তন্ময় বিশ্বাসের আগে গল্পঃ পুটি ও ভগবান , ছায়া ফেলে যায়, ক্যারন, পর্দার আড়ালে
বিষ্ণুপুর সাহিত্য প্রতিযোগিতা- দ্বিতীয় সেরা গল্প
রূপকথার ভাঁজে
তন্ময় বিশ্বাস
এই হাঁচি ব্যাপারটার সঙ্গে না বাঁকুড়ার একটা ডিরেক্ট টাচ আছে। না আমার ডাস্ট অ্যালার্জি আছে, না সর্দির ধাত, এমনকি নস্যির নেশা অব্দি নেই।
তবু মোটামুটি বাঁকুড়ার ম্যাপের ধারেকাছে গেলেই কোত্থেকে যে বাওয়া গঙ্গা, থুড়ি মা গঙ্গা এসে আমার নাকে ভর করেন, এবং থেকে থেকেই সেখান থেকে সমুদ্রে মিশতে চান, তা আমি হাজার ভেবেও বার করতে পারিনি।
তাছাড়া আমি কিছু অবতারের কালেকশন নিয়ে ঘুরি কিনা। তারা কোত্থেকে যে কী টেনে আনে! এই তো যেমন মোহিনী, কাল এপাশ ওপাশ থেকে ঘুরে জিরাফ দর্শনের মত দেখে নিয়ে রায় দিল, “সেকি! তাহলে এখানেই কোথাও… না, মানে কেউ তোর কথা না ভাবলে এত হাঁচি…”
আমার চটিটা খুলতে দেরি হয়ে গিয়েছিল তাই, নইলে মিস করার কোনো…
যাক গে শুনুন। সমস্যা হাঁচিতে না, হাঁচির শব্দে। ফকুটিয়া বোঝেন? ছেঁড়া পকেট? আমাদের শুটিং পার্টি হচ্ছে সেই ক্যাটাগরির। একটা ডিএসএলআর ক্যামেরা, একটা ডিঙ্কি লাইট আর চারটে ভাট বকার মত মাথা হচ্ছে আমাদের সম্বল। আগে একটা কথা চালু ছিল না, “ঘরে নেই নুন, ছেলে হবে মিঠুন”? আমাদের হচ্ছে সেই হাল। তো বুঝতেই পারছেন অডিও এবং ভিডিও দুটোই একসঙ্গে তুলতে হয়। পরে ডাবিং করার মত পকেটের হাল আমাদের নয়। তাই শট চলাকালীন হাঁচির শব্দের ব্যাকগ্ৰাউন্ড মিউজিক হরর ফিল্মে তো খুব একটা বাঞ্ছনীয় নয় তাই না? অত হাসি পেলে শোনার দরকার নেই। এখন মোবাইলেও হরর ফিল্ম শ্যুট হয়, ঠিক আছে?
আসল হল বলাটা। বলার স্টাইল। থ্রো। হ্যাঁচ্চোওও! দেখবেন কমাদাঁড়ির কম্বিনেশনগুলো জাস্ট এদিকওদিক করে কথার মধ্যে যদি অল্প ভয়ের মেদ সেলাই করে দিই, এতক্ষণ ধরে চলে আসা হালকা ভাবটা কেমন ভারি হয়ে যাবে, কেমনভাবে গল্পে ঘনিয়ে আসবে কালো মেঘ, মেঘের মধ্যে আনাগোনা করবে অস্বস্তির চোরাস্রোত! গল্প বদলাতে তো আর বেশি সময় লাগে না মশাই।
যাকগে সেই বদল-টদল পরে দেখবেন। এখন বলুন, ইউটিউব দেখেন তো? যা রেটে ওখানে শর্টফিল্ম হচ্ছে, তাতে ইউনিকনেস বজায় রাখা দায়। তাই এবার আর হরর না করে এখান ওখান থেকে ইন্সপিরেশন নিয়ে (পড়ুন টোকার চেষ্টা করে) ঠিক হল সিনেমা হবে গ্রাম্য পুজো নিয়ে। ওই ক্যামেরার সামনে একটু লাল-সাদা শাড়ির হাঁটা চলা, বলির আগে পুরুত মশাইয়ের রগ থেকে গড়িয়ে পড়া ঘামের মোশন শট বা ধরুন প্রদীপকে অফ ফোকাসে রেখে দেবতার স্নান দৃশ্য, এই সব আর কী।
তা সেন্টিমেন্টাল সুড়সুড়ি বলতেই পারেন। বোঝেনই তো একটা মাত্র ক্যমেরা, তাই স্লট মিলেছে সাকুল্যে পাঁচ মিনিট।
তো এই যেখান থেকে দাঁড়িয়ে বোম্বাই সাইজের হাঁচি গুলো দিচ্ছি, যার কটা কিনা একটু আগেই চিরু রেকর্ড করল, ওর পরের প্রোজেক্টে ফেউয়ের ডাক বলে চালাবে বলে, সেই জায়গাটাকে এখানকার লোকেরা বলে কপিলেশ্বরের মন্দির। বাঁকুড়া টাউনটাকে যদি মুখ হিসেবে ধরা হয়, তবে কপিলেশ্বর পড়বে মোটামুটি তার নাভির কাছটায়। কীভাবে, কেন এবং বাড়িতে ঠিক কী কী ঢপ দিয়ে আমরা এখানে, সে সব বলে ছোটগল্পের মানহানির না করে বরং একটু মন্দিরের গল্পটা শুনে নিন।
আচ্ছা আমি বলছি না। নাকে ক ড্রপ ইয়ে নেয়া ইমিডিয়েটলি দরকার৷ তাই বলছি কী, ব্যাপারটা পুরোটাই চিরু ব্যাকগ্রাউন্ড ভয়েসের জন্য লিখে রেখেছিল। বইমেলায় ৫০ পিস বই বিক্রি হওয়া বেস্ট সেলার থ্রিলার রাইটার কিনা, তাই কথায় কথায় রক্ত, ভয়, ধ্বংস এই শব্দগুলো পাঞ্চ করতে পারে বেশ। পড়ুন পড়ুন, মজা পাবেন।
চিরুর স্ক্রিপ্টঃ
সে বহুকাল আগের কথা। তখন বাংলায় রাজাদের আসা যাওয়া লেগে আছে প্রতিনিয়ত। কেউই টেকেন না বেশিদিন। গৌতম বুদ্ধ সবে সবে এসেছেন।
তো একবার হল কী, গ্রামের এক গোয়ালা, ধরে নিন তার নাম শ্যাম, আর সঙ্গের যে একটু দুর্বল চেহারার গরুটা, ওটা হচ্ছে বুধি। দুজনই ঘরে ফিরছিল দিনের শেষে। এমনিতে শ্যামের মন ভাল ছিল না তেমন। এই যে সঙ্গে সাক্ষাৎ কামধেনুর মত ধবধবে গরুটা, যার হাঁটার তালে তালে বেজে উঠছে ধাতব ঘণ্টার টিং টিং শব্দ, গেল পরশুই ও বাচ্চা বিইয়েছে। নাদুস নুদুস একখান বকনা বাছুর হয়েছে তার। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার বুধির একটা বাঁটেও দুধ নেই! এক ফোঁটাও না! বাচ্চাটাও মুখে তুলছে না কিছুই! এভাবে চলতে থাকলে তো…
শ্যামের চিন্তার সুতোয় টান পড়ে, হাতের দড়িটাও টানটান হয়ে পিছলে যায় সামান্য। আরে বুধি দাঁড়াল কেন! এটা তো একটা মরা মাঠ। ফসল তো দূর অস্ত একটা ঘাসের শিষ অব্দি নেই কোথাও। ঘাসের বাঁধুনির অভাবে মাটিতে ফাটলও ধরেছে কিছু। তবে?
শ্যামের মেজাজ ঠিক ছিল না। তাই টানটা একটু জোরেই দিল দড়িতে। কিন্তু বুধি তাতে একচুলও নড়ল না। মেজাজ খারাপ করে হাতের ডালটা তুলেই নিয়েছিল প্রায়, ঠিক তখুনি ছর ছর করে শব্দটা পেল শ্যাম। ও পিছনে ফিরল। ওর মনে হল ও আর কোনদিন নড়াচড়া করতে পারবে না! মনে হল শিরায় যত রক্ত আছে সমস্তটাই যেন উঠে আসবে মুখ দিয়ে। বুধি তখনও ওইখানেই দাঁড়িয়ে। পেছনের একটা পা ঈষৎ তোলা। আর…! আর সেই তোলা পায়ের ফাঁক দিয়ে, বাঁট চারটে থেকে অঝোর ধারায় নেমে আসছে দুধের স্রোত! সাদা, ঘন দুধের স্রোত!
শ্যাম তখনই ছুট লাগিয়েছিল পিছন ঘুরে। যদি না যেত, তাহলে দেখতে পেত গাইয়ের দুধের ফেনার মধ্যে থেকে খুরের ধাক্কায় আস্তে আস্তে মাথা তুলছে একটা পাথরের গোল অবয়ব! আর সেই পাথরের ফাটল থেকে লাল রঙের একটা স্রোত এসে মিশেছে দুধের সঙ্গে— যাকে রক্ত বলে মেনে নিতে কোন অসুবিধাই হত না শ্যামের।
হ্যাঁচ্চোওওও!
গল্পখানা আবার চিরুর বেজায় পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। তো এরম লিখে টিখে আমাদের পড়িয়ে বলল, “এইটা শ্যুট করলে কেমন হয়? বেশ একটা মাইথলজিক্যাল থ্রিল আছে না?”
আমি আর মোহিনী তাও চেপে গেছিলাম। কিন্তু অঞ্জাটা নিজের স্কার্ফটো মেলে দিয়ে “দুধ না খেলে হবে না ভাল ছেলে” করে এমন নেত্য শুরু করল যে আমরাও আর রেজিস্ট করতে পারলাম না। মোহিনী তো হাসতে হাসতে গড়িয়েই গেল প্রায়!
আর তার এফেক্ট এই এখন অব্দি সামলাচ্ছি। চিরুবাবুর এখনও পাত্তা নেই। যাকগে আমার কাজ আমি করি।
এখন আমার কাজ মোহিনীকে শট বোঝানো। বোঝাচ্ছিলামও তাই। ওকে দেখাচ্ছিলাম কীভাবে হাঁটতে হাঁটতে হুট করে ক্যামেরার দিকে তাকালেও লেন্সের সঙ্গে চোখাচোখি হবে না।
মোহিনী ক্যামেরা সেজে হাসছিল পিছনে। আজকের সিনটা ওই হোস্ট করবে। আমি চোদ্দ নম্বর সিনের পাঁচ নম্বর শটের ট্রায়ালে হাঁটতে হাঁটতে চমকে তাকালাম পিছনের দিকে। তারপর কাঁধ কাঁপিয়ে আরও একবার চমকালাম। না ভুল ভাবছেন। এই পরের চমকটা আগেরটার মত অভিনয় নয়। দরকারও ছিল না ভান করার। কারণ পিছনে ঘুরতেই আমি অঞ্জাকে দেখতে পেয়েছি! আমাদের টিমের খুদে সদস্য অঞ্জা। যার কাজই ছিল মোহিনীর একটা এক্সপ্রেশন সিট বানান, আর কোথায় কোনটা বসবে সেটা ঠিক করা। অথচ সেই অঞ্জার মুখেই এখন আর রক্ত নেই। সব থেকে হরর ফিল্মের সব থেকে ভয়ের এক্সপ্রেশনটাকেও পেরিয়ে গেছে ওর দুটো চোখ। সেই চোখের সব থেকে কাছে যে ডালটা, সেই ডালটা থেকে ঝুলে আছে একটা মৃতদেহ! বেলা একটার প্রকাশ্য দিবালোকে, শাল গাছের ডালে পিঠের দিক থেকে শিক দিয়ে গাঁথা, একটা ঝুলন্ত মৃতদেহ!
অঞ্জা বোধহয় কোথাও একটা আটকে যাচ্ছিল। বেরোতে পারছিল না এতক্ষণ। আমরা তাকানোতে, আমার চমকানোতে সেটা চিৎকার হয়ে বেরিয়ে এলো হঠাৎ! তারপর লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
এবার বলুন? ডিএসএলআর ক্যামেরায় হরর বলে খুব তো হেসেছিলেন। হুট করে যেমনি কমাদাঁড়ির ইকুয়েশনগুলো বদলে দিলুম, অমনি হয়ে গেল তো টাইট? ওই তো এখনও চেয়ারের হাতল খামচে আছেন। আসল হচ্ছে বলাটা, প্রেজেন্টেশন। গরুর গল্প শুনে হাসি আমারও পেয়েছিল। সদ্য আসা হাঁচিটুকু সামলে নিয়ে আমিও গলা মিলিয়েছিলাম অঞ্জার প্যারোডিতে। বাঙালি কিনা! সবেতে গরুর রচনা খুঁজে পাওয়া জন্মগত অভ্যেস। তাই পরের গল্পটুকু অঞ্জার মুখেই শুনে নেবেন। আগেই বলেছি আমার আবার সিরিয়াস সিচুয়েশন আসে না। আর ও ছোট তো। পৃথিবীটা আমাদের মত অত ঘোলা চোখে দেখে না। জয়ঢাকের জন্য, ওই বলুক বরং।
অঞ্জার কথা –
লম্বা টানেলের মধ্যে দিয়ে কেউ একটা হিড়হিড় করে টেনে আনছিল আমায়। আমি কাউকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। বাধাও দিচ্ছিলাম না তেমন। এমন কী হাঁটছিলামও না। পুকুরের জলে টুকেটুকে লাল বটফল পড়লে প্রথমটা যেমন ডুবে যায়, তারপর আবার যেমন দুলতে দুলতে ভেসে উঠে সুড়ুৎ করে! আমার এগিয়ে যাওয়াটাও অনেকটা সেরকম। শুধু বটফলের মত অত ছোট রাস্তা নয়। সেই যেতে যেতেই যখন একটু আলো মত দেখতে পেলাম, চোখে এসে লাগল ঠাণ্ডা ঝাপটা, তখনই মনে হল আলো থেকে যেন কয়েকটা মাথা এসে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আলোটা বড্ড লাগছিল। আমি চোখ বুজলাম। তারপর জলের স্পর্শ লেগে আবার তাকালাম চোখ মেলে। প্রথমেই যেটা চিনতে পারলাম সেটা হচ্ছে রনিদার একপাল চুল, চিরুদার ক্যাটক্যাটে হলুদ চশমা আর মোহিনীদির প্রজাপতি ক্লিপ। তারপর অবশ্য সঙ্গের মানুষগুলোকে চিনতেও অসুবিধা হল না তেমন।
আমি বোধহয় নিজেকে ঠিক দেখাতেই বোকার মত একটু হেসেছিলাম। আমি হাসাতে মোহিনীদি আমাকে ধরে ধরে উঠে বসাল। হাঁ করে একটু জল খাইয়ে, ঝেড়ে দিতে লাগল পিঠের ধুলোগুলো। আমার অবশ্য একটু রাগই হচ্ছিল। আমি তো ঠিকই আছি! এত বেবি সিটিং করার কোনও মানে হয়? বাচ্চা তো নই!
আমি তেড়েমেড়ে বলতেও যাচ্ছিলাম বোধহয় কিছু। কিন্তু তার আগেই খপ করে ধরে ফেললাম মোহিনীদির হাতটা।
ওই লোকটা! কালো মিশমিশে ওই লোকটা! যে একটু আগেও গাছ থেকে ঝুলছিল। সে এখন ওই একই গাছের নীচে বসে বিড়ি টানছে! অথচ, পিঠে গেঁথে রাখা সেই লোহার রডটা এখনও সেই একইরকম। সেলাইয়ের ছুঁচের মত পিঠের চামড়া এফোঁড় ওফোঁড় করে ঢুকে আছে এখনও।
রনিদা কীসব যেন বলছে লোকটাকে। জানি জঙ্গলওয়ালার হরর রোগ আছে একটু। তাই বলে সত্যি সত্যি ইয়ে (তেনাকে) ভাড়া করছে নাকি শ্যুটিংয়ের জন্য!
আমি বাবা কিছুতেই যাব না। হলই বা ডিরেক্টর! হেডমাস্টার তো নয়। অবশ্য বয়সে ছোট হওয়ার পাপে আমার বারণ কবেই বা খেটেছে? মোহিনীদি আমাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল সামনে। বলল আমার নাকি ভয়টা কাটানো দরকার। অবশ্য আমার ভয় তেমন একটা করছিল না আর। কারণ, লোকটার পায়ের পাতা দুটো সামনের দিকেই ছড়ানো দেখলাম। অন্য কিছু হলে তো… আর তা ছাড়া যে এই ভরদুপুরে, এতজনের মাঝে বসে বসে বিড়ি খায়, সে আর যাই হোক অমানুষ কিছু নয় (উঁহু আমি নাম নেব না কিছুতেই। মরি আর কী!)।
আমি সামনে যেতে লোকটা মিটিমিটি হাসল। ওর দাঁতগুলো একদম পার্ফেক্ট হলুদ। যেমন হলুদ দিয়ে আমি ছোটবেলায় গ্রামের রাস্তা আঁকতাম, তেমনি।
‘ভয় পেয়েছিলে গো দিদিমণি?’ লোকটা হাসিটা ধরে রেখেছে তখনও। আমার আর ভয় করছিল না। ওই ওরা যাদের নাম নেওয়া যায় না, তারা মোটেই এমনি করে হাসতে পারে না। হলদে দাঁত, সাদার ওপর লালের স্প্রে পেন্টিং চোখ, এধার ওধার কেমন যেন উঠে উঠে যাওয়া চামড়া, তাও কত্ত মিষ্টি হাসি! আমি জোরে জোরে মাথা নাড়লাম।
‘আর করছে না। কিন্তু তুমি ওভাবে আছ কেন কাকু?”
রনিদা আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘ওটাকে এরা বাণ ফোঁড়া বলে। এক ধরণের রিচ্যুয়াল বলতে পারিস। এই কাকুটা হচ্ছে সেই ভক্তা দলের লোক। শরীরের যেখানে যেখানে চামড়া একটু আলগা সেখানে সেখানে বাণ গেঁথে এরা গাজনের মেলায় খেলা দেখায়। কী তাই তো মহি?”
“হাঁ দিদিমণি।” হাতের বিড়িটা ফেলে দিয়ে, আবার একগাল হাসে লোকটা, “মাংস না ফুঁড়লে যে প্যাট চলে না!” তারপর গাছটাতে আরেকটু হেলান দিতেই পিঠের শিকটা ‘ঠং’ করে উঠল একবার। যেন সেটা শুনতেই পায়নি, এমন ভাবে বলল, “তুমি এতেই মুচ্ছো যাচ্ছ দিদিমনি! এরপর মেলা বসলে এই বাণেই তো দড়ি বেঁধে বন বন করে ঘুরব! তখন কী করবা গো!”
“তোমাদের লাগে না?”
“লাগে কিন্তুক ব্যথা যে পাতি নাই। ওপারের শ্মশানটা দেখছ তো? ওখানেই আমাদের অভিষেক হয় গো। ওখানকার অঘোরীবাবা জ্যান্ত শকুনের পা থেকে ছিঁড়ে আনা নখ ঢুকিয়ে দেন আমাদের তালুতে। তখন খুব লাগে, কেউ কেউ মুচ্ছো যায়, এমন কী মরেও যায় ভয়ে, ব্যথায়। আর যারা টিকে যায় তাদের সারাজীবন বলি চড়ে ওই টঙে। বাঁই বাঁই করে ঘুরে। হি হি হি!”
লোকটা কেমন অদ্ভুত ভাবে হাসল। আমার কেন কে জানে একটু শিরশির করে উঠল গাটা। তাও মোহিনীদির হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলাম, “কেন করো বলো তো? ঠাকুর কী কখনও বলে ব্যথা পেতে?”
লোকটা কপালে বারদুয়েক হাত ঠেকিয়ে বলে, “সে তো তিনিই জানেন দিদিমণি। আমি শুধু জানি লোকে বলে, আমরা কষ্ট পেলে লোকে খুশি হয়। ভিড় করি দেখতি আসে। পয়সা দেয়। সারা বছর কাটাতে হবেক তো? জমি যা কতক আছে তাতে কী আর বছর চলে গো?”
লোকটা আর বসল না। সেই বাণ পিঠে করে হাঁটা দিল মন্দিরের দিকে। এই চলে যাওয়ার সময় এলেই যে ঠিক কী বুঝে সূর্যটা অমন হেলে পড়ে! জামা বদলে গাছের ফাঁক দিয়ে আলো পাঠায়! চিরুদার ভাষায় একেই বলে ক্লাইম্যাক্স লাইট, ড্রামাটিক্যাল ছায়া!
সে চলে যাচ্ছিল। যার যন্ত্রণায় নাকি আমরা খুশি হই! শুধু সূর্য বুজে আসে তার চলার পথে!
আমার ঝাপসা চোখের সামনে সে মিলিয়ে যাচ্ছিল দূরে। আমার কেন যে তখন সকালের গরুর গল্পটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল খুব করে! রনিদার হাত ধরে ঝুলে পড়ে বলতে ইচ্ছে করল, “বলো না রনিদা। যে গল্পগুলো, যে রক্তগুলো, যে হাঁটুতে মুখ লুকোনোগুলো সত্যি হবার নয় সে গুলোই কেন সত্যি হয়! এর থেকে তো গরুর গল্পটা সত্যি হতে পারত বলো? সে নাই বা মানল বিজ্ঞান। কাউকে ব্যথা তো দিচ্ছিল না। এমন কারোর কথা তো বলছিল না, যাকে প্রথম দেখায় মানুষ বলে ভাবতেই কষ্ট হয়!
তুমি না ডিরেক্টর? একবার “কাট” বলো না গো? একবার বলে দাও না গো এখানে ভুল শট নেওয়া হচ্ছে। একটা গরু আনতে হবে। মাটি খুঁড়তে হবে বলো? আমি খুঁড়ে দিচ্ছি। রক্তও বানিয়ে দিচ্ছি রঙ গুলে…
হ্যাঁচ্চোবিহীন পুনশ্চ- “আমার অক্ষমতা হুট করে লুকোব কোথায়।”
আমি একটা দু টাকার ইউজ অ্যাণ্ড থ্রো শর্ট ফিল্ম ডিরেক্টর। কেঁদেকেটে একশা হওয়া অঞ্জার কাঁধে হাত রেখে কোন মুখে বলতাম আমার অক্ষমতা? দু দিনে দুটো গল্প নামাতে পারি, পেনের খোঁচায় সমাজ বদলাতে পারি না। গল্পটা ভুল আছে বলে কেটে দিয়ে গরুর রচনাও লিখতে পারি না কোনোদিন!
এমনিতে অঞ্জা এখন ভালই আছে। ভক্তারাও রয়ে গেছে তাদের গল্প নিয়ে। আচমকা চমকে আমার হাঁচি বন্ধ হয়ে গেছিল। তাই শ্যুটিংটা আমরা ঠিকই করেছিলাম। লোকটার সাথে মোহিনীর কথাবার্তগুলোও তুলে রেখেছিলাম ক্যামেরায়।
না লাইক কমেন্ট সাবস্ক্রাইব চেয়ে বাঁধাধরা বুলি আওড়াব না। চলো পাল্টাই মার্কা স্লোগানও দেব না। আমার আপনার দৌড় ওই মাদুলি বাবা অব্দি। কৌপিন পরে সমাজ পাল্টানো আমাদের কম্ম নয়।
তবু দেখতে বলব। অন্তত এটুকু বুঝতে যে, সবাই অন্যের কষ্ট দেখে দয়া করে দু দশ টাকা ছুঁড়ে দেয় না। পয়সার ওপিঠে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ চলে যাওয়াও দেখে। কেউ কেউ নিজের পুঁচকে গালটুকু ভিজে যেতে দেয় অকাতরে।
অলঙ্করণঃ ইন্দ্রশেখর
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস
অসাধারণ। এই ছেলেটার লেখা পড়লে মনটা কেমন হয়ে যায়।
LikeLike