পূর্ব হিমালয় বায়োডায়ভার্সিটি হটস্পট বলতে যে এলাকা চিহ্ণিত করা হয়েছে তাতে ভারতের তিনটি রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও অরুণাচল প্রদেশ অবস্থিত। তা বাদে রয়েছে নেপাল আর ভুটান। তবে নেপালের কেবল মধ্য ও পূর্বাঞ্চল এই জীববৈচিত্র অঞ্চলের আওতায় পড়ে।
এই অঞ্চলে হিমালয়ের সর্বোচ্চ গিরিশৃঙ্গ এভারেস্ট যেমন আছে তেমনই আছে শিবালিকের মত নিচু পাহাড়ও। উত্তর থেকে দক্ষিণে ক্রমশ উচ্চতায় কমতে থাকা পাহাড়গুলোর বিস্তার খুব সরু এলাকায়, অল্প জমিতে। ফলে উচ্চতার পরিবর্তন এখানে আকস্মিক। বলাবাহুল্য এই কারণে নদীর স্রোতের গতি, পলি জমার পরিমাণ থেকে নানা ধরণের গাছপালার ও জীবজন্তুর বসতি এখানে পরিবর্তিত হয় আকস্মিকভাবেই।
আবার ক্রমশ পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে বিস্তীর্ণ এলাকায় কমতে থাকা উচ্চতার জন্য আবহাওয়ায় অর্থাৎ তাপমান ও বৃষ্টিপাতের পরিমাণে ক্রমিক পরিবর্তন ঘটে। এই ক্রমিক পরিবর্তনের ছাপ দেখা যায় গাছপালার ও জীবজন্তুর রকম বদলের মধ্যেও। সুতরাং পূর্ব হিমালয় বায়োডায়ভার্সিটি হট স্পটে জীববৈচিত্র উত্তর থেকে দক্ষিণে যত আকস্মিকতায় বদলায় পশ্চিম থেকে পূর্বে তেমনভাবে বদলায় না।
তাছাড়া পশ্চিম কিংবা মধ্য হিমালয়ের তুলনায় পূর্ব হিমালয় নিরক্ষরেখার অপেক্ষাকৃত কাছে থাকার জন্যে এখানে জলহাওয়া অনেক বেশি আর্দ্র। তাই মধ্য বা পশ্চিমের শুষ্ক বনের তুলনায় এখানে আর্দ্র বনের পরিমাণ বেশি। বৃক্ষরেখাও অপেক্ষাকৃত বেশি উচ্চতায় অবস্থিত। ফলে এখানে জীববৈচিত্র্য বিকাশের জন্য আবহাওয়া বেশ অনুকূল। কিন্তু এই এলাকা নির্মীয়মাণ হিমালয় পর্বতের কোলে।
ফলে ক্রমাগত ভূকম্পে শিবালিকের শিথিলতর পলি দিয়ে গড়া পাহাড়গুলো হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে। পাহাড় ভেঙে গেলে উলটে যায় পাহাড়ের গায়ে জমা মাটি। ভেঙে পড়ে মাটিতে থাকা গাছ। পাথর, মাটি, পলি আর গাছ চাপা পড়ে মৃত্যু হয় পশুপাখির। তাছাড়া শিবালিকের শিথিল পলি ক্রান্তীয় প্রবল বর্ষায় জল শুষে প্রায়ই ফুলে ওঠে আর পিছলে নেমে আসে কঠিনতর পাথরের গা বেয়ে। একে বলে ধস নামা। ধসের কারণেও ধ্বংস হয় গাছ আর প্রাণীর জীবন।
সুতরাং পূর্ব হিমালয়ের প্রাকৃতিক অবস্থাই বেশ নড়বড়ে। তার ওপর এই এলাকায় চায়ের চাষ শুরু হওয়ার পর শুরু হয়েছিল ক্রিপ্টোমেরিয়া জাপোনিকা নামের কাষ্ঠল গাছের বাগান করা। কারণ চায়ের ব্যাবসায়িক উৎপাদন ও নিষ্কাষণের মূল লক্ষ্য ছিল সারা পৃথিবীতে চা রপ্তানি করা। রপ্তানি করার জন্য চা পাতাকে বাক্স বন্দি করার দরকার ছিল। সেই বাক্স বানানোর জন্য সবচেয়ে উপযোগী কাঠ পাওয়া যায় ক্রিপ্টোমেরিয়া জাপোনিকা গাছের থেকে। ফলে চায়ের চাষ করার জন্য আর চায়ের রপ্তানির ব্যবসার জন্য দরকারি বাক্স বানানোর কাঠ জোগাতে পারে এমন গাছের বাগান করার জন্য ধ্বংস করা হয়েছিল এই এলাকার প্রাকৃতিক বন।
তাছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য এলাকার মতো পূর্ব হিমালয়েও জনবসতি প্রচণ্ড ঘন। ফলে পাহাড়ের ঢালের বাঁশ, ঘাস বা অন্যান্য গাছ তুলে ফেলে সেখানে বসতবাড়ি তোলা হয়। তার থেকেও বেশি হয় পাহাড়ের গায়ে ধাপ কেটে শ্রেণীজ চাষের কাজ। ফলে পূর্ব হিমালয়ের শিথিল পলিতে জমাট ঠুনকো পাহাড়ের ওপর মানুষের জীবনের ও জীবিকার চাপটা বেশ বাড়াবাড়ি রকম। হালে এই এলাকায় গাছ কেটে ফেলার ঘটনাও বেড়ে গেছে ভীষণ রকম। ফলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে নানান প্রাণীর উপযুক্ত বসতি এলাকা।
বসতি নষ্ট হলে পূর্ব হিমালয়ের প্রাণীরা পশ্চিম থেকে পুবে বা পুব থেকে পশ্চিমে সরে যেতে পারে। কিন্তু উত্তর-দক্ষিণে তাদের জন্য বাসস্থানের প্রাকৃতিক ব্যবস্থাই নেই। ফলে জনবসতি বাড়ায়, বাণিজ্য আর কৃষি বাড়ায় প্রাণীদের অস্তিত্ব সংকট দেখা দিয়েছে। বিপন্ন অস্তিত্বের প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ১৬৩। এই সব প্রজাতির মধ্যে যেমন আছে এক শিং-ওয়ালা গন্ডার, তেমনই আছে জলার মোষ। সব মিলিয়ে ছত্রিশটা প্রজাতির গাছপালা, তিন প্রজাতির অমেরুদণ্ডী, বারো প্রজাতির উভচর, সতেরো প্রজাতির সরীসৃপ, পঞ্চাশ প্রজাতির পাখি আর পঁয়তাল্লিশ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর অস্তিত্ব বিপন্ন।
এই অঞ্চলে সব মিলিয়ে প্রায় দশ হাজার প্রজাতির গাছপালার সন্ধান পাওয়া গেছে। এই সব গাছেদের মধ্যে তিনশ প্রজাতির গাছই এই এলাকায় সীমাবদ্ধ। পৃথিবীর আর কোথাও এদের দেখা পাওয়া যায় না। সেরকমই এই অঞ্চলের স্তন্যপায়ীদের প্রজাতির সংখ্যা প্রায় তিনশ হলেও তার মধ্য হাতে গোণা কয়েকটাই এই এলাকায় সীমাবদ্ধ। এই এলাকায় সীমাবদ্ধ যে সব প্রজাতির প্রাণী তার মধ্যে অন্যতম
রেলিক্ট ড্র্যাগন ফ্লাই এবং নামাধাপা জাতীয় উদ্যানের উড়ুক্কু কাঠবেড়ালি। তা বাদে টাকিন, হিমালয়ান তাহ্র, পিগমি হগ, গোল্ডেন লাঙ্গুর, লাঙ্গুর, এশীয় বুনো কুকুর, গাউর, মুনজ্যাক, স্লথ বিয়ার, ব্ল্যাক বিয়ার, স্নো লেপার্ড, ব্লু শিপ, জলের মোষ, সোয়াম্প ডিয়ার আর গ্যানজেটিক ডলফিন এই সব প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীরাও পূর্ব হিমালয়ের বায়োডাইভার্সিটি হট স্পটে আবদ্ধ।
আগামী পর্যায়গুলোতে এই অঞ্চলের সংরক্ষিত বনগুলোর কথা আরও বিশদে জানব আমরা।
আশ্চর্য খবরঃ
রেলিক্টরা হিমালয়ের বাসিন্দা। ১৮০০ থেকে তিন হাজার মিটার উচ্চতায় ছুটন্ত জলধারায় এদের প্রজনন হয়। রেলিক্ট ড্র্যাগনফ্লাইয়ের শূককীটের পরিণত হতে পাঁচ ছবছর সময় লাগে। দুনিয়ায় এদের পরিবারের আর একটিই সদস্য আছে। তার বাসা জাপানে।
পিংব্যাকঃ জয়ঢাক(নতুন) বর্ষা ২০১৫-সম্পূর্ণ সূচিপত্র | এসো পড়ি। মজা করি
specific কোন প্রাণী গুলো বিপন্ন পুরব হিমালয় হটস্পটে
LikeLike