অন্তিম অভিযান আগের পর্বগুলো
“লক্ষ্যবস্তু রেডারে ধরা পড়েছে অ্যাডমিরাল।”
“যার যার আসনে ফিরে যাও। আমরা থামছি,” বলতে বলতেই পাইলটিং পর্দার সামনে আঙুলের একটা জটিল মুদ্রা গড়ে তুললেন অ্যাডমিরাল লালপিওতে। ইশারা পেয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই থেমে গেছে মিসিয়ারির পেছনের জোড়া ইঞ্জিন। তার শরীরের সামনের দিকে বিভিন্ন জায়গায় লাগানো থ্রাস্টারগুলোর সম্মিলিত জেট, মুহূর্তের মধ্যে থামিয়ে আনছিল তার অকল্পনীয় সম্মুখগতিকে। তীব্র গতিজাড্যের চাপে আসনের সঙ্গে পিষে যাচ্ছিল যানের সৈনিকদের শরীর।
“দূরত্ব?”
“দশ হাজার মাইল।”
“শক্তিচিহ্ন?”
“শূন্য।কাছাকাছি এলাকায় হালকা প্লাজমাস্রোতের স্বাক্ষর রয়েছে তবে তা একেবারেই নগণ্য। প্রাকৃতিক হতে পারে। কেবল নির্দিষ্ট সময় পর পর দুর্বল একটা বেতারসঙ্কেত ছাড়া…আশ্চর্য…”
“কী?”
“এ-এটা একটা পোলারাইজড সিগন্যাল অ্যাডমিরাল।”
হঠাৎ লালপিওতের ভ্রুদুটো কুঁচকে উঠল সামান্য। পোলারাইজড সঙ্কেত সাধারণত একটা নির্দিষ্ট দিকে প্রবাহিত হয়। অন্য কোনো অঞ্চল থেকে তার অস্তিত্ব টের পাওয়া কঠিন। তাহলে…
“অভিমুখ?”
“আ-আমরা অ্যাডমিরাল। সরাসরি আমাদের যানকে লক্ষ্য করে ছুটে আসছে ওই পাথরে টুকরো থেকে ভেসে আসা বেতার সঙ্কেতগুলো।”
“অসম্ভব। কোনো ভুল…” বলতে বলতেই কী মনে হতে নিয়ন্ত্রক গণকের ক্যামেরার সামনে ফের একটা সঙ্কেত করলেন লালপিওতে। যানের বাঁদিকের দুটো থ্রাস্টার হঠাৎ জেগে উঠেছে তাঁর ইঙ্গিত পেয়ে। তাদের তীব্র ধাক্কায় ডানদিকে সটান ছিটকে গেল মিসিয়ারি। সামনের মনিটরে ভেসে ওঠা সংখ্যাগুলো দ্রুত বদলে যাচ্ছিল। মিসিয়ারির সরণের পরিমাণ মেপে চলেছে তা।
প্রায় একশো মাইল ডানদিকে সরে গিয়ে ফের স্থির হল মিসিয়ারি। প্রায় পাশে বসা সামিরা রেড্ডির দিকে ফিরে লালপিওতে বললেন, “রিডিংস্?”
“এ অ-অসম্ভব! সঙ্কেতটা দিক বদলে ফের আমাদের দিকেই ধেয়ে আসছে অ্যাডমিরাল। অথচ আমি নিশ্চিত এটা একটা পোলারাইজড বিম!!”
হাতের ইশারায় ইঞ্জিন থামিয়ে দিলেন লালপিওতে। তাঁর ভ্রূদুটো একটা গিঁট পাকিয়ে উঠেছে কপালে। দ্রুত চিন্তা করছিলেন তিনি। পৃথিবীর ভূসমলয় কক্ষপথের যে অবস্থান থেকে পৃথিবীমুখী রহস্যময় সঙ্কেতগুলো ছুটে গিয়েছিল, সেই অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসছে একটা লক্ষ্যসন্ধানী রেডিও তরঙ্গ। তাঁর যানের প্লাজমা সিগনেচারের সঙ্গে এক সুরে বাঁধা থেকে তা অনুররণ করে চলেছে তাঁর যানকেই। কী করে তা সম্ভব?
যানের টেলিস্কোপ তখন বস্তুটার একটা আবছা ছবি গড়ে তুলছে তাঁর সামনের পর্দায়। একটা পাঁচ মিটারের কাছাকাছি ব্যাসের পাথরের টুকরো!
“আদেশ পেলে এখান থেকেই ওটাকে…”
“না সামিরা,” মৃদু মাথা নেড়ে কম্যান্ডো দলের প্রধান সামিরা রেড্ডিকে থামিয়ে দিলেন লালপিওতে, “ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে নিতে হবে প্রথমে। অজানা একটা বস্তু। তার সাহায্যে মিসিয়ারিকে লোভ দেখিয়ে কেউ টেনে এনেছে এখানে। কাছাকাছি এসে পৌঁছুলে তার লক্ষ্যসন্ধানী পোলারাইজড বিম-এর বিষয়টা যে-কোনো যানের নজরে পড়বেই এটা একেবারেই সাধারণ সত্য। তার মানে, ধরে নিতে হবে, যে সেটা রেখেছে তার উদ্দেশ্যই ছিল কাছাকাছি এসে পৌঁছোবার পর মিসিয়ারি বিষয়টা যাতে টের পায়।”
“কিন্তু এমন অযৌক্তিক কাজ…আমি এর কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছি না অ্যাডমিরাল।”
মেয়েটি তরুণ। এখনও যুদ্ধ তার কাছে অ্যাড্রিনালিনের ধাক্কায় হত্যা আর আগুনবৃষ্টির একটা উৎসব ছাড়া আর কিছু নয়। উৎসুক মুখটার দিকে তাকিয়ে একবার নিজের মনেই মাথা নাড়লেন লালপিওতে। একদিন তিনি নিজেও অমন ছিলেন। উৎসাহী, অনভিজ্ঞ এক তরুণ তুর্কি।
কিন্তু অভিজ্ঞতা তাঁকে শিখিয়েছে, যুদ্ধ একটা দাবাখেলার মতন। অস্ত্রের জোরের পাশাপাশি, শত্রুর চালকে কে কতটা অগ্রিম পড়ে নিতে পারে তার ওপর হারজিত নির্ভর করে। শত্রুর চিন্তাস্রোতকে সফলভাবে অনুসরণ করতে পারাই একজন অ্যাডমিরালকে যুদ্ধে জয়ের পথ দেখায়।
“ভাবো সামিরা। শত্রুকে ছোটো করে দেখো না। বিকনটা এখানে যে-ই রেখে থাকুক, পৃথিবীর দিকে রহস্যময় সিগন্যালদুটোও সে-ই এখান থেকে পাঠিয়েছে সেটা অনুমান করে নেয়া যায়। কিন্তু তারপর, কেন সে এই টোপটা রেখে গেল এখানে? মিসিয়ারি টের পাবার পর কী পদক্ষেপ সে নিতে পারে বলে আন্দাজ করেছে অজানা শত্রু? এক্ষেত্রে সবচেয়ে যুক্তিগ্রাহ্য পথটা হল তোমার প্রস্তাব। গোলা মেরে উড়িয়ে দেয়া জিনিসটাকে। তার অর্থ সে সেটাই চায়। চায় স্বাভাবিক যুক্তিকে ব্যবহার করে আমরা যেন এটাকে ধ্বংস করে দিই। কেন?”
একটুক্ষণ স্থির হয়ে রইল সামিরা। তারপর সামান্য ইতস্তত করে বলল, “পাথরটার সঙ্গে হয়ত এমন কিছু তথ্য রয়ে গেছে যা তাদের এখান থেকে সরে যাবার সময় সঙ্গে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তাই হয়ত…কিন্তু অ্যাডমিরাল, সেক্ষেত্রে ওরা নিজেরাই তো ওটাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে…”
“জানি না সামিরা। এর কাছাকাছি যাওয়া যাক প্রথমে। যুক্তি বলছে, আগে একে কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করা দরকার। হয়ত তাতেই কারণটাও জানা যাবে! তারপর প্রয়োজন হলে…”
অতিকায় পাথরের টুকরোটা নিতান্তই সাধারণ চেহারার। বৈশিষ্ট্যহীন। কোনো ধরণের বিকীরণের চিহ্ন নেই তার শরীরে। মিসিয়ারির যান্ত্রিক হাত তাকে সাবধানে ধরে ঢুকিয়ে আনছিল তার পেটের ভেতর। যানের মাথার নিয়ন্ত্রণকক্ষের পর্দায় তখন তার ছবিটা বিরাট আকার নিয়ে ভাসছে। কমান্ডোদের দলটার একটা অংশ তার শরীর থেকে বিকনটাকে খুলে এনেছে। অন্য একটা বড়ো অংশ আস্তে আস্তে যানের মেঝেতে স্থির হতে থাকা বস্তুটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। তাদের হাতে ধরা যন্ত্রগুলো তখন বস্তুটার অন্দরমহলের খবর নিতে শুরু করেছে।
“বস্তুটা পাথর নয় অ্যাডমিরাল,” নিজের পর্দায় ভসে ওঠা সঙ্কেতগুলোর দিকে ইশারা করছিল সামিরা রেড্ডি। উত্তেজনায় লাল হয়ে উঠেছে তার মুখটা, “কোন একধরণের প্লাস্টিক। থ্রিডি প্রিন্টিং প্রযুক্তিতে তৈরি। সফ্ট এক্স রে-র ছবি আসছে…”
লালপিওতের চোখে সামনে পাথরের টুকরোটার ছায়াছায়া ছবিটার ভেতরে ফুটে উঠছিল একটা ধাতব গোলকের ছবি।
“মেটাল আইডেন্টিফিকেশন?”
“সীসা। আধ মিটার পুরু। নিউট্রিনো রেডিয়েশন ফোটোগ্রাফি শুরু হচ্ছে…”
পর্দায় ভেসে ওঠা বেঁটে যন্ত্রটাকে তখন ভাসিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে জিনিসটার গা ঘেঁষে। সেদিকে একনজর তাকিয়ে দেখলেন অ্যাডমিরাল লালপিওতে। সীসার আবরণ! কোনো পারমাণবিক কোর? বুবি ট্র্যাপ?
পর্দায় এবার সিসের গোলকের ভেতরের ছবিটা ফুটে উঠছিল। ঝাপসা, কাঁপা কাঁপা ছবিটায় দুটো পাশাপাশি ক্যাপসুলের ভেতর কোনো ধাতুর দুটো পিণ্ড রাখা আছে। তাদের গায়ে ভেসে ওঠা লেখাগুলোর দিকে চোখ াটকে গেছে তখন তাঁর। বিশুদ্ধ প্লুটোনিয়াম!
তাদের মাঝখানের আবরণের ওপর লাগানো ছোট্ট যন্ত্রটার গায়ে একটা ডায়াল। তাতে ভেসে ওঠা সংখ্যাগুলো তখন দ্রুত শূন্যের দিকে এগিয়ে চলেছে।
মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলেন লালপিওতে। দীর্ঘ সামরিক জীবনে এমনভাবে ঠকে যাবার মুহূর্ত তাঁর আসেনি বিশেষ। অজানা শত্রু তাঁর চেয়ে আরো একধাপ আগে এগিয়ে ভেবেছিল। তাঁকে সে চেনে! তাঁর চিন্তাপদ্ধতি কীভাবে এগোবে সেটা আগে থেকেই নিখুঁত অনুমান করে নিয়েছিল সে। তারপর সেই পথেই ফাঁদ পেতে রেখে গিয়েছে সে।
দেরি করবার সময় ছিল না। ক্যাবিনেটের তলায় হাত বাড়িয়ে একটা বোতামে চাপ দিলেন তিনি। তারপর হঠাৎ সচল হয়ে ওঠা এমার্জেন্সি থ্রাস্টারের ধাক্কায় নিয়ন্ত্রণ ক্যাপসুল সহ পৃথিবীর দিকে ছিটকে যেতে যেতেই তাঁর অসহায় চোখের সামনে পর্দায় ভেসে উঠল নিঃশব্দ একটা বিস্ফোরণের ছবি। সেখানে তখন মহাশূনের অন্ধকারে সাতরঙা আলোর ঝলক ছড়িয়ে বিস্ফোরণে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে মিসিয়ারীর মূল শরীর।
*****
“কতজন অবশিষ্ট রয়েছে?”
“একুশজন অ্যাডমিরাল। বাকিরা…” সামিরার গলায় কাঁপুনি লেগেছে তখন। তার চোখে জলের ছোঁয়া ছিল। এখনো তার মন যুদ্ধের আগুনে পুড়ে শক্ত হয়নি।
বিস্ফোরণের জায়গাটা থেকে প্রায় পাঁচশো মাইল দূরে এসে স্থির হয়েছে মিসিয়ারির কনট্রোল ক্যাপসুল। পর্দায় চোখ আটকে রেখেই লালপিওতে মাথা নাড়লেন, “দুঃখ করবার সময় এ নয় সামিরা। ওরা শহিদ হয়েছে। তবে এ কাজ যে করেছে তাকে আমি ছাড়ব না। নরকে পালিয়ে গেলেও তার সন্ধান আমি বের করবই। এখন এস। বস্তুটা প্রথম যখন নজরে এল তখন তুমি একটা কথা বলেছিলে, “ওর কাছাকাছি হালকা প্লাজমা স্রোতের স্বাক্ষর রয়েছে।”
“হ্যাঁ অ্যাডমিরাল। তবে তা একেবারেই ক্ষীণ। বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণেই তা…”
“হতে পারে। তবে সেইসঙ্গে অন্যকিছুও তা হতে পারে সামিরা। স্বাক্ষরগুলোকে আলাদা করে অ্যামপ্লিফাই করতে পারবে?”
“হয়ত পারব অ্যাডমিরাল। তবে তার অনেকটাই গাণিতিক অনুমান হবে। অত্যন্ত ক্ষীণ… বলতে বলতেই সামিরার দক্ষ হাতের ছোঁয়ায় গণকের মস্তিষ্ক থেকে বের করে আনা প্রাথমিক স্ক্যানের তথ্য থেকে আলাদা হয়ে পর্দায় ভেসে উঠছিল কয়েকটা প্রায় অদৃশ্য আলোর বিন্দু।
বিন্দুগুলোর জ্যামিতিক নকশা বিশ্লেষণ করো সামিরা। এদের মিলিত সম্ভাব্য চেহারা…
হঠাৎ শিকারের গন্ধ পাওয়া শ্বাপদের মতই তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল সামিরার চোখদুটো। তার দ্রুত নড়তে থাকাআঙুলের ইশারায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিন্দুগুলোর মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠছিল একটা উপবৃত্তাকার দাগ।
“ট্র্যাজেকটরি! কার? আনুমানিক গণনাসূত্র প্রয়োগ কর। এইবার… হ্যাঁ…
পর্দায় এইবার একটা পরিস্কার দাগ ফুটে উঠছিল। -১২৭ ডিগ্রি দ্রাঘিমা থেকে বের হয়ে তা সোজা ঝাঁপ দিয়েছে পৃথিবীর গভীরতর আবহমণ্ডলের দিকে।
“এটা একেবারেই আনুমানিক অ্যাডমিরাল। বিশ্লেষণের মত যথেষ্ট তথ্য নেই আমাদের হাতে। ভুল হবার সম্ভাবনা শতকরা আটানব্বই…”
হঠাৎ হাতের ইশারায় সামিরাকে থামিয়ে দিলেন লালপিওতে। মুখে একটা বিচিত্র ভাব ফুটে উঠছিল তাঁর, “ভুল সামিরা। ওই স্থানাঙ্ক আমি চিনি। এই তথ্যের সঙ্গে আমার সেই জ্ঞানটুকুকে যোগ দিলে তোমার কমপিউটার একটা নতুন হিসেব দিতে পারত। তাতে ভুল হবার সম্ভাবনা শূন্য।”
“বুঝলাম না অ্যাডমিরাল।”
পর্দায় ভেসে ওঠা স্থানাঙ্কগুলোর দিকে বোকার মত তাকিয়ে কিশোরী্টি বলে উঠল।
“গ্লোবাল মানচিত্রে স্থানাঙ্কগুলোকে বসিয়ে ছবিটা দেখাও সামিরা।”
পর্দায় ভেসে ওঠা বিশাল মহাকাশবন্দরটা নির্জন। তার একপাশে যশপাল স্পেস রিসার্চ সেন্টারের অতিকায় বোর্ডটা তখনও আলো জ্বালিয়ে যে কোনো অদৃশ্য অতিথির অপেক্ষায় মূক হয়ে আছে।
হাতের একটা ইশারায় হঠাৎ ক্যাপসুলের মুখটা ঘুরে গেল পৃথিবীর দিকে। থ্রাস্টারের তীব্র ধাক্কায়, সেই স্পেসপোর্টকে লক্ষ্য করে তার আবর্তনপথকে ততক্ষণে বেঁধে দিয়েছে যানের গণক।
“বাহিনীকে তৈরি করো সামিরা। হাতে সময় বেশি নেই আর। ওখানে যে-ই থাক, এইবার তার বাঁচবার অধিকার শেষ হয়ে গেছে…”
ক্রমশ
গ্রাফিক্স্- ইন্দ্রশেখর