আগের পর্বগুলো
১৩ আগস্ট ২১২৬। পার্থিব সময় সন্ধ্যা আটটা জিএমটি
মনিটর থেকে ভেসে আসা তীক্ষ্ণ শিসের শব্দটা তাঁর ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুলল এবার।
“আর সতেরো ঘন্টা জেমস। বাহিনী…”
“সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে আছে অ্যাডমিরাল। গ্রহাণু বলয়ের এই ইঁদুরের গর্ত ছেড়ে আর তেরো ঘন্টার মধ্যে রওনা হব আমরা। ঠিক সংঘাতমুহূর্তে মঙ্গলের অস্থায়ী পার্থিব হেডকোয়ার্টারে আঘাত হানা হবে। তারপর…”
সামনের পর্দায় হেসে থাকা গোলকটার শরীর প্রায় ছুঁয়ে ফেলা উজ্জ্বল আলোকবিন্দুটা আপাতদৃষ্টিতে স্থির। কিন্তু লালপিওতে জানেন, অবশেষে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্রের অন্তিম আকর্ষণ তাকে আকাশচ্যূত করে পৃথিবীর মহাকর্ষ কুপের দিকে ঠেলে দিয়েছে এইবারে। এইবার তীব্রবেগে একটা দানবিক স্ক্রুয়ের মত পৃথিবীকে ঘিরে ক্ষয়িষ্ণু কক্ষপথে তার শেষ যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। অবশেষে… দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান।
হ্যাঁ। প্রজাতি হিসেবে মানুষের বেশির ভাগটাই শেষ হয়ে যাবে ওতে। কিন্তু তাতে কোনো আক্ষেপ নেই অ্যাডমিরাল লালপিওতের। চাঁদ ও মঙ্গল উপনিবেশ কিংবা ওদের অন্যান্য মহাকাশঘাঁটিগুলোতে এই মুহূর্তে যে মানুষদের সরিয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছে, তাদের মধ্যে এই প্রজাতিকে নতুন করে গড়ে তোলবার সমস্ত উপাদানই মজুত রয়েছে।
আর শেষ পর্যায়ে এসে, মৃত্যু নিশ্চিত জেনে ওদের চালু করা প্রজেক্ট এক্সোডাস তাঁর হাতে তুলে দিয়েছে এ-গ্রহের শ্রেষ্ঠ মানবসম্পদের একটা বড়ো অংশকে। ধ্বংসের পালা শেষ হয়ে গেলে তাদের দিয়েই ফের তিনি গড়ে তুলবেন তাঁর সাম্রাজ্য। তারপর একদিন, সৌরজগত ছেড়ে তাঁর সেনাবাহিনী হয়ত…
“আপনার পাঠানো সিগন্যালগুলোর প্রাথমিক বিশ্লেষণ যন্ত্রগণক শেষ করেছে অ্যাডমিরাল,” হঠাৎ সামনের পর্দায় ভেসে ওঠা গ্রোভারের মুখটা তার চিন্তার সুতোটা ছিঁড়ে দিল, “তবে তা কোনো প্রাকৃতিক রেডিও নয়েজ নয়।”
হঠাৎ মুখটা শক্ত হয়ে উঠল লালপিওতের, “তুমি নিশ্চিত?”
গ্রোভারের মুখে মৃদু একটা হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল ফের, “সাইফার আমার প্রিয় গবেষণার বিষয় ছিল একসময়। আমি নিশ্চিত, সিগন্যালের সংখ্যার সারটা অক্টাডেসিম্যাল ভিত্তিতে দাঁড়ানো দুই বা তিন স্তরীয় কোডিং-এর ফল।”
মাথায় ঝিকিয়ে ওঠা অসংখ্য সম্ভাবনার ভিড়টাকে সযত্নে সরিয়ে দিলেন লালপিওতে। এখন সে নিয়ে ভাববার সময় নেই। যুক্তির কঠিন পথে কেবল পরের ধাপটাকে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে তাঁকে। চিন্তাভাবনাগুলোকে খানিক সাজিয়ে নিয়ে যখন ফের মুখ খুললেন তিনি তখন তাঁর গলায় উত্তেজনার ছিটেফোঁটাও নেই আর, “ডি-কোডিং করতে কত সময় লাগবে তোমার?”
“নির্ভর করছে মূল অক্টাডেসিম্যাল সিরিজটাকে ঠিক কতগুলো স্তরে রি-কোডিং করা হয়েছে ও কোন স্তরে কী পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে তার ওপর। প্রাথমিক বিশ্লেষণে এর চরিত্র বুঝতেই প্রায় দু’দিন লেগেছে আমাদের। কাজেই এর অর্থ উদ্ধারের ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে আরো কিছুদিন…”
“আঃ গ্রোভার। অভিজ্ঞতা থেকে আনুমানিক একটা সময় বলতে পারবে কি?”
একটুক্ষণ চুপ করে থাকলেন গ্রোভার। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, “দুঃখিত অ্যাডমিরাল। আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী গণককে কাজে লাগালেও অন্তত কয়েকদিন সময় আমার এতে লাগবেই। এর চেয়ে নিখুঁত পূর্বাভাষ দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু এখন ধাঁধার উত্তর খোঁজবার সময় নয় অ্যাডমিরাল। আগে মিশন সম্পূর্ণ হোক, তারপর না হয়… ”
পাথরের মত স্থির মুখে তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন অ্যাডমিরাল লালপিওতে। গ্রোভারের কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বললেন, “সংকেতটার উৎস বলো গ্রোভার।”
“ভুসমলয় কক্ষপথ মাইনাস ১২৭ দ্রাঘিমা। কিন্তু…”
“এখান থেকে সর্বোচ্চ গতিতে ওখানে পৌঁছোতে কত সময় নেবে?”
“আমাদের সর্বোচ্চ গতির যান আপনার ব্যক্তিগত ফ্রিগেট মিসিয়ারি। তাতে অন্তত ছ’ঘন্টা সময় লাগবে। কিন্তু…”
“বেশ। চল্লিশজন কম্যান্ডোর একটা দল নিয়ে তুমি ঠিক আধঘন্টার মধ্যে এই যানের দু’নম্বর এয়ারলক-এ মিসিয়ারি যুদ্ধযানে পৌঁছাবে।”
হঠাৎ আসন ছেড়ে তার পাশে এসে দাঁড়ালেন জেমস আরিয়ানা, “অ্যাডমিরাল লালপিওতে, নির্দিষ্ট সময়ের আগে আত্মগোপনের জায়গা ছেড়ে একটা যান কেন এভাবে…”
পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে গণকের ফিঙ্গারপ্যাডে নিজের আঙুলগুলো ছুঁইয়ে নিলেন লালপিওতে। তারপর সেখানে ভেসে ওঠা ফাঁকা জায়গাটায় দ্রুত কিছু সংকেত টাইপ করতে করতেই জবাব দিলেন, “ষষ্ঠেন্দ্রিয় জেমস। দীর্ঘকাল ধরে পৃথিবীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছি আমি। আমার মন বলছে এটা কোনো অঘটন নয়। এখানকার মিশনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব আপনি নেবেন এবারে। আমি কমপিউটারে কর্তৃত্ব বদলের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছি।”
“তুমি…”
“আমি নিজে ওখানে যাব জেমস। শেষ পার্থিব যানটা উৎক্ষেপণের সময় পরপর দুটো সঙ্কেত ওখান থেকে পৃথিবীর দিকে পাঠানো হয়েছে। তার মধ্যে দ্বিতীয়টা ওদের যান ধ্বংস হবার বেশ কিছুক্ষণ পরে। আমার মন বলছে, সত্যব্রত বোসের আস্তিনের শেষ তাসটা এইবার খেলা হয়েছে ওখানে।”
*****
“টাইমার চালু কর টাইকো।”
“কতক্ষণ সময় দিতে চান?”
মাইনাস ১২৭ দ্রাঘিমার ভুসমলয় কক্ষপথ ছেড়ে থ্রাস্টারের তীব্র ধাক্কায় পৃথিবীর অভিকর্ষ কূপের আরও গহনে তলিয়ে যাচ্ছিল কার্তাং। তার তাপপ্রতিরোধক আবরণ আস্তে আস্তে গণগণে হয়ে উঠছিল ক্রমশ ঘন হয়ে ওঠা বায়ুমণ্ডলের ঘষায়।
“মাইনাস ১২৭ দ্রাঘিমায় মিসিয়ারির পৌঁছোবার আনুমানিক সময় বল।”
পর্দায় টাইকোর মুখটা ভাবলেশহীনভাবে ঝুলে আছে। একটুক্ষণ থেমে থেকে সে জবাব দিল, “ওরা গ্রহাণু বলয় ছেড়ে রওনা হয়েছে ছ’ঘন্টা আগে। আমার হিসেবমত আর ঠিক একঘন্টা।”
“সেক্ষেত্রে ধরে নেয়া যায়, ওখানে ছেড়ে আসা রেডিও বিকন লাগানো পাথরের টুকরোটা দেখে ওরা প্রথমে সাবধান হবে। তারপর ধীরে ধীরে ওটার কাছে এগোবে পরীক্ষা করবার জন্য। আনুমানিক কতটা সময় তাতে লাগতে পারে টাইকো?”
পর্দায় ভেসে থাকা অতিকায় কুকুরের ছবিটা ফের একবার তার দু-পায়ের থাবায় মুখ গুঁজল। কা-পোন সেদিকে তাকিয়ে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছিলেন। ওই ছবিটার পেছনে আত্মগোপন করে থাকা অতিকায় যন্ত্রমস্তিষ্ক মানুষের চিন্তার চেয়েও দ্রুতগতিতে সম্ভাবনাতত্ত্বের অসংখ্য চলরাশিকে বিশ্লেষণ করে গড়ে নিতে পারে যেকোন পূর্বাভাষ মডেল। চোরাচালানকারীর অনিশ্চয়তা ভরা জীবনে সম্ভাব্য পূর্বাভাষের এই জুয়ায় বহুবারই কা-পোনকে জিতিয়ে এসেছে টাইকো।
সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎ মুখে একটা মৃদু হাসি খেলে গেল কা-পোনের। অদৃষ্টের পরিহাসে, আজ বাঁচবার জন্য পৃথিবীর শেষ ভরসা হয়ে উঠেছে এক চোরাচালানকারির যানের যন্ত্রমস্তিষ্ক আর তার পূর্বাভাষের আলগরিদম।
“অন্তত এক ঘন্টা। সম্ভাবনা শতকরা আশি ভাগ।”
“আরো একটু বেশি সময় দাও। এখন থেকে ঠিক আড়াই ঘন্টা ব্যবধানে ডিটোনেশন পয়েন্ট স্থির করো।”
“যো হুকুম।”
প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের দিকে ছুটন্ত কার্তাং থেকে ধেয়ে গেল একটা বেতার সঙ্কেত। তার লক্ষ্য মাইনাস ১২৭ দ্রাঘিমার ভুসমলয় কক্ষপথে কার্তাং-এর ছেড়ে আসা পাথরের টুকরোটার গায়ে আটকানো যন্ত্রটার গ্রাহক মডিউল। সযত্নে ঢেকে রাখা ছোট্টো যন্ত্রটাকে দেখলে দূর থেকে পাথরেরই অংশ বলে ভুল হয়। তবে সেই ছদ্মবেশের আড়ালে তখন সেই সংকেত পেয়ে জেগে উঠেছে একটা বিস্ফোরকের টাইমার। বিস্ফোরকটার শক্তি খুব কম, কিন্তু দুখণ্ড বিশুদ্ধ প্লুটোনিয়ামের পিন্ডের মাঝখানের রক্ষা আবরণকে গুঁড়িয়ে দিয়ে মুহূর্তে তাকে বিস্ফোরক সংকট ভরে পৌঁছে দেবার জন্য সেটুকু শক্তিই যথেষ্ট।
*****
“ক্রিস…ক্রিস্টোফার…”
ঠোঁটদুটো থরথর করে কাঁপছিল এলেনার। নির্জন হ্যাঙারের অন্ধকারে এতক্ষণে চোখ সয়ে এসেছে তার। আবছা আলোয় শুয়ে থাকা শরীরটার ওপর ঝুঁকে পড়ে বারবার তাকে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগাবার চেষ্টা করতেকরতে শরীরটার ওপরেই হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। এইবারে একেবারে একা হয়ে গিয়েছে সে। গত কয়েকদিন ধরে স্নায়ুর ওপর চলতে থাকা ঝড়কে আর সে বইতে পারে না।
“এলেনা…”
হঠাৎ কানের কাছে হালকা একটা শব্দ জেগে উঠল তার।”
“ক্রিস!! তুমি…”
“ক্রিস নয় এলেনা। আমি জিষ্ণু। প্রফেসর সত্যব্রত বোস-এর ছেলে জিষ্ণু বোস।”
হঠাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত তাকে ছেড়ে ছিটকে সরে এল এলেনা। গলাটা বদলে গেছে ক্রিসের। বদলে গেছে তার সামনে আস্তে আস্তে উঠে বসতে থাকা ছেলেটার শরীরের ভাষাও। আর… ওর বলা ওই নামটা…”
“স-সত্যব্রত বোস! দ্য গ্রেট মার্টার অব দ্য ডেসট্রয়েড একাঘ্নি প্রজেক্ট! তুমি…”
“ডেস্ট্রয়েড, হ্যাঁ। শহীদ তাও সত্যি,” জিষ্ণুর গলায় ক্লান্তির ছাপ ছিল, “কিন্তু একাঘ্নি মরেনি এলেনা। আমাদের শেষ আশা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। “সাড়ে আঠাশ ডিগ্রি উত্তর—পঁচানব্বই ডিগ্রি পূর্ব। হ্যাঁ সেখানেই সব রহস্যের উৎস রয়েছে। আমাদের সেখানে পৌঁছোতে হবে। আঘাতমুহূর্তের অন্তত কয়েকঘন্টা আগে।”
“সাড়ে আঠাশ ডিগ্রি উত্তর—পঁচানব্বই ডিগ্রি পূর্ব!” নিজের মনেই বিড়বিড় করছিল এলেনা, “তার মানে অরুণাচল প্রদেশের ভেতরে!” হঠাৎ করেই একটা অবুঝ আশা ফের জেগে উঠেছে তার বুকের ভেতর।
কিন্তু পরমুহূর্তেই আশার আলোটুকু ফের নিভে গেল তার, “কিন্তু কী করে? আমাদের কাছে কোনো…”
“যান নেই। কিন্তু ভেবো না এলেনা। কা পোন সংকেত যখন পাঠিয়েছেন তখন…” বলতেবলতেই বাইরের দিকে তাকিয়ে তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল হঠাৎ, “তৈরি হও এলেনা। কা পোন আসছেন।”
সেখানে স্পেসপোর্টের আকাশের গায়ে তখন অন্ধকার ছিঁড়েখুঁড়ে দ্রুত ধেয়ে আসছিল একটা জ্বলন্ত আগুনের বিন্দু।
ক্রমশ
গ্রাফিক্স্- ইন্দ্রশেখর