তাপসশংকর ব্রহ্মচারী র সমস্ত লেখা একত্রে
কবি নজরুল ইসলামের ‘লিচুচোর’ অবলম্বনে। নাট্যরূপ- তাপস শংকর ব্রহ্মচারী।
চরিত্রঃ-অমল ,কমল,বাচ্চু, বিল্টু , গাবলু, বিজন, হরিয়া, বোসবাবু, একটি কুকুর
একটা শান বাঁধানো রোয়াকে দেখা যাবে কয়েকজন বসে গল্প গুজব করছে। বয়স সব ১২ থেকে ১৫ এর মধ্যে। অমল সবচেয়ে বড়ো লিডার গোছের। সঙ্গে কমল, বাচ্চু।
অমল- আর পারা যায় না। কী গরম কি গরম রে বাবা।
কমল- ঠিক বলেছ। সারাটা রাত ছট্ফট্ করে কেটে গেল।
বাচ্চু- কেন ছটফট করলি কেন? তুই তো বলিস গরম শীত কোন কিছুতেই তোর কিছু যায় আসে না।
কলম- দেখেছ অমলদা, বাচ্চুর কথাটা শুনছ তো? সব সময় ঝগড়া বাধানোর তাল।
অমল- ছাড়তো কমল ওসব কথা। আর এই বাচ্চু তুইই বা সবটাতে ফোড়ণ কেটে কথা বলিস কেন?
বাচ্চু- ঠিক আছে বলব না। ছিঁচকাঁদুনে। সবসময় “শুনেছো অমলদা” -মেয়েদের মত স্বভাব।
কমল- কী বললি? আমার মেয়ের মত স্বভাব? দ্যাখ বাচ্চু (এমন সময় দেখা যাবে বাচ্চু পকেট থেকে বার করে কী একটা মুখে দেয়। কমল সেটা ভাল করে লক্ষ করে) এই কী খেলি রে? দে দে আমায়।
বাচ্চু- দেব না-
কমল- দিবি না? অমলদা দ্যাখ বাচ্চু কী যেন খাচ্ছে।
অমল- এ্যাই বাচ্চু কী খাচ্ছিস রে? নিয়ে আয় নিয়ে আয় তো এখানে। (বাচ্চু অমলের কাছে আসে) বার কর বাচ্চু।
বাচ্চু- আর একটাই আছে। লজেন্স।(বার করে)
অমল- দে এদিকে। (লজেন্স নিয়ে ও মুখে পুড়ে দেয়)
কমল- অমলদা আমি-
অমল- চোপ্। মিষ্টি বেশি খেলে কিরমি হবে।
কমল- কিন্তু তুমি, বাচ্চু তোমরা যে খাচ্ছ?
অমল- বড্ড ডেঁপো হয়েছিস কমলা। এইনে খবর কাগজ নে। একটু হাওয়া কর। অসহ্য লাগছে। জোরে জোরে কর।
কমল- (হাওয়া করতে করতে) গাবলুটাই বেশ ভাল। যা আনে সবার জন্য আনে। বাচ্চুটা এক নম্বরের-
বাচ্চু- আরে গাবলুটা কোথায় গেল রে। ওকে দেখছি না কেন?
অমল- আরে তাইতো বটে। এ্যাতো দেরি তো ও করে না!
কমল- বাড়ি থেকে বোধ হয় বেরোতে দেয়্নি। পড়তে বসিয়েছে।
বাচ্চু- ধ্যেৎ পরীক্ষা হয়ে গেছে। এখন আবার লেখাপড়া কীসের?
অমল- রোজই তো আসে। এতক্ষণের মধ্যে তো এসে যায়।
কমল- বিল্টুটাত ও আসেনি। কী হল বল তো?
বাচ্চু- দুজনে মিলে কোথাও গেল টেল নাকি?
অমল- কই কালকে কিছু বললে না তো? এখানেই তো ছিল?
বাচ্চু- গাবলুটাকে কোনও বিশ্বাস নেই অমলদা। ওর মাথায় হঠাৎ হঠাৎ প্ল্যান গজায়।
কমল- বিল্টুটার মাথায় তো গোবর পোড়া। একটুও বুদ্ধি নেই। গাবলুটা যা বলে তাই করে। কতবার ও এই করে ফেঁসেছে-
অমল- কমলা তুই চুপ করবি? কিচ্ছু জানিস না শুনিসনি ক্যাচ ক্যাচ করছিস্।
কমল- আমি সবই বাজে কথা বলি, না? তুমিই বল না বিল্টুর কোনও সাহস আছে?
অমল- তোর আছে তো? এক কাজ কর যা চট্ করে বিল্টুদের বাড়িতে যা তো। দেখে আয় ত বাড়ি আছে কি না?
কমল- ওরে বাবা সে আমি পারব না। ওদের বাড়ি আমি যেতে পারব না।
বাচ্চু- কেন ওদের বাড়ি যেতে পারবি না কেন?
কমল- বিল্টুর বাবাটা না কেমন যেন। দেখা হলেই বড়ো বড়ো বানান জিজ্ঞাসা করে। আর না পারলেই রাস্তার মাঝখানে কান ধরে ওঠবোস করায়। ও আমি পারব না।
বাচ্চু- আরে বানান জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিবি।
কমল-(ভেঙিয়ে) উত্তর দিবি। বল্তো কুজ্ঝ্বটিকা বানান কী?
বাচ্চু- (ঢোঁক গিলে) অমলদা দেখেছ তো কমল কেমন তর্ক করে।
অমল- সত্যিই তো। একটা বানান পারিস না আবার বড়ো বড়ো কথা।
কমল- তু- তু- তুমি বলো…………
অমল- চোপ্ আবার মুখে মুখে কথা। যা বলছি। এক্ষুনি যাবি দৌড়ে গিয়ে খবরটা নিয়ে আসবি।
(কমল ক্ষুণ্ণ মনে বেরোতে যায়। দেখা যায় হাঁফাতে হাঁফাতে বিল্টু মঞ্চে আসে। চেহারা অবিন্যস্ত। বিল্টু তোত্লা। বয়স কমলদের মতই)
কমল- আরে এই তো বিল্টু। তুই কোথায় ছিলি রে। তোর জন্যে ভেবে ভেবে আমরা তো সবাই অস্থির হয়ে উঠেছি। এ্যাতো বেলা হয়ে গেল তুই এলি না। তাইতো আমি সবাইকে বললাম যাই ওর বাড়ি গিয়ে একবার খোঁজ নিয়ে আসি।
অমল- (ধমক দিয়ে) আর একটা কথা যদি আমি তোর মুখে শুনি কমল- এই বিল্টে এধারে আয় বোস এখানে।
(বিল্টু আসে ও রোয়াকে বসে। বসে বসেই হাঁফাতে থাকে।)
বাচ্চু- আরে কী হল তোর? এ্যাতো হাঁফাচ্ছিস কেন?
বিল্টু- ব-বলছি বলছি সব বলছি- আগে একটু জ…জ…জ…
অমল- জল খাবি? (বিল্টু ঘাড় নাড়ে) এই কমলা যা পাশের দোকান থেকে এক গ্লাস জল নিয়ে আয়…
কমল- আমি, কেন বাচ্চু তো…
অমল- চোপ্ যা জল নিয়ে আয়। (কমল বেরিয়ে যায় একটু পরেই একটা বোতলে করে জল নিয়ে আসে বিল্টু গোগ্রাসে জলটা খায়।)
অমল- বল এবার কী হয়েছে। কেউ তোকে তাড়া করেছে, বকাবকি করেছে। পাড়ার কোন মস্তান……
কমল- বলনা আমরা ত আছি রে বাবা। ভয়্ কি তোর?
অমল- আবার…………
বিল্টু- না! না! ওসব কি কিছু না অ- অন্য ব্যাপার
বাচ্চু- অন্য ব্যাপার। কি ব্যাপার?
কমল- আরে ঘাবড়াচ্ছিস কেন? বল্না কী হয়েছে?
বিল্টু- হ-হয়েছে কি? আ-আজ স-সকাল বেলা ঘু-ঘুম থেকে উঠেছি, গা-গাবলু এসে ডা-ডাকল।
অমল- গাবলু? কেন?
বিল্টু- ব-বলছি, ব-বললে লি-লিচু খা-খাবি। মি-মিষ্টি লা-লা-
বাচ্চু- কী লা লা করছিস। লিচুর কথা শুনে লাল ঝড়ল তোর
বিল্টু- আরে তা তা ঠিক নয়। ব-বললে লা লা লাল লাল ব-বড়ো বড়ো লি-লিচু খাবি।
কমল- তারপর
বিল্টু- আমি ব-বললাম কে কে দেবে লি-লিচু? গাবলু বললে কে কে আবার দেবে। আ-আমরাই নি-নিজেরা নে-নেব। য-যত খুশি নে-নেব। যা-যাবি কিনা ব-বল।
আমি ব-বললাম কো-কোথায় রে। ও ব-বললে চ-চল তো।
বাচ্চু- গেলি?
বিল্টু- যাব না মা-মানে। না-না গেলে ও ছা-ছাড়বে?
কমল- লিচু খেলি খুব মিষ্টি নারে। আমাদের জন্যে আনলি না?
বিল্টু- (কাঁদো কাঁদো গলায়) তু-তুই চুপ কর। মি-মিষ্টি!
অমল- এই কমলা তুই চুপ করবি?
কমল- ঠিক আছে ঠিক আছে।
অমল- বল্তো এবার পুরো ব্যাপারটা। কিছুই তো ছাই বুঝতে পারছি না। গাবলাটাই বা কোথায় গেল?
বাচ্চু- ঠিকই তো। হ্যাঁ রে বিল্টু গাবলু কোথায় গেল। বুঝেছি তোকে হাটিয়ে দিয়ে একাই সব লিচু গুলো সাবড়াচ্ছে, তাই তো?
বিল্টু- সে আ-আমি কী করে ব-বলব। আ-আমি তো ওকে আর দে-দেখতেই পেলাম না। আমাকে যে-যেই না ধ-ধরেছে ও যে কো-কোথায় লু-লুকলো কে-কে জানে।
কমল- ধরেছে কী রে? তোকে কে ধরল?
বিল্টু- তবে শোন পুরো ব্যা-ব্যাপারটা
অমল- বল তো শুনি। এই কমলা ভাল করে হাওয়া দে।
(কমল বিমর্ষ মুখে কাগজ তুলে হাওয়া করে। ক্রমে লাইট কমতে থাকে। অন্যদিকে হালকা আলোয় দেখা যাবে বিল্টু ও গাবলু এপাশ ওপাশ তাকাতে তাকাতে সন্তর্পণে ভেতরে আসছে। গাবলুর হাতে একটা কাস্তে। এটা একটা বাগানের দৃশ্য। উইংসের একপাশ থেকে একটা গাছের ডাল বেরিয়ে থাকতে দেখা যাবে। সেই দিকেই ওরা এগোতে থাকে)
বিল্টু- কি-কিরে আর ক-কতদূর।
গাবলু- এই তো এসে গেছি।
বিল্টু- তু-তুই যে বললি হা-হাবুদের তা-তা-তালপুকুরের কাছে।
গাবলু- তাই তো ঐ তো তালপুকুর। বলেছিলাম না পুকুরে ওপারে লিচুর গাছটা।
বিল্টু- তা-পু-পুকুর তো পেরিয়ে এ-এলাম গা-গাছ, লি-লিচু কই?
গাবলু- (উইংসের দিকে দেখিয়ে) ঐ তো লিচুগাছ দেখতে পাচ্ছিস না। আর লিচুগুলো দ্যাখ। কী রকম লাল লাল বড়ো বড়ো।
বিল্টু- আরে বা-ব্বাস কী ব-বড়ো বড়ো লি-লিচুরে। পাড়লে কেউ প্যাঁ- প্যাঁ……
গাবলু- কি প্যাঁ প্যাঁ করছিস। বেশি কথা বলিস না। চুপ কর।
বিল্টু- না-না বলছি কেউ প্যাঁ- প্যাঁদাবে না তো?
গাবলু- ধরা পড়লে ছেড়ে দেবে নাকি। পেঁদিয়ে একেবারে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেবে। শোন তুই এখানে দাঁড়িয়ে থাক। পাহারা দে। আমি গিয়ে গাছে উঠছি। কাউকে দেখলেই জোরে জোরে সিটি মারবি। ছুটে পালাব এখান থেকে। পারবি তো?
বিল্টু- পা-পারব না কেন? আমি খু-খুব ভাল সি-সিটি মারতে পারি। পুঁ-পুঁ-পুঁই পুঁই ক-করে।
গাবলু- ঠিক আছে ঠিক আছে…… আমি যাচ্ছি তবে
( গাবলু হাতে বস্তাটা নিয়ে গাছের দিকে যায়)
বিল্টু- এই গা-গাবলু কা-কা-কাস্তেটা এনেছিস কেন?
গাবলু- আস্তে। আস্তে কথা বলতে বলছি না। লিচুর ছড়া পাড়ব কী করে কাস্তে ছাড়া?
বিল্টু- (হাসতে হাসত) ও তা-তা-তাই বল। ব-ব-বড়ো বড়ো লিচু। খুব মি-মিষ্টি ব-বল?
(গাবলু চলে যায় বিল্টু ওর দিকে তাকিয়ে থাকে) লিচুর ভাবনায় বিভোর বিল্টু। পেছন দিয়ে মঞ্চে ঢোকে গাছের মালিক বিজন বাবু। বিল্টু অন্যদিকে তাকিয়ে থাকায় তাকে দেখতে পায় না)
বিজন- (ভাল করে আপাদমস্তক দেখে) এই ছোকরা
বিল্টু- কে কে কে ডাকছে?
বিজন- আমি ডাকছি।
বিল্টু- আপ-আপনি আ-আমায় ডাকছেন কে-কেন আ-আমি কি
বিজন- তুই এখানে দাঁড়িয়ে কী করছিস?
বিল্টু- কি-কিছু না তো। কি-কিছু না
বিজন- তুই বাগানে ঢুকেছিস কেন?
বিল্টু- এ-এমনিই ঢু-ঢু-ঢু…
বিজন- কি ঢু-ঢু করছিস? তালপুকুর পেড়িয়ে বেড়া ডিঙিয়ে বাগানে ঢুকে কি করছিলি লিচুগাছের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বল্। বুঝেছি চুরি করার মতলব-
বিল্টু- না না আমি চু-চুরি করব কেন? আমি চু-চুরি করতে আসিনি?
বিজন- তবে কীজন্যে এসেছিস। পাহারা দিতে? তোর সঙ্গে আর কে আছে? বল?
বিল্টু- এ মা- কী- কী বলছেন। কে- কেউ নেই আ-আমার সঙ্গে। এই দেখুন না আ-আমি তো একা।
বিজন- তুই একা? তোর সঙ্গে কেউ নেই? ঠিক বলেছিস?
বিল্টু- পু-পুরোপুরি ঠিক।
বিজন- পুরোপুরি ঠিক। তুই একা বাগানে ঢুকেছিস।
বিল্টু- আজ্ঞে হ্যাঁ এ-একা।
বিজন- এ্যাই হরিয়া ইধার আও। একটা মোটা ডান্ডা লে আও।
বিল্টু- এ্যাঁ ডা-ডা-ডান্ডা কেন? ডা-ডান্ডা কী-কী হবে?
(মঞ্চে আসে হরিয়া। কালো গাঁট্টা গোট্টা চেহারা। বড়ো গোঁফ হাতে ডান্ডা। মাথায় গামছা বাঁধা।)
হরিয়া- কেয়া হুয়া বাবু? ডান্ডা কিঁউ? সাপ-খোফ বেরুলো কি?
বিজন- আরে না সাপ-টাপ না। এটাকে দ্যাখ। বাগানে ঢুকেছে।
হরিয়া- আরে এতো একটা ছুঁচো আছে।
বিল্টু- কী- কী বললে? আ-আমি ছুঁচো?
হরিয়া- চোপ শালা। কথা বলবি তো মেতে হাড্ডি গুঁড়ো করে দেব। বোল শালা বাগানে ঢুকলি কেন? চোরি মতলব?
বিজন- আমার ও তাই মনে হচ্ছে।
হরিয়া- বোল্ কী চুরি করলি? সামান দেখা।
(বিল্টুর কোমর জামার পকেট ইত্যাদি দেখে।)
হরিয়া- না বাবু কিছু নিতে পারেনি। কিন্তু শালা জরুর চুরি করত। আপনি আসিয়ে গেছেন তো তাই- শালা চোর কাহিকার
বিল্টু- চো-চোর চোর বলবে না তো-
বিজন- না তোমায় চোর বলবে না সাধু বলবে শয়তান কোথাকার বেড়া টপকে বাগানে ঢুকে লিচুগাছের দিকে তাকিয়ে তুমি ধ্যান করছিলে।
বিল্টু- ব-বললাম তো যে আ-আমি……
বিজন- চোপ্। আর একটাও কথা নয়। উঠ বোস কর। উঠ বোস কর।
বিল্টু- ও-ও-ও
বিজন- হ্যাঁ উঠবোস- কানে ধরে দশবার। শুরু কর-
হরিয়া- কী রে চোর- শুরু কোর শুরু কোর-
বিল্টু- এটা কি কিন্তু অ-অন্যায় হচ্ছে।
হরিয়া- আরে এমনি করবি? না (ডান্ডা দেখায়) এটা লাগবে?
বিল্টু- ক-করছি করছি (ওঠ বোস শুরু করে)
হরিয়া- আরে কান ধর। বাবু বললেন শুনিসনি কি-
(কান ধরে ওঠবোস শুরু করে)
হরিয়া- হ্যাঁ ঠিক আছে হামি গুনতি করছি। এক- দো- তিন-
(দশবার ওঠবোসের পর)
বিজন- আর কোনদিন এ বাগানে ঢুকবি?
বিল্টু- (কাঁদো কাঁদো সুরে) আ- আজ্ঞে না জী-জীবনে কো-কোনদিনও না।
হরিয়া- ভাগ হিয়াসে। ভাগ্। আর কভি এ বাগানে দেখব তো এমন ঝাড় দিব যে জিন্দগি ভোর ইয়াদ রাখবি যা শালা-
(ঘাড় ধাক্কা দেয়। বিল্টু ধাক্কায় পড়ে যায় ও উঠেই দৌড়ে পালায়)
বিজন- শোন হরিয়া তুই কাছে পিঠেই থাক মনে হচ্ছে ওর সঙ্গে আরও কেউ আছে। ছোকরা মুখে বলল না বটে-
হরিয়া- হামার ভি ওহি ইয়াদ হচ্ছে।
বিজন- ঠিক আছে। যদি কেউ বাগানে ঢোকে পালাবে কোথায় ধরা ব্যাটা পড়বেই-
হরিয়া- হাঁ হাঁ জরুর ধরা পড়বে। হাতে পেলে এমন মার দিব না… (গোঁফ মোচড়ায়)
বিজন- আমি একটু কাজে বেরুচ্ছি। তুমি বাগানেই থাক। এধার ওধার একটু নজর রাখ।
হরিয়া- হাঁ হাঁ জরুর নজর রাখবে। আপনি নিশ্চিন্তে চলিয়ে যান। কোই চিন্তা নাই। হামি আছে না-
বিজন- চলি তাহলে।
(বিজন বেরিয়ে যায়। হরিয়া যেদিকে গাছের ডাল দেখা যাচ্ছে সেই দিকে উইংসের ধার ঘেসে বসে পড়ে)
হরিয়া- ইখানটাতেই বসি। বেশ হাওয়া ভি আছে। ইতনা বড়া লিচু গাছ হাওয়াতে ও জরুর হোবে।
(হরিয়া বসে কোমর থেকে খৈনী বের করে টিপতে থাকে। মনে মনে গানের সুর ভাঁজে। খৈনী মুখে দেয় ও একটু পরে আরামে ঘুমিয়ে পড়ে। হঠাৎই মড়াৎ করে গাছের ডাল ভাঙার শব্দ শোনা যাবে। দেখা যাবে গাবলু এসে ঘুমন্ত হরিয়ার পিঠের ওপর পড়ে। হরিয়া অর্তনাদ করে ওঠে।
হরিয়া- আরে বাপ রে বাপ। মর গিয়ারে মর গিয়া। হাড্ডি চুরচুর হো গিয়া রে বাপ।
(এতক্ষণে সম্বিৎ ফেরে গাবলুর। ওর পিঠের ওপর থেকে নেমে পালাবার চেষ্টা করে। খপ করে ধরে ফেলে হরিয়া)
হরিয়া- এই শালা। ভাগ্ছিস কাঁহা রে। পালিয়ে বাঁচবি তুই?
গাবলু- পালাব কেন। পালাব কেন? কি করেছি আমি যে পালাব?
হরিয়া- না না কিছু করিস নি তুই। তা হামার ঘাড়ে পড়লি কেন বোল। কোমড় শালা মনে হচ্ছে কি ভেঙে গেল।
(পিঠে কিল মারে)
গাবলু- এ্যাই কী হচ্ছে কি মারছ কেন?
হরিয়া- না মারবে না আহ্লাদ করবে তুমাকে। (মারতে মারতে) বোল শালা বোল ঘাড়ে পড়লি কেন বোল-
গাবলু- বলছি বলছি-
হরিয়া- বোল।
গাবলু- আরে ঐ গাছের ডালটা ভেঙে গেল যে। ওটা যে এত পলকা ডাল আমি কী করে জানব?
হরিয়া- গাছের ডাল। আরে শালা তার মানে হচ্ছে কি তু লিচু গাছে উঠেছিলি। লিচু চুরি করতে এসেছিস তুই।
গাবলু- আরে না না লিচু চুরি করব কেন। আমি তো……
হরিয়া- গাছে কি খেলা দেখাতে উঠেছিলি? (আবার মার) বোল কেন চুরি করছিলি।
গাবলু- ওরে বাবারে। আরে আমার কথাটা আগে শোনে না দারোয়ান বাবা?
হরিয়া- কী শুনব রে তোর কথা। মেরে আজ শালা তোর হাড্ডি মাস চুড়া চুড়া করে দেব। বোল কোথা লিচু রেখেছিস বার কর আগে।
গাবলু- এই দ্যাখো না আমার কাছে কোন লিচু আছে কিনা? সার্চ করে দ্যাখো-
হরিয়া- ওসব সারাচ টরাচ্ বুঝি না আমি। লিচু দেখা আমায়
গাবলু- এই মারবে না বলছি। তোমাদের লিচু একটাও নিইনি আমি। সরু সরু পলকা সব ডাল- ধরতেই ভেঙে গেল।
হরিয়া- আবার করছিস শালা। গাছে উঠলি ডাল ভাঙালি আবার কথা। দাঁড়া বাবুকে আগে ডাকি…
(পেছন ফিরে বাবু আসেন বাবু আসেন লিচু চোর পাকড়েছি বলে চেঁচাতে থাকে। সেই সময় গাবলু সুযোগ বুঝে এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে হরিয়ার কোমরে টেনে লাথি কষায়। হরিয়া মুখ থুবড়ে পড়ে। সেই সুযোগে গাবলু দৌড় মারে। হরিয়া শুয়ে দেখে। পরে বাবু বাবু বলে উল্টো দিকে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে যায়। গাবলুকে দেখা যাবে বেশ জোরে খানিকটা দৌড়ে এসে (মাইকে দৌড় শোনানো হবে) হাঁফ ছাড়ে।)
গাবলু- (পেছন ফিরে তাকিয়ে বলে) ওঃ বাবা বাঁচলাম। বেটা তাড়া করতে পারেনি একটা লাথি ঝেড়েছি যে কদিন ধরে ব্যাটা টের পাবে। কিন্তু এ মা কাস্তে, কাস্তেটা কোথায়। বুঝেছি যখন ডাল ভেঙে পড়লাম তখনই কোথায় পড়ে গ্যাছে। ধ্যুৎ একটা লিচুও পেলাম না, কাস্তেটাও গেল। কার মুখ দেখে যে উঠেছিলাম আজ। ঐ বিল্টেটা। ঐ তোতলাটা এক নম্বরের আপয়া। বলেছিলাম এখানে দাঁড়াতে। ব্যাটা পালিয়েছে ঠিক। যাক্গে খুব জোর বেঁচে গেছি। আড্ডায় ফিরি তো আগে। ওরা কী ভাবছে কে জানে। যাওয়া যাক্। কেউ আসছে না ত আবার
(পেছন ফিরে দ্যাখে। সেখানে হরিয়া ছিল সেখানে দেখা যাবে একটা কুকুর জড়সড়ো হয়ে শুয়ে আছে)
শেয়াল নাকি রে এটা। এটা আবার এখানে কোথা থেকে এল। যাঃ যাঃ
(তাড়া দেয়। কুকুরটা ওঠে দাঁড়ায়। আস্তে আস্তে ওর দিকে এগিয়ে আসতে থাকে)
ওরে বাবা শেয়াল কোথায়? এতো বাবুদের নচ্ছার ভেলো কুকুরটা। ওরে বাবা এতো এদিকেই আসছে রে। কী করি এখন? কোথায় পালাই রে বাবা?
(ছুটতে শুরু করে। পেছনে ভেলোও দৌড়য়। বেশ খানিকটা দৌড়ে উইংসের কাছে যায় ও আর্তস্বরে চেঁচায়)
মরে গেলাম। বোস কাকু বোস কাকু দরজা খুলুন, বাঁচান বাঁচান, হেল্প হেল্প
(দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন বোস বাবু বয়স্ক ভদ্রলোক)
বোস- কী হল কী হল কে চেঁচায়?
গাবলু- আজ্ঞে আমি গাবলু।
বোস- গাবলু, গাবলুটা কে?
গাবলু- বলছি বলছি আগে ওটাকে তাড়ান।
বোস- কাকে তাড়াব। ওটাতো একটা কুকুর দেখছি।
গাবলু- হ্যাঁ ঐ তো দেখুন না আমায় তাড়া করেছে আর একটু হলেই কামড়ে দিচ্ছিল।
(বোস কুকুরটাকে তাড়া দেয়। কুকুর চলে যায়)
বোস- কিন্তু কুকুরটা তোমায় তাড়া করল কেন? নিশ্চয় ওর পেছনে তুমি লেগেছিলে।
গাবলু- না না আমি কিছু করিনি। ও ঐ বাগানে শুয়েছিলো আমাকে দেখেই।
বোস- বাগানে? মানে ঐ বিজনবাবুর বাগানে? হ্যাঁ ওতো ঐ বাগানেই শুয়ে থাকে।
গাবলু- হ্যাঁ ওখানেই তো ছিল।
বোস- তা তুমি ঐ বাগানের মধ্যে ঢুকেছিলে কেন?
গাবলু- না মানে আমি ঠিক ঢুকিনি বুঝলেন। বাগান মানে ঐ গাছ-
বোস- বুঝেছি। গাছ মানে লিচু গাছ। লিচু চুরি করতে ঢোকা হয়েছিল ওখানে। কুকুরের তাড়া খেয়ে পালিয়েছ, এতো ভাল কথা নয়। বিজনবাবুকে ত একটা খবর দিতে হয়।
গাবলু- কেন কেন বিজনবাবু কেন? তিনি- তিনি-
বোস- তিনি নাও আসতে পারেন। তাঁর ঐ দারোয়ানটা কী যেন নাম- হরিয়াটাকে পাঠাতে পারেন-
গাবলু- ওরে বাবা আবার হরিয়া? আর এখানে এর মুহুর্ত নয়
(দৌঁড়ে পালিয়ে যায়। আবার ছুটতে দেখা যাবে। অন্ধকার হয়। আলো ক্রমশ পরিষ্কার হলে দেখা যাবে সেই শানবাঁধানো বাগানের দৃশ্য। সবাই বসে আছে।)
অমল- কিরে বিল্টে গাবলুর তো কোন পাত্তাই নেই রে।
বিল্টু- তা-তাইতো দে-দেখছি। এ-এখনো তো এল না।
কমল- অনেক লিচু পাড়ছে বুঝলি। আহ হেভি লিচু খাওয়া হবে।
বাচ্চু- আসলে গাবলুটা বেশ সাহসী আছে। বিল্টেটার মত নয়। বোকার হদ্দ।
কমল- হ্যাঁ ধরা পড়ে কান ধরে ওঠ বোস করে পালিয়ে এল।
অমল- এই বিল্টে যা না একটু এগিয়ে গিয়ে বাগানের ধারটা দেখে আয় না।
কমল- হ্যাঁ হয়তো অনেক লিচু একা বয়ে আনতে পারছেনা ও।
বিল্টে- আমি ঐ বা-বা-বাগানে। ক-কখনো ন-নয় ছিঃ ছিঃ ছিঃ ও- কি অ-অপমান।
(গাবলু মঞ্চে ঢোকে । উদ্ভ্রান্ত চেহারা। জামাটামা ছেঁড়া চোখে মুখে কালশিটার দাগ)
বাচ্চু- ওইতো গাবলু এসেছে। আয় গাবলু আয়। বোস্ বোস্।
কমল- লিচু কোথায় রে গাবলু? ব্যাগটা নিয়ে আয়।
অমল- ওকে একটু বিশ্রাম নিতে দে। দেবে দেবে সবাইকে দেবে। তুই একটু জিরিয়ে নে তো গাবলু। তোরা এখন করিস না! যেন সব লিচু ও একা খাবে।
গাবলু- (মুখে গালে হাত বোলাতে বোলাতে) ওরে বাবা মরে গেলাম কী ব্যথা রে বাবা।
বাচ্চু- হবেই তো। অনেকগুলো লিচু সাবরেছিস তো। মুখতো ব্যথা হবেই।
কমল- খুব মিষ্টি লিচু তাই না রে? মুখ ভর্তি রস! আঃ-
বিল্টু- ক-কত গুলো পারলি গা গা গা
গাবলু- চোপ্ গা-গা করছে গাধা কোথাকার?
অমল- চুপ কর বিল্টু। যা বরং লিচুর ব্যাগটা নিয়ে আয়। কোথায় রেখেছিস রে গাবলু?
গাবলু- কীসের ব্যাগ, কীসের লিচু?(কেঁদে কেঁদে)লিচু নেই।
সকলে- লিচু নেই কীরে?
অমল- সকাল থেকে লিচু গ্যাঁড়ালি লিচু নেই কীরে?
কমল- একা একা অত লিচু তুই খেলি। আমাদের কথা একটুও তোর মনে এল না।
বিল্টু- তো-তোর জন্যে আ-আমি কি অ-অপমানটাই না হ-হলাম! কান ধরে ও-ওঠবোস। ছিঃ ছিঃ ছিঃ-
গাবলু- তুই ত ওঠ বোস করেছিস। আর আমি–
বাচ্চু- তুই আবার কী করলি?
গাবলু- উঃ কি প্যাঁদানিটাই না খেলাম।
অমল- মানে তোকে ঠেঙিয়েছে। কে রে?
গাবলু- আরে ওদের ঐ শয়তান মালিটা, কী মার মারল রে ভাই। জীবনে এরকম ধোলাই খাইনি-
কমল- আর লিচু?
গাবলু- একটাও না। ডাল ভেঙে পড়ে গিয়েই তো বিপত্তিটা হল। আর পড়বি পড় ওরই ঘাড়ে পড়ে গেলাম ব্যাটা গাছের পাশেই শুয়েছিল। চড় থাপ্পড় কিল ঘুসি- ও সারা শারীর আমার টনটন করছে।
বাচ্চু- গাছটায় লিচু দেখতে পাসনি?
গাবলু- ও সারা গাছ ভর্তি থোকা থোকা লিচু
অমল- আহা হা বলিস কি রে……
কমল- আগামী হপ্তায় চল সকলে মিলে যাব-
গাবলু- কী? আবার? ঐ লিচু চুরি করতে?
বাচ্চু- হাঁ আমরা সবাই থাকব তোর ভয় কী?
গাবলু- পাগল, মালির ঐ পিটুনি, কুকুরের ঐ বেদম তাড়া, ওরে বাবা, এই নাক কান খৎ দিচ্ছি আমি আর ঐ চুরির মধ্যে নেই। তোমরা যা খুশি কর গে যাও। আমি চল্লাম। আমি তোমাদের মধ্যে নেই।
(পিঠে গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে হন হন করে বেরিয়ে যায়।)
সকলে- আরে গাবলু, যাচ্ছিস কোথায়। শোন না, শোন না।
ওর গমন পথের দিকে সকলে এগিয়ে যায়। পর্দা পড়ে)