জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস
তন্ময় বিশ্বাস
মোটামুটি গোটা লালবাগটাকেই ছাদের যেখান থেকে দেখা যায়, সেখানে এসে দাঁড়ালেন তিনি। অন্ধকার নেমে গেছে অনেকক্ষণ। আসতে আসতে পোস্টের আলোগুলো জ্বলে উঠছে। রাতের লালবাগ জেগে উঠছে একটু একটু করে। তার মধ্যেই হঠাৎ বাসটা স্টার্ট নিল। এতক্ষণ যেন ছিলই না সেটা! হঠাৎই সামনে-পিছনের আলোগুলো জ্বলে উঠল। খুব আস্তে করে এগিয়ে গেল একটু। একবার থামল। তারপর আবার স্পিড তুলে চলে গেল ধুলো উড়িয়ে।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরো চলে যাওয়াটুকু দেখলেন উনি। পেছনের লাল আলোগুলো মিলিয়ে যাওয়া অবধি দাঁড়িয়ে রইলেন ঠায়। তারপর একসময় যখন সব শব্দ মিলিয়ে গেল, যখন লালবাগের সমস্ত ঝিঁঝিঁ গান ধরল একসঙ্গে, তখন কোমর থেকে তলোয়ারখানা বের করে এনে তুলে ধরলেন আকাশের দিকে। যদিও তাতে মরচে পড়েছে অনেকদিন।
সত্যি বলতে কি এটা তিনি ব্যবহারও করেননি কখনও। তবু হাতে থাকা ভাল। বেশ একটা বাদশা বাদশা ফিলিং আসে। মনে হয় লাফ মারলেই পেরিয়ে যাবেন মতিঝিলের সমস্ত কবর। যেন মনে হয় এটা কাছে থাকলে, এক সিটিংয়েই সাবাড় করে দেবেন গোস্ত বিরিয়ানির দু-দুটো শাহি হাঁড়ি। তলোয়ার ছাড়া এসব আসে নাকি?
এই এখন যেমন তলোয়ারখানা ধ্রুবর সাথে ৯০ ডিগ্রি করে তুলে ধরেছেন। এতেই অনেক অনেক দূর অব্দি পৌঁছে যাবে রাস্তা পরিষ্কারের সবুজ সংকেত। এই তলোয়ার দেখেই ফৈজি বাঈ ঝেড়ে-ঝুড়ে বের করে আনবে তার থোকা আঙুরের মত জোড়া নুপুর। মাথায় ওড়না দিয়ে ভাঙা কাচের সামনে বসবে কাজল লতা নিয়ে।
এই তলোয়ার দেখেই কুলুঙ্গি থেকে বেরিয়ে এসে আবার শরীর ধরবেন লুৎ বেগম। নিজের সেরা শাড়িটা পরে বসবেন পান সাজতে। সম্রাটের আবার দরবারের সময় পান ছাড়া চলেই না। তাছাড়া উনি তো আর যার তার হাতের পান খেতে পারেন না!
দীর্ঘ দুদিন পর তলোয়ার দেখেই আবার হাত ধরাধরি করে বেরিয়ে আসবে মীরজাফর-মহম্মদির জুটি। দুশো বছর ধরে করে আসা প্রায়শ্চিত্তের থালায় সাজাতে বসবে গরম অলিভ অয়েল, মাখন ইত্যাদি। দরবারের শেষে একটু দলাই-মালাই না হলে আবার নবাবের ঠিকঠাক ঘুম আসে না। তাই প্রায়শ্চিত্ত বাবদ দুশো বছর ধরে কাজটা তাদেরই করতে হয়।
তেলের বাটিটা আগুনের কাছে ধরে বেগকে জোর সে একটা গালই দেয় মীর। “শালা খুব শখ না ছুরি চালাবার? আজ ব্যাটা নীচের দিকটা তুই ডলবি।”
পাক্কা দু”মিনিট তলোয়ারটা ধরে রেখে দরবার ঘরের দিকে পা বাড়ান নবাব। আজ দু দিন পর আবার নাচগান হবে। আলোর আরামে ভরে উঠবে হাজার দরজার প্রাসাদ। আসলে রোজই হয়। কিন্তু এই দুদিন ওই নচ্ছারের জাতটা বাস নিয়ে হাজির হল বলেই তো, উনাকে দিতে হল জরুরিকালীন লুকিয়ে পড়ার হুকুম।
সবাই বিনা জিজ্ঞাসায় লুকিয়েও পড়েছিল। শুধু এক সহিস বোকার মত জিজ্ঞেস করেছিল- “কেন হুজুর? হঠাৎ আমরা লুকাতে যাব কেন?”
“ওরে মর্কট। ভয়ে রে ভয়ে।”
“কিন্তু হুজুর ভয় তো আমাদের সবাই পায়। আমরা তো….”
একেই ছিল মাথা গরম। তার ওপর এই হেন ট্যাণ্ডেলিপনা। মেজাজ ঠিক থাকে কখনও? তাই কোমর থেকে তলোয়ারখানা বের করে দিলেন চালিয়ে গলা বরাবর।
তারপর সেই গড়াগড়ি খাওয়া মুন্ডুটার দিকে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “ওরে মর্কট এরা হচ্ছে গিয়ে লেখকওয়ারির জাত। এমনিতেই গালগল্পে ওস্তাদ। কলমের খোঁচায় ভগবানকে পর্যন্ত পটল তোলাতে পারে! তো আমরা কোন ছাড়! রাত বিরেতে ঘুরতে ঘুরতে আমাদের দু-এক পিস যদি পেয়ে যায় না! তাহলে আর দেখতে হবে না। সোজ্জা গিয়ে সাদা কাগজে পুরে দেবে। বুঝলি হতভাগা।”
ততক্ষণে হাতদুটো মুন্ডুটাকে ঠিকই খুঁজে পেয়েছে। এবার সেটাকে গলার ওপর মাঙ্কিটুপির মত করে গলিয়ে নিয়ে, একটা সেলাম ঠুকল জোরসে।
“জি হুজুর! আপনি তাহলে এবেলা লুকিয়ে পড়ুন। তবে দেখবেন, এবারও জুতোজোড়া বাইরে খুলে যাবেন না যেন। আগেরবার ওইজন্যই কেসটা খেলেন কিনা!”
গ্রাফিক্স্ঃ ইন্দ্রশেখর