আগের পর্বগুলো
ব্যস্ত এই এয়ারওয়ে নয়াদিল্লি থেকে বের হয়ে এসে যশপাল গবেষণাকেন্দ্রের ক্যাম্পাসের পাশ ঘেঁষে চলে গেছে মধ্যভারতের দিকে। ভাসমান গাড়িগুলো অন্ধকার বাতাস কেটে তিরবেগে ছুটে যায় তার বুক চিরে। তাদের উন্নত ন্যাভিগেশান এখন পৃথিবীকে ফের ফিরিয়ে দিয়েছে তার রাতের প্রাকৃতিক অন্ধকার। ২০৮৮ সালের প্রকৃতিসংরক্ষণ আইনের ১৮৫ তম ধারা, কিছু নির্দিষ্ট এলাকা বাদে রাতের প্রাকৃতিক আলো আঁধারিকে ফিরিয়ে দিয়েছে পৃথিবীর বাকি সমস্ত অঞ্চলে। মাটির ওপর থেকে সভ্যতার কৃত্রিম চিহ্নদের সরিয়ে ফেলবার কাজও এখন প্রায় শেষ। পৃথিবী ফের ফিরে গেছে তার গাছপালায় ছাওয়া আদিম স্বর্গের রূপটাতে।
আকাশে ঘন মেঘ ছিল। তার অন্ধকারের আড়ালে, মূল এয়ারওয়ে ছেড়ে যশপাল গবেষণাকেন্দ্রকে ঘিরে থাকা জাতীয় উদ্যানের মাটির কাছাকাছি ভাসতে থাকা ছোটো যানটা পথচারী যানদের স্ক্যানারে ধরা পড়লেও সে নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি বিশেষ। জায়গাটা ভারী সুন্দর। দিনে বা রাতে তার বন্য সৌন্দর্য উপভোগ করবার জন্য মাঝেমাঝেই কোন ভাবুক মানুষ সেখানে যান থামিয়ে একটু সময় কাটিয়ে যান।
ছোটো যানটার তিনজন আরোহী তাদের একজনের হাতে ধরা পর্দাটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। সেখানে ধূসর পটভূমিকায় একটা ছোটো সাংকেতিক শব্দের পাশে একটা উজ্জ্বল লাল আলোর বিন্দু দপদপ করছিল।
“অবশেষে! পোকাটা তাহলে এখানেই–” সেদিকে চোখ স্থির রেখে যানের চালক কথা বলে উঠল।
“তাহলে আমার অনুমানটাই শেষপর্যন্ত ঠিক হল গ্রোভার,” যানের যাত্রীদুজনের মধ্যে একজন চাপা গলায় দ্বিতীয়জনকে বলল, “যশপাল ইনস্টিটিউট থেকেই তাহলে-”
“নিজের পিঠ চাপড়ানোর কাজটা অন্য সময়ের জন্য তুলে রাখ জালাল,” গ্রোভারের জবাবে উত্তেজনার ছোঁয়া ছিল, “হাতে সময় বেশি নেই। যে আইডেন্টিফিকেশান নম্বরের কমিউনিকেটর থেকেই প্রোগ্রামটা বুদ্ধের মস্তিষ্কে গিয়েছে সেটা যে এখনো এই ইনস্টিটিউটেই রয়েছে সেটা আমাদের সৌভাগ্য। এবার বাকি রইল কমিউনিকেটারটা যাকে ইস্যু করা হয়েছে, তার খবর বের করা।”
বলতেবলতেই তার হাতে একটা অস্ত্র উঠে এসেছে। সেটাকে একবার পরীক্ষা করে নিয়ে ফের পোশাকের মধ্যে রেখে দিয়ে সে বলল, “চল। এদের রিসেপশনের টার্মিনাল থেকে-”
প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই যানের চালক তাকে মাটির বুকে নামিয়ে এনেছে। তারপর সামনের বাক্স থেকে দুটো অস্ত্র তুলে নিয়ে তার একটা বাড়িয়ে ধরেছে জালালের দিকে।
সেটা হাতে নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করে ফের ফিরিয়ে দিল জালাল। তার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি খেলা করে যাচ্ছিল, “রিসেপশানের টার্মিনালের দখল নিলে কোন না কোন বিপদসঙ্কেত বাজবেই। তারপর বেশিক্ষণ সময় পাব না আমরা। ইঁদুরটাকে ধরবে কেমন করে?”
“ভয় পাচ্ছ জালাল?” গ্রোভারের ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি খেলে যাচ্ছিল, “এটা একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তিনতিনটে ব্লাস্টারের সামনে কিছু বইপোকা-”
“ভুল গ্রোভার। ভুলে যেও না, প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত গবেষণা যশপালের প্রধান কাজ। এদের নিরাপত্তাবিভাগ যথেষ্ট শক্তিশালী হবার কথা কিন্তু,” জালাল হাসছিল, “টের পেয়ে গেলে একটা আধাসামরিক রক্ষিবাহিনীর সামনে দশ মিনিটও টিকব না আমরা।”
“ওই দশমিনিটের মধ্যেই যা করবার-”
“সেটা বিপজ্জনক হবে।”
“বিপজ্জনক জেনেই তো এ পেশায় এসেছি আমরা জালাল। এই মিশনের গুরুত্ব আমাদের প্রাণের চেয়ে-”
“অনেক বেশি,” মৃদু হাসল জালাল, “আর ঠিক সেইজন্যই ব্যর্থ চেষ্টা করে নাহক প্রাণটা দেবার বদলে মিশনটাকে সফল করবার জন্য একটু বুদ্ধি ব্যবহার করাটাই ভালো নয় কি? মনে হয় তাতে অ্যাডমিরাল লালপিওতে খুশিই হবেন।”
লালপিওতের নামটা গ্রোভারের উত্তেজনায় একটু রাশ টানল বোধ হয়। একটু থেমে থেকে সে বলল, “কীভাবে করতে চাইছ কাজটা?”
“বলছি। হ্যাকিং আমার পেশা ছিল তা জানো বোধ হয়। আমার দক্ষতায় যথেষ্ট ভরসা না থাকলে অ্যাডমিরাল লালপিওতে আমাকে পার্থিব জেল থেকে বের করে নিয়ে মঙ্গল উপনিবেশের তথ্য উপদেষ্টার পদে বসাতেন না। আর এ অভিযানটাতেও তোমার সঙ্গে আমায় পাঠাতেন না। চেয়ারটা ছাড়ো। আমায় টার্মিনালে বসতে দাও। এ পথে আসবার আগে, ছেলেবেলায় যখন সরকারি প্রোগ্রামারের চাকরি করতাম তখন যশপালের ডেটাবেস তৈরির টিম-এ ছিলাম। ও ডেটাবেসের হাড়হদ্দ আমার জানা।”
অন্ধকারে নিঃশব্দে আসন বদলাবদলি করে যানের গণকের টার্মিনালে এসে বসল জালাল। পর্দার সামনে তার আঙুলের নড়াচড়ার নির্দেশে গড়ে উঠছিল একটা ছোট্ট প্রোগ্রাম। কয়েকমিনিটের মধ্যে রাতের অন্ধকার বেয়ে কিছুদূরে দাঁড়িয়ে থাকা গবেষণাকেন্দ্রের তথ্যকেন্দ্রের গণকের মস্তিষ্কের উদ্দেশ্যে ভেসে গেল তার তৈরি একটা জীবাণুপ্রোগ্রাম—
–তাদের সামনের পর্দায় ভেসে উঠছিল একটা তরুণ মুখ।তার একপাশে তার সম্পূর্ণ পরিচয়—তার রুম নম্বর—
“যাওয়া যাক এবার।”
“আর কয়েকমিনিট গ্রোভার।” বলতেবলতেই তথ্যকেন্দ্রের অন্য একটা ফোল্ডারের ঠিকানায় আঙুল ছোঁয়াল জালাল। সেখানে ভেসে ওঠা তিনজন কর্মীর পরিচয়তথ্যগুলো একত্র করে নিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল সে তথ্যকেন্দ্রের সঙ্গে।
তারপর পর্দার দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় নির্দেশ দিল, “প্রোগ্রাম সংকেত গামা ২৭৬৫।”
কিছু নির্দেশ ফুটে উঠেছে পর্দায়। স্ক্যানারের নিচে নিজের হাতটা রেখে সেগুলো ধরে ধরে জালাল বলে চলেছে তখন—“নাম হেইন্স অ্যাকোরা। বয়স সাতচল্লিশ। পেশা সাফাইকর্মী-”
“আমি তৈরি। এবারে তোমার হাতটা এখানে রাখ গ্রোভার,” বলতেবলতেই উঠে দাঁড়িয়ে গ্রোভারকে স্ক্যানারের সামনে এগিয়ে দিল জালাল। মৃদু গলায় সে তখন বলে চলেছে গ্রোভার নামে মানুষটার নতুন পরিচয়—নাম রঞ্জিত পল। পেশা সাফাইকর্মী—”
খানিক বাদে যানটা থেকে নেমে আসা তিনজন মানুষ পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেল ইনস্টিটিউটের প্রধান দরজায়। একে একে তিনটে হাত তারা মেলে ধরল প্রহরী গণকের লেন্সের তলায়।
“রাত্রির শিফটে স্বাগত সাফাইকর্মী অ্যাকোরা, পল ও চ্যাং,” গণকের যান্ত্রিক, সুরেলা গলা কথা বলে উঠল এবার, “সাফাইয়ের এলাকা বলুন।”
“রিসার্চ স্কলার হোস্টেল, চতুর্থ তল,” গ্রোভার মৃদু গলায় জবাব দিল।
******
“সাড়ে আঠাশ ডিগ্রি উত্তর—পঁচানব্বই ডিগ্রি পূর্ব—” তার স্বপ্নে বারংবার ঝনঝন করে শব্দদুটো বেজে উঠছিল। একটা গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটা বেলুনে উড়ে চলেছে সে। তার সঙ্গে আরো কেউ একজন আছে। পায়ের তলায় গুম গুম শব্দ তুলে ছুটে যাওয়া পাহাড়ি নদীটার ভেতরের একটা দ্বীপের দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে সে স্থানাঙ্কদুটো আবৃত্তি করে চলেছিল বারবার।
ছুটন্ত বেলুনের তলার দোলনায় দাঁড়িয়ে ভিজে হাওয়ার ঝাপটা লাগছিল তার চোখেমুখে। পেছনদিকে ঘুরে মানুষটার দিকে একবার তাকাল সে। তার মুখটা ধোঁয়ায় ঢাকা। নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখল সে। হঠাৎ করে কোন এক ভুলে যাওয়া শৈশবে ফিরে গেছে তার শরীর। তার ভয় লাগছিল, উত্তেজনা হচ্ছিল ভেতরে ভেতরে। বেলুনটা নামছে এবার। তিরবেগে ছুটে চলেছে দ্বীপটার ওপরে মাথা জাগিয়ে থাকা একটা গুহার অন্ধকার মুখ লক্ষ করে—
“সাড়ে আঠাশ ডিগ্রি উত্তর—পঁচানব্বই ডিগ্রি পূর্ব—” ফের একবার বলে উঠল ধোঁয়ায় মুখ ঢাকা মানুষটা।
এইবার চমকে উঠল ক্রিস। তার মনে পড়ে গেছে। সুইফট টাট্ল্ এর আঘাতবিন্দুর স্থানাঙ্ক এরা! কিন্তু –এ কে?
–ঘন অন্ধকারের মধ্যে একটা গভীর নির্জন গুহার মেঝেতে হাঁটছে সে। তার একপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া অন্ধকার পাতালনদীটার জল ছলছল শব্দ তুলছিল।তার সামনে অন্ধকার মেঝের ওপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে—ওটা কী? ওর পরিচয় সে জানে—কিন্তু—
–ঘন্টি বেজে উঠেছে—বিপদজ্ঞাপক ঘন্টা—প্রক্সিমিটি সেনসর সাক্ষাত মৃত্যুর উপস্থিতি টের পেয়ে মৃত্যুঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছে হঠাৎ। গুহার নৈঃশব্দ খানখান হয়ে যাচ্ছিল সেই শব্দে—তাকে ঘিরে ভেঙেচূরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল গুহার অন্ধকার—হারিয়ে যাচ্ছে তার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা চির চেনা অথচ একদম অচেনা সেই মানুষটা—তুমি—আ-আপনি কে—”
ঘন্টার শব্দটা একটানা বেজে যাচ্ছিল তার কানের কাছে। চোখ মেলে হালকা আলোয় চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখল ক্রিস। অনেকটা উঁচুতে সুনীলের বিছানাটা হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। পাশে টেবিলের ওপর থেকে তার বাজারটা শব্দ তুলছিল একটানা। ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে রাত তিনটে বেজে চার। এত রাতে—ভিজিটর? কে এল তার কাছে?
ক্রমশ
জয়ঢাকের সমস্ত ধারাবাহিক