বিষ্ণুপুর-শুশুনিয়া সাহিত্যভ্রমণ
ভিডিও রিপোর্ট
লেখা – পুষ্পেন মণ্ডল।
ছবি – অরিন্দম দেবনাথ।
৭ই ডিসেম্বর রাত্রি দশটা। হাওড়া স্টেশনের বড় ঘড়ির নীচে জড়ো হচ্ছিলাম আমরা। একে একে পরিচিত মুখগুলি উঁকি দিচ্ছিল ভিড়ের মধ্যে থেকে। ছোটরা যখন উত্তেজনায় ফুটছিল টগবগ করে বড়রা তখন উপভোগ করছিল এই নতুন ধরনের মজাটিকে। বছরে এমন মাহেন্দ্রক্ষণ তো একবারই আসে! তাই আমরা সবাই সারা বছর উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করি এই দুটি দিনের জন্য।
লিখিয়ে হিসাবে এনাদের নতুন করে পরিচয় দেওয়ার ধৃষ্টতা আমি করব না। শুধু খোঁজার চেষ্টা করব আমাদের মনের ভিতরে যে জীবন্ত আগ্নেয়গিরির মত ক্রমাগত আনন্দের বিস্ফোরণ হচ্ছে তার গভীরতা কত?
এই যেমন তরুণ স্ফূর্তি তন্ময়, শুনলাম ও নাকি যাওয়ার আগে তিন রাত্রি ঘুমায়নি। আর ঘুমলেও শুধু বেড়াতে যাওয়ার স্বপ্নই দেখেছে। ল্যাবরেটরির জাদুগর, বিষবৈদ্য, মেজর মনজিৎ কাপুর, বোধিসত্ত্ব মজুমদার ওরফে বুধোদা, সঙ্গে পান্নালাল, এঁদের সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্তই তো অনবদ্য! তাই তো প্রথমে পরীক্ষার জন্য বাতিল করেও পরে তড়িঘড়ি নিজেই ট্রেনের টিকিট কেটে ‘ওয়াইল্ড কার্ড এন্ট্রি’ নিয়েছে নীলাভ। বাকি সপ্তর্ষি, নূরজামান, নচিকেতা, অভিজিৎ এরা তো দু’হাত তুলে নাচতে নাচতে চলল আমাদের সাথে। আর রাহুল, ঈশিতা এবং উপাসনা পরের দিন ভোরবেলা বিষ্ণুপুর ইউথহোস্টেলে সরাসরি এসে যোগ দিল আমাদের দলে।
যাই হোক, রাতের ট্রেন হাওড়া স্টেশন ছাড়ল ঘড়ি মিলিয়ে এগারটা। আমরা চললাম হৈহৈ করতে করতে। কারোর চোখেই ঘুম নেই তখন। ভোর চারটেতে বিষ্ণুপুর স্টেশনে পৌঁছানো পর্যন্ত একমাত্র উল্লেখ যোগ্য ঘটনা হল, সৈকতদার আইকার্ড, ডেবিটকার্ড সহ গুরুত্বপূর্ণ নথি ওনার পকেট থেকে ভোজবাজির মত ভ্যানিশ হওয়া। কনকনে শীতের ভোরে সৈকতদার কপালে তখন বিন্দু বিন্দু ঘাম। আমরা সবাই খুঁজছি হন্যে হয়ে। তারপর হঠাৎ জিনিসটা নিজের জ্যাকেটের হাতার মধ্যে খুঁজে পেয়ে আহ্লাদে আমাদের সকলকে চা-বিস্কুট খাওয়ালেন স্টেশনে নেমে। সেখান থেকে নিস্তব্ধ ভোরে দেড় কিলোমিটার হেঁটে হোস্টেলে পৌঁছলাম আমরা। ঝাঁ-চকচকে এই ইউথহোস্টেলে ঢুকেই আমাদের চক্ষু ছানাবড়া হয়েছিল। সরকারি ব্যবস্থাপনায় এমন টিপটপ থাকার জায়গা খুব বেশি আছে বলে জানা নেই।
পরের দিন সকালে শুরু হল “নিকুতি” রহস্য। মানে ঈশিতারা যে দুটো বড় প্যাকেট ভর্তি নিকুতি আর প্যাঁড়া এনেছিল তা মুহূর্তের মধ্যে কোথায় যে গায়েব হল, তা আর কেউ খুঁজে পেল না। এত বড় বড় বাঘা গোয়েন্দার স্রষ্টারাও বেমালুম ঘোল খেয়ে গেলেন, বলাই বাহুল্য।
প্রাতরাশ সেরে বিষ্ণুপুরের কিছু দর্শনীয় স্থান টোটো যোগে ঘুরে দেখলাম আমরা। অসাধারণ ঐতিহাসিক পোড়ামাটির কাজগুলি চাক্ষুষ না করলে আমি নিশ্চিত যে এ বাংলায় জন্মানোই বৃথা। রাসমঞ্চ, মদনমোহন মন্দির, শ্যামরায় মন্দির, গুমগড়, জোড়বাংলা মন্দির, বড়-পাথর আর ছোট-পাথর দরজা, দলমাদল কামান, ছিন্নমস্তা মন্দির, জোড়মন্দির মাঠের মেলা। চার পাঁচশ বছর আগে
মল্লরাজাদের আমলে তৈরি এই অনবদ্য পুরাকীর্তি গুলি খুঁটিয়ে দেখলে সেই সময়ের শিল্প ও ভাস্কর্য কোন উচ্চতায় উঠে ছিল তার একটা আন্দাজ পাওয়া যায়।
শিবশঙ্কর বাবু হঠাৎ করে কেন যে গেয়ে উঠলেন, “ওগো নিরুপমা.. আমায় করিও ক্ষমা…” সে রহস্য অধরাই থাক। দলমাদল কামানের সামনে কৃষ্ণেন্দুদা কেষ্ট ঠাকুরের মত দাঁড়িয়ে ঘ্যামা একটা ছবি তুলে পোস্ট করলেন ফেসবুকে। মৌসুমিদি আর দেবশ্রী আগের বারে মুর্শিদাবাদের মতই শাড়ির দোকানে ঢুকে পড়ছিল বারবার। ঘোরা ফেরা সেরে মহামায়া হোটেলে ভুরিভোজ করে বিকেলে সবাই মিলে চললাম শনিবারের জোড়মন্দিরের হাটে। সেখানে তখন চলছে সাঁওতালীদের নাচ। আকর্ষণীয় বিষয় পেয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন অরিন্দমদা। জয়দীপদা আর সৈকতদাকে ভিড়ের মধ্যে চোখে পড়ল না। ঝিনুক আর বুধোদা নিশ্চয়ই কোন নতুন গল্পের প্লট খুঁজে পেয়েছিল আর নিশ্চিত ভাবেই আরাকিয়েনের ফাঁদ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন
দেবজ্যোতিদা। ঈশিতা, উপাসনা তখন হাটের মেলায় ছড়ানো ডোকরা আর হস্তশিল্পের পসরা ঘাঁটছে ক্রমাগত। আমি গুবলুর পিছনে দৌড়চ্ছিলাম হরেক রকম মিষ্টি আর পিঠেপুলির খোঁজে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামল জোড়মন্দিরের পিছনে।
হোস্টেলে ফিরে শুরু হল আমাদের সান্ধ্যকালীন সাহিত্যবাসরের তোড়জোড়। সেখানে প্রথমেই অরণ্যমন ও জয়ঢাক প্রকাশনের তরফ থেকে প্রকাশিত হল চারটি নতুন বই। শিবশঙ্কর ভট্টাচার্যের ‘পান্নালাল’, সৈকত মুখোপাধ্যায়ের ‘তুলোফুড়কি’, অরিন্দম দেবনাথের ‘বিচিত্রদুনিয়া’ ও মহাশ্বেতার ‘দ্বীপমালার রূপকথা’। অতঃপর হল বিজিত প্রতিযোগীদের গল্প ও কবিতা পাঠ সহ সমালোচনা। বিভাবসু দে’র প্রথম গল্প “গুমঘরে অন্ধকারে” চমকে দিয়েছিল আমাদের সবাইকে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয়েছে যথাক্রমে তন্ময়ের “রূপকথার ভাঁজে” এবং সপ্তর্ষির “রক্তসূত্র” গল্প দুটি। এই আনকোরা নতুন কলম গুলিকে ঘষে মেজে চকচকে করাটাই এই সাহিত্যভ্রমণের অন্যতম উদ্দেশ্য। গল্পগুলি প্রকাশিত হয়েছে এই পুজো সংখ্যায়। অনুগ্রহ করে পড়ে জানাবেন সেই পথে কতটা সফল হয়েছি আমরা।
সমস্ত চিন্তাভাবনার মূল কাণ্ডারী জয়ঢাকের সম্পাদক মাননীয় দেবজ্যোতি ভট্টাচার্যকে জানাই অশেষ ধন্যবাদ। সেদিন সভার শেষে কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ও মৌসুমিদির অসাধারণ শ্রুতিনাট্যটি আমাদের সবার মনে দাগ কেটে গেল।
উপাসনা কর্মকারের গল্পপাঠ রইল নীচের লিঙ্কে
পরের দিনে সকালে উঠেই আমরা বাসযোগে চললাম শুশুনিয়ার উদ্দেশ্যে। ঘণ্টাখানেকের মজাদার সফর শেষে শুশুনিয়া ইউথ হোস্টেলে পৌঁছে সারা হল প্রাতরাশ পর্ব। তারপর আমরা যাত্রা করলাম পাহাড়ের গায়ে খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে তৈরি রাজা চন্দ্রবর্মার শিলালিপি দেখতে। পথের মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মোহিত করে রেখেছিল আমাদের। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আমরা এগোচ্ছিলাম জঙ্গলের রাস্তায়। শিলালিপি দর্শনের শেষটা বড় খাড়াই। সেখানে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে আমরা আবার উপরে ওঠা শুরু করলাম। পাহাড় বেয়ে শুশুনিয়ার শিখরে পৌঁছলাম কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায়। অপটু পায়ে পাহাড়ে চড়ে সব থেকে পরিশ্রান্ত তখন মৌসুমিদি আর দেবশ্রী। বাকিদের মধ্যে অনেকই ঘর্মাক্ত শরীরে হাঁফাচ্ছে। শুধু খুদে অংশগ্রহণকারী পাঁচ বছরের অরণ্য ওরফে গুবলুর উৎসাহে খামতি নেই কোন। প্যান্টে ফোটা চোরকাঁটাগুলি তুলে ফেলে পার্থ জেঠুর হাত ধরে তড়বড়িয়ে পাহাড় বাইছে সে। মাঝেমাঝেই হাঁক ছাড়ছে, “চলো সবাই, পা চালিয়ে চলো।” বড় একটা মোটা ডাল ভেঙে নিজের অবলম্বন তৈরি করে ছিলেন শিবশঙ্কর বাবু। সব চেয়ে বয়জ্যেষ্ঠ মানুষটির সদাহাস্য মুখে এগিয়ে চলা নিরন্তর উৎসাহিত করছিল আমাদের।
চূড়ায় দাঁড়িয়ে সবাই মিলে ছবি তোলা হল। সেটা ছিল নিঃসন্দেহে একটা সেরা মুহূর্ত। উপাসনা তার মিষ্টি গলায় শোনাল রবীন্দ্রসঙ্গীত। গলা ছেড়ে গান গাইলেন শিবশঙ্কর বাবুও। সৈকতদা আর জয়দীপদা শোনালেন কবিতা ও গান। আপ্লুত হলাম আমরা। এবার ফেরার পালা।
সৈকত মুখোপাধ্যায়ের আবৃত্তি শুনতে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে
প্রায় দেড় হাজার ফিট উচ্চতার শুশুনিয়া পাহাড়ে দীর্ঘ ন’কিলোমিটার ট্রেক করে নীচে নামতে বিকেল গড়িয়ে গেল সেদিন। হোস্টেলের উল্টো দিকে শালগাছের জঙ্গলে পড়ন্ত রোদে চড়ুইভাতির রূপে অপরাহ্নের আহার শেষ করে কিছুটা বিশ্রাম। তারপর সবাই মিলে উঠে পড়া হল বাসে। আমরা যখন শুশুনিয়া ছাড়লাম জঙ্গলের গায়ে নেমে এল অন্ধকার।
বাস আমাদের ছেড়ে দিয়ে গেল বাঁকুড়া স্টেশনে। অনেকটা সময় কাটল ওয়েটিং রুমে সুখস্মৃতি রোমন্থন আর আড্ডা দিয়ে। স্টেশন সংলগ্ন একটি রেস্টুরেন্টে রাতের আহার সেরে হাওড়াগামী ট্রেনে উঠে পড়লাম আমরা। পরের দিন ১০ই ডিসেম্বর সোমবার ভোরের আলো ফোটার সাথে পৌঁছে গেলাম কলকাতায়।
কিন্তু এই সাহিত্যভ্রমণ শেষ হল না এখানেই। সঞ্চিত অর্থে ২০১৯এর বইমেলাতে সব ক’জন যুবা অংশগ্রহণকারীকে দেওয়া হল “প্রোৎসাহন” পুরস্কার হিসেবে তাদেরই প্রিয় লেখকদের বই।
আবার শুরু হয়ে গেছে সুতোয় গিঁট বাঁধা। পরের বছরের তোড়জোড়। শীতের হাওয়া গায়ে মেখে এবার আমাদের গন্তব্য ঘাটশিলা।
জয়ঢাকের গত বছরের দুই ট্রেকের খবর