পঞ্চা নামে ভালুকটি-> চিত্ত ঘোষাল
সেদিন সকালটা ছিল ঝকঝকে। বেশ রোদ্দুর উঠেছে।
মামা বলল, “মনে হচ্ছে আজ বৃষ্টি-বাদলা হবে না। চল্, আজকেই পঞ্চাকে ছেড়ে দিয়ে আসি।”
কান্না চেপে আমি বললাম “চলো।”
পঞ্চা যা যা খেতে ভালোবাসে সেদিন দুপুরে সব খেতে দেওয়া হল ওকে। তারপর বিকেল-বিকেল বেরিয়ে পড়লাম আমরা। মামা খেলা দেখানোর সরঞ্জামের থলে, ডুগডুগি সব সঙ্গে নিয়েছে। যেতে যেতে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এগুলো সঙ্গে নিলে কেন মামা?”
“লোকে ভাববে আমরা খেলা দেখাতে বেরিয়েছি।”
কিন্তু কাল যখন বস্তির লোকেরা জানতে চাইবে পঞ্চা কোথায় তখন কী বলবে?”
“সে দেখা যাবে,” মামা আমার প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল। চুপচাপ হাঁটতে থাকলাম আমরা। ছোটো শহর আমাদের। সন্ধে নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম শহরের শেষে। শহর এখান থেকেই একটু একটু করে গ্রাম হয়ে যাচ্ছে।
বড়ো রাস্তা, যার নাম হাইওয়ে, ধরে আমরা এগোতে লাগলাম। থেকে থেকে আমার কান্না পাচ্ছে। মামা খানিকটা এগিয়ে এগিয়ে হাঁটছে। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে মাঝে মাঝে চোখ মুছছি। পঞ্চার গলার দড়িটা আমার হাতে। ও কি কিছু বুঝতে পারছে? কী জানি।
হাইওয়ের দু’পাশে খেত, দূরে দূরে গ্রাম। সাইকেলে করে, হেঁটে দু’চার জন লোককে মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে রাস্তায়। তারা ঘুরে ঘুরে আমাদের দেখছে। হুসহাস করে দূরপাল্লার বাস যাচ্ছে-আসছে থেকে থেকে।
আরো খানিকটা গিয়ে মামা দাঁড়িয়ে গেল। সূর্য অস্ত গেছে অনেকক্ষণ। এখন বেশ অন্ধকার। দূরে দূরে এক এক জায়গায় টিমটিমে কয়েকটা আলো। ওগুলো গ্রাম।
আমি পঞ্চাকে নিয়ে কাছে যেতে মামা বলল, “চল্, মাঠে নামব।”
রাস্তা খেত থেকে বেশ উঁচুতে। ঢাল বেয়ে আমরা নেমে গেলাম। দু’পাশে খেত। মাঝখানের সরু রাস্তা দিয়ে মামা চলেছে। আমি পঞ্চাকে নিয়ে তার পিছু পিছু। আমি কথা বলছি না, বলতে পারছি না, ভীষণ কান্না পাচ্ছে আমার। মামাও চুপচাপ। বোধ হয় অমাবস্যা। কুচকুচে অন্ধকার। কেউ কারো মুখ দেখতে পাচ্ছি না। একসময় মামা বলল, “দাঁড়া। পঞ্চার গলার দড়িটা খুলে দে। খুলেছিস? বেশ। শোন্, আমি ঠোঙায় করে অনেক বিস্কুট নিয়ে এসেছি। ঠোঙাটা ওর সামনে রাখব, যেই ও খেতে আরম্ভ করবে আমরা দৌড়োব হাইওয়ের দিকে। …নে পঞ্চা, খা, বিস্কুট খা। দশা, পঞ্চা বিস্কুট খাচ্ছে, দৌড়ো, দৌড়ো…”
আমি অন্ধকারের মধ্যে একবার পঞ্চার পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে দৌড়তে লাগলাম মামার পিছু পিছু।
অনেক রাত করে ঘরে ফিরলাম আমরা। সারা রাস্তা আমরা একটাও কথা বলিনি। আমি মাঝে মাঝে শব্দ না করে কেঁদেছি। মামা কী করেছে জানি না। হাতমুখ ধুয়ে এসে মামা বলল, “আজ আর রান্না করব না দশা। মুড়ি-বাতাসা আছে ঘরে। খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়।”
“আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। বলে এক গ্লাস জল খেয়ে আমি শুয়ে পড়লাম।”
অন্যদিন আমি ‘খাব না’ বললে মামা একটা হইহই কান্ড বাঁধিয়ে দেয়। আজ কিন্তু সে কিছু বলল না। শুধু আমি শুয়ে পড়তে চুপচাপ আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।
পরদিন সকালে হইহট্টগোলে ঘুম ভেঙে গেল আমার। উঠে দেখি মামারও ঘুম ভেঙে গেছে। সে বসে আছে বিছানায়।
“কী হয়েছে মামা?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“বুঝতে পারছি না।”
ঠিক তখনই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। মামা দরজা খুলে দিতে দেখি বস্তিরই কয়েকজন। দেবেনকাকু, ভোম্বলদা এরা সব। তারা বেশ উত্তেজিত, আবার বেশ খুশি-খুশিও।
“কী ব্যাপার?” মামা বলল।
“দেখবে এসো তোমাদের ভালুকের কান্ড,” কে একজন বলল।
“অ্যাঁ!” চমকে গিয়ে মামার তো গাছ থেকে পড়ার অবস্থা। আমারও তা-ই। ঝটপট আমরা বেরিয়ে পড়লাম ওদের সঙ্গে। হাবুল মন্ডলের বাড়ির সামনে বেজায় ভিড়। ভিড়ের মধ্যে দিয়ে রাস্তা করে দেবেনকাকুরা আমাদের নিয়ে গেল হাবুলের ঘরের পাশে। সেখানে এক অদ্ভুত দৃশ্য। একটা লোককে জাপটে ধরে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে পঞ্চা। পাশে হাবুল মন্ডল এক ছড়া কলা হাতে পঞ্চাকে নিজে হাতে করে কলা খাওয়াচ্ছে। আমাদের হাবুলের মুখ হল ভারি লাজুক-লাজুক।
“কী ব্যাপার হাবুলদা?” মামা জিজ্ঞেস করল।
“আর বল কেন ভাই। এই ব্যাটা চোর আমার ঘরে সিঁধ দিচ্ছিল। তোমাদের ভালুক ওকে ধরেছে। কী উপকার যে করেছে…”
“তাই বলে ওকে অত কলা খাওয়াতে হবে? ওর স্বভাবই পরোপকার করা, সেই শিক্ষাই ও আমাদের কাছ থেকে পেয়েছে। আর কলা ওকে দিয়ো না হাবুলদা, তুমি বরং বাকিটা খেয়ে নাও।”
ভিড়ের মধ্যে কেউ খিক করে হেসে উঠল। হাবুল কটমট করে সেদিকে একবার তাকিয়ে আবার মিইয়ে গেল। পরানদাদু এসে গেছে। সবাই জায়গা করে তাকে সামনে আসতে দিল।
“ব্যাপারটা কী?” দাদু জিজ্ঞেস করল।
সব শুনে তারপর বলল, “তা হইলে হাবুল, তুমি যারে তাড়াইতে চাইছিলা সেই হইল তোমার রক্ষাকর্তা। খাওয়াও, কলা খাওয়াইয়া পাপস্খালন করো।”
লজ্জায় হাবুলের কালো মুখ বেগুনি। হো হো করে সবার হাসি। পরানদাদু এবার মামাকে বলল, “কিন্তু নয়কড়ি, তুমি কি রাত্রে তোমার ভল্লুকরে ছাইড়া রাখ নাকি?”
“না জেঠু,” মামা থতিয়ে থতিয়ে বানিয়ে বলল, “রাতে উঠে একবার কলতলায় গিয়েছিলাম। তখন হয়তো ফাঁকতালে বেরিয়ে পড়েছে। আমি ঘুমচোখে খেয়াল করতে পারিনি।”
দাদু পঞ্চার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়তে লাগল, মুখে মিটিমিটি হাসি, “ইয়ারে কয় বিয়ার হাগ্। দশা, কথাটার অর্থ জান কি?”
“না দাদু।”
অর্থ হইতাছে ভল্লুকের আলিঙ্গন। ধরলে সহজে ছাড়ে না।
সত্যিই তা-ই। কে জানে কখন থেকে চোরটাকে অমনি করে ধরে আছে। সে ব্যাটা পঞ্চার ঘাড়ে মাথা রেখে বোজা চোখ।
“মামা,” আমি ভয়ে ভয়ে শুধোলাম, “চোরটা মরে যায়নি তো?”
পাশ থেকে একজন হেসে উঠল, “আরে না। ঘুমোচ্ছে, ভালো গদি পেয়েছে না!”
দাদুকে জিজ্ঞেস করল মামা, “পঞ্চাকে বলব নাকি ওটাকে ছেড়ে দিতে?”
“ছাড়ব ক্যান? থাউক। পুলিশে খবর দেওয়া হইছে?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, থানায় লোক গেছে খবর দিতে,” পাঁচ-সাত জন একসঙ্গে জানাল।
এইসব কথাবার্তা হচ্ছে, তারই মধ্যে আওয়াজ উঠল, “দারোগাবাবু এসে গেছে, দারোগাবাবু এসে গেছে… ”
পুলিশরা সাধারণত বেশ মোটাসোটা হয়। ভালো খায়-দায় তো! দারোগাবাবু মানে থানার বড়োবাবু বড়ো পুলিশ, তাই মোটাও সে বেশি। ঘামতে ঘামতে হাঁপাতে হাঁপাতে সঙ্গে দু’জন কনস্টেবল নিয়ে সে সামনে এসে দাঁড়াল। দারোগাবাবু আমার পাশটিতে। তার গা থেকে বাসি লুচি আর বোঁদের গন্ধ আসছিল।
“এ যে অবিশ্বাস্য কান্ড হে,” দারোগাবাবু বলল পঞ্চা আর তার বগলদাবা চোরকে দেখতে দেখতে, “তোমাদের লোকের কথা শুনে আমি তো প্রথমটায় বিশ্বাসই করতে পারিনি। আরে! এ তো সেই কুখ্যাত সিঁধেল চোর জিতু চক্রবর্তী। ছি ছি। বামুনের ছেলে হয়ে শেষে কিনা সিঁধেল চোর!”
“ঠিকই আছে,” পরানদাদু মন্তব্য করল, “ও সেরা চোর, চোর জাতের ব্রাহ্মণ।”
গলা ছেড়ে হাসি সবার।
“চোপ, চোপ,” দারোগাবাবু ধমক দিল, “জান না আমি ও.সি.রাধেশ্যাম মুখুটি? আমার সামনে ভয়ে কেউ হাসে না? অ্যাই ব্যাটা জিতু, কোথায় চুরি করতে এসেছিলি?”
জিতু চোর চিঁ চিঁ করে বলল, “দারোগাবাবু, এই যে এই হাবুল মন্ডলের বাড়িতে। এখানে যে আপনি একটা ভালুককে ডিউটিতে রেখেছেন জানলে, সত্যি বলছি, আসতাম না। তিন-চার ঘণ্টা হয়ে গেল বড়বাবু, সেই যে ধরেছে আর ছাড়ে না।”
“অ্যাই হতভাগা,” গর্জে উঠল দারোগাবাবু, “একদম বাজে কথা বলবি না। পুলিশে ভালুককে চাকরি দেবার নিয়ম নেই। থাকলে একে আমি কনস্টেবল করে নিতাম। হ্যাঁ ভাই ভালুক, চোরটাকে এবার ছেড়ে দাও। থানায় নিয়ে যাই।”
দারোগাবাবুর কথা কানেই তুলল না পঞ্চা। জিতু চোরকে বগলদাবা করে সে যেমনকে তেমন। দারোগাবাবু ভুরু কপালে তুলে বলল, “আরে! এ যে আমাকে পাত্তাই দেয় না! কার ভালুক এ?”
এক পা এগিয়ে মামা বলল, “আজ্ঞে আমার। ভালুক তো, কাকে কতটা গুরুত্ব দিতে হয় জানে না। এখন কি ছেড়ে দিতে বলব চোরটাকে?”
“হ্যাঁ।” তারপর একটা কনস্টেবলের ভুঁড়িতে খোঁচা দিল দারোগাবাবু, “অ্যাই ভ্যাবলা, দেখছিস কী? তুই আর ক্যাবলা ওই কোমরে দড়ি বাঁধ্, হাতে হাতকড়া লাগা।”
দুই কনস্টেবল ভ্যাবলা আর ক্যাবলা পঞ্চার কাছে যেতেই মামা বলল, “ছেড়ে দে পঞ্চা।” আর অমনি পঞ্চা জিতু চোরকে ছেড়ে দিয়ে আমাদের কাছে এসে দাঁড়াল। দুই কনস্টেবল লেগে গেল চোরের কোমরে দড়ি বেঁধে হাতকড়া লাগাতে।
দারোগাবাবু হাসি-হাসি মুখে বলল পঞ্চাকে দেখিয়ে, “এর গায়ে কি নির্ভয়ে হাত দেওয়া যায়?”
মামা বা আমি কিছু বলার আগেই পরানদাদু আমাদের হয়ে উত্তর দিল, “হ, হ। নয়কড়ি কী দশা বইলা দিলে ও আপনেরে আলিঙ্গন কইরা আদরও করতে পারে।”
“না না,” এক পা পেছিয়ে গেল দারোগাবাবু প্রথমটায়, “আলিঙ্গন করতে হবে না।” তারপর আবার এক পা এগিয়ে আস্তে আস্তে পঞ্চার পিঠে চাপড় মারতে লাগল, “ভেরি ভেরি গুড, ইউ আর আ ভেরি গুড বিয়ার।”
পঞ্চা নড়ে-চড়ে সামনের ডান পা-টা তুলে এগিয়ে ধরল দারোগাবাবুর দিকে।
“এ কী!” দারোগাবাবু অবাক।
“আপনি ইংরিজি বলেছেন তো,” মামা বলল, “তাই ও আপনার সঙ্গে হ্যান্ড-লেগ-শেক করতে চায়।”
“হ্যান্ড-লেগ-শেক! সেটা কী?” দারোগাবাবুর জিজ্ঞাসা।
“হাতে হাতে হলে হ্যান্ডশেক। হাতে-পায়ে হলে হ্যান্ড-লেগ-শেক। শব্দটা আমার এই ভাগনে দশকড়ির আবিষ্কার,” মামা ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দিল।
তখন দারোগাবাবু হাসতে হাসতে আবার “ইনটেলিজেন্ট, ভেরি ইনটেলিজেন্ট,” বলতে বলতে পঞ্চার সঙ্গে হ্যান্ড-লেগ-শেক করতে লাগল।
এদিকে জিতু চোরকে বেঁধে-ছেদে ভ্যাবলা-ক্যাবলা রেডি। জিতু চোর কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, “বড়বাবু, বড্ড খিদে পেয়েছে।”
পঞ্চার পা ছেড়ে দিয়ে খেঁকিয়ে উঠল দারোগাবাবু, “খাবে?”
“হ্যাঁ,” মাথা নাড়ল জিতু।
“থানায় চলো, তারপর খাবে। আগে পিটুনি খাবে, তারপর…”
“তারপর,” দারোগাবাবুর মুখ থেকে কথাটা তুলে নিল জিতু, “লুচি-বোঁদে খাওয়াবেন তো বড়বাবু?”
“অ্যাঁ! লুচি-বোঁদে খাবে! দারোগা যা খাবে, চোরও তা-ই খাবে! সাহস দেখেছ? তোকে দেব কচুরি আর আলুর ঘ্যাঁট। কচুরি কিন্তু গরম হবে না, পরিষ্কার বলে দিচ্ছি। অ্যাই, নিয়ে চল্ ব্যাটাকে থানায়।”
তারপর পঞ্চার দিকে তাকিয়ে ‘থ্যাংক ইউ’ বলে চলে গেল দারোগাবাবু। আমরা পঞ্চাকে নিয়ে ঘরে ফিরে এলাম।
ঘরে ঢুকে দোর দিতেই আমি বলে উঠলাম, “এ যে অবাক কান্ড!”
“হ্যাঁ, অবাক কান্ড একটা নয়, একাধিক। প্রথমত, আমরা কত দূরে নিয়ে গিয়ে আমরা পঞ্চাকে ছেড়ে দিয়ে এলাম, ও ফিরে এল কী করে?” মামা বলল।
“হ্যাঁ।”
“দ্বিতীয়ত, ও চোরটাকে ধরল কেন?”
“হ্যাঁ। সবটাই তোমার খুব রহস্যজনক মনে হচ্ছে, না মামা?”
“তা হচ্ছে। তবে কী জানিস, অনেক পাখি জন্তুজানোয়ারের পথ চেনার আশ্চর্য ক্ষমতা থাকে। ভালুকদেরও হয়তো সেই ক্ষমতা আছে।”
“তা-ই হবে। না হলে পঞ্চা ফিরে এল কী করে। কিন্তু মামা, জিতু চোরকে ও ধরতে গেলে কেন?”
“চোর চুরি এসব বোঝার কথা নয় পঞ্চার। আমার মনে হয় জিতুর হাবভাব ওর অস্বাভাবিক ঠেকেছিল। জন্তুজানোয়ারেরও ইনট্যুইশন থাকে।”
“ইনট্যুইশন কাকে বলে মামা?”
“এক কথায় বোঝানো শক্ত। একটা ধারণা বা জ্ঞান, যা যুক্তি-তর্ক-চেষ্টা ছাড়াই আপসে মনে চলে আসে। হ্যাঁ, মনে পড়েছে, একটা কঠিন শব্দ আছে বটে-স্বজ্ঞা। তা, সে যা হবার হল, কিন্তু দশা, আমাদের সমস্যা যে রয়েই গেল!”
হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। দরজা খুলে দেখি নরেনকাকু শম্ভুকাকু, সঙ্গে আরো ক’জন।
“এসো, ভেতরে এসো,” মামা ডাকল।
“না ভাই, এখন আর ভেতরে যাবো না,” নরেনকাকু বলল, “একটা কথা বলতে এলাম। রাতে যদি পঞ্চা মন্দিরের সামনের চাতালটায় শুয়ে থাকে তাহলে বস্তিতে আর চোরের উপদ্রব হবে না। তোমাদের যদি আপত্তি না থাকে…”
“সে তো খুব ভালো কথা,” এক কথায় রাজি মামা, “রাতে খাইয়ে-দাইয়ে ওকে আমরা চাতালে শুইয়ে দিয়ে আসব।”
সবাই খুশি হয়ে চলে যেতে আমি বললাম, “রাতের জন্য একটা পাহারাদার রাখতে কত খরচ মামা?”
“মাসে দেড়-দু’হাজারের কমে হবে বলে মনে হয় না।”
“তাহলে পঞ্চার মাইনে মাসে অন্তত পাঁচশো কেন হবে না?”
“হওয়া উচিত,” মামা হাসল, “কিন্তু বলবে কে? তুই? শোন্ দশা, এতে পঞ্চার কিছু ক্ষতি হচ্ছে না। চাতালটা বেশ বড়ো। আরামে থাকবে। আর সবার এতে ভালো হলে আমাদেরও ভালো।”
সেইদিন থেকে রাতে পঞ্চার পাহারাদারি শুরু, বস্তিতেও চোর আসা বন্ধ।
আমাদের ছোট চাপা ঘরের চাইতে চাতালটা যে পঞ্চার বেশি পছন্দ তা ক’দিনেই বোঝা গেল। মাঝে মাঝেই ওখানে গিয়ে বসে থাকে। বাচ্চারা ওর সঙ্গে খেলা করে। এ রকম মিশুকে স্বভাবের মিষ্টি ভালুক কেউ দেখিনি সবাই স্বীকার করে। তবু একটু সাবধানতা তো ভালো। ও যখনই ঘর থেকে বেরোয় ওকে মুখ ঢাকার জালতি পরিয়ে দিই।
পঞ্চার জনপ্রিয়তা বেড়ে গেল খুব। কিন্তু আমাদের সমস্যা কিছু কমল না। আরো কিছুদিন গেল। বর্ষা নেমেছে খুব। আদ্দেক দিন বেরোতেই পারে না মামা। হাতের টাকাকড়ি সব প্রায় শেষ। মামা কোথা থেকে প্যাকেট-করা ঝুরিভাজা চানাচুর এইসব এনে বাড়ি বাড়ি ফিরি করে। তাতে তেমন কিছু হয় না। মামার শুকনো মুখ দেখে আমার খুব কষ্ট হয়। একদিন মামা আমার হাতে একটা ছাপা কাগজ দিয়ে বলল, “এই দ্যাখ্।”
বিচ্ছিরি ছাপা। বাজে কাগজ। তাতে লেখা –
ভালুক বিক্রি। ভালুক বিক্রি। ভালুক বিক্রি।
একটি অত্যন্ত ভদ্র সুশীল বুদ্ধিমান স্বাস্থ্যবান (ওজন আনুমানিক ১৫০ কেজি) ভালুক নিলামে বিক্রয় হইবে। তাহার ডাকনাম পঞ্চা। ভালো নাম পঞ্চানন দোসাদ। সে খেলা দেখাইতে অত্যন্ত পটু। খেলা দেখাইয়া রোজগারের জন্য বা বাড়িতে পোষ্য হিসাবে রাখিবার জন্য কিনিতে পারেন।
ক্রেতাকে ফাউ হিসেবে খেলা দেখানোর সরঞ্জাম দেওয়া হইবে। সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ভালুকের খেলা দেখানো শিক্ষার সুবন্দোবস্তও আছে। বিশেষ উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে, পঞ্চানন শিশুদের বড়ো ভালোবাসে।
নিলামের স্থানঃ ধুকধুকিয়ার মাঠ। সময়ঃ রবিবার ১৯শে জুন সকাল ১০টা।
আমি কাগজটা মামার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, “বিতিকিচ্ছি ছাপা।”
“বিনে পয়সায় একশো ছেপে দিল দুলু বড়াল। আর পয়সা খরচ করে ভালো ছেপেই বা কী হবে বল্? ”
আমি উত্তর দিলাম না।
“বুঝেছি বুঝেছি,” মামার মুখে করুণ হাসি, “তোর আসল রাগ তো পঞ্চাকে বেচে দিচ্ছি বলে। কিন্তু তুই বুঝদার ছেলে, বুঝিস তো সব।”
চটপট মনের রাগ-দুঃখ চেপে আমি বললাম, “আচ্ছা মামা, পঞ্চানন দোসাদ নামটা দিলে কেন?”
“আরে বুঝলি না, এ রকম একটা মানুষের মতো নাম দেখলে লোকের কৌতূহল হবে না? বেশি বেশি করে লোকে আসবে।”
“তা ঠিক।”
(আগামি সংখ্যায় সমাপ্য)
আগের সব কটা এপিসোড এই লিংকে পাবে