আগের পর্বগুলো
আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে দরজাটা খুলল সে। সেখানে দাঁড়ানো মানুষ তিনজনের দিকে একনজর দেখেই মাথার মধ্যে কোন বিপদসংকেত বেজে উঠেছিল তার। কিন্তু সামান্যতম শব্দ তোলবার আগেই তাদের সবচেয়ে সামনে দাঁড়ানো মানুষটার দিক থেকে ধেয়ে আসা একটা প্রায় অদৃশ্য ছুঁচ তার চামড়ায় ছুঁল এসে।
মুহূর্তের মধ্যে এলিয়ে পড়া শরীরটাকে সোজা করে ধরে রেখেছিল পেছন থেকে এগিয়ে আসা অন্য দুজন মানুষ। সামান্যতম শব্দও ওঠেনি। ততক্ষণে প্রথমজনের হাতে উঠে আসা দূরনিয়ন্ত্রক যন্ত্রের নির্দেশ মেনে প্রতিষ্ঠানের পাঁচিলের ওপর দিয়ে উড়ে এসে নিঃশব্দে অলিন্দের পাশে ভাসছে তাদের যানটা। তার পরিবর্তিত বৈদ্যুতিন পরিচয় পড়ে নিয়ে প্রতিষ্ঠানের গণক স্বয়ংক্রিয় সাফাই যান ক-২০২কে ভেতরে ঢোকবার ছাড়পত্র দিতে আপত্তি করেনি। সাফাইকর্মীদের কাজ শেষ হবার পরে আবর্জনা সরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য তাদের যানের প্রতিষ্ঠান চত্বরে ঢুকে আসাটাই দস্তুর—
********
“ক্রিস্টোফার?”
“কে?”
তার চোখের সামনে জমে থাকা ধোঁয়ার স্তূপ দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছিল। তীক্ষ্ণচোখে একবার চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিল ক্রিস। তীব্র একটা আলো এসে তার চোখে পড়েছে। আলোর পেছনে ছায়াছায়া তিনজন মানুষকে চোখে পড়ে।
“আমি কোথায়?”
“মাটি থেকে আড়াইশো কিলোমিটার ওপরে। নিকট মহাকাশে।”
এইবার সে সতর্ক হয়ে চারপাশে চাইল একবার। তার অর্থ এটা কোন ধাতব ঘর বা পরীক্ষাগার নয়। একটা যান। যানটা জানালাহীন। ছোট। নিকট মহাকাশে পৌঁছেছে তাকে নিয়ে। অর্থাৎ ফেরিযান। সামনের দিকটা তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়ে সরু হয়ে গেছে। তেকোণা এই গড়ণটা তীব্র গতিতে ছোটবার উপযুক্ত। এখনকার পার্থিব ফেরিযানগুলো সাধারণত পিরিচের মত গড়ণের হয়। ধীরগতি। জোরে ছোটবার মত গড়ণ নয় তাদের।
মৃদু একটা হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল ক্রিসের ঠোঁটের কোণে। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে ভুগছে এরা। অবস্থান সংক্রান্ত তথ্যটুকু তাকে না জানালে কোন সমস্যা ছিল না। সম্ভবত তাকে ভয় দেখাবার জন্যই কথাটা শুনিয়েছে। পৃথিবী ছাড়া আর একটা জায়গাতেই মহাকাশযান গড়বার মত পরিকাঠামো আছে। এটা মঙ্গল উপনিবেশের যান!
সাবধান হয়ে গেল ক্রিস। মঙ্গল উপনিবেশের একটা ফেরিযান এতটা বিপদের ঝুঁকি নিয়ে কেন তাকে—
“এটা তোমার?”
উল্টোদিকে একেবারে সামনে দাঁড়ানো লোকটার হাতে একটা কমিউনিকেটর ধরা। চমকে উঠে নিজের পকেটে একবার হাত দিয়ে দেখল সে। পাউচটা সেখানে নেই।
অস্বীকার করে লাভ নেই কোন। মাথার মধ্যে দ্রুত কিছু হিসেব কষে নিচ্ছিল ক্রিস। বাবার কাছে এদের সর্বাধিনায়কের নাম একাধিকবার শুনেছে সে। অ্যাডমিরাল লালপিওতে। মুখোমুখি কখনো এ বিষয়ে কথা না হলেও কা পোনের আসল ব্যবসার কথা তার অজানা নয়। মঙ্গল উপনিবেশের ক্রমবর্ধমান পার্থিব নিউক্লিয় জ্বালানির চাহিদার অনেকটাই চোরাই পথে মেটে তাঁর মাধ্যমে। চলে অন্যান্য প্রয়োজনীয় রসদের সরবরাহও। তাঁর নামটা এদের কাছে অজানা না-ও হতে পারে।
“এতে একটা ম্যালওয়ার আছে ক্রিস। সেটা তুমি কোথা থেকে পেয়েছ?”
একেবারে নির্বোধের মত মুখ করে মাথা নাড়ল ক্রিস, “আমি জানি না। এমন কোন কিছু—”
“বোকা সাজবার চেষ্টা করো না। জিনিসটা আমাদের অনেক ক্ষতি ঘটিয়েছে। আমাদের প্রশ্নের সঠিক জবাব না পেলে—”
হঠাৎ সোজা হয়ে বসল ক্রিস। তার কপালে ভ্রূকুটি ফুটে উঠেছে, “একটা ভুল করছেন আপনারা। ঠিক দু’দিন আগে আমার কমিউনিকেটর র্যান্ডম সিকিউরিটি চেক-এর নমুনা হিসেবে পরীক্ষা করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা উইং এ। সেখানে এমন কোন ম্যালওয়ারের চিহ্ন মেলেনি। তাছাড়া মঙ্গল উপনিবেশের কোন ক্ষতি চাওয়া আমার পক্ষে—”
“মঙ্গল উপনিবেশ? তুমি তা কী করে—”
মুখের সামনে হাতটা একবার অলসভাবে নাড়ল ক্রিস। ভেতরে জমে ওঠা দুরদুরানিটার একটা ঝলকও এখন প্রকাশ করলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
“আপনাদের কর্মপদ্ধতি দেখে আমার অনুমান আপনারা সেখানকার গোপন গোয়েন্দাব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত। মাপ করবেন, আপনাদের এই স্ট্রাইক টিমের দক্ষতার মান সম্পর্কে আমার সন্দেহ হচ্ছে। একটা সাধারণ বিশ্লেষণ মহোদয়। ভুপৃষ্ঠের আড়াইশো কিলোমিটার ওপরে ভেসে থাকা একটা মহাকাশফেরি। তার গড়ণ একেবারেই পার্থিব নয়। পৃথিবীর বাইরে একমাত্র মঙ্গলেই নিজস্ব মহাকাশযান গড়বার প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অতএব বিষয়টা অনুমান করে নিতে খুব বেশি মস্তিষ্কের পরিচয় লাগে কি?”
কথাগুলো বলে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল সে। তারপর ফের বলল, “এবারে যা বলতে চাইছিলাম সেটা শুনুন। মঙ্গল উপনিবেশের কোন ক্ষতি চাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয় তার কারণ আমাদের পরিবারের উপার্জনের বেশির ভাগটাই সেখান থেকে আসে। আমার বাবার নাম কা পোন চি। সোনার ডিম পাড়া হাঁসের পেট নিজেরাই চিরে ফেলব—মাপ করবেন, এটা একটা প্রাচীন পার্থিব প্রবাদ; মানেটা বোঝা কঠিন নয়- সেরকম কোন কাজ আমার দ্বারা হবে তা আপনারা ভাবলেন কী করে?”
নামটা শুনে একটু থমকে গেল মানুষগুলো। নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছিল ক্রিস। খুব সুক্ষ্ম ভারসাম্যের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে এখন তার নিরাপত্তা।
একটা একটা করে মুহূর্ত কেটে যাচ্ছিল একটা একটা ঘন্টার মতন। কয়েক মুহূর্ত পরে হঠাৎ তীব্র আলোটা নিভে এল। সামনে দাঁড়ানো মানুষটা একটা ছোট স্ক্যানার বের করে এনে তার হাতের আইডেনটিফিকেশান চিপটার ওপরে ঠেকাল একবার।তারপর তার পর্দায় ফুটে ওঠা তথ্যগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ইশারা করতেই আস্তে আস্তে তীব্র আলোটা নিভে গিয়ে ঘরের সাধারণ আলো জ্বলে উঠল।
সামনে একটা কনসোলের গায়ে তার কমিউনিকেটরটাকে বসিয়ে পর্দায় কিছু একটা নিবিষ্টভাবে দেখছিল ওদের একজন। তার দিকে এগিয়ে গিয়ে স্ক্যানারটা টেবিলে রেখে লোকটা মৃদু গলায় বলল, “জালাল?”
“দিনটা মিলে যাচ্ছে গ্রোভার। অ্যাডমিনিস্ট্রেটর স্তরের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে একটা ডায়াগনস্টিক চালানো হয়েছে সেদিন যন্ত্রটায়। ওইদিনই তো ম্যালওয়ারটা–”
গ্রোভার নামের মানুষটা ফের একবার তার দিকে ফিরলেন, “ঠিক কতটা সময়ের জন্য এই টেস্টটা হয়েছিল ক্রিস?”
ভেতরে জেগে উঠতে থাকা স্বস্তির ভাবটাকে আটকে রেখে মুখে একটা চাপা উৎকন্ঠার ভাবকে ফুটিয়ে রাখছিল ক্রিস। “যে সময় হয়। দিনের কাজের শেষে নির্বাচিত কমিউনিকেটরগুলো জমা করে দিই আমরা। পরদিন সকালে পরীক্ষানিরীক্ষা সেরে সেগুলো আমাদের ফেরৎ দেয়া হয়।”
“তার মানে পরশু রাতে তোমার কমিউনিকেটরটা প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা ল্যাবে ছিল,তাই তো?”
“আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।” জুয়াটা খেলেই দিল ক্রিস। কথাটা সে মিথ্যে বলেনি। রুটিন পরীক্ষার জন্য তার যন্ত্রটা সত্যিই সেদিন বিকেলে ঘন্টাখানেকের জন্য জমা পড়েছিল নিরাপত্তাবিভাগে। তার প্রমাণ যন্ত্রে থাকে। তবে পরীক্ষার সময়সীমা যন্ত্রের স্মৃতিতে থাকবার কথা নয়।
“তার প্রয়োজন হবে না। সেদিন পরীক্ষাগারের দায়িত্ব কার কাছে ছিল তা তুমি বলতে পাড়বে?”
“একজন সামান্য জুনিয়র গবেষককে সে তথ্য প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা বিভাগ জানাবে বলে আপনি মনে করেন কি?”
ধীরে ধীরে একচিলতে হাসি ফুটে উঠছিল মানুষটার মুখে। উঠে এসে হঠাৎ তার কাঁধে হাত রাখলেন তিনি, “তোমার বাবার পরিচয়টা শোনবার পরেই আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম, মঙ্গল উপনিবেশের সঙ্গে কোন বিশ্বাসঘাতকতা তুমি করতে পার না। সম্ভবত অন্য কেউ—পার্থিব গোয়েন্দা দফতরের কোন কর্মী তোমার যন্ত্রটাকে ব্যবহার করে নিজের পরিচয়–”
“ঠিক কী কাজে এটাকে ব্যবহার করা হয়েছে তার কোন আন্দাজ আমি পেতে পারি কি?”
মানুষটা হেসে মাথা নাড়লেন একবার, “না। এ তথ্যগুলো যত কম জানবে তত নিরাপদে থাকবে জুনিয়র পোন। উপস্থিত তোমাকে বিরক্ত করবার জন্য আমরা দুঃখিত। আমরা তোমাকে ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে দিয়ে আসব।”
বলতেবলতেই তার আঙুলের নির্দেশে হঠাৎ তীব্র গতিতে পায়ের নীচে ছড়িয়ে থাকা অন্ধকার গোলকটার দিকে ধেয়ে গেল যানটা।
“ইমপ্ল্যান্টটা ঠিক করে বসানো হয়েছে কি?”
“আমার দক্ষতায় তোমার কোন সন্দেহ আছে জালাল?” তীব্রবেগে চাঁদের বিপরীত কক্ষে অপেক্ষায় থাকা মূলযানের দিকে ধেয়ে যেতে থাকা ফেরিটার চারপাশে বাতাসের ধাক্কায় দাউ দাউ অগ্নিশিখা জ্বলে উঠেছে। পুরু স্বচ্ছ আবরণের বাইরে সেই আগুনের আভার দিকে চোখ রেখেই গ্রোভার বলছিলেন, “দাবাখেলার বোড়ে। এর যন্ত্রটাকে ব্যবহার করেছে ওরা জালাল। এবার ও আমাদের বোড়ে হবে।”
ক্রমশ
গ্রাফিক্স্- ইন্দ্রশেখর
জয়ঢাকের সমস্ত ধারাবাহিক
যাঃ আশা করেছিলাম এটাই শেষ পর্ব হবে । তবে আশা নিয়েই তো বাঁচে চাষা ।😀😁😂
LikeLike