জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস
“আজিমুন্নেসার সমাধি কেন মাটির নীচে, আর মানুষের চলার পথ কেন তার উপর দিয়ে,সে নিয়ে একটা অদ্ভুত গল্প চালু আছে জানিস তো?”
সমাধিটা দেখে বেরিয়ে টাঙ্গায় উঠেই সুলতানাকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল কবীর।
“হ্যাঁ, শুনেছি। ওনার নাকি একবার কী একটা কঠিন অসুখ করেছিল আর কবিরাজ তাঁকে মানুষের বাচ্চার কলজে খেতে বলেছিল। সেই খেয়ে অসুখ তো সারল, কিন্তু বেগমের নাকি সেটা নেশায় দাঁড়িয়ে গেল। আর তারপর শয়ে শয়ে নিষ্পাপ শিশু হত্যা করে তাদের কলিজার রক্ত খেত আজিমুন্নেসা। তাই মেয়ে মারা যাওয়ার পর সব শুনে নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ এই অভিনব সমাধিক্ষেত্রটা বানায়, যাতে বহু মানুষের পায়ের ধুলোয় মেয়ের পাপ কিছুটা স্খালন হয়।”
“সব ঝুট হ্যায়!” হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে উত্তেজিত গলায় বৃদ্ধ টাঙ্গাওয়ালা ইয়াকুব।
“হুম! বিশ্বাস তো হয় না ঠিকই। কিন্তু ঐ সবাই যে বলে…”
“সবাই তো অনেক কিছুই বলে মেমসা’ব। আসলে গল্প ছিল অন্য। তোমরা ছোট ছেলে মেয়ে। কী আর বলি। আসলে ও মেয়ে ছিল এক পাপিষ্ঠা। নিজের খেয়াল খুশি মেটাতে অনেক নিরীহ মানুষের সর্বনাশ করেছে। নবাব সব জেনেও কিছু করতে পারতেন না মেয়ের ভয়ে। তারপর কালে কালে গাঁয়ের লোক রাগের চোটে এইরকম সব রটিয়েছে। এইসব গপ্পো শুনতে টুরিস্টরা ভালবাসে তো। কিছু মনে করবেননি।”
“না না, মনে করব কেন! তুমি তো বেশ কথা বল ইয়াকুব। ঠিকই বলেছ।”
ইয়াকুব আবার একটা হালকা চাবুক মারে ঘোড়ার গায়ে। গাড়ি এগোয়। এবার সুলতানা আবার নীরবতা ভাঙে, “আচ্ছা তুই বল দেখি মুন্নি বেগমের কথা কী জানিস? চক মসজিদ দেখে এলি তো।”
“বাব্বাঃ! একেবারে দিদিমণি হয়ে গেলি যে !”
“আরে বল না!”
“বলছি,বলছি। মুন্নি বেগম ছিলেন মীরজাফরের দ্বিতীয় স্ত্রী, স্বামীর মৃত্যুর পরে তিনি মসনদেও বসেছিলেন, ক্লাইভের কাছের লোক হওয়ার সুবাদে। চক মসজিদও ওঁরই বানানো। কী, ঠিক আছে তো ম্যাডাম?”
ঠিকই বলেছিস, তবে ওনার লাইফটাও কিন্তু বেশ ইন্টারেস্টিং। অনেকেই জানেনা মুন্নি বেগম একেবারে একজন হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান ছিলেন। সিকান্দ্রাবাদের কাছে বালকুন্দা নামে এক গ্রামে জন্মানোর কিছু পরে অর্থাভাবে তাঁর মা নিজেই তাঁকে বেচে দেন এক নর্তক দলের হাতে, তারা খানিকটা ভবঘুরে মত ছিল, বানজারা টাইপ আরকি। সেইভাবে ঘুরতেঘুরতেই তারা একদিন এসে পড়ে মুর্শিদাবাদে। আর নবাবের কোন খাস লোকের নজরে পড়ে যান তিনি সেই কিশোরী বয়সে। ব্যাস! ঠাঁই হল তাঁর নবাবী প্রাসাদে। আর নিজের বুদ্ধিমত্তা ও রূপের মহিমায় অচিরেই এক সামান্য বাঁদী থেকে হয়ে উঠলেন কিনা একেবারে বেগম!”
“বলিস কী রে ! এত কিছু তো জানতামই না”।
“ভাব একবার। ক্লাইভ, তারপর হেস্টিংস, সবাইকে নানা রকম উপহার উপঢৌকন দিয়ে তোয়াজ করে রেখে নিজের কেমন একখানা জবরদস্ত জায়গা বানিয়ে রেখেছিলেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। মোটা টাকা পেনসনও আসত তাঁর নামে, ব্রিটিশ রাজের কোষাগার থেকে। অবশ্য শোনা যায় নাকি তিনি দানধ্যানও করেছেন প্রচুর। অনাথাশ্রমে, বিধবাদের জন্য, অসহায় মেয়েদের অনেক সাহায্য করেছেন। গরিব ছেলেমেয়েদের জন্য অবৈতনিক বিদ্যালয়ও স্থাপন করেন। নিজের প্রাক জীবনের কথা ভেবেই হয়তো…”
টাঙ্গা থামিয়ে বলে উঠল ইয়াকুব, “এসে গেছি সাব। দেখুন এবার।”
আকাশে হঠাৎই ঘন কালো মেঘ। অক্টোবরে বর্ষণ এখন আর নিম্নচাপের দৌলতে দুর্লভ কিছু নয়, তাও মাত্র দু’দিনের ট্রিপে এত বৃষ্টিবাদল আর ভাল্লাগে না। লাফিয়ে নামল কবীর আর সুলতানা। মেঘের আঁধার গায়ে মেখে দাঁড়িয়ে আছে ভগ্নপ্রায় তোরণটা। মুর্শিদাবাদে এসে বেশির ভাগ লোকেই শুধু হাজারদুয়ারি প্যালেস কিংবা মোতিঝিল ঘুরে ফিরে যায়। কিন্তু কবীরদের উদ্দেশ্য একটু আলাদা। ওরা আগে থেকে প্ল্যান করেই এসেছে এই প্রাচীন নগরীর আনাচেকানাচে থাকা অজস্র নিদর্শনের যতগুলো সম্ভব খুব ভালভাবে নিরীক্ষণ করবে। ইতিহাসেরই ছাত্রছাত্রী তারা দুজনেই। এম এর প্রোজেক্টের জন্য একটা ফিল্ডওয়ার্ক করার জন্য এই জায়গাটাই বেছে নিয়েছে দুই বন্ধু।
মীরজাফরের এককালীন প্রাসাদ। এখন এই ভগ্নস্তূপের নাম নমকহারাম দেউড়ি! বিশ্বাসঘাতকের প্রতি জনগণের তীব্র বিদ্বেষ আর অবহেলার পরিণতিতে শোচনীয় এক রূপ এখন তার। সুলতানা পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সেই তোরণের দিকে।
ঝড়টা কেমন যেন। ঘূর্ণির মত পাকিয়ে উঠছে চারপাশে। চরম অশুভ কিছুর ইঙ্গিতবাহী। কবীরের অস্বস্তি হতে থাকে, “বলছি, এটায় আর দেখার কী আছে, বল! ভাঙাচোরা একেবারে। চল না, ফিরে যাই। অন্য কোথাও না হয়…”
হাত তুলে তাকে থামিয়ে দেয় সুলতানা। “দাঁড়া, এসেছি যখন দেখেই যাব সবটা। এখন এটা খণ্ডহর বটে, কিন্তু এক সময় কী ছিল ভাব! এই এখানটায় এক সুদৃশ্য শ্বেতপাথরের ফোয়ারা, ওদিকে নাচমহল, সারারাত ঝাড়বাতির আলোয় আর সঙ্গীতে মুখর হয়ে থাকত চারপাশ। ঐ পাশটায় ছিল নবাবী জেনানা মহল। সেখানেই তো ছিলাম এক সময় আমি!”
কেমন একটা ঘোরের মধ্যে থেকে যেন সুলতানা একটানা বলে চলছে যন্ত্রচালিতের মত। এমন করে হাত নেড়ে নেড়ে দেখাচ্ছে যেন সব সে দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছে! আকাশ এখন আরও কালো, ঝড়ো হাওয়াও বওয়া শুরু হয়ে গেছে। কুচকুচে কালো একটা সাপ সরসর করে চলে গেল কবীরের পা ঘেঁষে। গা’টা শিরশির করে উঠল তার। অস্ফুটে বলল, “কী সব বলে যাচ্ছিস রে! তুই ঠিক আছিস তো? ওখানে এক সময় তুই ছিলি, মানেটা কী?”
হা হা করে হঠাৎ রক্তজল করা একটা হাসি। সুলতানা হাসছে! সে হাসি বিদ্রূপের না বেদনার ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল সে কবীরের দিকে। চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক লাগে না। ঘোলাটে, কেমন ভেজা ভেজা। খোলা চুল এলোমেলো হয়ে উড়ছে মুখ ঢেকে। বলে উঠল, “চিনতে পারলি না আমি কে? ঐ দেখ, আমার নবাব এসেছে আমায় নিতে।”
পা দুটো যেন কেউ মাটির সাথে পেরেক দিয়ে গেঁথে রেখেছে কবীরের। গলা দিয়েও স্বর বেরতে চাইছেনা অজানা কোন আতঙ্কে। সত্যিই যেন আবছা আবছা অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে নবাবী বেশ পরিহিত একটা কালো ছায়া মাটি ফুঁড়ে উঠে আসছে শতাব্দীপ্রাচীন দেউরির ভেতর থেকে। হাওয়ায় ভেসে এগোচ্ছে সে সুলতানার দিকে। কঙ্কালসার হাত দুটো বাড়িয়ে দিচ্ছে সামনে। সুলতানাকে বিহ্বল এক স্থাণুর মত দেখাচ্ছে। এভাবে আত্মসমর্পণ করতে হবে? কিছুই করার নেই অসহায়ের মত তাকিয়ে দেখা ছাড়া?
হঠাৎ তীব্র এক বিদ্দুচ্চমকের সাথে কান ফাটানো একটা আওয়াজ। আর তার সাথেই আরেকটা তীব্র চীৎকার। কবীরের পাশ কাটিয়ে ছুটে গেল তাদের গাড়োয়ান ইয়াকুব মিয়াঁ। হাতে তার একটা জপের মালা জড়ানো। আর একটা চামরের মত কিছু ধরা অন্য হাতে। পবিত্র কোরাণ আওড়াতে আওড়াতে সে চেঁচিয়ে ওঠে, “বজ্জাত নেমকহারাম! তোর এত সাহস? এত দিন কেটে গেল তাও তোর পাপ আত্মার মুক্তি হল না? দোজখে ফিরে যা শয়তান। তোর বংশধরদের সাথে রক্তের সম্পর্ক ছিল বলে একদিন আমার পূর্বপুরুষরা সমাজে মুখ দেখাতে পারত না। আমাকেও লুকিয়ে রাখতে হয় আত্মপরিচয়। সব কিছুর মূলে তোর লোভ আর নীচতা। আজ আবার নিয়ে যেতে এসেছিস এই ফুলের মত মেয়েটাকে? হোক সে পূর্বজন্মে তোর বেগম। ও তো জাতিস্মর নয়। ওর এ-জন্মের জীবনে তোর কোন অধিকার নেই। ওর পরিবার আছে, প্রিয়জন আছে, তাদের থেকে ওকে কেড়ে নিতে দেব না তোকে কিছুতেই। আমার তাতে যা হয় হোক। তোর পাপের কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত না হয় আমায় দিয়েই হোক।”
আবার একটা বাজ পড়ল সশব্দে। সুলতানাকে এক ঝটকায় কে যেন প্রায় উড়িয়ে আনল দেউরির বাইরে যেখানে কবীর দাঁড়িয়ে আছে ঠিক সেখানটায়। অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় কবীর ধরে ফেলল তার বন্ধুর অচেতন দেহটা, নিজেও পড়ে গেল মাটিতে। ভয়ানক এক আর্তনাদ ভেসে আসছে সেই কালো মেঘের মত কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়ার ভিতর থেকে। ঘূর্ণির মত ঘিরে উঠছে বাতাস। তার সঙ্গে শোনা যাচ্ছে ইয়াকুবের অট্টহাসির আওয়াজ। এই তালগোল পাকানো পরিস্থিতিতে ক্রমে দুটো স্বরই মিলিয়ে যায়। আশ্চর্য! ইয়াকুবও যেন মুহূর্তের মধ্যে উবে গেল কর্পূরের মত। ধোঁয়াটাও ফিকে হয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গেই বৃষ্টি নামল আকাশ ভেঙে। সুলতানার সম্বিৎ ফিরতেই সে অস্ফুটে বলে,“ কী হয়েছে রে কবীর? আমরা কোথায়? আমার কিছু মনে পড়ছে না কেন?”
শরীরে মনে বল ফিরে পেয়েছে এখন কবীর। পেতেই হবে যে। শক্ত হাতে সুলতানাকে তুলে দাঁড় করাতে করাতে বলে, “কিচ্ছু হয়নি রে, চল বৃষ্টি নেমেছে, আমাদের ফিরতে হবে তো লালবাগের হোটেলে।”
গাড়ির দিকে এগিয়ে গিয়ে সে সুলতানাকে টাঙ্গায় বসিয়ে নিজে লাগামটা হাতে নিল, ঘোড়াটাও ছুটতে আরম্ভ করল প্রাণ ভয়ে। সুলতানা হতভম্ব স্বরে জিজ্ঞেস করে “ইয়াকুব ভাই? ইয়াকুব ভাই কই?”
কবীর চাপাস্বরে বলল, “বলছি,সব বলছি, আগে হোটেলে ফিরি, পারলে আজ রাতেই বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরব আমরা। কেমন?”
বৃষ্টিভেজা অন্ধকার পথের বুক চিরে ঘোড়ার খুরের শব্দ মিলিয়ে যেতে থাকে ভূতের মত দাঁড়িয়ে থাকা নমকহারাম দেউরির থেকে দূরে,আরও দূরে।
অলঙ্করণঃ ইন্দ্রশেখর
অসাধারন লাগলো.. এত কম শব্দে এত কিছু নিয়ে এরকম একটা গল্প.. প্রথম হওয়ার মতই
LikeLike
জন্মান্তর গল্প টা বেশ ভালো লাগলো ॥
LikeLike