দেখা না দেওয়ার রেল
যুক্তরাষ্ট্রের মেইন প্রদেশের আলাগাসের চিরহরিৎ অরণ্যের মাঝে লুকিয়ে আছে দুটি ইঞ্জিন সহ শতাব্দী প্রাচীন রেলের ধ্বংসাবশেষ। প্রবাদ সে ইঞ্জিন দেখা না দিতে চাইলে তাকে সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না।
লিখেছেন – অরিন্দম দেবনাথ
যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরপূর্ব নিউ ইংল্যান্ড অঞ্চলের একটি প্রদেশ মেইন (Maine)। এর পশ্চিমে নিউ হাম্পশায়ার আর দক্ষিণ-পশ্চিমে অ্যাটলান্টিক মহাসাগর। উত্তর আর উত্তরপূর্ব দিকে রয়েছে কানাডার নিউবুয়েনসিক ও কুইবেক। মেইন প্রদেশ, তার বন্ধুর পর্বতমালা, পাহাড়ি উপকূল, ঢেউয়ের মতো পাহাড়শ্রেণী, জঙ্গলাকীর্ণ ভূমি আর ছবির মতো জলপথের জন্য প্রসিদ্ধ। এছাড়াও মেইন প্রদেশের সুখ্যাতি সামুদ্রিক খাদ্য, বিশেষ করে গলদা চিংড়ি ও ঝিনুকের জন্য। বছরভর এখানকার আবহাওয়া থাকে স্যাঁতসেঁতে। আগুস্তা হল মেইন প্রদেশের রাজধানী।
হাজার বছর ধরে এই অঞ্চলে বাস করত শুধু আমেরিকান আদিবাসীরা। ১৬০৪ সালে এখানে প্রথম পদার্পণ করেন বাইরের অঞ্চলের মানুষ। ফরাসিরা। তারপর ১৬০৭ সালে ইংরেজরা এসে এখানে বসতি স্থাপন করে। কিন্তু কঠোর প্রকৃতি ও স্থানীয় মানুষদের সাথে লড়াইয়ে মারা যান বহু ইংরেজ। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এসে সামান্য কিছু ইংরেজ বসতি টিকে ছিল। ১৮১২ মার্কিন বিপ্লব ও যুদ্ধের পর ১৮২০ সালের ১৫ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের ২৩তম প্রদেশ হিসেবে মেইন স্বীকৃতি পায়। কিন্তু ততদিনে এই অঞ্চল আরও একটি নামে পরিচিতি পেয়ে গেছে ব্রিটিশদের দৌলতে—নিউ ইংল্যান্ড।
এরপর শুরু হয় মেইন-এর বিকাশ। শিল্পের উন্নতির সাথে তাল মিলিয়ে মেইন প্রসিদ্ধি লাভ করে কাঠের জোগানদার হিসেবে।
মেইনের তটভূমি থেকে শুরু করে প্রদেশের গভীর পর্যন্ত জঙ্গলই জঙ্গল। নিউ ইংল্যান্ডের কাঠুরে আর গাড়োয়ানের দল ছিল এক অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ। কুঠার আর ঘোড়ার শকট নিয়ে ঘুরে বেড়াত মেইনের আনাচে কানাচে। যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়নে এদের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। এই কাঠুরের জীবনযাত্রা ছিল খুবই কঠিন। সে সময় গাছ কেটে, সেই গাছ নদীনালার স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া হত কাগজ-কলে। মেইনের কাঠ চালান যেত মূলত কাগজ-কলেই। বরফ-ঠাণ্ডা জলে ভিজে দিনের মধ্যে চৌদ্দ-পনেরো ঘণ্টা কাজ করত এরা। সামান্য খাবার খেয়ে আধভেজা কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোত এরা। জঙ্গলে আগুন জ্বালানো ছিল বিপদজনক। একবার শুকনো কাঠে আগুন লেগে গেলে সে আগুন পুড়িয়ে ছারখার করে দিত বনাঞ্চলের পর বনাঞ্চল। তাই জঙ্গলে এরা আগুন খুব একটা জ্বালাত না। এদের রোজগার ছিল খুবই কম। তা সত্ত্বেও এরা বুক বাজিয়ে গর্ব করত নিজেদের কাঠুরে বলে। বসন্ত চলে যেতে এরা জঙ্গল থেকে বার হয়ে আসত। নিউ ইংল্যান্ডের শহরে শহরে রোজগারের টাকা মদ্যপান আর খাবারের পেছনে উড়িয়ে বেজায় ফুর্তি করত। নাচ-গান করে শুয়ে বসে কাটিয়ে আবার ফিরে যেত কুঠার কাঁধে জঙ্গলে। এই কাঠুরেদের কয়েকজন ছিল ভীষণ ভালো গল্প বলিয়ে। এদের বলা গল্প শুনেই রোমাঞ্চের টানে কাঠুরদের দল ভারী হয়ে উঠত।
রবার্ট ই পাইক নামে এক কাঠুরে তার কাঠুরে জীবন নিয়ে রোমহর্ষক সব বর্ণনা লিখে গেছিল সে সময়। জঙ্গলে পতনরত গাছের শব্দ, জঙ্গলের গন্ধ… কাঠুরেদের দৈনন্দিন জীবনকথা, কাঠ কাটার কলাকৌশল। কাঠুরেদের বিভিন্ন পদাধিকারীদের কথা। তাদের কেউ দলনেতা, কেউ বা শুধু গাছের ডাল ও গুঁড়ি কাটতে ওস্তাদ। কেউ বা কাঠ চেরাইয়ে পারদর্শী। কেউ বা সেই চেরাই কাঠ ও গুঁড়ি পশুর জোয়ালে বেঁধে জলের ধার নিয়ে যেতে কুশলী। কাঠ ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া মাঝিদের কথা…
সে সময় কিং এডওয়ার্ড লাকরিক্স (king Édouard Lacroix) নামে কানাডার এক রাজনীতিক তথা ব্যবসায়ী ছিলেন। ১৯৮৯ সালের ৬ মার্চ জন্ম হয়েছিল তাঁর। মাত্র বারো বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের মেইনের এক কাঠ কোম্পানিতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। কাঠুরে বিদ্যায় হাতেখড়ি হবার কিছুদিন পর মেধাবী ও দূরদর্শী লাকরিক্স ১৯১১ সালে নিজেই একটি কাঠ চেরাই সংস্থা খুলে ফেললেন। ১৯২৫ সালে লাকরিক্স পার্লামেন্টের সদস্য হন ও পরবর্তী চার বার পুনঃনির্বাচিত হন।
লাকরিক্স যেখানেই গাছ কাটার সম্ভবনা দেখতেন সেখানেই ছুটে যেতেন কোম্পানিকে দাঁড় করাতে। তিনি মেইন প্রদেশে একটি লগিং কোম্পানি খুললেন। একসাথে তিন হাজারেরও বেশি লোককে নিয়োগ করলেন। দপ্তরি, করাতি, কাঠ বইবার লোক, মাঝি… সবরকম লোক নিয়োজিত হল তাঁর কোম্পানিতে। এই কর্মচারীদের অধিকাংশই ছিল কানাডার ফ্রেঞ্চ বংশোদ্ভূতরা।
লাকরিক্স একটু অন্য ধরনের মানুষ ছিলেন। অন্যান্য কাঠ ব্যবসায়ীদের থেকে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা। তিনি প্রতিটি কর্মচারীকে উপযুক্ত বেতন দিতেন, তাদের কাজের জন্য অত্যাধুনিক সরঞ্জাম দিতেন। তাদের বসবাসের জন্য আবাসন ও পুষ্টিদায়ক খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন। ফলে তাঁর কর্মচারীরা তাঁর জন্য অন্তর থেকে কাজ করত।
লাকরিক্স গ্রেট নর্দান পেপার কোম্পানির জন্য কাজ করতেন। সে সময় মেইনের ইস্ট মিলিনোকেটের গ্রেট নর্দান পেপার কোম্পানি ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ কাগজের কল। প্রতিদিন ৩০০ টন করে কাগজ তৈরি হত ওই কারখানা থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব খবরের কাগজের জন্য এই পরিমাণ ছিল যথেষ্ট। যদিও এই কারখানাটি এখন আর নেই।
১৯২৬ সালে লাকরিক্স গ্রেট নর্দান পেপার কোম্পানির সাথে চুক্তি করলেন যে বছরে তাঁর কোম্পানি ১২৫০০০ কর্ড (কর্ড হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় শুকনো কাঠ মাপবার মাপকাঠি। এক কর্ড সমান ১২৮ ঘন ফুট) কাগজ বানাবার উপযুক্ত কাঠ সরবরাহ করবেন মেইনের আলাগেস অববাহিকা থেকে।
আলাগেস, মেইন প্রদেশের একটি ছোট্ট শহর। আলাগেস নদী বয়ে গেছে এই শহরের পাস দিয়ে। নদীর নাম থেকেই এই শহরের নাম আলাগেস। আলাগেস সেন্ট জন নদীর একটি শাখা। এই নদীর দু’পাশে আছে জনমানবহীন পাহাড়ের ঢাল আর দুর্গম অরণ্য। সে অরণ্য আবার ভালুকের আস্তানা। কিন্তু দুর্গমতা দমাতে পারেনি লাকরিক্সের দলবলকে।
তার আগেও এই জঙ্গল থেকে কাঠ সংগ্রহ করা হত। কিন্তু অনেক সমস্যা ছিল। আলাগেসের অরণ্যের অবস্থান নিউ ব্রানসুইকের সেন্ট জন নদীর অববাহিকায়। আর কাগজের কল হল পিনোবস্কট নদীর তীরে। জলস্রোতের অভিমুখের তারতম্যের ফলে সরাসরি জলপথে কাঠের গুঁড়ি ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া যেত না কাগজের কলে। আলাগেস নদী হয়ে কাঠ নিয়ে ফেলা হত ঈগল হ্রদে। তারপর ঈগল হ্রদের কিনারা থেকে জটিল জঙ্গুলে পথ দিয়ে কাঠের গুঁড়ি বলদ দিয়ে টানিয়ে ফেলা হত চাম্বেরলেইন হ্রদে। তারপর সেই কাঠ আবার ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া হত পিনোবস্কট নদীতে। নদী স্রোতের অভিমুখের সমস্যা মেটাতে কারখানা কর্তৃপক্ষ ঈগল ও চাম্বেরলেইন হ্রদে বাঁধ দিয়ে বরফ গলে হ্রদে জমা হওয়া জল সেন্ট জন নদীতে যাওয়া আটকে নিয়ে ফেলেছিলেন পিনোবস্কট নদীতে। কিন্তু এতে করে নদীর স্বাভাবিক স্রোত কমে যাওয়ায় গুঁড়ি ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছিল না।
১৯০২ সালে কাগজ-কল কর্তৃপক্ষ তখন ট্রাম পথ তৈরি করলেন গুঁড়ি টেনে নিয়ে যাবার জন্য। বাষ্পচালিত ইঞ্জিন দিয়ে মোটা তারে বাঁধা কাঠ বোঝাই গাড়িগুলোকে টেনে নিয়ে যাওয়া হত ঈগল লেকের ধার থেকে চাম্বেরলেইন হ্রদ পর্যন্ত। ১৯০৭ সালের পর ‘আলাগেস ওয়াল্ডারনেস ওয়াটারওয়ে’ নামের প্রকল্পের অংশ এই ট্রাম-লাইন বন্ধ হয়ে যায় ‘লম্বার্ড স্টিম লগ হাউলার’ কোম্পানি আর এই ট্রাম চালাতে রাজি না হওয়ায়। অধিকাংশ সময় বরফাবৃত জঙ্গলে এই ট্রাম চালানো ছিল জটিল কাজ। যদিও এখনও পর্যন্ত সেই ট্রাম-লাইনের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায় জঙ্গুলে পথে।
কিং এডওয়ার্ড লাকরিক্স আলাগেস থেকে কাঠ সংগ্রহের দায়িত্ব নেবার পর ঠিক করলেন যে তিনি ১৩ মাইল লম্বা রেলপথ বানাবেন ট্রামওয়ে কোম্পানির বানানো লাইনের পূর্বদিক থেকে। আর এই লাইন যাবে ঈগল লেকের সঙ্গে যুক্ত উম্বাযুকসাস (Umbazooksus) হ্রদ পর্যন্ত। এই হ্রদ পিনোবস্কট নদীর সাথে যুক্ত।
লাকরিক্স রেলপথের মালপত্র ও লোকলশকর হাজির করালেন কুইবেক-এর লেক ফ্রন্টিয়ার ও মেইনের গ্রিন-ভ্যালিতে। বরফঢাকা পথে এই মালপত্র টেনে নিয়ে যেতে তিনি তৈরি করিয়েছিলেন দৈত্যাকৃতি সব স্লেজ। জনমানবহীন অঞ্চলে স্লেজে চাপিয়ে লাকরিক্সের দলবল ও পশুর দঙ্গল ৬০টি রেলগাড়ি, অসংখ্য যন্ত্রাংশ, ১৫০০ ফুট লম্বা লোহার পাতের রেল (যার ওপর দিয়ে রেলগাড়ি যায়) একটি ৭২ টন ও ৯০ টনের স্টিম ইঞ্জিন বরফের ওপর দিয়ে ঘষটে নিয়ে গেছিলেন বরফে জমে যাওয়া ঈগল লেকের ধারে। অসমতল বন্ধুর জল-জঙ্গুলে পথে বসেছিল রেলপথ। এই অসাধ্য সাধন করতে কত যে অর্থ, পেশীবল ও ধীশক্তি প্রয়োজন হয়েছিল তার হিসেব নেই।
ঈগল লেকে ভাসিয়ে নিয়ে আসা কাঠের গুঁড়ি রেলগাড়িতে তুলতে লাকরিক্সের প্রকৌশলীরা ২২৫ ফুট লম্বা একটি পরিবাহক (কনভেয়ার) তৈরি করেছিলেন। যা মাত্র দেড় মিনিটে এক কর্ড কাঠ জল থেকে রেলগাড়িতে তুলে ফেলত। একটি ৩২ ফুট লম্বা রেলগাড়ি মাত্র ১৮ মিনিটে কাঠ বোঝাই হয়ে যেত। হিমশীতল অঞ্চলে যথাসম্ভব যান্ত্রিক শক্তি ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন লাকরিক্স।
রেল ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি চালাতে প্রয়োজনীয় জ্বালানীর যোগান দিতে উম্বাযুকসাস লেকে জ্বালানী তেলের ব্যারেল বোঝাই নৌকার ভিড় লেগে থাকত সে সময়। জঙ্গলে আগুন লাগা এড়াতে কয়লার বদলে বাষ্পীয় ইঞ্জিনদুটোকে তেল জ্বালানীর ইঞ্জিনে পরিবর্তিত করা হয়েছিল।
কিন্তু লাকরিক্সের নেতৃত্বে এই রেল বেশিদিন চলেনি। অচিরেই গ্রেট নর্দান কোম্পানি লাকরিক্সের থেকে এই রেল-রোড নিয়ে নিলেন। প্রথমদিকে এই ইঞ্জিন ভালো কাজ করছিল না। বাষ্পের পাইপ ফেটে যাচ্ছিল। কিন্তু ইঞ্জিন সরবরাহকারী সংস্থা এই সমস্যার দায়ভার নিতে অসম্মত হয়। কারণ, ইঞ্জিনের বয়লারকে কয়লা থেকে তেলের বয়লারে পরিবর্তিত করা হয়েছিল। যদিও পরে এই ইঞ্জিনে টানা রেল ভালোই কাজ করছিল। কাজ করছিল পরিবাহক সহ সব যন্ত্রপাতি সুচারুভাবে। ৬৫০০ কর্ড কাঠ কাগজ-কলে চালান যাচ্ছিল সপ্তাহে। ১৯৩৩-এ বিশ্বব্যাপী মন্দা শুরু হল। কাগজের চাহিদা অন্যান্য অনেক বস্তুর মতোই তলানিতে চলে গেল। বহু কলকারখানার মতো বন্ধ হয়ে গেল এ রেলপথ।
আলাগেসের অরণ্যকে নিভৃতে রেখে চলে এলেন কাঠুরে, করণিক, শ্রমিক ও প্রকৌশলীর দল। লাইনের ওপর দিয়ে গাছপালা গজিয়ে শ্যাওলায় ঢাকা পরে ইঞ্জিন, রেলগাড়ি, কাঠ চেরাইয়ের ছাউনি সহ একটি সাময়িক লোকবসতি পরিত্যক্ত হয়ে চলে গেল জঙ্গলের কবলে।
এরপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে কাগজের চাহিদা বাড়লেও ওই জঙ্গলে আর রেল চলেনি। কারণ, রেলের থেকে বন্ধুর পথে কাঠ টানতে ট্রাকের ব্যবহার অনেক সহজ হয়ে উঠল।
কালরিক্স আর ফিরে আসেননি এই জঙ্গলে। ১৯৪৫ সালে রাজনীতি থেকে অবসর নেন তিনি। তাঁর দুই নাতি রবার্ট ও মারসেল ডুটিল কানাডার দুই সফল ব্যবসায়ী। ১৯৬৩ সালে মৃত্যু হয় এই কর্মোদ্যোগী মানুষটির।
না, গল্প এখানেই শেষ নয়। কারণ, গল্পটি কালরিক্সকে নিয়ে নয়। জঙ্গলে তাঁর রেলপথ নিয়ে। জঙ্গলে গাছের মাঝে ঠিক কবরখানায় শায়িত অবস্থায় এক ভাঙা আচ্ছাদনের নীচে পড়ে ছিল যথাক্রমে ১৮৯৭ ও ১৯০১ সালে তৈরি ইঞ্জিন দুটি। কালরিক্স পুরনো ইঞ্জিন কিনেছিলেন। ১৯৬৬ সালে ভুল করে ইঞ্জিনের ওপর থাকা আচ্ছাদন দুটি পুড়িয়ে দেয় ‘মেইন ফরেস্ট সার্ভিস’-এর লোকজন। এই খবরটা জানাজানি হতেই হইচই শুরু হয়। ১৯৬৯ সালে ‘মেইনস পার্ক অ্যান্ড রিক্রিয়েশন কমিশন’ কিছু স্বেচ্ছাসেবকের সহায়তায় জং ধরে যাওয়া ইঞ্জিনদুটোকে রং করায় যাতে খোলা আকাশের নীচে মরচে ধরে ইঞ্জিনদুটো দ্রুত ধ্বংস না হয়ে যায়। হেলে পড়া ইঞ্জিন দুটোকে কাঠের গুঁড়ি দিয়ে যতটা সম্ভব ঠেকনা দিয়ে রাখা হল যাতে করে আর না মাটিতে বসে যায় ইঞ্জিনদুটো।
এখন আলাগাসের অরণ্যের এই বিজন অংশটি সংরক্ষিত অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। আলাগাস নদীর ৯২ মাইল জলপথও প্রদেশ কর্তৃক সংরক্ষিত। জঙ্গলের মাঝের এই জলপথে অ্যাডভেঞ্চার প্রেমীরা ছাড়পত্র নিয়ে ক্যানু চালাতে পারে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এই জলপথকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি রোমাঞ্চকর যাত্রার অন্যতম বলে শিরোপা দিয়েছে।
দৈত্যকার ভালুক অধ্যুষিত এই জঙ্গলে ভালুক তাড়ানোর অন্যতম সরঞ্জাম ‘বিয়ার স্প্রে’ ছাড়া অতি সাহসীও একপা চলেন না। মেইনের, ‘রকউড কাইনিওর’ ‘নর্দান আউটডোর অ্যাডভেঞ্চার রিসোর্ট’ কিম্বা ‘চেসানকুক লেক হাউস’ থেকে বহু মাইল দূরে এই ইঞ্জিনের কবরস্থান। কিছু অতি উৎসাহী ট্রেকার ও স্নো-মোবাইল প্রেমী গ্রীষ্মে পায়ে হেঁটে অথবা বরফ পড়ার সময় স্নো-মোবাইলে চেপে জঙ্গলের মাঝে অতীতের ভাঙা ইঞ্জিন ও রেলপথ দেখতে যায়।
কিন্তু ইঞ্জিনের এই কবরখানায় পৌঁছনো সহজ নয়। গহিন জঙ্গলের মাঝে কোনও পথ নির্দেশিকা নেই। কোনও জনমানব থাকে না এখানে। খানিক পর পর আসে ছোটো ছোটো ঝোরা। তরুতল পুরু শ্যাওলায় ঢাকা, গাছের ঝরা পাতায় হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যায়। একটু বেখেয়াল হলেই ঝরা পাতার মাঝে লুকিয়ে থাকা ভাঙা ডালে পা আটকে ছিটকে পড়ার সম্ভবনা প্রবল। এই জঙ্গলে মোবাইল ফোন বা জিপিএস কাজ করে না। ভাগ্য ভালো থাকলে কোথাও কোথাও ঝরা পাতা বা গুল্মের ফাঁক দিয়ে দেখা দেয় লোহার পাত। অতি উৎসাহীদের ভরসা হঠাৎ দেখা দেওয়া এই লোহার পাত কিম্বা কোনও কাঠুরেদের ফেলে যাওয়া কোনও যন্ত্রপাতির টুকরো অথবা লোহার স্তম্ভ বা পরিত্যক্ত কোনও আবাসের ধ্বংসাবশেষের চিহ্ন। কিম্বা জঙ্গলের মাঝে কাঠুরেদের পায়ে চলা পায়ের চিহ্ন। এই জঙ্গলে এখনও কাঠ কাটা হয়। তবে চাইলে গাইড ভাড়া করা যায়। কিন্তু এতে করে জঙ্গলে লুকোচুরি খেলার মজাটা পাওয়া যায় না বলে অনেকে মনে করেন।
বরফের সময় স্নো-মোবাইলে চেপে চলাচল খানিক সুবিধের হলেও পথচিহ্ন খুঁজে পাওয়াটা আরও কঠিন। সেসময় মাঝেমধ্যে শিং বাগিয়ে তেড়ে আসতে পারে বিশাল চেহারার হরিণ। জঙ্গল এখানে খুব ঘন। ম্যাপ আর কম্পাস ভরসা যোগায় অনেকটাই।
তবে শুধুমাত্র গাছপালায় ঢাকা দুটো ভাঙা শতাব্দী প্রাচীন ইঞ্জিন দেখতে এই উৎসাহী হন কেন কিছু লোক? বিশ্বের বহু জায়গায়, বিভিন্ন রেল মিউজিয়ামে অনেক প্রাচীন ইঞ্জিন ও রেলগাড়ি রাখা আছে। রাখা আছে ইতিহাসের রেলের অনেক ব্যবহৃত সরঞ্জাম। সেখানে গিয়ে দেখে নিলেই তো হয়! ভালুকের খপ্পরে প্রাণ সংশয় কিম্বা জঙ্গলে পথ হারানোর ঝুঁকি নিয়ে ওই ইঞ্জিন দেখতে যাওয়া কি নিখাদ অ্যাডভেঞ্চারের লোভ? নাকি এটা অনুভব করতে যে, যেখানে সাধারণ মানুষ যাওয়ার আগে একশো বার ভাববে সেখানে কতটা মনের জোর বা ইচ্ছাশক্তি থাকলে পাহাড়-জঙ্গলের ওই গহিন কন্দরে সে যুগে এত ভারী ভারী ইঞ্জিন ও রেলগাড়ি নিয়ে ফেলেছিলেন এক কাঠ ব্যবসায়ী ও তাঁর দলবল! শুধু তাই নয়, জঙ্গলের মধ্যে পেতেছিলেন লম্বা রেলপথ! যেকোনও লোকের কাছে গাছপালায় ঢাকা পড়ে থাকা এই ধ্বংসাবশেষ গা শিউরে দেওয়ার মতো অনুপ্রেরণা তো বটেই!
নাহ্! এগুলো ছাড়াও এর পেছনে আছে এক মিথ! জনশ্রুতি! কী?
সেই জঙ্গল-প্রবাদ শোনার আগে এক উৎসাহী পর্যটক জ্যাক বোম্যান-এর অভিজ্ঞতার কথা শোনা যাক।
“ছোটবেলা থেকেই আমি রেলের প্রতি আসক্ত ছিলাম। রেল লাইনের ওপর ধাতুর কয়েন রেখে দিতাম। ট্রেন সেই ধাতুর কয়েনের ওপর দিয়ে চলে গেলে সেই চ্যাপ্টা কয়েন আমি তুলে নিয়ে এসে জমিয়ে রাখতাম। আলাগাসের জঙ্গলের মাঝে বছরের পর বছর ধরে পরে থাকা গাছপালার শাখাপ্রশাখা গজিয়ে ওঠা দৈত্যাকৃতি ইঞ্জিনের কথা শুনেছিলাম। সেই রেলের ছবি দেখে তাকে চাক্ষুষ করার ইচ্ছে ছিল অনেক। লাল, কমলা, সবুজ, বাদামি রঙে সাজানো সবুজ প্রকৃতির মাঝে সে নাকি এক অদ্ভুত বৈপরীত্য। ইতিউতি হঠাৎ কোনও গাছের শেকড়ের ফাঁকে দেখা যায় লোহার রেল লাইন। ঠিক যেন গাছের মাঝ দিয়ে চলে গেছে ভূতুড়ে লোহার পাত।
এই ইঞ্জিন অবশ্যই সাধারণ পর্যটকদের অবশ্য দ্রষ্টব্যের মধ্যে পড়ে না। এই ইঞ্জিনের কথা লেখা নেই পর্যটন দফতরের পুস্তিকাতে। এমনকি রাস্তার ধারের পথ-নির্দেশিকাতেও এর কোন অস্তিত্ব নেই। ‘নর্থ মেইন উডস’ অর্থাৎ যারা এখন এই জঙ্গল থেকে কাঠ কাটার দায়িত্বে আছে তারাও চায় না এ-জঙ্গলে কোনও পদব্রজী পর্যটক প্রবেশ করুক। জঙ্গলের প্রবেশপথের দ্বাররক্ষককের কাছে ইঞ্জিনের কাছে পৌঁছনোর পথের হদিশ জানতে চাইলে উত্তরের বদলে ভ্রূকুটি মিলবে। যদি ভাগ্য ভালো থাকে তবে আবছা দিকনির্দেশ পেলে পাওয়াও যেতে পারে। কিছু যেন লুকোনোর প্রচেষ্টা।
গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম এখানে কাজ করে না। কারণ, মোবাইলের সংকেত এখানে অনুপস্থিত। শুধু কয়েকটা সংকেত মাথায় রাখতে হয়। একটা ঝোরার পাশ ধরে যেতে যেতে ডানে যে জঙ্গুলে পথ পাবে সেটাই রাস্তা। মাটিতে দুটো গভীর দাগ কেটে যাওয়া ক্বচিৎ চলা ট্রাকের পথ ওটা। জঙ্গল-পথের একটা ম্যাপ আছে ঠিকই, কিন্তু সেটার কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো। প্রায় কোনও কিছুর হদিশ নেই সে-ম্যাপে।
এক রোদ ঝলমলে সকালে আমরা ইঞ্জিনের খোঁজে যাত্রা শুরু করলাম। আমরা মানে আমি, আমার স্ত্রী বেথ, আমার শিশু কন্যা কিডো ও আমার বন্ধু ব্রান্ডন। ওর স্ত্রী লের শরীর খারাপ থাকায় ও ‘ভূতের খোঁজে’ যেতে চাইল না।
আমরা আমাদের যাত্রায় শুকনো খাবার ও কিছু জামাকাপড় ছাড়াও সঙ্গে নিয়েছি মশা ও পোকা তাড়ানোর ‘বাগ স্প্রে’। ভাল্লুকের হাত থেকে রক্ষা পেতে ‘বিয়ার স্প্রে’। জঙ্গুলে পাহাড়ি পথে হাঁটতে পরেছি হাইকিং বুট। আর পিঠে নিয়েছি ক্যামেল-ব্যাক স্যাক। তার ওপর কিডোকে বসানোর ব্যবস্থা আছে।
শরতের ঝকঝকে নীল আকাশ ছিল নির্মেঘ। ম্যাপল পাতায় রং ধরেছে বিস্তর। কমলা, লাল, বাদামি, হলদে… সবুজের মাঝে চারপাশটা যেন শিল্পীর নিজস্ব ইজেল। কিন্তু হাঁটার পথ মোটেই সঙ্গ দিচ্ছিল না। গাড়ি চলার প্রাচীন গভীর গর্ত জলে বোঝাই। তার মধ্যে ঘাপটি মেরে রয়েছে ব্যাঙ ও ব্যাঙ্গাচির ঝাঁক। ভূতুড়ে ইঞ্জিনের খোঁজে ভূতুড়ে পথ দিয়ে চলেছি যেন। মেঠো গাড়ি পথের পাশের শুকনো জমি বেছে পা ফেলছিলাম আমরা। খানিক শুকিয়ে থাকা মাটিতে হরিণ, মুস আর ভালুকের পায়ের ছাপ চিনতে কোনও ভুল হচ্ছিল না আমাদের। আমরা চেষ্টা করছিলাম জন্তুগুলোর পায়ের ছাপের ওপর পা ফেলতে। কারণ, ওইখানে জমি শক্ত।
খানিক চলার পর পিঠের ওপর বসে থাকা কিড উসখুস শুরু করে দিল। ওইটুকু শিশু সে আর আমাদের পাগলামি কী বুঝবে! পায়ের চাপে পাতা আর শুকনো ডাল ভাঙার শব্দে সে খিলখিলিয়ে হেসে উঠছিল আর আমি ভারসাম্য হারাচ্ছিলাম পিঠে ৩০ পাউন্ড বোঝা সামলাতে। কাঠবিড়ালির ছোটাছুটি দেখেও সে ভীষণ খুশি। এটাই চাইছিলাম। কঠোর প্রকৃতির স্বাদ তাকে শিশু-অবস্থাতেই পাইয়ে দিতে। আমাদের সৌভাগ্য যে এখনও পর্যন্ত কোনও বুনো জানোয়ারের মুখোমুখি হতে হয়নি।
অকস্মাৎ পুরনো রাস্তাটা শেষ হয়ে গেল। সামনে শুধু গাছ আর গাছ। অন্ধকারের অজানা সাম্রাজ্য। কে জানে এখানে আগে মানুষের পা পড়েছে কি না! বেথ আর ব্রান্ডন হামলে পড়ল ম্যাপের ওপর। জিপিএস কাজ করবে না জেনেও ওটার ওপর সময় নষ্ট করতে লাগল। আমি ব্যস্ত হয়ে থাকলাম কিডোকে নিয়ে। ওকে হাসিয়ে খুশি রাখাটা খুব দরকার।
একটু এগিয়ে পাতায় ঢাকা একটা পথের হালকা চিহ্ন দেখা গেল। দু’পাশে টাল দেওয়া কাঠের গুঁড়ি। তার ওপর জন্মেছে ফার্ন আর শ্যাওলা। আমাদের কাছে কাঠগুলোর পরিমাণ অনেক হলেও কাঠ কোম্পানির কাছে বোধহয় এগুলো কিছুই নয়। তাই এগুলো সংগ্রহ করেনি ওরা। পাইন আর ফারের জঙ্গল এখানে এত ঘন ও তমসাচ্ছন্ন যে সামনে পনেরো-কুড়ি ফুটের মধ্যে একটা আস্ত ট্রেন গায়ে মাথায় শ্যাওলা মেখে দাঁড়িয়ে থাকলে তার হদিশ পাওয়া অসম্ভব। না, আর সামনে যাওয়াটা বোকামি হবে, অন্য কোনও পথ আছে কি না খুঁজে দেখতে হবে। আমরা ওই রাস্তা ধরেই আবার ফিরতে শুরু করলাম।
ঝোরার কাছে ফিরে খানিক এগিয়ে আবার একটা পুরনো গাড়ি চলাচলের পথ পেলাম। এই পথে যে বহুদিন কোনও গাড়ি চলেনি তা রাস্তার ওপর পড়ে থাকা শুকনো কাঠ স্পষ্ট বলে দিচ্ছিল। ঝরা পাতার ওপর দিয়ে চলতে গিয়ে বেশ কয়েকবার পা ডুবে গেল হাঁটু সমান জলে। ভারসাম্য হারিয়ে কিডোকে নিয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিলাম বেশ কয়েকবার। খানিক এগিয়ে দেখি এ-রাস্তাও হঠাৎ শেষ। পিঠ আর কোমর ধরে আসছে। কিন্তু এত সহজে ‘ইঞ্জিন ভূত’ না দেখে হাল ছাড়তে রাজী নই আমরা কেউ। আবার ফিরে এলাম জঙ্গল পথের শুরুতে।
অন্য আরেকটা পথ ধরে খানিক এগিয়ে সেটাও দেখি হঠাৎ ঘ্যাচাং। বুঝলাম, এ রাস্তাগুলো এরকমই। ভারী ট্রাক জঙ্গলে খানিক ঢুকে কাঠ তুলে আবার বেরিয়ে যেত। এই পথগুলোর মধ্যে কোনও একটা গেছে জঙ্গলের গভীরে। কিন্তু সেটা কোনটা? হুম, এটাই তো কোটি টাকার প্রশ্ন।
না, আর পারা যাচ্ছে না। এবার ফিরতে হবে।
আমরা ঝোরার ধারে ফিরে আসতে কানে ভেসে এল একটা প্রশ্ন, “তোমরাও কি ইঞ্জিন খুঁজছ?”
দেখি, জঙ্গলের কিনারায় বিধ্বস্ত চেহারায় স্ত্রী-কন্যা সহ দাঁড়িয়ে আছেন এক ভদ্রলোক। আমরা সবাই মিলে ফিরে এলাম একবারে শুরুর জায়গায় যেখানে আমাদের গাড়িটা রাখা আছে। এই গাড়ি জঙ্গলে ঘোরার উপযুক্ত। গাড়ি নিয়ে ঝোরার ধার ধরে অনেকটা যেতে ঝোপের আড়ালে নজরে এল আগাছা-ঢাকা রেলপথ। গাড়ি রেখে আগাছার মধ্যে দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম আমরা। আগাছা ছাড়িয়ে পিঠে কিডোকে নিয়ে এগনোটা সত্যি কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু শেষ না দেখে হাল ছাড়তে রাজী ছিলাম না আমরা। খানিক এগিয়ে ভদ্রলোক আর যেতে চাইলেন না। পরিবার সহ উনি ফিরে চললেন। আমরা এগোতে লাগলাম সামনের দিকে। খানিক পরে মাটি আর গাছপালার শেকড়ে হারিয়ে গেল লোহার পাত।
না, আর নয়। এবার ফেরার পালা। আবার আসব তোমার দেখা পেতে হে ইঞ্জিন। এবার কিডো একটু বড়ো হলে। মনে হল খানিক আগে শোনা এ-জঙ্গলের প্রবাদ ‘নিজে দেখা না দিলে তাকে দেখতে পাবে না। শুধু ভাগ্যবানদের দেখা দেন তিনি–আলাগাসের ইঞ্জিন।’