শিবানী রায়চৌধুরীর আগের গল্প খোক্কস, ফুলঝাড়ু
প্যাঁচার বুদ্ধি
শিবানী রায় চৌধুরী
লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি বছর আগের কথা। পৃথিবীর মাটিতে তখন কিছুই ছিল না। চারদিক শূন্য। একটা থমথমে ভাব। একদিন একটা মস্ত বড় সোনালী ডিম মাটিতে গড়াতে গড়াতে ফেটে গেল। ফাটা ডিম থেকে বের হয়ে এলেন এক মহান শিল্পী। তাঁর মাথার মধ্যে ছিল রাশি রাশি কল্পনা। কল্পনারা ডানা ঝটপট করে বের হয়ে আসতে চাইছিল। শিল্পী কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। একদিন গভীর ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখলেন যে তিনি একটা বিশাল ছবি আঁকছেন। ছবিতে ওর কল্পনাগুলো উঠে আসার চেষ্টা করছে। কল্পনাদের ডানা ঝটপটানিতে শিল্পীর ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম থেকে চটপট উঠে পড়লেন। তারপর সেই মহাশূন্যে ছবি আঁকতে শুরু করলেন। সেদিন থেকে সেই শিল্পী হলেন পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা। ঠিক করলেন এই শূন্যতাকে ভরাতে হবে। আলো দিতে হবে, রঙ দিতে হবে। সৃষ্টিকর্তার একটা তুলির আঁচড়ে মহাশূন্যে নীল আকাশ হল। সেখানে কমলা আর লাল রঙের সূর্য উঠল। হলুদ রোদে ছবিটা ঝলমল করছিল। তিনি যতই আঁকছেন, ওঁর মনটা খুশিতে ভরে উঠছে। সৃষ্টিকর্তা এঁকেই চললেন সবুজ ঘাস, লতাপাতা, গাছ,বন-জাঙ্গল, ফুল-ফল। একটা করে আঁকছেন আর আঁকা শেষ হলে সেটা জীবন্ত হয়ে উঠছে। একদিন সৃষ্টিকর্তার খেয়াল ছিল না, আচমকা তাঁর তুলির জলের ছিটে লেগে সব রঙ ঝাপসা হয়ে বৃষ্টি নামল। সৃষ্টিকর্তার হলুদ রঙের তুলির ছোঁয়ায় সূর্য ফিরে এল। আকাশে উঠলো সাতরঙা রামধনু। সৃষ্টিকর্তা নিজের ক্ষমতা দেখে দারুণ খুশি।
সৃষ্টিকর্তার একা একা আর ভাল লাগছিল না। শূন্য পৃথিবী ভরে তুলতে সাত তাড়াতাড়ি গড়লেন বিশাল বিশাল এক পাল জন্তু। তারা হল ডাইনোসোর।
তাঁর খোলা মাঠের স্টুডিওতে একে একে বসল চল্লিশ ফুট লম্বা আর বিরাট মাথাওলা ডাইনোসোর টাইরানোসোরাস রেক্স। ডাক নাম টি-রেক্স। তার দুটো হাতে ধারাল নখ, মুখে শক্ত চোয়াল। সে বলল, ‘আমার খিদে পেয়েছে। আমি মাংস খাব।’ তার পাশে ছেচল্লিশ ফুট লম্বা জাইগান্টোসোরাসও বলল, ‘আমি মাংস ছাড়া কিছু খাই না।’ এই ভয়ঙ্কর দানব দুটো জন্মেই খাই খাই করছিল।
পরের সারিতে বসল নব্বই ফুট লম্বা ডিপ্লোডোকাস আর চারটে ডবল ডেকার বাসের মত লম্বা একশো একুশ ফুট টাইটানোসোর। দেখতে বিশাল হলে কী হবে, এরা দুজন হল শান্ত শিষ্ট প্রাণী। মাথা নিচু করে সৃষ্টিকর্তাকে বলল, ‘আমরা গাছপালা আর ফলমূল খাব।’
সৃষ্টিকর্তা অনেক রকমের ডাইনোসোর গড়লেন। তার মধ্যে একটার চল্লিশ ফুট ডানা, মাথায় ঝুঁটি আর ফোকলা মুখে ধারালো লম্বা ঠোঁট। তার একটাও দাঁত ছিল না। সে আকাশে উড়ল। চাইলে সে মাটিতেও হাঁটতে পারত। সে হল পেটরোসোর।
সৃষ্টিকর্তা কাজ শেষ করে ঘুমতে গেলেন। কিন্তু শান্তিতে ঘুমতে পারলেন না। দেখলেন টি-রেক্স, জাইগান্টো আর তাদের বন্ধুরা দল বেঁধে পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ডিপ্লোডোকাস আর টাইটানোসোরের মত নিরীহ প্রাণীদের ঘাড় মটকে চিবিয়ে খাচ্ছে। আর পেটেরোসোরও তার ছুরির মত ঠোঁট দিয়ে মাংস ছিঁড়ছে আর খাচ্ছে।
সৃষ্টিকর্তা নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। তিনি তাড়াহুড়ো করে পৃথিবী ভরে তুলতে গিয়ে একদল দানব তৈরি করেছেন। এরা ওঁর সাধের ছবিটা নষ্ট করে ফেলছে। একদল অত্যাচারী ডাইনোসোর দাপাদাপি, চেঁচামেঁচি আর মারামারি করছিল। তাদের তান্ডব নাচ দেখে উনি রাগে মনে মনে গর্জে উঠলেন ‘দাঁড়া, তোদের মজা বের করছি। তোদের এই পৃথিবী থেকে সরাতে হবে।’ ভয়ঙ্কর একটা হুঙ্কার দিয়ে সৃষ্টিকর্তা চারদিকে ওঁর তেজ ছড়িয়ে দিলেন। তারপর ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লেন।
ওঁর তেজে পাহাড় ফেটে আগুন বের হল। জন্ম নিল আগ্নেয়গিরি। আগ্নেয়গিরি থেকে উগরে উঠল গরম লাভা। লাভায় ছিল গলা পাথর, ধাতু আর ধূলো। লাভায় পৃথিবী ঢেকে গেল। আগ্নেয়গিরি থেকে দূষিত গ্যাস বের হয়ে আকাশ বাতাস বিষিয়ে তুলল। ডাইনোসোররা তার মধ্যে লাফালাফি দাপাদাপি করে জ্বলেপুড়ে ধ্বংস হল। এই ভাবে তারা পৃথিবী থেকে মুছে গেল।
এরপর আরো কোটি কোটি বছর কাটল। একদিন সৃষ্টিকর্তা ঘুম ভেঙে দেখলেন সব কিছু হারিয়ে যায়নি। মাটি আর জল আছে। সুবাতাস ফিরে এসেছে। চার ভাগের এক ভাগ গাছপালা আর পশুও বেঁচে আছে। পেটেরোসোরের মত দু একটা ডাইনোসোরও বেঁচে গিয়েছিল। পেটেরোসোরদের অনেক ছোট দেখাচ্ছিল। তারা পাখি হয়ে আকাশে উড়ছিল।
সৃষ্টিকর্তার পৃথিবীটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। অনেক ভেবেচিন্তে কাজে হাত দিলেন। ঠিক করলেন এবার যাদের গড়বেন তাদের মনের মতো করে গড়বেন। তাড়াহুড়ো করে কিছু করবেন না। নিজের কল্পনায় তৈরি করতে শুরু করলেন ছোট বড় নানা রকমের অসংখ্য পশুপাখি। যেমনি তাদের বিচিত্র চেহারা, তেমনি তাদের স্বভাব! ভাবলেন সবাই এক রকম হলে পৃথিবীটা একটা সাদামাটা জায়গা হয়ে যাবে, ভীষণ একঘেয়ে লাগবে। তাই গড়ে তুলবেন এক আজব চিড়িয়াখানা।
সৃষ্টিকর্তার কাজ শুরু হল। তাঁর খোলা মাঠের স্টুডিওর প্রথম সারিতে বসল যারা কাজ করবে –
উট, হাতি, ঘোড়া, গাধা, গরু, মহিষ, ষাঁড়, ভেড়া, ছাগল,কুকুর…
পরের সারিতে বসল –
জিরাফ, জেব্রা, হরিণ, ক্যাঙারু, ময়ূর, রাজহাঁস, মাছরাঙা…। এরা পৃথিবী আলো করে ঘুরে বেড়াবে।
তারপর সারি সারি বসল –
ভাল্লুক, শিয়াল, হনুমান, বাঁদর, ভোঁদড় আরো অনেকে…
মাঠের সবশেষে বসল হিংসুটেদের দল। তারা হল বাঘ,সিংহ, নেকড়ে, চিতা, হায়েনা,গন্ডার, জলহস্তি, কুমীর, হাঙর, শকুন…
এদের অনেক দূরে সৃষ্টিকর্তার একপাশে বসল ছোট জন্তুরা– বিড়াল, সজারু, বেজি, খরগোস, কাঠবিড়ালি, ধেড়ে ইঁদুর…। অন্য পাশে বসল একরাশ পাখি – প্যাঁচা, কাঠঠোকরা, বক, সারস, কাক, দাঁড়কাক, শালিখ, পায়রা, টিয়া ময়নারা…
এতগুলো জন্তুকে মনের মত তৈরি করতে সৃষ্টিকর্তার অনেক সময় লাগছিল। এত কাজের চাপ যে কোনটাই শেষ করে উঠতে পারছিলেন না। ন্যাড়া মাথা সিংহ মুখ গোমড়া করে বসেছিল। তার ঘাড়ে কেশর নেই,পায়ে নখ নেই। মুখে এখনও দাঁত ওঠে নি। বাঘেরও একই অবস্থা। তার চোখের গর্তে হলুদ আলো জ্বলে নি। ক্যাঙারুর গায়ে বাচ্চা রাখার পকেট লাগানো হয় নি। বাচ্চটা মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছিল। সজারুর গায়ে কাঁটা লাগানো হয় নি বলে কেমন ন্যাড়া ন্যাড়া দেখাচ্ছিল।
কচ্ছপের পিঠের ঢাকনাটা তৈরি হয় নি বলে সে গজ গজ করছিল, ‘বুনো শিয়ালটা আমাকে কামড়াতে এলে আমি কী করে নিজেকে বাঁচাব।’
প্যাঁচার গোল মাথা আর চ্যাপ্টা পেটমোটা শরীরটা শুধু গড়া হয়েছিল। সৃষ্টিকর্তা ওকে দুটো শক্ত ডানা আর একটা ক্যাঁশকেঁশে গলার স্বরও দিয়েছিলেন। কাজটা তখনও শেষ হয় নি। প্যাঁচা একটা ডোবার জলে নিজের ছবিটা দেখে একটুও খুশি হয় নি। সে সৃষ্টিকর্তাকে বলল,
‘আমাকে এত খারাপ দেখতে করেছ কেন? আমি রাজহাঁসের মতো লম্বা গলা চাই।’ সৃষ্টিকর্তা কাজে ব্যস্ত ছিলেন, কোন উত্তর দিলেন না। প্যাঁচা চটে গিয়ে বলল, ‘আমি মূয়রের মতো নানা রঙের পালক চাই।’
সৃষ্টিকর্তা আপন মনে কাজ করে যাচ্ছিলেন। প্যাঁচা এবার বলল, ‘আমি মাছরাঙার মতো বড় ঠোঁট চাই।’
সৃষ্টিকর্তা আর থাকতে পারলেন না। রেগেমেগে বললেন, ‘তোর শুধু চাই, চাই, চাই। চাইলেই সাবকিছু পাওয়া যায় না। অপেক্ষা করতে হবে। আমি কাজ করছি, তুই চোখ বন্ধ করে বসে থাক। আমার কাজের সময় কেউ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলে আমার কাজ করতে অসুবিধে হয়।’
তারপর উনি খরগোশকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘শশক, তুমি তো কিছু বলছ না। তুমি কি চাও?’ খরগোশ খুব মিহি গলায় আস্তে আস্তে বলল, ‘আমি লম্বা লম্বা পা চাই, দুটোলম্বা কান চাই, আর চাই ধারল নখ।’
প্যাঁচা ভেংচি কেটে বলল, ‘খরগোশ, তুই একটা বোকা, তোর মাথায় কিছু নেই। দরকারি কিছু চাইছিস না কেন?’
সৃষ্টিকর্তা প্যাঁচাকে সাবধান করে বললেন, ‘তোকে শেষবারের মতো বলছি তুই চুপ করে চোখ বন্ধ করে বসে থাক।’
প্যাঁচা তো চুপ করার পাত্র নয়। ঝগড়া করতে শুরু করল, ‘আমি যা যা চাই তা দিতেই হবে। আমার দাবি মানতেই হবে। আমি মন চাই, জ্ঞান চাই, বুদ্ধি চাই, …’
বললেন, ‘এবার তোর মজা দেখাচ্ছি।’
চটে গিয়ে উনি প্যাঁচার মাথায় একটা বেদম জোরে চাঁটি মেরে ওর মাথাটা ওর চ্যাপ্টা শরীরে গুঁজে দিলেন। প্যাঁচার মাথা আর শরীরের মাঝে গলা বলে কিছু রইল না। তারপর প্যাঁচার মাথাটা ধরে এমন ঝাঁকুনি দিলেন যে ভয়ে প্যাঁচার চোখদুটো ছানাবড়া হয়ে গেল। ওর দু কান ধরে এমন টান দিলেন যে কান দুটো মাথা থেকে বের হয়ে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
সৃষ্টিকর্তা প্যাঁচাকে বললেন,
‘তোকে তৈরির কাজ আমার শেষ।
বড় কান দিয়েছি, ভাল শুনতে পাবি।
বড় চোখ দিয়েছি, ভাল দেখতে পাবি।
আর মাথা ভর্তি জ্ঞান দিয়েছি, তাই নিয়ে দিগগজ হবি।
এখনি এখান থেকে উড়ে চলে যা। নইলে যা দিয়েছি সব কেড়ে নেব।’
প্যাঁচার তখন অনেক জ্ঞানবুদ্ধি হয়েছে। সে আর বসে রইল না। ডানা মেলে উড়ে গেল। সৃষ্টিকর্তা এবার খরগোশের দিকে মন দিলেন, ‘শশক, তোর লম্বা লম্বা পা চাই?’
কিন্ত দেখলেন শশক সেখানে বসে নেই। সে ভয় পেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে গেছে। লম্বা পায়ের অপেক্ষায় সে আর বসে থাকেনি।
প্যাঁচা উড়ে গিয়েছিল। সে আর ফিরে তাকায়নি। সৃষ্টিকর্তা যদি ওর সব কিছু কেড়ে নেন। তাই আজও প্যাঁচা রাতের অন্ধকারে বের হয় যখন সৃষ্টিকর্তা ঘুমিয়ে থাকেন।
এই গল্পের প্যাঁচা আমেরিকার আাদি অধিবাসীদের লোকগাথা থেকে এসেছে
প্যাঁচার ছবিটি একটি মধ্য আমেরিকান ইন্ডিয়ান সূচিশিল্প থেকে নেয়া