পূর্বপ্রকাশিতের পর
তৃতীয় অধ্যায়
বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ মনে করেন লম্বা পুষ্পক বৃক্ষগুলো (এঞ্জিওসস্পার্ম) ডায়নোসরের বিলুপ্তির জন্য অনেকাংশে দায়ী। দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য হঠাৎ করেই এরকম উদ্ভিদের সংখ্যা পৃথিবীতে বেড়ে যেতে লাগল। আমরা জানি, এই গাছেরা অক্সিজেন ত্যাগ করে এবং কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে। এই দ্রুত বেড়ে যাওয়া পুষ্পক উদ্ভিদদের জন্য তৃণভোজী ডায়নোসরদের বিপাক এত বেড়ে গেল যে তারা সেই হারে খাদ্য পেল না। ফলশ্রুতিতে তাদের বিলুপ্তি ত্বরান্বিত হয়।
এখন কেউ প্রশ্ন করে বসতে পারে বিপাক কী?
বিপাকের ইংরেজি নাম মেটাবোলিজম। শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ মেটাবোলি থেকে যার অর্থ পরিবর্তন। জীবের দেহে সংঘটিত সব রাসায়নিক বিক্রিয়ার নামই বিপাক। এর মাধ্যমেই খাদ্য বস্তু পরিবর্তিত হয়ে জীবদেহের কাজে লাগে।
রাতুল চকলেটের গাছের ছবি আঁকতে আঁকতে এসব কথা ভাবছিল। গাছেরা যদিও নিরীহ এবং উপকারী কিন্তু কিছু গাছ হতে পারে ভয়ংকর। ক্যারিবিয়ান এবং মেক্সিকো উপসাগরীয় এলাকায় এক ধরনের গাছ পাওয়া যায় যার নাম মাঞ্চিনিল। একে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর গাছ। এর বাকলে থাকে এক ধরনের রস যা গায়ে লাগলে ফোস্কা পড়ে যায়। চোখে লাগলে চোখ অন্ধ হয়ে যায়। এর ফল হয়। ফলের নাম বীচ আপেল বা ডেথ আপেল।
রাতুল যখন এসব ভাবতে ভাবতে চকলেট গাছের ছবি আঁকছিল তখন আকাশ তার টেবিলের পাশে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী আঁকছ?”
রাতুল আঁকা থামিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করল। চকলেট গাছ এবং সেই জাদুকরের কথা একে বলা যেতে পারে। আসলে ঘটনাটা কাউকে না বলে রাতুল শান্তি পাচ্ছিল না।
রাতুল বলল, “এটা একটা জাদুর গাছ। নাম চকলেট বৃক্ষ। জাদুর চকলেটের বীজ থেকে এই গাছ হয়।”
আকাশ রাতুলের খাটে বসে বলল, “চকলেট কি গাছে ধরে নাকি?”
রাতুল বলল, “হ্যাঁ, তবে এই গাছ পৃথিবীতে কখনো হয়নি।”
আকাশ বলল, “তাহলে তুমি এর কথা কীভাবে জানতে পারলে?”
রাতুল বলল, “জানতে পেরেছি জাদুকরের কাছ থেকে। তিনি আমাকে জাদুর চকলেট দিয়েছিলেন। সে চকলেটের বীজ থেকে চকলেটের গাছ হবে। তবে বীজটি এখন হস্টেলের সামনে ঘাসে পড়ে আছে।”
আকাশ বলল, “কেন? হস্টেলের সামনে কি চকলেটের গাছ হবে?”
রাতুল বলল, “না। আমি বীজটি নিয়ে আসছিলাম। ম্যাডাম ভেবেছেন হয়ত কোন পাথর বা মাটি নিয়ে এসেছি। তাই ফেলে দিতে বলেছেন। এজন্য ফেলে দিতে হয়েছে। কাল সকালে গিয়ে বীজটি খোঁজে বের করব। তারপর আরেক জায়গায় রোপন করতে হবে।”
আকাশ কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু এত বড় জায়গায়, ঘাসের মধ্যে তুমি সেটি খুঁজে পাবে কীভাবে?”
রাতুল বলল, “আমি চকচকে একটি কাগজে মুড়ে ফেলেছি। কাগজটা সহজেই পাওয়া যাবে।”
আকাশ বলল, “কোথায় রোপন করবে?”
রাতুল বলল, “এখনো ঠিক করিনি। কাল বীজটি পেলে ঠিক করব। তুই এ ব্যাপারে কাউকে কিছু বলবি না।”
আকাশ মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
তারপর বলল, “চকলেটের গাছে যদি বেশি চকলেট ধরে তাহলে তুমি কী করবে?”
রাতুল বলল, “কী করব আবার? খাব। কিন্তু আসল কথা হল গাছ হয় কি না।”
আকাশ বলল, “জাদুর গাছের কথা আমি আগে শুনেছি।”
রাতুল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় শুনেছ?”
“আমার বাবার কাছে। খুব ছোটবেলায় বাবা আমার সাথে অদ্ভুত জাদুর গাছের গল্প করেছিলেন। আমার কিছুটা মনে আছে। অবশ্য মা বলেছেন ওগুলো মিথ্যা গল্প।”
রাতুল বলল, “হতে পারে। আমাদের হেডস্যারও অনেক গল্প বলেন। জাদু রাজ্যের অদ্ভুত সব গল্প। তার ক্লাস করলে হয়ত শুনতে পারবি। তিনি খুব দারুণ গল্প বলেন।”
চকলেটের বীজটি নিয়ে কথা বলার পর রাতুলের কিছুটা ভালো লাগল। মনের মধ্যে চেপে রাখা কথা বন্ধুদের সাথে বলতে পারলে ভালো লাগে। দুশ্চিন্তা কিছুটা দূর হতেই অন্য এক দুশ্চিন্তা চলে এল তার মাথায়। কাল হোমওয়ার্ক আছে জটিল কয়েকটা অংক। এর মধ্যে একটি সে বুঝতে পারে নি। এটা নিয়ে ম্যাডামের কাছে যেতে হবে।
হস্টেলের প্রতিটি ফ্লোরের দায়িত্বে একজন করে স্যার বা ম্যাডাম রয়েছেন। তারা সেই ফ্লোরে বসবাসরত ছাত্রদের লেখাপড়া থেকে যাবতীয় খোঁজখবর নেন। হস্টেলের কোন ছাত্র হোমওয়ার্ক না পারলে বা পরীক্ষায় খারাপ করলে সেই ফ্লোরের দায়িত্বে থাকা শিক্ষককে ক্লাস টিচার ডেকে নিয়ে দেখান। ফলে ফ্লোরের দায়িট্বে থাকা শিক্ষকেরা কখনোই চান না তার ফ্লোরের কোন ছাত্র হোমওয়ার্ক না নিয়ে যাক কিংবা পরীক্ষায় খারাপ করুক। কোন ছাত্র কোন কিছু না বুঝলে সন্ধ্যা থেকে শুরু করে রাত দশটা পর্যন্ত যেকোন সময় গিয়ে সে ফ্লোরের শিক্ষকের সাহায্য নিতে পারে।
রাতুল খাতা এবং বই নিয়ে অংকটা বুঝতে কোরেশী ম্যাডামের রুমে গেল। ম্যাডাম তখন আরো দুজনকে একই অংক বুঝাচ্ছিলেন।
রাতুল বলল, “আসতে পারি ম্যাম?”
ম্যাডাম বললেন, “আসো। তোমারো কি এই অংকে সমস্যা?”
রাতুল বলল, “জি ম্যাডাম।”
ম্যাডাম বললেন, “তোমরা ক্লাসে কী কর আমি বুঝি না। বসে পড় এখানে।”
রাতুল তার ক্লাসমেট আরো দুজনের পাশে বসে পড়ল। ম্যাডাম অংক বুঝিয়ে দিলেন দশ মিনিটের মধ্যে।
তারপর রাতুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াও? আজ সবাই হস্টেলে চলে আসল আর তুমি আসলে এক ঘন্টা পড়ে। আর মুখের অবস্থা এমন কেন? শরীর খারাপ নাকি?”
রাতুল আস্তে করে বলল, “জি না ম্যাডাম।”
ম্যাডাম রাতুলের কপালে হাত দিয়ে দেখলেন জ্বর আছে কি না। বললেন, “ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করবে না। বেশ শীত পড়েছে। জ্বর আসতে পারে। আর তোমার রুমে যে নতুন ছেলেটা এসেছে…কী যেন নাম?”
রাতুল বলল, “আকাশ।”
ম্যাডাম বললেন, “হ্যাঁ, ঐ আকাশ, ওর কোন অসুবিধা হয় কিনা দেখো।”
রাতুলের একবার মনে হল রিমনদের কথা বলবে কি না। কিন্তু সে বলল না কারণ ম্যাডামকে বললে কী করবেন তার ঠিক নেই। হয়ত টিসিও দিয়ে দিতে পারেন। ম্যাডামের রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়াল।
রুমে এসে সে দেখতে পেল রুম খালি। আকাশ তার চেয়ারে নেই। রাতুল বাথরুমের দরজা খুলে দেখল বাথরুমও খালি। ব্যাপার কী! ছেলেটা গেল কোথায়? পাশের দুই রুমে গিয়ে সে খোঁজ নিল। কিন্তু না পেয়ে আবার ফিরে এল রুমে। চেয়ারে বসে ম্যাডামের বুঝিয়ে দেয়া অংকটি হোমওয়ার্কের খাতায় অর্ধেক করেছে এমন সময় আকাশ রুমে এসে ঢুকল।
রাতুল তার দিকে ঘুরে বলল, “কোথায় গিয়েছিলি?
আকাশ কিছু বলল না। মুখ কাঁদো কাঁদো করে তার চেয়ারে বসে রইল। অদ্ভুত অনুভূতি হল রাতুলের। সে চেয়ার থেকে উঠে আকাশে পাশে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? আমাকে বল।”
এবার আকাশ কেঁদেই দিল। কেঁদে কেঁদে বলল, “আমি কিছু বলতে পারব না। তুমি চলে যাবার পর ঐ ছেলেরা এসে আমাকে ধরে নিয়ে গেছে। বলেছে তাদের কথা না শুনলে খালি একটা রুমে বন্দি করে রাখবে।”
রাতুল বলল, “আমি না তোকে ভয় না পেতে বললাম। তোকে কি ভয় দেখিয়েছে না মেরেছে? আমি এখনি ম্যাডামের কাছে যাচ্ছি।”
আকাশ তার কাঁদার শব্দ বাড়িয়ে বলল, “না, ওরা বলেছে ম্যাডামকে বললে আমাকে আজ রাতেই ধরে নিয়ে যাবে।”
রাতুল বলল, “ঠিক আছে। তোকে নিয়ে কী করেছে আমাকে বল। তারপর দেখ আমি কী করি।”
আকাশ কান্না থামিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল, “তুমি রাগ করো না। আমি প্রথমে বলতে চাইনি। ওরা আমাকে খালি রুমে নিয়ে যেতে চাইল। যে রুমে ভূত আছে। তাই আমি বলে দিয়েছি।”
রাতুলের বুক ছ্যাঁৎ করে উঠল।
সে জিজ্ঞেস করল, “কী বলে দিয়েছিস?”
আকাশ বলল, “তারা জিজ্ঞেস করেছিল তোমার আর আমার মধ্যে কী কী কথা হয়েছে। আমি সব বলে দিয়েছি ভয়ে।”
রাতুল কোনভাবে নিজেকে সামলে জিজ্ঞেস করল, “চকলেটের বীজের কথাও বলেছিস?”
আকাশ মাথা নিচু করে বলল, “হ্যাঁ।”
রাতুলের তখন ইচ্ছে হচ্ছিল ভীতু এই ছেলেটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে। রাগে তার সারা শরীর কাঁপছিল। সে উঠে গিয়ে তার চেয়ারে বসল। আর একটা কথাও বলল না।
এমনিতেই তার দুশ্চিন্তা ছিল বীজটা কাল পাওয়া যায় কি না। এর উপর রিমন, সিয়ামি, মুস্তাফিজেরা জেনে গেছে। এখন কাল নিশ্চয়ই তারা এটি নেবার চেষ্টা করবে। রাগে দুঃখে রাতুলের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হচ্ছিল। বোকা এই ছেলেটাকে তার বীজটির বিষয়ে বলা ঠিক হয় নি।
রাতুল গম্ভীর হয়ে আছে দেখে আকাশ একবার এসে বলল, “আমি সরি। ভয়ে বুঝতে পারিনি।”
রাতুল গর্জে উঠল, “তুই আমার সাথে আর কখনো কথা বলবি না।”
চতুর্থ অধ্যায়
রাতে রাতুলের ভালো ঘুম হল না। সে স্বপ্নে দেখল কিছু ভয়ংকর সাপ তাকে তাড়া করেছে। দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় সে দেখল একটি গাছ। যেমনটি সে খাতায় এঁকেছিল ঠিক তেমন গাছ। চকলেট বৃক্ষ। রাতুল প্রাণের ভয়ে সে গাছে উঠে গেল। নিচে জড়ো হল বিকটদর্শন সাপেরা। তারা বিষাক্ত নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করল। সে নিঃশ্বাসের উত্তাপে চকলেট বৃক্ষ গলে যাচ্ছে। রাতুল গাছের উপরে থেকে এ দৃশ্য দেখছিল। গাছ ভেঙে পড়ার ঠিক আগমুহূর্তে তার ঘুম ভেঙে যায়। তখন ঘড়িতে বাজে ছ’টা। সাড়ে সাতটার সময় এসেম্বলি শুরু হয়। সুতরাং সাতটা পনেরোতে সবাইকে একসাথে স্কুলের দিকে রওনা হতে হয়। এর আগে হস্টেলের গেট খোলা হয় না। কিন্তু তবুও রাতুল উঠে হাতমুখ ধুয়ে নীচে চলল।
দারোয়ান সাজু ভাই হস্টেলের দরজায় বসে আছে। রাতুল তাকে গিয়ে বলল, “সাজু ভাই, আমি একটু বাইরে যেতে চাই।”
সাজু ভাই বলল, “বাইরে যাবে কেন? বাইরে কোল্ড।”
সাজু ভাইয়ের বয়স ত্রিশের মত হবে। হাসিখুশি লোক। সে প্রায় প্রতিটি কথায় একটা করে ইংরেজি শব্দ জুড়ে দেয়।
রাতুল বলল, “আমার একটু জরুরি দরকার।”
সাজু মিয়া হয়ত জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল কী দরকার। কিন্তু তার আগেই কোরেশী ম্যাডামের কন্ঠ শোনা গেল। তিনি প্রায় চিৎকার করে বললেন, “রাতুল তুমি এখানে কী করছ এত সকালে?” বলতে বলতে ম্যাডাম এগিয়ে এলেন। সাজু মিয়ার উপস্থিত বুদ্ধি ভালো। সে রাতুলের বিপদ আঁচ করতে পারল। সে হাসিমুখে বলল, “না ম্যাডাম রাতুল এসেছিল একটু বাইরে যাবে বলে। কুয়াশা দেখার জন্য।”
ম্যাডাম বললেন, “কুয়াশা! এই ঠান্ডার মধ্যে! এই ছেলেদের নিয়ে আমি আর পারছি না। এই তুমি রুমে যাও।”
রাতুল দ্রুত উপরে উঠতে শুরু করল। উঠতে উঠতে সে শুনল ম্যাডাম সাজু মিয়াকে বলছেন, “৪৭ নাম্বার রুমে বাথরুমের লাইট আনতে বললাম তোমাকে পরশু। আজো লাইট লাগানো হয় নাই। এসব কী?”
সাজু মিয়া বলছে, “ম্যাডাম হয়েছে কী, লাইট এনেছিলাম। কিন্তু লাগানোর ব্যাপারটা ঠিক মাইন্ডে ছিল না। আজই লাগাব ম্যাডাম।”
রাতুল রুমে গিয়ে স্কুলের জন্য তৈরি হল। সাতটা পনেরোতে যখন সবাই গেট দিয়ে বের হচ্ছিল তখন কিন্তু অন্যদিকে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। দু’পাশে দু’জন শিক্ষক দাঁড়িয়ে থাকেন। ফলে প্রায় লাইন বেঁধে সবাই স্কুলের দিকে হাটা দেয়। স্কুল বিল্ডিং এ যেতে এক মিনিটের মত লাগে।
রিমন সিয়ামি মুস্তাফিজ বি সেকশনে। রাতুল এ সেকশনে। রাতুলের রুমমেট আকাশও বি সেকশনে। দুশ্চিন্তা ও উৎকন্ঠার মধ্য দিয়ে ক্লাস শুরু হল রাতুলের। সে ভাবছিল ১২ টার ব্রেকে হস্টেলের দিকে যেতে পারবে কি না। মাত্র পনের মিনিটের মত ব্রেক হয়। এ সময় হস্টেলে যাওয়ারও কোন নিয়ম নেই।
ব্রেকের সময় দেখা গেল যাওয়া সম্ভবও না। রাতুল বিমর্ষ মুখে ক্যান্টিনে বসে টিফিন খাচ্ছিল। তার রুমমেট কিংবা রিমনদের কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ক্লাসের বন্ধুদের সাথেও কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তাই রাতুল একা একা বসে ছিল। হঠাৎ তার পাশে এসে একটি মেয়ে বসল। মেয়েটির নাম উর্মি। রাতুল একে চেনে। বি সেকশনে আছে মেয়েটি কিন্তু যেহেতু কিছু কম্বাইন্ড ক্লাস হয় তাই সবাই সবাইকে চেনে।
মেয়েটি বসে রাতুলকে বলল, “তুমি কি আমাকে চকলেট দিতে পারবে?”
রাতুল বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “মানে?”
উর্মি বলল, “আমি শুনেছি তোমার চকলেটের গাছ আছে। আমাকে চকলেট দেবে?”
রাতুল জিজ্ঞেস করল, “কে বলেছে আমার চকলেটের গাছ আছে?”
উর্মি বলল, “রিমন বলেছে। আমার আব্বু আমাকে চকলেট খেতে দেন না। আমাকে চকলেট দেবে?”
রাতুল বিরক্ত হয়ে বলল, “কিন্তু আমি যে কয়েকদিন আগে টিফিনের সময় দেখলাম তুমি চকলেট খাচ্ছ?”
উর্মি বলল, “হ্যাঁ। মাত্র তিনটে খেয়েছি। আব্বু বলেছে সপ্তাহে মাত্র সাতটা খাওয়া যাবে। কিন্তু আমি আরো চাই।”
রাতুল এমনিতেই দুশ্চিন্তায় ছিল। এই মেয়ের কথা শোনে তার মেজাজ আরো বিগড়ে গেল। সে ঝট করে উঠে ক্লাসের দিকে হাঁটা দিল। উর্মি মন খারাপ করে বসে রইল। ক্লাসে যেতে যেতে সে ভাবছিল হয়ত রিমন ক্লাসের সবাইকে বলে ফেলেছে চকলেটের গাছের কথা। হয়ত সবাই এখন তাকে নিয়ে মজা করা শুরু করবে। সে ভয়ে ভয়ে ক্লাসে গেল। কিন্তু দেখা গেল কেউ এ নিয়ে কোন কথা বলছে। অর্থাৎ রিমন সবাইকে বলেনি।
দেড়টায় ক্লাস ছুটি হয়। আর মাত্র দেড় ঘন্টা। ছুটি হলেই দৌড়ে যেতে হবে। রিমনদের আগে। উত্তেজনায় রাতুল ক্লাসে মন দিতে পারল না। একসময় সর্বশেষ ক্লাস শেষ হল। অর্থাৎ এবার ছুটি। কিন্তু স্যার বললেন, “তোমরা একটু বসো। সভাপতি সাহেব আজ এসেছেন তোমাদের সাথে দেখা করতে।”
চশমা চোখে ভুঁড়িওয়ালা এক লোক প্রবেশ করলেন। তিনি বললেন, “কেমন আছ তোমরা? আমি ডক্টর মোফাখখারুল ইসলাম। তোমাদের স্কুলের নতুন সভাপতি।”
ক্লাসের শিক্ষক বললেন, “সভাপতি স্যার কিন্তু একজন বিজ্ঞানী। যুক্তরাষ্ট্রের বেল ল্যাবরেটরিতে তিনি গবেষণা করেছেন।”
সভাপতি বললেন, “আজ আমি তোমাদের দেখতে এলাম। আমি যখন ছাত্র ছিলাম তখন থানা নির্বাহী কর্মকর্তা বা কোন অফিসার এলে একই দিনে সব ক্লাস ঘুরে ঘুরে দেখতেন। আধ ঘন্টায় সাত আটটা ক্লাসের সাথে পরিচিত হওয়া শেষ হয়ে যেত তার। কিন্তু এ কি সম্ভব? তাই আমি করেছি অন্য নিয়ম। প্রতিদিন একটা করে ক্লাসে যাবো। এক ক্লাসের সাথে পরিচিত হব। আজ পড়েছে তোমাদের ক্লাস। আগামী আধঘন্টা আমরা আলাপ করব। তা তোমরা কেমন আছ?”
ছাত্রছাত্রীরা সমস্বরে বলল, “ভালো। আপনি কেমন আছেন স্যার?”
মোফাখখারুল ইসলাম বললেন, “আমি ভালো আছি। তবে হয়েছে কি ইদানীং শরীরে বল পাই না আগের মত। রবীন্দ্রনাথের গান গাই “বল দাও মোরে বল দাও”। তোমরা কি রবীন্দ্রনাথকে চেন?”
ছাত্রছাত্রীরা বলল, “জি স্যার। তিনি আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা।”
মোফাখখারুল ইসলাম বললেন, “শাবাশ! রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করে ছোটবেলায় আমি পুরস্কার পেয়েছিলাম।”
রাতুল দেখল বি সেকশনের ছাত্ররা বেরিয়ে যাচ্ছে। তার ইচ্ছে হচ্ছিল ব্যাগ তুলে সভাপতির মুখে ছুঁড়ে মারতে।
সভাপতি সাহেব আরো আধঘন্টার মত বক বক করে চলে গেলেন। এ সেকশনের মুক্তি মিলল।
রাতুল ক্লাস থেকে বের হয়েই দৌড় লাগাল। এক দৌড়ে পৌছে গেল হস্টেলের সামনে। উঁচুনিচু ঘাসের মধ্যে সে খুঁজতে লাগল সেই জাদুর চকলেটের আবরণ। কিন্তু কোথায় সেই চকচকে কাগজ? শুধু সবুজ ঘাস।
রাতুল দেখল একটু দূরে বসে আছে রিমন, সিয়ামি, মুস্তাফিজ এবং আরো দুয়েকজন। রিমনের হাতে চকচকে কী একটা দেখে সে প্রায় দৌড়ে গেল। রিমন তাকে দেখে কাগজটি লুকানোর চেষ্টা করল না। বরং সে সবাইকে দেখাতে দেখাতে বলল, “এটা হচ্ছে জাপানি চকলেটের মোড়ক। আমার ছোটমামা জাপান থেকে পাঠিয়েছেন। সুন্দর না?”
রাতুল গর্জে উঠল, “এটা আমার। আমি ফেলে রেখে গিয়েছিলাম।”
রিমন ব্যঙ্গাত্বক ভাবে বলল, “বললেই হল? এটা আমার। সাক্ষি সিয়ামি, মুস্তাফিজ। কী রে তোরা দেখিস নি ঐদিন যে আমার ছোটমামা এসে চকলেট দিয়ে গেল? তোদেরও তো দিয়েছিলাম।”
সিয়ামি বলল, “ঠিক বলেছিস। এমন চকলেট আমি আগে কখনো খাইনি।”
মুস্তাফিজ বলল, “দারুণ টেস্ট। এখনো মুখে লেগে আছে।”
রাতুল আর নিজেকে সামলাতে পারল না। সে রিমনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এক হাতে চকলেটের মোড়কটি কেড়ে নিয়ে আরেক হাতে ধাক্কা দিয়ে তাকে নিচে ফেলে দিল।
রিমন উঠে দাঁড়িয়ে রাতুলকে পালটা ধাক্কা দিল।
হস্টেলে মারামারি করা ভয়ংকর অপরাধ। এর জন্য টিসি পাওয়া খুব সাধারণ ব্যাপার। তাই উপস্থিত অন্য ছাত্ররা ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল। এমনকী রিমনের দু বন্ধু মুস্তাফিজ এবং সিয়ামিও পিছিয়ে গেল। রাতুলের মুখে ঘুষি মারল রিমন। রাতুল মারল পালটা ঘুষি। দুজনেরই ঠোট কেটে রক্ত ঝরতে লাগল। তারপর শুরু হল মাটিতে পড়ে কুস্তি। হইচই শুনে সাজু মিয়া এগিয়ে এসে বলল, “এই, এই কী হয়েছে এখানে?”
রাতুল ও রিমন একে অন্যকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। মারামারি করার অপরাধে কী শাস্তি হতে পারে এখন সে চিন্তা এল তাদের মাথায়। সাজু ভাই দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, “আরে! মেরে ব্লাড বের করে দিয়েছে! কী নিয়ে মারামারি?”
রাতুল বলল, “ও আমার চকলেটের মোড়ক নিয়ে গেছে।”
সাজু মিয়া বলল, “এই জন্যে মারামারি? ম্যাডাম জানতে পারলে মেরে তোমাদের তক্তা বানাবে। তারপর সেই তক্তা টিসি দিয়ে বাড়িতে সেন্ড করবে।”
রিমন বলল, “ভুল হয়ে গেছে সাজু ভাই। ম্যাডামকে বলবেন না প্লিজ।”
সাজু মিয়া রাতুলের দিকে তাকাল। রাতুলও বলল, “ম্যাডামকে বলবেন না, সাজু ভাই।”
সাজু মিয়া বলল, “আচ্ছা যাও যাও! সে দেখা যাবে। এখন রুমে যাও। বলব কি বলব না আমি বিবেচনা করে দেখব।”
রিমনসহ বাকিরা একে একে রুমের দিকে পা বাড়াল। রাতুলের হাতে চকলেটের মোড়কটি ছিল। সে তা হাতে নিয়ে রুমে চলে এল। রুমে এসে মোড়কটি খুলে তার চক্ষুস্থির! ভেতরে একদলা মাটি কেবল। বীজটি হয়ত হারিয়ে গেছে। অথবা রিমনদের কাছে। ভীষণ মন খারাপ হল রাতুলের। নিজের দুর্ভাগ্যকে মনে মনে দোষারোপ করতে করতে সে বাথরুমে গেল। বাথরুমে গিয়ে দেখল ঠোট সামান্য কেটে গেছে। পানি লাগতেই জ্বালা করল খুব। মুখ ধোয়ে স্কুল ড্রেস বদলে সে এসে খাটে শুয়ে রইল। তার কিছুই ভালো লাগছে না। শুনতে পেল পাশের খাটে বসা আকাশ ডাকছে, “রাতুল, রাতুল।” রাতুলের ইচ্ছে হল উঠে গিয়ে কষে দুটো চড় দিতে। এই ছেলেটার জন্যই সে সব হারাল। সে জবাব না দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে রইল।
হঠাৎ সে দেখতে পেল তার ঠিক মুখের সামনে একটি হাত। সেই হাতের উপরে গতকালের সেই কালো চকলেটের বীজ।
রাতুল প্রায় লাফিয়ে উঠে বসল। দেখল আকাশই হাত বাড়িয়ে আছে এদিকে এসে। হাতের মধ্যে চকলেটের বীজ। রাতুল বীজটি হাতে নিয়ে বলল, “এটি তুই কোথায় পেলি?”
আকাশ বলল, “আমি আজ সবার আগে এসে কাগজটি কুড়িয়ে পাই। তারপর বুদ্ধি করে বীজটি নিয়ে ওর ভিতর মাটি ভরে আসি।”
রাতুল আকাশের আগের সব নির্বুদ্ধিতা মুহুর্তেই ভুলে গেল। তার মনে হল ছেলেটাকে যত বোকা সে মনে করেছিল অতটা বোকা সে নয়। বীজটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বীজটি দেখতে লাগল সে। চকচকে কালো বীজ। গায়ে চকলেটের গন্ধ।
পঞ্চম অধ্যায়
পরদিন একটা অদ্ভুত কান্ড হল। রাতুলের ঘুম ভাঙল প্রচন্ড হইচই এর শব্দে। হস্টেলে সচরাচর এমন হয় না। ইতিমধ্যে তার রুমমেট আকাশও ঘুম থেকে উঠে ভয়ার্ত মুখে তাকাচ্ছে। রাতুল দেখল পাশের রুম থেকে রাকিব এবং অন্তু ছুটে যাচ্ছে। রাতুল তাদের জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? এত চিৎকার কেন?”
অন্তু পেছনে ফিরে বলল, “তুই জানিস না? ৩৪ নাম্বার রুমে যে নতুন ছেলেটি এসেছিল তাকে ভূতে ধরেছে। স্যারেরা হস্টেলে এসেছেন।”
রাতুল বেশ অবাক হল। কারণ এর আগে এখানে কাউকে ভুতে ধরেনি। সেও অন্তুদের সাথে গেল ম্যাডামের রুমে। সেখানে সবাই জড়ো হয়েছে। আরো তিনজন স্যার এসেছেন। নতুন ছেলেটি, যার নাম বিনয় সে নিশ্চুপভাবে একটি চেয়ারে বসে আছে। ম্যাডাম তার দিকে ঝুঁকে এসে বিভিন্ন প্রশ্ন করছেন। বলছেন, “তুমি ঐ রুমে গিয়েছিলে কেন? সত্যি করে বল, কেন গিয়েছিলে?”
ছেলেটি কোন উত্তর করছে না।
স্যারেরা প্রশ্ন করছেন, “সারারাত তুমি ওখানে ছিলে কেন? তোমার সমস্যাটা কী?”
ছেলেটি হস্টেলে এসেছে তিন চারদিন হল। প্রথম থেকেই সে সবার চেয়ে আলাদা। কারো সাথে কোন কথা বলে না। গতকাল মধ্যরাতে তার রুমমেট ঘুম ভেঙে দেখে সে রুমে নেই। ছেলেটি ভয় পেয়ে যায় এবং পাশের রুমের বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে ম্যাডামকে খবর দেয়। তারপরই শুরু হয় নতুন ছেলেটাকে খোঁজা। খুঁজতে খুঁজতে তাকে শেষরাতের দিকে পাওয়া যায় একটি খালি রুমে।
কিন্তু খালি রুমে কারো পক্ষে ঢোকা অসম্ভব। কারণ রুমগুলো তালাবদ্ধ থাকে। ঢুকতে হলে চাবির দরকার। নতুন ছেলেটি অর্থাৎ বিনয়ের কাছে সে চাবি থাকার কথা না। কিন্তু তবুও তাকে পাওয়া যায় সেই খালি রুমে। অন্ধকারের মধ্যে বসে কী যেন বিড়বিড় করছিল সে।
বিনয়কে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে সে কেন ওখানে গিয়েছিল, কীভাবে গিয়েছিল। কিন্তু সে কোন উত্তর দিচ্ছে না। পাথরের মূর্তির মত চুপ হয়ে বসে আছে। হস্টেলে ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে বললেন, “শারীরিক কোন সমস্যা দেখা যাচ্ছে না। ছেলেটা সুস্থ। হয়ত আপনাদের ঐ রুমটা খোলাই ছিল।”
ম্যাডাম সিদ্ধান্ত নিলেন এর অভিভাবকের সাথে যোগাযোগ করবেন। বন্ধ রুমগুলোর সত্যি সত্যি তালাবদ্ধ আছে কি না স্যার ম্যাডামরা আরেকবার দেখে নিলেন। ইতিমধ্যে সারা হস্টেলে ছড়িয়ে পড়েছে ভুতের গল্প। ভুত নিয়ে অনেক গল্প এখানে এমনিতেই প্রচলিত ছিল। এর মধ্যে আরো একটি যোগ হল।
রাতুল দেখল এক জায়গায় সেভেনের কয়েকজন ছাত্র জড়ো হয়েছে সাজু ভাইকে ঘিরে। সাজু ভাই গল্প করে যাচ্ছেন। তাঁর গল্পগুলোতে নিজের বাহাদুরির বর্ণনা যেমন থাকে তেমন হাস্যরসও থাকে অনেক।
সাজু ভাই বলছিলেন, “এই স্কুলে আমি যতদিন ধরে আছি আর কোন স্টাফ ততদিন থাকেনি। এখানকার মানুষ ভুত প্রেত সব আমার চেনা।”
অন্তু নামের নাক খাড়া একটি ছেলে জিজ্ঞেস করল, “সাজু ভাই, আপনি হস্টেলে কখনো ভুত দেখেছেন?”
সাজু ভাই বললেন, “দেখেছি মানে? তাহলে তোমাদের গল্পটা বলেই ফেলি। তখন এই স্কুল সবে ওপেন হয়েছে। স্কুলের চেয়ারম্যান তখন সরয়ার্দি বেগ সাহেব। উনি ছিলেন সরকারের অবসরপ্রাপ্ত একজন বড় কর্মকর্তা। আমাকে অনেক পছন্দ করতেন। সব কাজেই আমাকে ডাকতেন, ‘এই সাজু, এটা কীভাবে হবে? এই সাজু, ওটা কীভাবে হবে?’ দারুণ লোক ছিলেন।”
নাক খাড়া অন্তু বলল, “তারপর?”
সাজু ভাই বললেন, “ওঁর সাথে আমার এত ভালো সম্পর্ক ছিল যে ওঁর বাজারহাটও আমিই করে দিতাম। তিনি স্কুলের টিচার্স বিল্ডিংয়েই থাকতেন। এলাকায় নতুন। জায়গা চেনেন না। তাই আমাকেই তারঁ কাজ করে দিতে হত। বাজার করতে গিয়ে আমি সরয়ার্দি বেগ স্যারের বউকে বলতাম, “ম্যাডাম, বাজারে যাব, ব্যাগ দেন।”
নাক খাড়া অন্তু বলল, “তারপর?”
সাজু ভাই বলতে লাগলেন, “তারপর একদিন বাজারে গেলাম। গিয়ে শুনলাম পাশের বাজারে নাকি বেজায় মাছ উঠেছে। আমি ভাবলাম সরয়ার্দি স্যার বড়ো মাছ পেলে খুশি হবেন। চললাম পাশের বাজারে। কিন্তু এত যে দূরে তা আমি বুঝতে পারিনি। যেতে যেতে রাত হয়ে এল। ফিরতে ফিরতে আরো রাত। আর ফিরতে হয় এই হস্টেলের জায়গাটা দিয়ে। তখন এই হস্টেল ছিল না। ছিল শুনশান এক নীরব মাঠ। আমি যখন ঠিক মাঠের মধ্যখানে…”
সাজু ভাই আর গল্প শেষ করতে পারলেন না। ম্যাডাম তার বাজখাঁই গলায় ডাকছেন, “সাজু, সাজু।”
সাজু ভাই হতদন্ত হয়ে উঠে গেলেন। গল্প শ্রোতারা হতাশ হল।
রাতুল এগিয়ে গিয়ে অন্তুকে জিজ্ঞেস করল, “বিনয় ছেলেটা কী করছে রে?”
অন্তু কিছু বলার আগেই মোটকু সোহেল বলল, “সে তার রুমে বসে আছে। আমি কথা বলতে গিয়েছিলাম। কোন কথা বলে না।”
রাতুল বলল, “তোরা কি আমার সাথে যাবি? আমি ওর সাথে কথা বলতে চাই।”
সবাই উৎসাহিত হয়ে বলল, “চল।”
সাকিব নামের চশমাপড়া একটা ছেলে বলল, “কিন্তু ম্যাডাম বলেছেন ওকে বিরক্ত না করতে।”
রাতুল বলল, “আমরা বিরক্ত করতে যাচ্ছি নাকি, পন্ডিত? আমরা কথা বলতে যাচ্ছি।”
অন্তু বলল, “আচ্ছা তুই কি সত্যি মনে করিস ওকে ভূতে নিয়ে আটকে রেখেছিল ঐ রুমে?”
রাতুল বলল, “সেটা তার সাথে কথা বললেই বোঝা যাবে।”
রাতুল এবং অন্যরা হেঁটে বিনয়ের রুমের সামনে এল। রাতুল ঢোকবার করার পর অন্যরা ঢুকল। রাতুল এগিয়ে গিয়ে বিনয়ের খাটে বসল। বিনয় তখন চেয়ারে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।
“কেমন আছো বিনয়?”
বিনয় ফিরে তার দিকে তাকাল। চোখে উদাস দৃষ্টি। কোন উত্তর না দিয়ে সে আবার ফিরে তাকাল জানালার দিকে।
রাতুল বলল, “তুমি আমাদের সাথে কথা বলতে পারো। আমরা তোমার বন্ধু। তোমার কোন ক্ষতি করব না।”
বিনয় রাতুলের দিকে ফিরে তাকিয়ে কিছুটা হেসে শান্তভাবে বলল, “তোমরা আমার ক্ষতি করতে পারবে না। তোমরা এখানে কীজন্য এসেছ আমি জানি।”
অন্তু জিজ্ঞেস করল, “কীজন্য?”
বিনয় শান্তভাবে বলল, “আমি ঐ তালাবদ্ধ অন্ধকার রুমে কী করে গিয়েছিলাম তা জানার জন্য।”
রাতুল বলল, “হ্যাঁ। সেখানে তুমি কী করে গিয়েছিলে? কেউ কি তোমাকে নিয়ে রেখেছিল? আমাকে বলতে পার। আমি ম্যাডামকে বলব এবং যে তোমাকে নিয়ে রেখেছিল সে টিসি খাবে।”
বিনয় এবার শব্দ করে হাসল, “তোমরা খুব বোকা।”
এভাবে সরাসরি “বোকা” বলে অপমান, তাও অবলীলায় একসাথে এতজনকে আর কেউ কখনো করেছে কি না কে জানে! রাতুল অবাক হয়ে গেল। কী বলবে ভেবে পেল না। ইতিমধ্যে বিনয় জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।
একটু পর রাতুল বলল, “তুমি আমাদের বোকা কেন বললে?”
বিনয় জানালার দিক থেকে মুখ না সরিয়েই বলল, “বোকা তাই বোকা বলেছি। আমার আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। এখন তোমরা যাও।”
রাতুলের দিকে তাকিয়ে বলল, “আর তুমি যে জিনিসটা কাগজে মুড়িয়ে ড্রয়ারে রেখে দিয়েছ তা রাতের চাঁদের আলোতে কিছুক্ষণ রেখো। চাঁদের আলো গায়ে না লাগলে এই বীজ মরে যাবে।”
রাতুল যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। এই ছেলেটা কীভাবে জানলো সেই বীজের কথা!
বিস্মিত অবস্থায় কোনরকমে আমতা আমতা করে রাতুল জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু তুমি কীভাবে জানলে…?”
বিনয় তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “এখন যাও। এসব নিয়ে পরে কথা হবে। বিকেলে মাঠের ধারে বেঞ্চিতে বসে থাকলেই আমাকে পাবে।”
এমনভাবে বিনয় কথাটা বলেছিল যে রাতুল আর দাঁড়াল না। ছেলেটার শান্ত চেহারা এবং কালো চোখের মধ্যে যেন সম্মোহনী শক্তি আছে। রাতুল ওর রুম থেকে বের হয়ে এল। সাথে অন্য সবাই। অন্যরা অবশ্য বেশ বিভ্রান্ত হয়েছে। কিন্তু রাতুল বুঝতে পেরেছে এই ছেলেটা আসলে অনেক কিছুই জানে।
ক্রমশ
ছবিঃ অতনু দেব