললেন তিনি, “একটা নৃতাত্ত্বিক সমস্যাকে গোয়েন্দা গল্পের সমস্যা সমাধান পেয়েছ?”
“কেন নয়?” আমি পাল্টা বলে উঠি, “ আমি আমার সমস্ত সিদ্ধান্ত নিজস্ব পর্যবেক্ষণ আর বৈজ্ঞানিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই নিয়েছি।”
“বিজ্ঞানের কাজ স্রেফ অনুসন্ধান, ব্যস, সোজা সাপটা,” ঠান্ডা মাথায় যোগ করেন ভদ্রলোক, “ওসব এটা সেটা প্রমাণ করে বেড়ানো তার কাজ নয়!” না পড়া পান্ডুলিপিটা একপাশে সরিয়ে দিয়ে টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়েন উনি।
“এটা সত্যি যে দক্ষিণ আমেরিকাতে কিছু প্রাচীন আশ্চর্য সভ্যতা ছিল, কিন্তু তাদের সম্বন্ধে আমরা প্রায় কিছুই জানি না; তারা কারা, আর ইনকারা ক্ষমতায় আসার পর তারা উবেই বা গেল কোথায়? কিন্তু একটা কথা আমরা নিশ্চিত করেই জানি যে এদের মধ্যে কেউই দক্ষিণ আমেরিকা থেকে উজিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপে আসেনি।”
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু খুঁজছিলেন ভদ্রলোক, “কেন জানো? খুব সহজ কথা। তারা ওখানে পৌঁছতেই পারত না। তাদের কোনো নৌকোই ছিল না।”
“কিন্তু ভেলা ছিল তাদের,” আমি বাধা দিয়ে ইতস্তত করে বলি, “আপনি তো বালসা কাঠের ভেলার কথা জানেন।”
বুড়ো হাসলেন, তারপর শান্তস্বরে বললেন, “ভালো। পেরু থেকে একবার তাহলে ভেলায় চেপে প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপে পৌঁছনোর চেষ্টা করেই দ্যাখ!”
কী বলব ভেবে পেলাম না। দেরি হয়ে যাচ্ছিল। দুজনেই, অতএব, উঠে পড়লাম। অগ্রজ বৈজ্ঞানিকটি আমার পিঠ চাপড়ে দিলেন আর বল্লেন, প্রয়োজনে যেন তাঁর কাছেই আসি। আর হ্যাঁ, ভবিষ্যতে হয় পলিনেশিয়া অথবা আমেরিকা এই দুটোর একটার ওপর গবেষণা চালাই, দুটো নৃতাত্বিক জায়গাকে একত্রে মিশিয়ে নয়। ভদ্রলোক আবার নিজের টেবিলে ফিরে গেলেন।
“এটা ভুলে যেও না,” উনি আমার পান্ডুলিপিটা বাড়িয়ে দিলেন। আমি তাকিয়ে দেখলাম আমার লেখার শিরোনামটির দিকে, “পলিনেশিয়া এবং আমেরিকা – একটি প্রাগৈতিহাসিক সম্পর্ক।” পান্ডুলিপি বগলে খটাখট সিঁড়ি বেয়ে নেমে দ্রুত বাইরের রাস্তার ভিড়ে মিশে গেলাম।
সেই সন্ধ্যায় গ্রিনিচ ভিলেজের একপ্রান্তে একটা ফ্ল্যাটবাড়ির দরজায় গিয়ে টোকা দিলাম। যখনই গোলমেলে সমস্যায় ঘেঁটে গেছি, এখানেই এসেছি। বেঁটে গোলগাল লম্বা নাকের লোকটা দরজা অল্প ফাঁক করে আমায় দেখে একগাল হাসি হেসে দরজা হাট করে খুলে আমায় ভেতরে ডেকে নিল। তারপর আমায় নিয়ে সোজা ওর ছোট্ট রান্নাঘরে। যথারীতি থালা, বাটি, চামচ, এসব বাসনপত্র এগিয়ে দেবার কাজে জুটে গেলাম। ও ততক্ষনে গ্যাসের উনুনে যেটা ফুটছিল, জানি না সেটা কী তবে চমৎকার গন্ধ বেরোচ্ছিল, তার পরিমাণটা দ্বিগুণ করে দিল।
“ভালো করেছ চলে এসেছ। তারপর, কী খবর?”
“আর খবর! কেউই পান্ডুলিপিটা পড়তে রাজি নয়।”
ইতিমধ্যে ও খাবার বেড়ে নিল। আমরা খেতে শুরু করলাম।
“ব্যাপারটা কী জানো,” ও বলল, “যাদের সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে সবাই ভাবছে এটা তোমার একটা স্রেফ চলতি ভাবনা ছাড়া আর কিছু নয়। আমেরিকাতে লোকে কতরকম উদ্ভট ভাবনা নিয়ে আসে জানো?”
“আমারটাও তেমনি, তাই তো!” আমি বলি।
“ঠিক তাই,” ও বলে, “তোমার ধরণটাই তো অমনি। আরে বাবা তেনারা সক্কলে বিশেষজ্ঞ! সব্বাই। আর তাঁরা কেউই এরকম কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বিশ্বাসই করেন না যাতে উদ্ভিদবিদ্যা থেকে শুরু করে নৃতত্বের তত্ত্ব একযোগে কাজে লাগানো যায়। তারা কেবল নিজেদের সীমার মধ্যে আরো গভীর অনুসন্ধানের পক্ষে, আরো বেশি মনোযোগী, যাতে অনেক তথ্য উঠে আসে। আধুনিক গবেষণা চায় যে প্রত্যেক বিষয় তার নিজের পরিসরেই খননকার্য চালাক। নিজের নিজের গর্ত থেকে বেরিয়ে সব বিষয়কে একত্রে নিয়ে কাজ করাটা তো আধুনিকতার নিরিখে অস্বাভাবিক, তাই না?’
ও উঠে একটা তাড়া কাগজের পান্ডুলিপি নিয়ে এলো, “দ্যাখো! আমার শেষ কাজ এটা। চীনদেশীয় কুটিরশিল্পের এমব্রয়ডারির১ পাখিদের নকশা নিয়ে। সাত বছর লেগেছে ঠিকই, কিন্তু প্রকাশের জন্য মনোনীত হল তৎক্ষণাৎ। সকলেই এখন নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ের ওপর গবেষণাই চায়।’’
কার্লই ঠিক। কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগরের এই সমস্যাটাকে চারদিক থেকে আলো ফেলে না দেখলে, ব্যাপারটা ঠিক হবে না, অন্তত আমার কাছে তো সেটা একরঙের টুকরো দিয়ে ছবি-ধাঁধা সমাধান করার সমান হবে। টেবিল পরিষ্কার করে আমি বাসন ধোয়ার কাজে হাত লাগালাম।
“শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় কিছু জানাল?”
“নাঃ।”
“কিন্তু তোমার পুরোনো বন্ধু, ওই যে মিউজিয়ামে, সে কী বললে?”
“সেও তেমন গা করল না। উলটে আমাকে বলল যে যেহেতু ইন্ডিয়ানদের কেবলমাত্র ভেলাই ছিল সুতরাং তারা প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলো আবিষ্কার করেছে এমন ভাবাটা খুবই কষ্টকল্পনা।”
কার্ল হঠাৎ ক্ষেপে উঠল। খুব জোরে জোরে বাসনগুলো ধুতে আরম্ভ করল, “হ্যাঁ। সত্যি বলতে কী তোমার তত্ত্বের বিরুদ্ধে আমারও ওই একই মত।”
আমি মুষড়েই পড়লাম কার্যত, কেননা এই ছোটোখাটো নৃতাত্বিক ভদ্রলোকটিই আমার একমাত্র ভরসার জায়গা ছিল।
“আমায় ভুল বুঝো না”, কার্ল বলে চলে, “একদিক থেকে দেখলে তুমি ঠিকই বলছ মনে হয়, কিন্তু অন্যদিক থেকে এত অসম্ভব! নক্সার ওপর আমার কাজটা কিন্তু তোমার তত্ত্বকেই সমর্থন করে।”
“কার্ল!” আবারও আমি মুখ খুলি, “আমি নিশ্চিত যে ইন্ডিয়ানরা ভেলায় চড়ে প্রশান্ত মহাসাগর পার হয়েছিল। আর সেই কারণে আমি একইরকম একটা ভেলা তৈরি করে সাগর পাড়ি দেব ঠিক করেছি, তাতেই প্রমাণ হবে যে এমনটা সম্ভব।”
“তুমি পাগল!”
আমার বন্ধু ব্যাপারটাকে ঠাট্টা ভেবে খুব হাসতে থাকল, খানিকটা ব্যোমকেও গেছিল আমার এরকম ভাবনা-চিন্তায়।
“পাগল তুমি! ভেলায় চড়ে?”
কার্ল ভেবে পেল না কী বলবে। অদ্ভুত জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। ভাবছিল আমি হেসে বলব, হ্যাঁ সত্যি সত্যিই ঠাট্টা করছি।
কিন্তু তা হল না। আমি স্পষ্ট দেখছিলাম আমার তত্ত্বটাকে বাস্তবিক কেউই গ্রহণ করতে পারছিল না তার কারণ পলিনেশিয়া আর পেরুর মাঝের দুস্তর সাগর।আর সেটাকে আমি কি না পার হতে চাইছি একটা প্রাগৈতিহাসিক ভেলায় চড়ে!
প্রসঙ্গ এড়াতে কার্ল বলল, চলো একটু পানশালায় ঘুরে আসা যাক। তো আমরা বেরিয়ে পড়লাম।
————————————–
১ চীনদেশের শিল্প ও সংস্কৃতিতে এমব্রয়ডারির স্থান খুবই বিশিষ্ট। রেশমকীট পালন ও তা থেকে রেশম তৈরির ইতিহাসের সমসাময়িক এই সূচীশিল্প, খৃষ্টজন্মেরও প্রায় পাঁচহাজার বছর আগে। বিভিন্ন রাজতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতায় এর ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন থেকেছে আধুনিক কাল অবধি। চীন দেশের অন্যতম চারিত্রিক ও সামাজিক বৈশিষ্ট হিসেবে একে উল্লেখ করা যায়।
ক্রমশ
জয়ঢাকের খেলা লাইব্রেরিতে এমন অনেক অভিযানের সংগ্রহ