ম্যাকলিড সাহেবের ট্রেন
১৯১৭ সালে চলা শুরু করে ১৯৫৭ মাত্র ৪০ বছর চলেছিল এই রেল কালীঘাট থেকে ফলতা পর্যন্ত।
লিখেছেন দেবাঞ্জলি ভাণ্ডারী
বেহালায় বাড়ি আমার। ছোটোবেলা থেকে শুনে এসেছি অনেকেই জেমস লং সরণিকে রেল লাইন বলতেন। উত্তর থেকে দক্ষিণে কলকাতা শহরের বুক চিরে চলে গেছে ন্যাশনাল হাইওয়ে ১১৭, যাকে সবাই ডায়মন্ড হারবার রোড নাম চেনেন। ডায়মন্ড হারবার রোডের সমান্তরাল চলে গেছে শহরের ব্যস্ততম রাস্তাগুলোর মধ্যে অন্যতম এই জেমস লং সরণি। রিক্সাচালক, অটোচালক বা স্থানীয় লোকজন খামোখা একটা আস্ত রাস্তাকে রেল লাইন কেন বলতেন আমার মাথায় ঢুকত না। ভাবতাম, সত্যি বুঝি ট্রেন চলে এখানে। কিন্তু বিশ বছরেও এই রাস্তার ধরে কাছে কোনও ট্রেন দেখিনি।
কিন্তু ট্রেন চলত বটে এককালে। এই রাস্তা তখন ছিল ন্যারো গেজ রেল লাইন। ‘কু ঝিক ঝিক’ শব্দ করে কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে চলে যেত কয়লার ইঞ্জিন। কালীঘাট থেকে ফলতা পর্যন্ত এই রেল লাইনটি চালাত ম্যাকলয়েড লাইট রেলওয়েজ কোম্পানি। লোকে বলত ম্যাকলিড সাহেবের ট্রেন। তা সেই ম্যাকলিড সাহেবের কোম্পানিই ১৯১৭-র ২৮ মে তারিখে প্রথম কলকাতার বুকে এই রেলগাড়ি চালাতে শুরু করে। রেল চলত কালীঘাট থেকে ফলতা পর্যন্ত। কালীঘাট স্টেশন বলে কোনও স্টেশন ছিল না। মাঝেরহাট পর্যন্ত এসে ট্রেন নামিয়ে দিত যাত্রীদের। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে লোকে যেত কালীঘাটের মন্দিরে পুজো দিতে। ইংরেজরা এই ট্রেনের নাম দিয়েছিল কালীঘাট-ফলতা রেলওয়েজ, সংক্ষেপে কে.এফ.আর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যুদ্ধের রসদ পরিবহনের জন্য তড়িঘড়ি করে ইংরেজরা মিশরের ডেল্টা রেলওয়েজ চালাবে বলে অনেকগুলো লাইট-ওয়েট রেল ইঞ্জিন বানায়। সেগুলোর প্রয়োজন ফুরোয় যুদ্ধ শেষের আগেই। কাজেই ব্যবহার না হওয়া রেল ইঞ্জিনগুলো চলে আসে ইন্ডিয়াতে। তারই একটামাত্র ইঞ্জিন দিয়েই তৈরি হয় কে.এফ.আর। লাইট-ওয়েট ইঞ্জিন বলে এই ট্রেন খুব ধীরগতিতে পাড়ি দিতো ৪৩ কিলোমিটার রাস্তা। দিনে দুটো মাত্র গাড়ি। লোকজনের বাড়ির উঠোনের সামনে দিয়ে চলে যেত সেই রেলগাড়ি। তখন রেললাইনের কাছে কারুর বাড়ি থেকে ডাক দিলেই দাঁড়িয়ে যেত ম্যাকলিড সাহেবের গাড়ি। গাড়ি থামিয়ে তুলে দেওয়া যেত কলাটা, মুলোটা কিংবা পুকুরের মাছ। শহর থেকে রেল চালিয়ে খবর নিয়ে আসার রেওয়াজও ছিল সে সময়ে। অনেকেই মাঝেরহাট স্টেশনে এসে ড্রাইভারকে বলে দিত বাড়িতে খবর দেওয়ার কথা। ড্রাইভার ট্রেন চালাতে চালাতে হঠাৎ পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া পথচারীকে ডেকে বলত, “পোড়া অশ্বত্থতলার বাঁড়ুজ্জ্যে মশাইকে বলে দিও হে কলকাতায় ওঁর নাতি হইছে।”
শোনা যায় এক বুড়ি রেল লাইনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। ড্রাইভার বলল, “ও বুড়িমা, যাও কোথা? টেরেনে উঠে পড়ো গো।”
বুড়ি বললে, “না বাবা, আজ আমার এট্টু তাড়া আছে, পায়ে হেঁটেই যাই।”
সেই রেল ইঞ্জিন এখন লন্ডনের রেল মিউজিয়ামে রাখা আছে। কে.এফ.আর লেখাটুকু আজও অমলিন।
তবে ভারতের স্বাধীনতার পর ১৯৫৭ সালে ম্যাকলিড সাহেবের কোম্পানি এদেশ থেকে পাততাড়ি গোটায়। তার সঙ্গে সঙ্গেই হারিয়ে যায় সেই ঝমাঝম শব্দ। তৈরি হয় নয়া রাস্তা। ১৮৬১ সালে দীনবন্ধু মিত্রর লেখা নীল দর্পণ নিষিদ্ধ করেছেন ইংরেজ সরকার। এরই মধ্যে সেই নাটকটিকে ইংরাজি ভাষায় অনুবাদ করা হয় অনুবাদকের নাম ছাড়াই। বইয়ের স্বত্ব কিনেছিলেন পাদরি জেমস লং। আদালতে তিনি সেই অনুবাদকের নাম কিছুতেই প্রকাশ করলেন না। শাস্তি হল তাঁর। হাজার টাকা জরিমানা এবং কারাবাস। হাসিমুখে মেনে নিলেন সাহেব, কিন্তু একবারও বলতে রাজী হলেন না সেই নেটিভের নাম যে এরকম একটা নিষিদ্ধ বই অনুবাদ করেছেন (প্রসঙ্গত সেই নামটি ছিল মাইকেল মধুসূদন দত্ত)। সেই জেমস লং সাহেবের নামে নামকরণ হল রাস্তার। সময়ের রেলগাড়ি হয়তো ঝমঝম শব্দে চলে গিয়েছে অনেকদূরে। ইতিহাসের লেন্স ছাড়া শত চেষ্টাতেও তাকে আর দেখা যাবে না। কংক্রিটের রাস্তায় কান পাতলে হয়তো আজও শোনা যাবে, “ও ডেরাইভার সাহেব, এট্টু কান দাও না গো ইদিকে। মায়ের থানে পোসাদ চড়াব গা।”
তিনশ বছরের এই শহরের স্মৃতিতে আজও সেই রেল লাইন পাড়ি দেয়। বেহালাতে যেকোনও জায়গা থেকে রিক্সায় উঠে রেল লাইন বললে বিনা প্রশ্নে পৌঁছে যাবেন জেমস লং সরণি।