আগের পর্বগুলো
তাদের সামনের পর্দায় তখন একটা ছোটো বিন্দু এগিয়ে চলেছে পর্দার বাঁদিকের কোণের দিকে। তাকে ঘিরে ছড়িয়ে থাকা ম্যাপটায় প্রতিমুহূর্তে তার পেরিয়ে যাওয়া ল্যান্ডমার্কগুলোর নাম ফুটে উঠছিল। না, অন্য কোথাও নয়। নিজের ঘরের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে ছেলেটা। কাছাকাছি অন্য কোন মানুষ নেই। ওর রুমমেটের আইডেন্টিফিকেশন চিপের উপস্থিতি টের পাচ্ছিল শুধু তার গলার কাছে অলক্ষ্যে আটকে দেয়া আণুবীক্ষণিক বিকনটা। পর্দায় রুমমেটের পরিচয়ও ভেসে উঠছে তখন। সেদিকে চোখ রেখে গ্রোভার মৃদু হেসে মাথা নাড়ল, “এখন থেকে কয়েকটা দিন ও যেখানে যার সঙ্গে যোগাযোগ করবে তাদের সবার খবর আমার চাই। যদি ওকে দাবার ঘুঁটি হিসেবে কেউ ব্যবহার করতে চায়, অথবা ও যদি নিজেই—”
“দ্বিতীয় সম্ভাবনাটার বিষয়ে তুমি বোধ হয় খুব সিরিয়াস নও গ্রোভার, তাই না?”
“সে সম্ভাবনা কম। কা পোন চি-র সন্তান-”
হঠাৎ মৃদু হাসলেন জালাল, “একটা আকর্ষণীয় জিনিস দেখবে?” বলতেবলতেই তাঁর ইশারায় পর্দায় পাশাপাশি দুটো আঁকাবাঁকা দাগের ছবি ভেসে উঠেছে।
“চেন?”
“আমার সময় নষ্ট কোরো না জালাল। স্কুলস্তরের বিজ্ঞানের প্রশ্নোত্তর করবার জন্য আমরা এখানে আসিনি। দুটো ডি এন এ তন্তুর ছবি—”
“সময় নষ্ট নয় গ্রোভার। আমাদের সঙ্গে ব্যাবসা করে এমন প্রতিটি পার্থিবের জেনেটিক পরিচয়ের ডেটাবেস আমাদের কাছে রয়েছে তা তুমি জান। ক্রিসকে অজ্ঞান করবার জন্য ব্যবহার করা ছুঁচটাতে তার ডি এন এ-র সামান্য নমুনা রয়েছে। তার আইডেনটিফিকেশন চিপ থেকে তার পিতৃপরিচয় পাবার পর ডেটাবেস থেকে কা পোন চি-র ডিএন এ সংক্রান্ত তথ্য ডাউনলোড করেছি আমি। পাশাপাশি তাদের দুজনের ডি এন এ-র ছবি দেখছ তুমি মনিটরে।”
“কিন্তু তা থেকে—”
“ছেলেটাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসবার পথে দুটোকে গণকযন্ত্রে তুলনা করে দেখেছি আমি খানিক আগে। এই হল তার ফলাফল—
পর্দায় ছবিদুটো মিলিয়ে গিয়ে একটা লাইন শুধু ভেসে উঠেছে সেখানে, “নো ম্যাচ ফাউন্ড!!”
“বিশ্বাসঘাতক! এটাজানবার পরেও তুমি ছেলেটাকে ছেড়ে দিলয়ে এলে? তুমি—”
“হাতটা নামাও গ্রোভার,” মৃদু হাসল জালাল।তার গলায় বরফের শীতলতার ছোঁয়া ছিল, “তুমি বড়োমাপের বিজ্ঞানী হলেও স্ট্র্যাটেজির খেলায় তুমি এখনো শিশুই রয়ে গেছ। অ্যাডমিরাল থিকই বুঝবেন। একটু অপেক্ষা কর। তাঁর কাছেও এ খবরটা পৌঁছে গেছে এতক্ষণে।”
“তার মানে?”
“শোনো—”
******
“তার মানে?”
গ্রহানুপুঞ্জ বলয়ের কোন গোপন এলাকায় আত্মগোপন করে ভেসে থাকা দুটো অতিকায় যানের প্রথমটির মধ্যেও গ্রোভারের প্রশ্নটাই উচ্চারিত হচ্ছিল সেই মুহূর্তে। জেমস আরিয়ানা খানিকটা অবাক হয়েই তাকিয়েছিলেন পর্দার দিকে। সেখানে জালাল-এর কাছ থেকে সদ্য এসে পৌঁছোন তথ্যস্রোতটার ছবি ফুটে উঠেছে। এটা জানা সত্ত্বেও ছেলেটাকে আরও অনুসন্ধান করবার জন্য ধরে না রেখে ওরা ছেড়ে দিল? এর দায়িত্ব জালালকে নিতে হবে। ওদের ফের একবার ক্যাম্পাসে ঢুকে যে কোন মূল্যে—”
সেদিকে তাকিয়ে লালপিওতের চোখদুটোয় একটা অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠছিল, “শাস্তি নয় জেম্স্। জালাল একদম সঠিক পদক্ষেপটাই নিয়ে নিয়েছে। হয়ত শুধু এই পদক্ষেপটার জন্যেই আমাদের এতদিনের সাধনা শেষমুহূর্তে এসে ব্যর্থ হয়ে যাবার সম্ভাবনা কমে আসবে জেম্স্।”
বলতেবলতে উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি করছিলেন লালপিওতে। খানিকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়লেন জেম্স্ আরিয়ানা, “আমি বুঝতে পারছি না অ্যাডমিরাল। আপনি-”
“বুঝতে পারছ না জেম্স্? তাহলে শোন। পার্থিব প্রজেক্ট একাঘ্নীর কথা তোমার মনে আছে আশা করি!”
“প্রফেসর সত্যব্রত বোস?”
“হ্যাঁ। দীর্ঘকাল আত্মগোপন করে থাকবার পর উত্তরপূর্ব ভারতের জঙ্গলে আমি তাকে শেষ করেছিলাম। কিন্তু কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর আমার মেলেনি। পালিয়ে থাকবার সময়টা সে কোন কাজে লাগিয়েছিল?
যেখান থেকে তাকে আমরা ধরি সে জায়গাটা সভ্যতা থেকে বহু দূরে। সেখানে একমাত্র মনুষ্যবসতি বলতে ছিল একটা গুহাবাসী উপজাতিগোষ্ঠী। সেক্ষেত্রে প্রফেসর বোস সেখানে থাকবার সময় তাদের সহায়তা পেয়েছিলেন সেটা ধরে নেয়া যায়। ঘটনাটা ঘটবার পর তারা সে অঞ্চল থেকে সম্পূর্ণ উধাও হয়ে যায়। তাদের গুহা আবাসের মুখ আমরা হাজার চেষ্টাতেও খুঁজে পাইনি। কেন?
প্রফেসর বোস যখন চাঁদ থেকে পালান তখন তাঁর সঙ্গে তাঁর একটি ছেলে ছিল। বেঁচে থাকলে সে এই ক্রিসের বয়সী হত। তার কোন হদিশ আমরা আর পাইনি। কেন?
আমাদের রসদের পার্থিব সরবরাহকারীদের প্রত্যেকের বিষয়ে যাবতীয় অনুসন্ধান আমরা করি। কা পোন চি-র বিষয়ে অনুসন্ধানে আমরা জেনেছি, সে এই গুহাবাসী সম্প্রদায়েরই একজন বিতাড়িত সদস্য।
এই চারটে প্রশ্নকে একত্র করে দেখ জেম্স্। আর, তার সঙ্গে জালালের পাঠানো তথ্যটা মিলিয়ে দেখ। কা পোন চি-র তথাকথিত সন্তানের ছবিটা দেখ। সম্পূর্ণ বাঙালি চেহারা। এবার সবক’টা তথ্যকে একত্র মিলিয়ে দেখ জেম্স্!! জালাল এ পরীক্ষাটা না করলে এ সম্ভাবনাটার দিকে আমাদের নজর কখনই পড়ত না।”
“অথচ জালালের তাকে ছেড়ে দেয়াকে আপনি সমর্থন করছেন অ্যাডমিরাল। আমার পরামর্শ, ছেলেটাকে ফের ধরে এনে—”
মৃদু হাসলেন লালপিওতে, “কোন লাভ হবে না জেম্স্। গ্রোভার এবং জালাল, আমার সেরা দুজন কাউন্সিলর ওকে জেরা করেছে। তাদের দক্ষতায় আমার বিশ্বাস আছে। সত্যকে আড়াল করতে গেলে সেটা তাদের চোখে ধরা পড়ত।”
“সেক্ষেত্রে ওকে এখানে এনে-”
“জেমস্,” ক্লান্ত গলায় বললেন অ্যাডমিরাল লালপিওতে, “তুমি একজন যোদ্ধার মত কথা বলছ। কেন বুঝতে পারছ না, ছেলেটা নিজেকে কা পোন চি-র সন্তান হিসেবে বিশ্বাস করে। ওকে ধরে এনে আমাদের কোন লাভ হবে না। অথচ, কিছু একটা রহস্য আছে এর মধ্যে। সেটা আমার সামনেই আছে। ছুঁতে পারছি না কেবল। প্রফেসর সত্যব্রত বোসের ছেলের সঠিক সময়ে এভাবে ফিরে আসা—তার কমিউনিকেটর থেকে তার অজান্তে আমাদের প্রোগ্রামকে ধরবার ম্যালওয়ার চালু হওয়া, এর পেছনে কোন একটা পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে আছে।
“ছেলেটা কোন জটিল খেলার বোড়ে জেম্স্। এটুকু এতক্ষণে আশা করি তুমি বুঝতে পেরেছ। খেলাটা কী আমরা তা জানি না। তবে এইটুকু জানি, দশটা বছর ওই অজানা পাহাড়ের আশ্রয়ে সত্যব্রত বোস চুপচাপ বসে থাকেননি। এই মানুষটাই সব জানতেন। একমাত্র এই মানুষটার হাতেই পৃথিবীর অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসের প্রতিষেধক ছিল। বুকের মধ্যে এই একটামাত্র দুশ্চিন্তা লুকিয়ে নিয়ে এতগুলো বছর আমি চলেছি। আজ ভাগ্য হঠাৎ করেই একটা নতুন সুতো আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে।
“কী করে রেখে গেছেন প্রফেসর বোস ওই পাহাড়ের বুকে তা জানবার জন্য এই ছেলেটা হয়ত আমাদের একমাত্র সূত্র। কিছু একটা পরিকল্পনা তাঁর নিঃসন্দেহে ছিল। এ ছেলেটা হয়ত নিজের অজ্ঞাতে সে পরিকল্পনার কোন অংশ। একে খাঁচায় ভরে রাখলে শেয়ালের গর্তের সন্ধান পাওয়া যাবে না।
“সমস্ত পার্থিব এজেন্টদের খবর দাও। আজ থেকে প্রত্যেকটা মুহূর্ত এর প্রতিটা গতিবিধিকে অনুসরণ করে চলবে তারা। এই মুহূর্ত থেকে তাদের আর সমস্ত অপারেশান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হল। আমাদের হাতে সময় বড্ডো কম জেম্স্। বড্ডো কম। আজ তেইশ আগস্ট ২১২৫। সংঘাতমুহূর্ত ১৪ আগস্ট ২১২৬ মাঝরাত। একটা বছরও আর বাকি নেই। ”
জেম্স্ আরিয়ানা মাথা নাড়লেন একবার, “একেবারেই সামরিক প্রশাসকের মত কথা বললে লালপিওতে। উপনিবেশের সাধারণ প্রশাসন আমাকে চালাতে হয়। খাদ্য ট্যাবলেট থেকে পাওয়ার স্টেশনের জ্বালানি, এই প্রত্যেকটা জিনিসের অন্য আমরা—”
“তার আর বেশিদিন প্রয়োজন হবে না জেম্স্,” মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন লালপিওতে, “সুইফ্ট্ টাট্ল-এর গতিপথের খবর পার্থিব সরকার জানবার পর বুদ্ধের ডেটাবেস থেকে মঙ্গল উপনিবেশের সঙ্গে গোটা বিষয়টার সম্পর্কের প্রমাণ খুঁজে পাওয়া কেবল খানিকটা সময়ের ব্যাপার। সেটা আমার হিসেবের মধ্যে রয়েছে। মঙ্গল উপনিবেশ আমাদের হাতছাড়া হবে। নিজে ধ্বংস হবার আগে পর্যন্ত পার্থিব সরকারই তার সব দায়িত্ব নেবে। সুন্দর হিসাব, তাই না?”
*******
“সাড়ে আঠাশ ডিগ্রি উত্তর—পঁচানব্বই ডিগ্রি পূর্ব—” বেলুনটা ধীরে ধীরে নেমে আসছিল গুহাটার মুখের কাছে–
একটা সরু অন্ধকার পথ—তার একপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া অন্ধকার পাতালনদীটার জল ছলছল শব্দ তুলছিল। তার সামনে অন্ধকার মেঝের ওপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে—ওটা কী? ওর পরিচয় সে জানে—এ—একাঘ্নী–
–ঘন্টি বেজে উঠেছে—বিপদজ্ঞাপক ঘন্টা—প্রক্সিমিটি সেনসর সাক্ষাত মৃত্যুর উপস্থিতি টের পেয়ে মৃত্যুঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছে হঠাৎ। গুহার নৈঃশব্দ খানখান হয়ে যাচ্ছিল সেই শব্দে— তাকে ঘিরে গমগম করে উঠছিল একটা গলা—জিষ্ণু–
“ক্রিস—”
চমকে উঠে চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখল সে। ধীরেন্দ্র বাজপেয়ীর কঠোর মুখটা একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
“আমরা অপেক্ষা করছি। গত এক বছরে তুমি তোমার কাজে-”
আস্তে আস্তে কমপিউটার কনসোলের মধ্যে তার ডেটা চিপটা গুঁজে দিল ক্রিস্টোফার। পর্দায় ফুটে উঠতে থাজা সৌরজগতের স্কেমাটিকটার দিকে তাকিয়ে ডঃ বাজপেয়ী কিছু বলে উঠতে গিয়েছিলেন। তাঁকে ইশারায় থামতে বলল সে। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “যে গবেষণার জন্য আমার এখানে সুযোগ পাওয়া, গত এক বছরে আমি তার সামান্যই করে উঠতে পেরেছি স্যার। তবে সে নিয়ে বলবার আগে–”
টেবিলে অপেক্ষায় থাকা বিশেষজ্ঞদের মধ্যে গুঞ্জন উঠল একটা। ডঃ বাজপেয়ীর হতবুদ্ধি মুখটা ধীরে ধীরে লাল হয়ে উঠছিল। কিন্তু উঠে দাঁড়াতে গিয়েও ফের বসে পড়তে হল তাঁকে। পর্দায় ফুটে উঠতে থাকা লাল আর নীল দুটো দাগের দিকে দেখিয়ে ক্রিস তখন বলে চলেছে, “এটা পৃথিবীর অস্তিত্বের প্রশ্ন স্যার। আমাকে ঠিক দশ মিনিট সময় দিন আপনারা—”
ক্রমশ
গ্রাফিক্স্- ইন্দ্রশেখর
জয়ঢাকের সমস্ত ধারাবাহিক